বাংলা ভাষায় প্রযুক্তি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চাহিদা বুঝবে কবে
Published: 3rd, December 2025 GMT
আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। দিবসটি ঘিরে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সচেতনতামূলক পোস্টে সয়লাব, ঠিক সেই সকালেই স্মার্টফোন হাতে নিয়ে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রিফাতের (ছদ্মনাম) দিনটা রয়ে যায় মলিন।
এই দিনটির অর্থ রিফাতের জন্য আলাদা। প্রতিবন্ধিতার পরিসংখ্যানের তালিকায় সে শুধু একটি সংখ্যা নয়; সে রক্তমাংসের একজন মানুষ, যার প্রতিটি দিনই প্রযুক্তির সঙ্গে এক নীরব সংগ্রাম।
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রিফাতের দিনও শুরু হয়। চোখে আলো নেই, তবু এক অদ্ভুত সুর যেন তার পৃথিবীর দরজা খুলে দেয়। সেই দরজাটি ‘বাংলা টেক্সট-টু-স্পিচ অ্যাপ’। সেই অ্যাপের কল্যাণে চোখ নয়, শ্রবণই এখন রিফাতের দৃষ্টি। সেই অ্যাপের মাধ্যমেই নানান মাধ্যমে প্রকাশিত লেখাগুলোর প্রতিটি শব্দ শুনেই শুরু হয় তার প্রতিদিনের পথচলা।
সেই অ্যাপে কিছু শব্দ স্পষ্ট ভেসে আসে, আবার কিছু শব্দ স্পিকারের গহিনে বেঁকে যাওয়া লোহার মতো খটখটে শোনায়। তবু রিফাত থেমে থাকে না, কারণ এ পৃথিবী তাকে থামিয়ে দেওয়ার অনেক কারণ দিলেও, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা সে নিজেই হয়ে উঠেছে।
রিফাতের এই অভিজ্ঞতা অনন্য নয়। দেশের হাজারো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির দিন শুরুই হয় ত্রুটিপূর্ণ স্ক্রিন রিডার, ভুল উচ্চারণ, অপাঠ্য পিডিএফ আর অ্যাক্সেসিবিলিটি (প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রযুক্তি সহজীকরণ সেবা)-বিমুখ ওয়েবসাইটের সঙ্গে লড়াই করে।
ঢাকার অন্য প্রান্তে ঠিক একই সকালে অনলাইন ক্লাসে যোগ দেয় মিতু। দৃষ্টিশক্তি কম হলেও স্বপ্নে আলো কম নেই তার। সহপাঠীরা নির্বিঘ্নে পড়তে পারলেও মিতুকে (ছদ্মনাম) বারবার স্ক্রিন বড় করতে হয়। কিন্তু স্ক্রিন একটু বড় করলে অনলাইন পেজের বিন্যাসই হারিয়ে যায়। স্ক্রিন রিডার ব্যবহার করতে গেলে উচ্চারণ যেন আরেক বিপত্তি। সেখানে ‘বাংলাদেশের সংবিধান সমতা নিশ্চিত করে’ বাক্যটি ইংরেজিতে উচ্চারিত হয় ‘বাংলাদেশ কনস্টিটিউশন গ্যারান্টি কোয়ালিটি’ হিসেবে। যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘বাংলাদেশের সংবিধান মান নিশ্চিত করে’।
মিতুর চোখের সামনে অক্ষরগুলো বেঁকে গেলেও সবচেয়ে বেশি বেঁকে যায় বোঝার সেতুটা। অর্থের সঙ্গে বোঝাপড়ার দূরত্ব তখন আরও বাড়ে। বাংলাদেশে লক্ষাধিক মানুষ রিফাত বা মিতুর মতো নিয়মিত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন ভাষা, প্রযুক্তি আর অ্যাক্সেসিবিলিটির ফাঁকফোকরের মাঝখানে।
একদিকে প্রযুক্তির অগ্রগতি, অন্যদিকে তার অসামঞ্জস্যতা। স্ক্রিন রিডার আছে, ম্যাগনিফায়ার আছে, বাংলা ওসিআর আছে, কিন্তু অধিকাংশই ব্যবহার উপযোগী নয়। কোথাও ভুল উচ্চারণ, কোথাও স্থানীয়করণের ঘাটতি, কোথাও প্রশিক্ষণহীনতা। গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে উন্নত বাংলা প্রযুক্তি আছে, কিন্তু সেগুলো যেন কাচের আলমারিতে আটকে থাকা প্রদর্শনীর জন্য। মানুষের বাস্তব জীবনে তা পৌঁছায় না।
