বাধার দেয়াল যখন গড়ে ওঠে, গোপনে ওই দেয়াল ভাঙ্গার একটা সূত্রও লুকিয়ে থাকে। মজার ঘটনা হলো, যারা দেয়াল তৈরি করে ক্ষমতা বসে, তারা এই গোপন প্রতিরোধের প্রস্তুতি জানে না। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশে যখন দেয়াল গড়ে ওঠে, অলক্ষ্যে গড়ে ওঠে প্রতিরোধের হাতুড়ি বাটাল গাইতি শাবলের ঐক্য।
‘লিটলম্যাগ’ বা ‘ছোটকাগজ’ শব্দ দুটোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিরোধের বারুদ গন্ধ পাওয়া যায়। ‘অণু’ লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয়েছে বীর চট্টলার মাটি থেকে অনুপমা অপরাজিতার সুযোগ্য সম্পাদনায়। সম্পাদক অনুচ্চারিত কিন্তু জীবনের জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ ‘বিবাহ’ সূচনা সংখ্যার বিষয় করেছেন। এবং এই সংখ্যা দিয়েই অচলায়তন ভাঙার প্রয়াস করেছেন।
‘বিবাহ’ আদিম সময় থেকে আজকের আধুনিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত বৈধ আচার বা প্রথা বা ধর্মীয় রীতি। কিন্ত এই একই ‘বিবাহ’ শব্দটার রয়েছে বিচিত্র প্রয়োগ, দেশ সমাজ ও সংস্কৃতি ভেদে। সম্পাদক প্রথম সংখ্যায় নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়ে সম্পাদনার মতো দুরূহ ও ব্যয়বহুল একটি ধারায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করেছেন দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যা অনেকের জন্য প্রেরণার দুয়ার খুলে দিতে পারে। সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছেন:
‘ছোটকাগজ প্রকাশ করার ইচ্ছে বহুদিনের। দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে ফিরেছি একটি মাধ্যম যেখানে স্বাধীনভাবে বিচরণ করা যাবে, কারও ভ্রুকুটি ও খবরদারি ছাড়া প্রকাশ করা যাবে একান্ত উচ্চারণ। মূলধারার পত্রপত্রিকার বাণিজ্যিক চাপে যখন সৃজনশীল চিন্তা ও বিকল্প সাতিহ্যপ্রয়াস প্রায় নিশ্বাসই নিতে পারে না, তখন ছোটকাগজ হয়ে ওঠে প্রকৃত আশ্রয়, প্রতিবাদের মঞ্চ, আবার একই সঙ্গে অপার সম্ভাবনা। আমাদের স্বপ্ন একটাই- সৃষ্টিশীলতা ও মননের এক নিরীক্ষামূলক ভুবন নির্মাণ, যেখানে লেখক পাঠকগণ খুঁজে পাবেন আত্মীয়তার স্পর্শ, মুক্ত পরিসর।’
দীর্ঘ সম্পাদকীয়র প্রথম পয়ারেই সম্পাদক নিজের স্বপ্নের কথা সুনির্দিষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন। পরের দিকে পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা ও লেখকের সঙ্গে নিজের জানাশোনা বোঝাপড়ার একটা ইতিবৃত্ত উপস্থাপন করেছেন, যাতে পাঠকের মনে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি না হয়। সম্পাদকীয়র একেবারে শেষের দিকে আবার জানান দিয়েছেন নিজের চলার পথরেখা, যেখান থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি লিখেছেন: ‘ছোটকাগজের প্রতিটি পৃষ্ঠা স্বপ্ন, সাহস ও স্বতন্ত্র চিন্তার সাক্ষ্য বহন করে। নতুন লেখক মুখ, নিরীক্ষাধর্মী ভাষা ও বিষয়বস্তুর সংমিশ্রণে ছোটকাগজ হয়ে ওঠে এক রুদ্ধদ্বার খুলে দেওয়ার উতলা হাওয়া। আমরা কতটুকু সফল হয়েছি বিচারের ভার রইলো প্রিয় পাঠকদের হাতে।’
এভাবেই সাঁতার কেটে এগিয়ে যায় সাতারু নির্ভিক চিত্তে, সৃষ্টির লালিত্যে, নতুনের পদযাত্রায়। লিখতে দ্বিধা নেই প্রথম যাত্রায় অনেক দূর এগিয়ে গেছেন অনুপমা অপরাজিতা। প্রমাণ হিসেবে আমরা ‘অণু’র লেখক তালিকা ও লেখার বৈচিত্র্যর দিকে তাকাতে পারি। বিবাহ চিরকালের প্রথা কিন্তু রকমসকম আলাদা। বিয়ের রীতি, সামাজিক বা ধর্মীয় আচার স্থান কাল পাত্র ভেদে ভিন্ন। এমন কী দেশের বিচিত্র জনগোষ্ঠি- জাতি ধর্ম বর্ণর মধ্যেও নানা ধরনের বিবাহ রীতি ও প্রথা বিরাজমান। বিবাহ তো হলোই এক নারীর সঙ্গে আর পুরুষের- তাহলেই কি সব শেষ? বরং শুরু হলো নতুন অভিযাত্রা, অভিঘাত, আঘাত- প্রতিঘাত অথবা কুসুমে কুসমে ভরিয়া উঠিল প্রাণ। কিন্তু কতটুকু কুসুম ফোটে বিবাহের পরে? ‘অণু’ বিবাহ সংখ্যায় খুব ক্ষুদ্র পরিসারে সেই ‘পরের’ পরিস্থিতি অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়েছে। এবার তাকানো যাক এই সংখ্যার লেখক ও লেখার দিকে।
