এখনই দেশে ফিরতে পারছেন না বিএসএফের পুশ ইন করা ভারতীয় নাগরিক
Published: 24th, October 2025 GMT
চাঁপাইনবাবগঞ্জে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো (পুশ ইন) ছয় ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের দিন পিছিয়েছে। আগামী ৬ নভেম্বর তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য করেছেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (তৃতীয় আদালত) আশরাফুল ইসলাম এ আদেশ দেন।
অভিযোগ গঠনের দিন পেছানোয় ছয় ভারতীয় নাগরিক এখনই দেশে ফিরতে পারছেন না। এর আগে এক রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে চার সপ্তাহের মধ্যে তাঁদের ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্ট। এতে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ওই ভারতীয় নাগরিকদের দেশে ফেরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
ছয় ভারতীয় নাগরিক হলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার ধিতোরা গ্রামের দানিশ শেখ (২৮), তাঁর স্ত্রী সোনালি বিবি (২৬), তাঁদের ৮ বছর বয়সী ছেলে এবং সুইটি বিবি (৩৩) ও তাঁর ১৬ ও ৬ বছর বয়সী ছেলে। তাঁদের মধ্যে সোনালি বিবি অন্তঃসত্ত্বা। গত ২০ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের আলীনগর এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পুলিশ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই ভারতীয় নাগরিকেরা দিল্লিতে কাগজ কুড়ানোর কাজ করতেন। দিল্লি পুলিশ তাঁদের আটক করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মাধ্যমে কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠায়। পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আটক হলে তাঁদের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশ আইনে মামলা করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
আসামিপক্ষের আইনজীবী একরামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আদালত আগামী ৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য করেছেন। ওই দিন শুনানি শেষে অভিযোগ গঠন করা হবে বলে তাঁরা আশা করছেন। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার ছয়জনই ভারতীয় নাগরিক। এ–সংক্রান্ত কাগজপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। তাঁরা বিএসএফের মাধ্যমে পুশ ইনের শিকার।
গ্রেপ্তার ছয়জনের মামলার তদারক করতে বাংলাদেশে এসেছেন ভারতের নাগরিক মফিজল শেখ। গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দিল্লি পুলিশ জঘন্য একটি কাজ করেছে। শুধু বাংলায় কথা বলার কারণে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে যাচাই-বাছাই ছাড়াই বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। তাঁরা কলকাতা হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। বিচারপতি রায় দিয়েছেন, চার সপ্তাহের মধ্যে তাঁদের দেশে ফেরাতে হবে। শুক্রবার চার সপ্তাহ শেষ হচ্ছে। এরপরও কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি।
মফিজল শেখ বলেন, ‘তারা অসহায়-গরিব মানুষ। আমরা চাই তারা দেশে ফিরে যাক। ছয়জনের মধ্যে সোনালি বিবি অন্তঃসত্ত্বা। বাংলাদেশের কোর্টের কাছে আমরা আবেদন করেছি যে তাঁদের বিচার যেন দ্রুত শুরু করা হয়। বাংলাদেশের আইনকে সম্মান জানিয়েই আমরা তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এন এম ওয়াসিম ফিরোজ বলেন, কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে পুশ ইনের পর ওই ছয় ভারতীয় নাগরিক ঢাকায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আসার পর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। তাঁদের দেশে ফেরার আকুতি ছিল। কিন্তু বৈধ কোনো কাগজপত্র (পাসপোর্ট-ভিসা) না থাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলা করা হয়। এরপর আদালতের মাধ্যমে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ইনব বগঞ জ প শ ইন
এছাড়াও পড়ুন:
পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটাই বাতিল হওয়া উচিত: আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া
পদ্ধতিগত ত্রুটি, বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্যের কারণে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটাই বাতিল হওয়া উচিত বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। তবে বিকল্প হিসেবে তিনি বলেছেন, সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে আপিল বিভাগ সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের স্বার্থে সংশোধনীর কিছু বিধান সুরক্ষার জন্য মার্জনাও করতে পারেন।
পঞ্চদশ সংশোধনীর অংশবিশেষ অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানিতে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ চার ব্যক্তির পক্ষে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী আজ রোববার এই আরজি তুলে ধরেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ এ শুনানি গ্রহণ করেন। আগামীকাল শুনানির পরবর্তী দিন রাখা হয়েছে।
