তিন দফা দাবি আদায়ে লাগাতার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা কর্মবিরতি কর্মসূচি স্থগিত করেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার পর আন্দোলনকারী একজন শিক্ষক নেতা প্রথম আলোকে এ কথা জানিয়েছেন।

ওই শিক্ষক নেতা বলেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত শাটডাউন কর্মসূচি  স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরীক্ষা শেষে আবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। রাতেই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কর্মসূচি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকেরা পাঠদান করেন। সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৫৬৯টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটির বেশি। শিক্ষক রয়েছেন পৌনে চার লাখের বেশি। সহকারী শিক্ষকের অনুমোদিত পদ ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২১৬টি, বর্তমানে কর্মরত ৩ লাখ ৫২ হাজার ২০৮ জন।

প্রাথমিক শিক্ষকদের তিন দফা দাবি হলো সহকারী শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেল আপাতত ১১তম গ্রেড দেওয়া, চাকরির ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতার নিরসন এবং সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি দেওয়া। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকেরা ১৩তম গ্রেডে আছেন।

গত ২৭ নভেম্বর তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করে ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’। গত সোমবার তারা বার্ষিক পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচিও শুরু করে। এই পরিষদ বুধবার থেকে বিদ্যালয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করে।

প্রায় একই দাবিতে সহকারী শিক্ষকদের আরেকটি সংগঠন ‘সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে ২৩ থেকে ২৭ নভেম্বর কর্মবিরতি পালন করেছিল। বৃহস্পতিবার থেকে তারাও বিদ্যালয়ে ‘তালাবদ্ধ’ কর্মসূচি শুরু করে। সব মিলিয়ে বৃহস্পতিবার চতুর্থ দিনের মতো দেশের অনেক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা নিজেরাই ফটকে তালা লাগিয়ে দেন।

এর মধ্যে কোথাও কোথাও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় তালা ভেঙে পরীক্ষা হয়েছে। পুলিশ ও আনসারের পাহারায়ও পরীক্ষা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কিছু বিদ্যালয়ে ‘কোনোরকম’ পরীক্ষা হলেও উত্তরপত্র মূল্যায়ন সঠিকভাবে হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। সব মিলিয়ে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলমান তৃতীয় প্রান্তিক মূল্যায়ন (বার্ষিক পরীক্ষা) বড় রকমের সমস্যায় পড়ে।

আরও পড়ুনপ্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোথাও তালা, কোথাও পরীক্ষা০৩ ডিসেম্বর ২০২৫

বার্ষিক পরীক্ষার মধ্যে এই কর্মবিরতিতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতির মুখে পড়ে। এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে আন্দোলন দমাতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর অবস্থানে যায়। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শিক্ষক নেতাসহ বৃহস্পতিবার বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষককে ‘প্রশাসনিক কারণে’ এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বদলি করা হয়েছে।

এ রকম এক পরিস্থিতিতে শিক্ষকেরা চলমান ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য শিক্ষকেরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব র ষ ক পর ক ষ শ ক ষকদ র সরক র সহক র

এছাড়াও পড়ুন:

জরুরি সেবার স্থাপনার সুরক্ষা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার পরামর্শ

ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের সময় অতি জরুরি সেবা সচল রাখতে হাসপাতাল, সচিবালয়, ফায়ার সার্ভিস ও জেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক ভবনগুলো সুরক্ষিত রাখা জরুরি। এ ধরনের দুর্যোগে মানুষের একটা নির্দিষ্ট স্থানে আশ্রয় নিতে খোলা স্থান নির্ধারণ করা এবং সিভিল ডিফেন্সকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এগুলোর পাশাপাশি নিয়মিত মহড়া দিয়ে ভূমিকম্পের সময় করণীয় নিয়ে সচেতনতা তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন স্থপতি, প্রকৌশলী ও ভূমিকম্প–বিশেষজ্ঞরা।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘আর্থকোয়েক: রিয়েলিটি, পারসেপশন, অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক প্রিপেয়ার্ডনেস থ্রো অ্যাকশন’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তাঁরা।

খ্যাতিমান পুর প্রকৌশলী ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. শামীম জেড বসুনিয়া বলেন, ‘স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (অবকাঠামো প্রকৌশল) যাঁরা দক্ষ ও অভিজ্ঞ, তাঁরা যদি তাঁদের কাজটা ঠিকভাবে করেন, ভবন নির্মাণের সময় তদারকিও যদি ঠিকভাবে হয়, তবে আমি মনে করি ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির বলেন, ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো—যেমন সচিবালয়, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসের ভবনগুলো সুরক্ষিত রাখতে হবে। এসব ভবন ভেঙে পড়লে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলে কিছু থাকবে না।

এগুলো কতটা ভূমিকম্প সহনশীল সেটা পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে কাজী গোলাম নাসির বলেন, অনেক এলাকার সড়ক খুবই সংকীর্ণ। এগুলো সম্প্রসারণ করা উচিত, যাতে দুর্যোগ–পরবর্তী সময়ে উদ্ধারকাজ চালানো যায়।

ভূমিকম্পের দুর্যোগের সঙ্গে আরেকটি সংকট হতে পারে অগ্নিকাণ্ড। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমাতে স্থপতি কাজী গোলাম নাসির গ্যাসলাইনের নিয়ন্ত্রণ–ব্যবস্থা ভবনের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এ ছাড়া নির্মাণ উপকরণের গুণগত মান নিশ্চিত করা, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিতে তদারকির ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক প্যাট্রিক ডি রোজারিও জাপানের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, জাপানে ভূমিকম্প–পরবর্তী সুনামির সময় দেখা গেছে, সুনামিতে চারপাশের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সেন্টার টিকে গিয়েছিল।

প্যাট্রিক ডি রোজারিও বলেন, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে হাসপাতাল, সরকারি ভবনগুলো টিকে থাকতে হবে। এগুলো দুর্যোগ মোকাবিলার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে হাসপাতালের জন্য আলাদা কোড দেওয়া আছে। সেগুলো নিশ্চিত হচ্ছে কি না, সেটা তদারক করতে হবে।

প্রতিটি এলাকায় জড়ো হওয়ার জন্য খোলা স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া জরুরি জানিয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ভূমিকম্পে আমরা যদি হতাহত কমাতে চাই তাহলে অবিলম্বে আমাদের জাতীয়ভাবে সচেতনতামূলক মহড়া চালাতে হবে।’

ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা, প্রতিটি এলাকায় নির্দিষ্ট খোলা জায়গা নির্ধারণ করা, রাসায়নিকের গুদামগুলো চিহ্নিত করা জরুরি বলেন মনে করেন কর্নেল তাজুল ইসলাম।

উপাত্তের ঘাটতির কথা উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বদরুদ্দোজা মিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ ‘আর্থকোয়েক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ করার পরামর্শ দেন।

ঢাকায় নেই পর্যাপ্ত ফায়ার স্টেশন

ঢাকা শহরে খোলা জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে—এমন প্রশ্ন তুলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন আছে মাত্র ১৯টি। ঢাকা মহানগরে ওয়ার্ড আছে ৯২টি। প্রতিটি ওয়ার্ডে ফায়ার স্টেশন থাকা উচিত। তিনি প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ করার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, একটা বড় ভূমিকম্প হলে যে পরিমাণ কংক্রিটের স্তূপ তৈরি হবে, সেটা সরানোর মতো জায়গা ও সরঞ্জাম কোনোটাই কোনো সংস্থার নেই।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নভেম্বরের ২১ তারিখের ভূমিকম্পের পর আমাদের ২৭৭টি ভবনে নন-স্ট্রাকচারাল ফাটল পেয়েছি। আমরা এখন সরকারি ভবনগুলো পরীক্ষা করে দেখতে চাই।’

ইমারত বিধি হালনাগাদের কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন হায়দার বলেন, গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো এনফোর্সমেন্ট বা প্রয়োগ। সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রস্তুতি ভালো নয় উল্লেখ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমাদের যা কার্যক্রম হয়, সব প্রকল্পভিত্তিক। প্রকল্প শেষ, কার্যক্রমও শেষ।’

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক স্থপতি কাজী আজিজুল মাওলা বলেন, ‘আমরা যেহেতু এই দুর্যোগকে ঠেকাতে পারব না, সেহেতু এর মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। এ অঞ্চলের ভূমিকম্পের চরিত্র বুঝে আমাদের প্রস্তুতি নির্ধারণ করতে হবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের অধীন সিসমোলজিক্যাল রিসার্চ সেন্টার আছে, এটিকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে।’

স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি আসিফুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, এলাকাভিত্তিক খোলা জায়গা দরকার। স্কুলের মাঠগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, যেন ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের সময় সবাই সেখানে ছুটে গিয়ে নিরাপদে দাঁড়াতে পারে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘সচেতনতা আমাদের একমাত্র হাতিয়ার। নিয়মিত মহড়ার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করা ছিল সিভিল ডিফেন্সের কাজ। প্রতিটি পাড়ায় সিভিল ডিফেন্সকে সক্রিয় করে তুলতে হবে।’

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন স্থপতি ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি স্থপতি নওয়াজীশ মাহবুব। সভাপতিত্ব করেন স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি স্থপতি অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমেদ। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রাকিব আহসান, স্থপতি ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি স্থপতি খান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক জগলুল ও ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি মাসুদ উর রশিদ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