শুরুটাই হয়েছে বিরহের চাবুক চাকুর আক্রমনে, মান্যবর ময়ূখ চৌধুরীর কবিতা- ‘বহুদিন বাদে, বিবাহিত প্রেমিকের বাসায়’ দিয়ে। সম্পাদক পাঁচটি পর্বে সাজিয়েছেন প্রবন্ধরাজি। এবং প্রবন্ধগুলো খুবই গভীর চিন্তা ও বিবাহ সংক্রান্ত সামাজিক অনুসন্ধানী। এখান থেকে পাঠক নতুন ধারণা পাবেন। সূচি পাঠ করলেই বুঝতে পারবেন:
মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন এবং পরিবারপ্রথার উৎপত্তি ও বিবাহ- রাহমান চৌধুরী, বিবাহপ্রথা: একটি হোমো স্যাপিয়েন্স দৃষ্টিপাত- হাফিজ রশিদ খান, দুই ধ্রুপদি কবির বিয়ে আর কবি হয়ে ওঠার গল্প- জ্যোর্তিময় নন্দী, বাঙালির বিয়ে ও যৌনজীবন : প্রেক্ষিত ও পরম্পরা- রণদীপম বসু, বিয়ে ও রাজনীতি- খালেদ হামিদী, দাম্পত্যসর্ম্পকে ‘সার্থকতা’ প্রসঙ্গে- সিদ্ধার্থ বসু, বিয়ের পদ্য এবং কবিদের কবিতা- চিত্ত মন্ডল, বাংলা চলচ্চিত্রে বিবাহ- শৈবাল চৌধুরী, আদিবাসী বিয়ের দেশ বিদেশ- সেলিনা শেলী, বীরভূমের মুসলমান বিবাহরীতি- আয়শা খাতুন, বিবাহের মনস্তত্ত্ব ও লালনভাবনা- স্বপন মজুমদার, বাঙালির বিয়ে বাঙালির সম্পদ হারিয়ে যায়- শুভেন্দু দেবনাথ।
প্রিয় পাঠক, বিবাহ সংখ্যার ‘অণু’র প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম পাঠ করলেন। কী বুঝতে পারলেন? ঠিকই বুঝেছেন- সম্পাদক সুচিন্তিত বিন্যাসে নিজের মনোজগতের সুবর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই নেমেছেন ‘অণু’ নিয়ে পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার বিক্রিয়ায়, নতুন কোনো অভিলাষের বীজ বুনতে।
চারটি গল্প রয়েছে সংখ্যায়। প্রত্যেকটি গল্প জীবনের শ্বাসমূল থেকে উঠে আসা আশ্চর্য অন্ধ প্রদীপের আলোর দানা বিলিয়ে যায় পাঠকদের অন্তপুরে। বিয়ে তো প্রেম ভালোবাসা বিশ্বাস আর অনুরাগের যৌগে গঠিত একটা প্রথা কাঠামো। বিয়ে হলেই বা করলেই আমরা মনে করি- শুদ্ধতম চরিত্র। কিন্তু চরিত্রের মধ্যে কতো ধরনের ছায়াবাজি থাকে, ‘অণু’র প্রথম গল্প ‘ছায়া-অভিসার’ এর ছায়ায় প্রামাণ্য চিত্র রেখেছেন গল্পকার ফেরদৌস আরা আলীম।
গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুবাদ ‘অণু’ ছোটকাগজকে ভীষণ সমৃদ্ধ করেছে। বোঝা যায়, অণু প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সম্পাদকের দৃষ্টি চারদিকে প্রসারিত ছিল। টুকরো টুকরো বোধ ও পাথর একত্র করে নতুন এক সড়কের পথে পা রাখতে চেয়েছেন তিনি। লিখতে দ্বিধা নেই, সম্পাদক সফল হয়েছেন।
ঢাকা/তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর কর ছ ন প রক শ প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
নেসলের প্রথম ‘গাট হেলথ সামিট’: অংশ নিলেন দেশ-বিদেশের গবেষক, বিশেষজ্ঞ
নেসলে বাংলাদেশের আয়োজনে নিউট্রিশন সায়েন্সের অগ্রগতি ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘দ্য গাট নেক্সাস’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী বৈজ্ঞানিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ৪ ও ৫ নভেম্বর রেডিসন ব্লু ঢাকায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের ২৫০ জনের বেশি গবেষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। গাট মাইক্রোবায়োমের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব ও মানুষের সার্বিক সুস্থতার সঙ্গে এর নিবিড় সম্পর্ক তুলে ধরাই ছিল সম্মেলনের মূল লক্ষ্য।