আদালতে বদিউল আলম মজুমদারসহ চার ব্যক্তির পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী কারিশমা জাহান ও বিদুয়ানুল করিম। আপিলের ওপর ৩ ডিসেম্বর (গত বুধবার) শুনানি শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার ও আজ শুনানি হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ আনা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা দুই ভাবে বাতিল হয়েছিল। ১৪ বছর আগে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে এবং পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের বিধান দিয়ে। আপিল বিভাগের রায়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন এনে ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ ওই সংশোধনীতে সংবিধানে ৫৪টি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছিল।
‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কিছু বিধান ফিরেছে, কিছু ফেরেনি’
শুনানিতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া বলেন, হাইকোর্টের রায়ের (পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা বাতিল) মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে কিছু বিধান ফিরেছে। কিছু বিধান ফেরেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যথাযথভাবে ফেরাতে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের এ-সংক্রান্ত বাকি ধারাগুলো অসাংবিধানিক ঘোষিত হতে হবে।
‘সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা’পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে পাইকারিভাবে সংশোধন আনা হয়, যা পুনর্লিখন হিসেবে বিবেচনা করা যায় বলে শুনানিতে উল্লেখ করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের চরিত্র পরিবর্তন করা হয়েছিল। নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছিল।’
পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পাঁচটি ক্রটি তুলে ধরে শরীফ ভূঁইয়া বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণে সেকশনগুলো (ধারাগুলো) একই হওয়ার কথা। অথচ বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণের সেকশনের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সংশোধনীর জন্য আনা কোনো বিলের সম্পূর্ণ শিরোনামায় এই সংবিধানের কোন বিধান সংশোধন করা হবে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়। সংশোধনীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ এবং সংসদের বিধি ও প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
শরীফ ভূঁইয়া বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশও লঙ্ঘিত হয়েছে। কেননা আপিল বিভাগের (ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত) সংক্ষিপ্ত আদেশে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন নির্বাচনের কথা বলা হয়। এমনকি জাতীয় সংসদের বিশেষ কমিটি গঠন করা হলেও তাঁদের মতামতের বাইরে গিয়ে ওই সংশোধনী আনা হয়। পদ্ধতিগত এসব ক্রটি বিবেচনায় পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটাই অসাংবিধানিক ঘোষণার যোগ্য।
‘কর্তৃত্ববাদী কাঠামো ও নেক্রোক্রেসি পদ্ধতি প্রবর্তন’পঞ্চদশ সংশোধনীতে যুক্ত জাতির পিতার প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শন–সংক্রান্ত ৪ক এবং ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি–সংক্রান্ত ১৫০(২) অনুচ্ছেদ তুলে ধরেন আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটা জাতির পিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সংশোধনীতে ওই বিধান যুক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী কাঠামো ও নেক্রোক্রেসি (মৃত ব্যক্তির নামে শাসনব্যবস্থা) পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়।
পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে রিট, হাইকোর্টের রায় ও আপিলজুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরো আইন ও আইনের কয়েকটি ধারার বৈধতা নিয়ে গত বছর হাইকোর্টে আলাদা দুটি রিট হয়। সুজন সম্পাদকসহ পাঁচ ব্যক্তি একটি এবং নওগাঁর বাসিন্দা মো. মোফাজ্জল হোসেন আরেকটি রিট করেন।
চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি–সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। এই দুটিসহ পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। রায়ে গণভোটের বিধানসংক্রান্ত ১৪২ অনুচ্ছেদ (দ্বাদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে আনা) পুনর্বহাল করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন সম্পূর্ণ বাতিল না করে বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে আইন অনুসারে পরবর্তী সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর পঞ্চদশ সংশোধনী আইন সম্পূর্ণ বাতিল চেয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ চার ব্যক্তি। অন্য তিন ব্যক্তি হলেন এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। নওগাঁর বাসিন্দা মোফাজ্জল হোসেন আরেকটি লিভ টু আপিল করেন। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার অপর একটি লিভ টু আপিল করেন।
শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ গত ১৩ নভেম্বর লিভ টু আপিল মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় পৃথক তিনটি আপিল হয়, যার ওপর ৩ ডিসেম্বর শুনানি শুরু হয়। আপিলে ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও গণফোরাম নেতা সুব্রত চৌধুরী। এ ছাড়া ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের কার্যনির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস এবং সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠনও ইন্টারভেনার হয়েছে।