এদিকে সরকারি ওয়েবসাইটগুলো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আরেক যুদ্ধক্ষেত্র। সেখানে অ্যাক্সেসিবিলিটির অভাবে ই-সেবা যেন অদৃশ্য দেয়ালে আটকে থাকে। সরকারি অনেক পিডিএফ ফাইল স্ক্রিন রিডারে ‘অপাঠ্য’। মোবাইল অ্যাপের বড় অংশেই ‘টেক্সট টু স্পিচ’ বা লেখাকে উচ্চারণ করার প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নেই।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতায় আমি এখানে তিনটি বড় বাধা আছে বলে মনে করি। প্রথমত, ডেটা ঘাটতি—প্রতিবন্ধী মানুষের প্রযুক্তিগত চাহিদা সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য নেই। দ্বিতীয়ত, সেবার ঘাটতি—সহায়ক প্রযুক্তিকে ডিভাইস হিসেবে দেখা হয়, ইকোসিস্টেম হিসেবে নয়। তৃতীয়ত, স্থানিকরণের ঘাটতি—বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক অ্যাক্সেসিবল প্রযুক্তি অনুবাদনির্ভর, মাতৃভাষাভিত্তিক নয়।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানায়, দেশে প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার। ইউনিসেফের তথ্য মতে, অর্ধেকের বেশি প্রতিবন্ধী শিশু স্কুলে যেতে পারে না। কারণ, পাঠ্যবই, ক্লাসরুম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তাদের জন্য মানানসই নয়। এই সংখ্যাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়, এগুলো রিফাতদের শিক্ষা, মিতুদের চাকরি, হাজারো মানুষের স্বপ্নের হিসাব, যা হাজারো ভবিষ্যতের দিগন্ত নির্ধারণ করে।
যদিও বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নীতিপর্যায়ে অনেক অগ্রগতি করেছে। দেশে অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩, ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি নীতি আছে। কিন্তু নীতি যদি প্রয়োগে না আসে, তাহলে তা তালাবদ্ধ দরজার মতো।
এদিকে বাংলা ভাষা প্রযুক্তি দ্রুত উন্নত হচ্ছে। উন্নত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক টিটিএস, বাংলা ওসিআর, স্পিচ-টু-টেক্সট। এই যাত্রায় ‘এটুআই’ প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এটুআই-এর ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি অডিট, অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজাইন প্রশিক্ষণ, স্থানীয় মানদণ্ড গঠন, ডেভেলপার প্রশিক্ষণ—এসব উদ্যোগ ডিজিটাল রূপান্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সৃষ্টি করেছে। নীতি ও বাস্তবায়নের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরিতে এটুআই এখন একটি জাতীয় রেফারেন্স মডেল। তবু পথ অনেক বাকি।
আরও পড়ুনপ্রতিবন্ধী মানুষটার দিকে তাকান, তার প্রতিবন্ধিতার দিকে নয়০৩ ডিসেম্বর ২০২২গবেষণা থেকে মূলধারায় আসার যাত্রা এখনো ধীর। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল বা সরকারি সেবায় এগুলোর প্রয়োগ খুব কমই দেখা যায়।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতায় আমি এখানে তিনটি বড় বাধা আছে বলে মনে করি। প্রথমত, ডেটা ঘাটতি—প্রতিবন্ধী মানুষের প্রযুক্তিগত চাহিদা সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য নেই। দ্বিতীয়ত, সেবার ঘাটতি—সহায়ক প্রযুক্তিকে ডিভাইস হিসেবে দেখা হয়, ইকোসিস্টেম হিসেবে নয়। তৃতীয়ত, স্থানিকরণের ঘাটতি—বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক অ্যাক্সেসিবল প্রযুক্তি অনুবাদনির্ভর, মাতৃভাষাভিত্তিক নয়।
এসব সংকট সমাধানের জন্য পাঁচটি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করি। ১.
শেষ পর্যন্ত রিফাতের স্ক্রিন রিডার আর মিতুর ম্যাগনিফায়ার আমাদের শেখায়, প্রযুক্তি ক্ষমতায়ন দিতে পারে, যদি তা মানুষের ভাষা বোঝে, অনুভূতি বোঝে, আর যদি তা অন্তর্ভুক্তির দৃষ্টিতে নির্মাণ করা হয়।
প্রতিবছর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে আমরা সমতার কথা বলি। অধিকার, মর্যাদা, সুযোগ—সবই উঠে আসে আলোচনায়। কিন্তু রিফাত-মিতুদের প্রশ্ন একটাই—‘আমাদের ভাষায় প্রযুক্তি যখন কথা বলবে, তখনই কি আমরা সত্যিকারের সমান হব?’
বাংলাদেশের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি কোনো বিলাসিতা নয়, এটি ন্যায়ের পরবর্তী অধ্যায়। এখন সময় বাংলায় অ্যাক্সেসিবল প্রযুক্তিকে প্রান্তিক প্রকল্প নয় বরং মূলধারার জাতীয় অগ্রাধিকার বানানোর। তবেই আধখোলা দরজার পৃথিবী পুরোপুরি খুলে যাবে, যেখানে রিফাত বা মিতুর মতো হাজারো মানুষ দেখতে পাবে নিজেদের ভবিষ্যতের আলো।
ভাস্কর ভট্টাচার্য্য ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি বিশেষজ্ঞ ও প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত বন ধ ত র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নীরব মহামারি মূল্যস্ফীতি যে মহাভুলে কমছেই না
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী আফগানিস্তানের গল্প বলতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘কুইনিন জ্বর সারাবে; কিন্তু কুইনিন সারাবে কে?’ দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার কমাতে গিয়ে উচ্চ সুদহারের ওষুধ প্রয়োজনীয় ছিল বটে; কিন্তু এখন উচ্চ সুদহারের যন্ত্রণা সারানো যায় কী করে, সেটিই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক রোগ কমায়; কিন্তু অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক অসুস্থ মানুষের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়।
গত দেড় বছরের উচ্চ সুদহার এবং একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অনমনীয় সহাবস্থান দেশের অর্থনীতিকে এক জটিল গ্যাঁড়াকলে ফেলে দিয়েছে। এখন উচ্চ সুদহারই অনমনীয় মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করছে। চড়া সুদ পুঁজিখরচ ও উৎপাদনের ব্যয় বাড়িয়ে শেষতক খরচতাড়িত মূল্যস্ফীতির জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে কি মুদ্রানীতির বিদ্যা ভুল হয়ে গেল? তা নয়। তবে কি এখন সুদহার কমিয়ে দিলেই মূল্যস্ফীতি দুর্বল হয়ে পড়বে? সেটিও সত্য নয়। তাহলে কি উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আমাদের ভাগ্যলিখন বলে মেনে নিতে হবে? সেটি আরও সত্য নয়।
চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, এর পেছনে ছিল ছয়টি ‘ব্লান্ডার’ বা মহাভুল। বর্তমান ঘাউড়া মূল্যস্ফীতির পেছনেও একাধিক ব্লান্ডার কাজ করেছে। প্রথম ভুল ছিল সময়মতো ওষুধ প্রয়োগ করা হয়নি। আগুনে পোড়া রোগীকে সময়মতো ওষুধ না দিলে তারপর অ্যান্টিবায়োটিকেও আর কাজ করে না।
এই সুদহার যখন বাড়ানো উচিত ছিল, তখন অর্থাৎ ২০২২-২৩-এর কালপর্বে তা করা হয়নি। অর্থনীতিবিদদের শত কাকুতিমিনতি কিংবা যুক্তি সদর্পে অগ্রাহ্য করেছিলেন তৎকালীন হিসাববিদ অর্থমন্ত্রী, যিনি নিজেই ছিলেন অর্থনীতির জ্ঞানশূন্য একজন খেলাপিবান্ধব ব্যবসায়ী। শোনা যায়, ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পেছনেও তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার তাঁর চেয়ে আর ভালো কিসিমের মানুষ অর্থমন্ত্রীর মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্বের জন্য জোগাড় করতে পারেনি।
শিয়ালের কাছে মুরগি বন্ধক দেওয়ায় ওই সময়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংক খাত। সর্বোচ্চ শতকরা ৯ ভাগ সুদহারে ঋণ বিতরণের নামে অনেকগুলো ব্যাংক খালি করা হয়েছে। তখন বাজারে মূল্যস্ফীতি ছিল শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ, অর্থাৎ ঋণাত্মক কিংবা শূন্য সুদহারে লুটেরা সম্প্রদায় ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়েছে। এটি অর্থনীতিতে অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি করে মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। কিন্তু সেটিকে এখন অজুহাত হিসেবে ধরে রাখলে অর্থবিদ্যার প্রতি অবিচার করা হবে।
আরও পড়ুনবাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কমবে কীভাবে৩০ নভেম্বর ২০২৫অর্থশাস্ত্রে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বা জীবনযাত্রার মান একটি দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। অর্থাৎ এগুলোতে পরিবর্তন আনতে হলে বছর দশেক সময় দিতে হয়। নিয়োগবৃদ্ধির কাজটিও প্রায় মধ্যমেয়াদি—দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পরিকল্পনার মাধ্যমে এর পরিবর্তন আনা যায়; কিন্তু মূল্যস্ফীতি দমনের বিষয়টি স্বল্পমেয়াদি—এক থেকে দুই বছরের মধ্যেই এর পরিবর্তন আনা সম্ভব। তিন প্রতিবেশী দেশ—ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা তা চৌকসভাবে প্রমাণ করেছে। যন্ত্রণা ঠেকে আছে বাংলাদেশের কপালে। বিশেষত গত ১৫ মাসে এর কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেনি।
দেশের গড় মূল্যস্ফীতি এখনো শতকরা ৯ থেকে ১০ ভাগের মধ্যে আসন গেড়ে বসে আছে। এর বড় কারণ সরকারের স্ববিরোধী নীতিমালা। উচ্চ রক্তচাপের
রোগীকে একদিকে ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে বেশি করে লবণ খাওয়ানো হচ্ছে। এ কাজই করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একদিকে অতি উচ্চ সুদহার বজায় রেখে ‘মানিটারি টাইটেনিং’ বা মুদ্রাগত কষায়নের দ্বারা ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে অর্থমৃত ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার স্বার্থে এগুলোকে অপরিমেয়
তারল্যসুবিধা দেওয়া হচ্ছে, যা দেহে লবণের মাত্রা বাড়িয়ে উচ্চ রক্তচাপ বা উচ্চ মূল্যস্ফীতি ধরে রাখছে।
এটি যে স্ববিরোধী, তা বিজ্ঞ গভর্নরও জানেন; কিন্তু তিনি নানামুখী চাপের মোকাবিলা করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতি দমনের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন না। ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে আসার যে কথা তিনি দিয়েছিলেন, সেটিও আজ স্বপ্নমঙ্গলের বাণী।
আমাশয় দীর্ঘদিন ধরে চললে যেমন কারও ‘ক্রনিক ডিসেন্ট্রি’ হয়ে যেতে পারে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির অনমনীয়তাও মধ্য আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার কতিপয় দেশের মতো বাংলাদেশের জন্যও অনিরাময় ব্যাধি হয়ে যেতে পারে। এর সঙ্গে বর্ধমান বেকারত্ব যুক্ত হলে অর্থনীতিতে বদ্ধাবস্থা বা ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ অনিবার্য হয়ে পড়বে।
গত ১৫ মাসে বহু অসার কমিশন গঠিত হলেও মূল্যস্ফীতি দমনের জন্য একটি বিশেষ কমিশন সরকার কেন গঠন করল না, সেটি বিস্ময়ের। মূল্যস্ফীতি সরকারের যথার্থ মনোযোগ পায়নি; অথচ এই নীরব মহামারি তিন-চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠীর নিত্যযন্ত্রণার ব্যাধি।
গোদের ওপর আবার আরেক বিষফোড়া যুক্ত হয়েছে, যার নাম সরকারের রাজস্ব অক্ষমতা; যা এখন ২৫ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো না থাকায় ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো আয়কর দিতে পারছেন না। রাজভান্ডারে টাকার অভাব। এখন টাকা দেবে গৌরী সেন, অর্থাৎ ব্যাংকব্যবস্থা। সরকার টাকা পেলে ‘ক্রাউডিং আউট’ বা খেদিয়ে দেওয়া প্রভাবের ফলে ব্যক্তি উদ্যোক্তারা টাকা পাবেন না বা কম পাবেন। কিন্তু সমাজে অতিরিক্ত তারল্য ঠিকই রয়ে যাবে। মুখ দিয়ে লবণ না খেলেও স্যালাইনের টিউব দিয়ে দেহে লবণের অনুপ্রবেশ ঠিকই ঘটানো হবে।
আরও পড়ুনমূল্যস্ফীতি নাহয় ঠিক হবে, কিন্তু মনঃস্ফীতি ঠিক করবে কে১৭ জানুয়ারি ২০২৪সরকার দক্ষ ও অধিক গ্রহণযোগ্য হলে দুটি কাজ অর্থাৎ ১. রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও ২. পরিচালন ব্যয় হ্রাস—এই ঘটনাদ্বয় পাশাপাশি ঘটত, যা মূল্যস্ফীতি দমনে সহায়ক হতো; কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এই দুই ক্ষেত্রেই উল্টো পথে হাঁটছে। এর দায় গিয়ে পড়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর। ফলে মুদ্রার জোগান দেওয়া ছাড়া সরকারকে বাঁচানো কঠিন। তাই মূল্যস্ফীতি ঠায় বসে আছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে আমদানি করা দ্রব্যের ওপর শুল্ক আরোপের পর থেকে সে দেশের মূল্যস্ফীতি আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়েছে। সেটি একটি নির্বাচিত সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের পথঘাটের মস্তানরা নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রতিনিধি নন; কিন্তু তাঁদের চাঁদাবাজি একটি রাজনৈতিক কর, যা মূল্যস্ফীতিকে উঁচুতে ধরে রাখছে। গত সরকারের একজন বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, সিন্ডিকেট দমন করা যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের বেলায় এই বদচর্চা কমেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি দমন না করতে পারার দায় বিগত ১৫ বছরের শাসনামলের ওপর চাপালে মূল্যস্ফীতি কমবে না। এই চলমান রোগ দমনের দায়িত্ব চলমান সরকারেরই বটে। চাঁদাবাজির কারণে জিনিসপত্রের দাম কতটা বেড়ে যাচ্ছে, তার হিসাব বিবিএসের কাছে নেই। এর জন্য খুচরা বিক্রেতা বা মোহাম্মদপুরের সবজির দোকানদার শ্রেণির মানুষদের ওপর জরিপ হতে পারে।
মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি বিষয় অন্তর্বর্তী সরকারের অনুকূলে রয়েছে। এগুলো হলো ১. বেকারত্ব বৃদ্ধি; ২. প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও ৩. দারিদ্র্যের ঊর্ধ্বগমন।
অর্থনীতির ফিলিপ রেখা অনুযায়ী এর যেকোনো একটি ঘটলেই প্রকৃত মজুরি ও মূল্যস্ফীতি কমে আসার কথা—যদিও এগুলো প্রার্থিত বিষয় নয়। ক্ষুধামান্দ্য রোগে আক্রান্ত হলে কারও যদি বাজারসওদার খরচ কমে, সেটি যেমন প্রার্থিত নয়; ২০২৪ সালের আগস্টে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল শতকরা ১০ ভাগ। সেটি ২০২৫ সালের অক্টোবরে মাত্র ৯ দশমিক ২২ ভাগে নেমেছে। এই পতন পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যহীন।
মূল্যস্ফীতির এই সামান্য পতনের পেছনে এই তিন অনুন্নতি বা অনাকাঙ্ক্ষিত কারণই বড় ভূমিকা রেখেছে। সরকারের রাজস্ব বা মুদ্রানীতির কোনো সাফল্যের ছাপ এখানে নেই বললেই চলে।
সরকারের উচিত এই উচ্চ সুদহার এখন কমিয়ে এনে সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতাদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়া এবং এভাবে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে খরচতাড়িত মূল্যস্ফীতিকে দুর্বল করা। সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজির পণ্য পরিবহনের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলো দাম কমাতে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে এখন চাহিদার দিকের চেয়ে সরবরাহের দিকগুলোতে বেশি মনোযোগ প্রয়োজন।
ড. বিরূপাক্ষ পাল স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক।
*মতামত লেখকের নিজস্ব