মানুষের পেটে থাকা ‘গাট মাইক্রোবায়োম’ বা উপকারী জীবাণুগুলো হজমশক্তি থেকে শুরু করে মানসিক সুস্থতা ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতাসহ অসংখ্য উপকারী ভূমিকা রাখে। ওই ওয়ার্কশপে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সেশন, প্রেজেন্টেশন, ইন্টারঅ্যাকটিভ আলোচনা এবং হাতে–কলমে শেখার নানা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অংশগ্রহণকারীরা এসবের মাধ্যমে গাট হেলথ–সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর আধুনিক গবেষণা ও বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করেন।
বিশেষজ্ঞের মতামত এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
আন্তর্জাতিক আলোচকদের মধ্যে ছিলেন শ্রীলঙ্কার অধ্যাপক ড. শামান রাজেন্দ্রজিথ। তিনি শিশুদের গাট মাইক্রোবায়োটার বিকাশ এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে কথা বলেন। এ ছাড়া স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও হজমজনিত সমস্যার মতো ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে প্রাথমিক জীবনে সঠিক মাইক্রোবায়োম প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরেন তিনি।
শামান রাজেন্দ্রজিথ বলেন, ছোটবেলা থেকে সঠিক মাইক্রোবায়োম গড়ে উঠলে জীবনের নানা পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা আরও শক্তিশালী হয়।
নেদারল্যান্ডসের অধ্যাপক ড. মার্ক এ বেনিঙ্গা অনুষ্ঠানে শিশুদের কলিক সমস্যা এবং গাটের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যহীনতার ওপর তাঁর গবেষণা বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেন। বেনিঙ্গা বলেন, ব্যাকটেরিয়ার সুষম উপস্থিতি বিঘ্নিত হলে শিশুদের পেটে অস্বস্তি, ব্যথা অনুভব হয়। ফলে শিশুদের কান্নার সম্ভাবনা দেখা দেয়। সঠিক প্রোবায়োটিক গ্রহণে এ সমস্যা সমাধান হতে পারে।
বাংলাদেশিদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টিবিষয়ক বাস্তবতা সামনে রেখে বক্তব্য দেন আইসিডিডিআরবির অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল হোসেন। তিনি গাটবান্ধব খাবার, প্রিবায়োটিক, প্রোবায়োটিক ও সিনবায়োটিক গ্রহণের সুবিধা এবং শিশুদের পুষ্টি উন্নয়নে করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় বায়োটিকস যুক্ত হলে হজমশক্তি ও সার্বিক সুস্থতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, যা জীবনমানকে দীর্ঘমেয়াদি উন্নত করতে সহায়তা করবে।’
গবেষণা ও প্রদর্শনী
কর্মশালায় গাট হেলথ–সম্পর্কিত আধুনিক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি বিভিন্ন সায়েন্টিফিক প্রদর্শনী করা হয়। সেখানে অংশগ্রহণকারীরা প্রোবায়োটিক ও সিনবায়োটিকের উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সরাসরি পরিদর্শনের সুযোগ পান, যা নেসলে বাংলাদেশের গবেষণানির্ভর নিউট্রিশনবিষয়ক উদ্ভাবনের প্রতিশ্রুতি আরও স্পষ্ট করে।
কর্মশালাটির সার্বিক বিষয়বস্তু এবং সহযোগিতামূলক মনোভাব ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করে এবং বাস্তব চিত্র সামনে এনে উৎসাহিত করার মাধ্যমে নেসলে বাংলাদেশ পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে তাদের ভূমিকা আরও সুদৃঢ় করেছে।
জনস্বাস্থ্যের প্রতি অঙ্গীকার
এই উদ্যোগটি নেসলে নিউট্রিশন ইনস্টিটিউটের বৃহত্তর উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করে, যা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বব্যাপী গাট হেলথ–সম্পর্কিত এডুকেশনকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে। গবেষণা ও জ্ঞানচর্চামূলক প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগের মাধ্যমে নেসলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থতা নিশ্চিত করতে এবং বিজ্ঞাননির্ভর সমাধানের মাধ্যমে আরও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে।