জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়াই কপ৩০ চুক্তি: শক্তি রূপান্তর কি তাহলে থমকে গেল
Published: 4th, December 2025 GMT
বহু আলোচনা, মতবিরোধ ও সমালোচনার পর শেষ পর্যন্ত একটি চূড়ান্ত চুক্তির মধ্য দিয়ে কপ৩০ সম্মেলন শেষ হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় হতাশার বিষয় হলো ৮০টির বেশি দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমানোর জন্য একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ দাবি করলেও তা চূড়ান্ত চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
অনেকেই মনে করছেন, এতে জলবায়ুর সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলোর মধ্যে তীব্র মতপার্থক্যের কারণে আলোচনা এক দিন বাড়াতে হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও পরিবেশগত অগ্রাধিকারের মধ্যে সমন্বয় করা কতটা কঠিন হয়ে পড়েছে।
শেষ পর্যন্ত যে চুক্তি হয়েছে, সেখানে শুধু বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছে, যা বিশ্বের জলবায়ু অগ্রগতির ক্ষেত্রে গভীর ভূরাজনৈতিক বিভাজনের প্রতিফলন। প্রতিবছরের মতোই ইউএনএফসিসিসির আওতায় কপ৩০ অনুষ্ঠিত হয়। এ বছরের সম্মেলন ৬ থেকে ২২ নভেম্বর ব্রাজিলের বেলেম শহরে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ১৯৪টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন। শিল্প ও কৃষি খাত থেকে শতাধিক লবিস্টও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এটি দেখায়, জলবায়ু নীতি নির্ধারণে বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রভাব কত দ্রুত বাড়ছে। উল্লেখ৵ যে যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও সান ম্যারিনো এই সম্মেলনে অংশ নেয়নি।
আমাজন নদীর মোহনায় আয়োজিত সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো এবং জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবিলায় জাতিসংঘের বিদ্যমান কাঠামোকে শক্তিশালী করা। এ বছরের আলোচনায় তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা সীমাবদ্ধ রাখা, নতুন জাতীয় জলবায়ু প্রতিশ্রুতি দাখিল এবং কপ২৯-এ করা জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পর্যালোচনা। আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোসহ ৮০টির বেশি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর একটি স্পষ্ট ও সময়বদ্ধ পরিকল্পনা দাবি করে। তাদের মতে, এ ধরনের রোডম্যাপ কপ৩০-এর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু বড় অর্থনীতি ও তেল-গ্যাস রপ্তানিকারক দেশগুলোর বিরোধিতায় সেই দাবি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো চূড়ান্ত চুক্তি থেকে ‘জীবাশ্ম জ্বালানি’ শব্দটাই বাদ দেওয়া হয়েছে, যা কপ ইতিহাসে প্রথম। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো বা এর ব্যবহার ধাপে ধাপে হ্রাস করার কোনো উল্লেখও চুক্তিতে রাখা হয়নি। অনেক অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধি ও পরিবেশবাদী কর্মী এতে গভীর হতাশা প্রকাশ করেন। তাঁদের মতে, জীবাশ্ম জ্বালানি বাদ দেওয়া মানে জলবায়ুসংকটের মূল কারণকে এড়িয়ে যাওয়া। অন্যদিকে কিছু তেল উৎপাদনকারী দেশ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। তাদের ভাষ্য, শক্তি রূপান্তরের গতি ও দিকনির্দেশনা ঠিক করার সার্বভৌম অধিকার তাদেরই থাকা উচিত। ফলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্য এবং জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাত কতটা গভীর।
জীবাশ্ম জ্বালানির রোডম্যাপ না পাওয়ার পেছনে কয়েকটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, কপ২৮-এ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে যাওয়ার যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তা এখন অনেক দেশে রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। তেল-গ্যাসনির্ভর দেশগুলো মনে করছে, দ্রুত শক্তি রূপান্তর তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। দ্বিতীয়ত, সৌদি আরব ও রাশিয়ার মতো প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর জন্য বাধ্যতামূলক কোনো ভাষা অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছে। কারণ, তাদের অর্থনীতি মূলত তেল রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি আলোচনায় নেতৃত্বের ঘাটতি তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া দেশগুলোর পাশে থাকে, ফলে তাদের অনুপস্থিতিতে তেলনির্ভর দেশগুলোর অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর রোডম্যাপ না থাকার প্রভাব গভীর হতে পারে। প্যারিস চুক্তিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো প্রয়োজন। কিন্তু কপ৩০-এর চুক্তিতে এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ না থাকায় অনেক দেশ চাপ অনুভব না–ও করতে পারে। ফলে কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রচেষ্টা ধীর হতে পারে, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার কম গতিতে বাড়তে পারে এবং জলবায়ু লক্ষ্য অর্জন আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
কিছু দেশ হয়তো শক্তি দক্ষতা বাড়ানোর মতো ‘সহজ’ উদ্যোগে আগ্রহী হবে; কিন্তু বিদ্যুৎ, পরিবহন ও শিল্পে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অব্যাহত থাকবে। এতে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি লক্ষ্য আরও দুরূহ হয়ে উঠবে। বিনিয়োগ ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
সবুজ ও টেকসই বিনিয়োগে আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা বুঝতে অসুবিধায় পড়বে কোন দেশ সত্যিই কার্বন কমাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এতে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলো এটাকে উৎসাহ হিসেবে নিয়ে উৎপাদন বাড়াতে পারে। এর ফলে বৈশ্বিক নিঃসরণ কমার বদলে বাড়তে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলো যেখানে জলবায়ুর ক্ষতি বেশি ভোগ করে, সেখানে উন্নত দেশগুলো প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে এগিয়ে থাকবে—এভাবে বৈষম্য আরও বাড়তে পারে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর রোডম্যাপ না থাকায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। জলবায়ু দুর্যোগ দারিদ্র্য, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও নগরব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে এসডিজি-৭, এসডিজি-৮, এসডিজি-১০ ও এসডিজি-১১ অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ পিছিয়ে গেলে পরিচ্ছন্নশক্তির প্রাপ্যতা বাড়ানোও কঠিন হবে।
তবে কপ৩০-এর কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। ‘জাস্ট ট্রানজিশন মেকানিজম’-এ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, যা নিশ্চিত করে যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সবুজ শক্তিতে রূপান্তর হবে ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। উচ্চ কার্বনশিল্পে কর্মরত শ্রমিক ও সম্প্রদায়কে পিছিয়ে না রেখে রূপান্তরের পথ তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য। পাশাপাশি প্রায় ৯০টি দেশ ধাপে ধাপে জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর রোডম্যাপের পক্ষে অবস্থান নেওয়া আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইচ্ছার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
জলবায়ু পরিবর্তন এখন বাস্তবতা, যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা ও চরম আবহাওয়ায়। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো জরুরি। একই সঙ্গে সব দেশকে অভিযোজন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে, টেকসই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং উন্নত-অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞান ও অর্থায়ন বিনিময় আরও শক্তিশালী করতে হবে। ন্যায্য ও টেকসই শক্তি রূপান্তরের মাধ্যমে মানুষের জীবন ও পৃথিবীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
ড.
মুহাম্মদ বদরুল হাসান সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ব শ ম জ ব ল ন র ব যবহ র কম ন র র প ন তর ক র বন লক ষ য য ক তর উল ল খ র জন ত এসড জ ট কসই জলব য়
এছাড়াও পড়ুন:
চাকরির প্রস্তুতি: কপ৩০ সম্মেলন–বিষয়ক সাধারণ জ্ঞান
COP–এর পূর্ণরূপ হলো Conference of the Parties. এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমাধান, নীতিনির্ধারণ, প্রতিশ্রুতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করা। প্রথম কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালে জার্মানির বন শহরে। ২০২৪ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে অনুষ্ঠিত হয় কপ২৯।
প্রশ্ন ১: কপ৩০ সম্মেলন কোথায় অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর: বেলেম, ব্রাজিল।
প্রশ্ন ২: কপ৩০ সম্মেলন শুরু হয় কত তারিখ?
উত্তর: ১০ নভেম্বর ২০২৫।
প্রশ্ন ৩: কপ৩০ সম্মেলন কত তারিখে শেষ হয়?
উত্তর: ২২ নভেম্বর ২০২৫ (২১ নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলও এক দিন সময় বৃদ্ধি করা হয়)।
প্রশ্ন ৪: কপ৩০–এর স্লোগান কী?
উত্তর: Global Mutirão (বিশ্বব্যাপী সম্মিলিত প্রচেষ্টা)। Mutirão একটি ব্রাজিলীয় পর্তুগিজ শব্দ, যার অর্থ হলো মানুষের স্বেচ্ছাসেবী, সমন্বিত ও একসঙ্গে কাজ করা।
প্রশ্ন ৫: কপ৩০–এর থিম কী?
উত্তর: অভিযোজন (Adaptation), নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর (Energy Transition), জলবায়ু অর্থায়ন (Climate Finance) এবং সামাজিক ন্যায়বিচার (Social Justice).
প্রশ্ন ৬: কপ৩০ সম্মেলনে কতটি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছে?
উত্তর: ১৯৩টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
প্রশ্ন ৭: কপ৩০–তে কতজন প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন?
উত্তর: প্রায় ৫৬ হাজার।
প্রশ্ন ৮: পরবর্তী কপ সম্মেলন (কপ৩১) কোথায় অনুষ্ঠিত হবে?
উত্তর: তুরস্ক (সম্ভাব্য সাল ২০২৬)।
প্রশ্ন ৯: বেলেম সম্মেলনের সর্বাধিক আলোচিত বিষয় কী ছিল?
উত্তর: জ্বালানিব্যবস্থার ন্যায্য রূপান্তর।
কপ৩০–এর গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ
জ্বালানি: কপ২৮–এর ‘ফসিল জ্বালানি থেকে সরে আসার’ সিদ্ধান্তই শুধু পুনর্ব্যক্ত হলো, নতুন বা শক্তিশালী চুক্তি যোগ হয়নি। ব্রাজিল আলাদা করে একটি স্বেচ্ছা ‘রোডম্যাপ’ দিলেও তা মূল চুক্তির বাইরে।
অর্থায়ন: ২০৩৫ সালের মধ্যে জলবায়ু অভিযোজন তহবিল তিন গুণ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু এই অর্থ কতটা সরকারি আর কতটা বেসরকারি, তা পরিষ্কার নয়। ধনী দেশগুলো আগের প্রতিশ্রুতিতেও পিছিয়েছে।
প্রকৃতি ও বন: ব্রাজিল ১২৫ বিলিয়ন ডলার তহবিলের ‘Tropical Forests Forever Facility’ চালু করেছে বন রক্ষায় উৎসাহ দিতে। ব্রাজিলের প্রস্তাবিত বন উজাড় রোধের রোডম্যাপও চূড়ান্ত চুক্তিতে জায়গা পায়নি।
আরও পড়ুনঅস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা: ভিসা–জটিলতা এড়াতে শিক্ষার্থীদের যে নতুন নির্দেশনা০৩ ডিসেম্বর ২০২৫