‘মেয়ে মরল, লাশ পাইলাম, এখন ক্ষতিপূরণ পামু তো?’
Published: 3rd, December 2025 GMT
রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে আগুনের ঘটনায় উদ্ধারকাজ তত দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু মেয়ে মার্জিয়া সুলতানাকে জীবিত অথবা মৃত খুঁজে পাচ্ছিলেন না মোহাম্মদ সুলতান। শেষে একটি শ্রমিক সংগঠনের সহায়তা নিয়ে ঢুকে যান পোড়া কারখানায়।
১১ দিন পর ঘটনাস্থলে খুঁজে পান মেয়ের পচা-গলা-পোড়া লাশ। এরপর ডিএনএ পরীক্ষা এবং সেটার ফলাফল পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা। শেষমেশ গত ২৬ নভেম্বর সুনামগঞ্জে মেয়ের লাশ দাফন করেছেন। ক্ষুব্ধ-হতাশ বাবার এখন একটাই প্রশ্ন—‘মেয়ে মরল, লাশ পাইলাম, এখন ক্ষতিপূরণ পামু তো?’
ঘটনাটি ঘটে গত ১৪ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে। শিয়ালবাড়ির ৩ নম্বর সড়কের আলম ট্রেডার্স নামের একটি রাসায়নিক গুদামে প্রথমে আগুন লাগে। আগুন গুদামের পাশের আর এন ফ্যাশন নামে পোশাক কারখানায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় শুরুতে ১৬ জনের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। ১১ দিন পর মার্জিয়ার লাশ উদ্ধার করা হলে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭।
মার্জিয়ার লাশ উদ্ধারের সময়কার একটি ছোট্ট ভিডিও তাঁর পরিবারের কাছে আছে। তাতে দেখা যায়, পোড়া ও খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশের ব্যাগে তোলা হচ্ছে। আশপাশে আর কিছু আছে কি না—খুঁজতে গিয়ে একজন বলে উঠলেন, ‘এই যে চামড়া আছে।’ একটু পর আরেকজন হাতের হাড়ের খণ্ডিত অংশ খুঁজে পান। এত খোঁজাখুঁজি আর মেয়ের লাশ উদ্ধারের পুরোটাই সামনে থেকে দেখেন মোহাম্মদ সুলতান।
নিহত হন মার্জিয়ার স্বামীওমার্জিয়ার বয়স মাত্র ১৪ বছর। স্বামী জয় মিয়ার বয়স ২০ বছর। মাস ছয়েক আগে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। মার্জিয়ার বাবা মোহাম্মদ সুলতান ও জয়ের বাবা সবুজ মিয়া আপন দুই ভাই। বাড়ি নেত্রকোনায়।
মোহাম্মদ সুলতান নেত্রকোনা থেকে সুনামগঞ্জে গিয়ে থিতু হন। পরে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি সিটি করপোরেশনের ময়লা পরিবহনের কাজ করেন। সবুজ মিয়া গাজীপুরে পরিবার নিয়ে থাকেন। কাজ করেন একটি পোশাক কারখানায়।
জয় ও মার্জিয়া ঢাকায় আর এন ফ্যাশনে কাজ করতেন। অগ্নিকাণ্ডের সপ্তাহখানেক আগে দুজন সেখানে কাজ নেন। জয় অপারেটর, আর মার্জিয়া হেলপার পদে। কারখানার তিনতলায় কাজ করতেন দুজনে। আগুনের ঘটনায় জয় পুড়ে মারা গেছেন। তাঁর লাশ আগেই পাওয়া গেছে।জয় ও মার্জিয়া ঢাকায় আর এন ফ্যাশনে কাজ করতেন। অগ্নিকাণ্ডের সপ্তাহখানেক আগে দুজন সেখানে কাজ নেন। জয় অপারেটর, আর মার্জিয়া হেলপার পদে। কারখানার তিনতলায় কাজ করতেন দুজনে। আগুনের ঘটনায় জয় পুড়ে মারা গেছেন। তাঁর লাশ অগ্নিকাণ্ডের পরপরই পাওয়া যায়।
একই পোশাক কারখানায় কাজ করতেন মার্জিয়ার আপন ভাই মো.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ল শ উদ ধ র ক জ করত ন ক জ কর র ঘটন ঘটন য়
এছাড়াও পড়ুন:
বন্দর পরিচালনা: জাতীয় সক্ষমতা তৈরি না করে বিদেশনির্ভরতা কেন
যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর–পশ্চিম ম্যাসাচুসেটসে হুসাক পর্বতমালার মধ্য দিয়ে ৪ দশমিক ৭ মাইল দীর্ঘ একটি রেলওয়ে টার্মিনাল নির্মাণ শুরু হয় ১৮৫১ সালে। ২৪ বছর পর ১৮৭৫ সালে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। নির্মাণ শুরুর আগে যতটা কঠিন ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল কাজটি। নির্মাণের সময় ১৯৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন।
সেই সময়ের তুলনায় পুরকৌশলের একটি ল্যান্ডমার্ক প্রকল্প হিসেবে স্বীকৃতি ছিল এটি। আলবার্ট হির্শমান নামের একজন অর্থনীতিবিদের একটি তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিউ ইয়র্কার–এর সাংবাদিক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল এই গল্প উদাহরণ হিসেবে দেখান।
হির্শমানের মতে, সৃজনশীলতা আমাদের জন্য সব সময় একটি বিস্ময় হিসেবে আসে; তাই আমরা কখনোই এর ওপর নির্ভর করতে পারি না এবং এটি ঘটে যাওয়ার আগে আমরা এর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করি না। সচেতনভাবে এমন কাজগুলোতে যুক্ত হতে চাই না, যেখানে সাফল্য অর্জন করতে সৃজনশীলতার প্রয়োজন হয়। তাই আমাদের সৃজনশীলতাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করার একমাত্র উপায় হলো, কাজটা যতটা কঠিন, তার চেয়ে কম কঠিন হিসেবে মূল্যায়ন করা।
হির্শমান এই নীতির নাম দিয়েছেন ‘হাইডিং হ্যান্ড প্রিন্সিপাল’। এর কারণ হলো, প্রকল্পের কঠিন দিকগুলো একটি ‘অদৃশ্য হাত’ দিয়ে পরিকল্পনাকারীর কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে লুকানো হয়, যেন পরে সৃজনশীলতা ব্যবহার করে কাজটি সম্পন্ন করা যায়। এই নীতির খারাপ ও ভালো উভয় দিকই আছে।
তবু ধরে নেওয়া হয়, আমরা যে সৃজনশীল হতে চাই না, এই হতে না চাওয়াকে অতিক্রম করার জন্য আমাদের কিছু ঝুঁকি নিতে হয়; অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা এখানে পথ দেখায়। অনিশ্চিত পৃথিবীতে এই নীতি অনুসরণ করে অনেকেই সামনের দিকে এগিয়ে যান।
আরও পড়ুনচট্টগ্রাম বন্দর: আমাদের সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসটি...২৫ অক্টোবর ২০২৫২.লালদিয়া চরে চট্টগ্রাম বন্দরের একটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ১৭ নভেম্বর এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার একটি চুক্তি করেছে। চুক্তির শর্ত প্রকাশ না করে মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে ৩৩ বছরের চুক্তি করা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ‘হাইডিং হ্যান্ড’ নীতি অনুযায়ী, এই বিতর্কে উভয় পক্ষই (চুক্তির পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং চুক্তির বিরোধিতাকারী) কিছু বাস্তব ভবিষ্যৎ সমস্যাকে তাদের মতো উপস্থাপন করছে। যেমন এপি মোলার এবং সরকার বন্দরের চুক্তির শর্ত আড়াল করে এর সম্ভাব্য ঝুঁকিকে তাদের জায়গা থেকে উপস্থাপন করছে। অন্যদিকে তড়িঘড়ি করে করা চুক্তির বিরোধিতাকারীরা বিকল্প হিসেবে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির পথে বাধাগুলোকে তাদের মতো করে দেখাতে চাইছে।
উপায় ভিন্ন হলেও উভয়ই এখানে একটি অচলাবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়। তবে এখানে পার্থক্য রয়েছে কর্তৃত্ব নিয়ে। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। কার নিয়ন্ত্রণে, কীভাবে এই সংকট দূর হবে? কার সৃজনশীলতা দিয়ে বন্দরের কর্মদক্ষতা বাড়ানো যায়? আমরা কি আশা করব, ইজারা দিয়ে বিদেশি কোম্পানির ওপর সৃজনশীলতার দায় চাপিয়ে বন্দর দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে, নাকি বাংলাদেশ তার নিজস্ব মালিকানার দায় থেকে সৃজনশীলতা ব্যবহার করে দুর্নীতি মোকাবিলা করতে পারবে? কে এই সৃজনশীলতা ব্যবহারে কার কাছে, কতটুকু দায়বদ্ধ? বিদেশি কোম্পানি ব্যবসা করতে আসে, দুর্নীতি যদি কোনো কারণে তার মুনাফা বৃদ্ধি করে, তাহলে কি দুর্নীতি রোধের দায় তার থাকবে? একইভাবে বন্দর ব্যবস্থাপনায় জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলে পরবর্তী সরকার যদি তা না করে, তাহলে কী হবে?
এখানেই গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রসঙ্গ চলে আসে। বিগত আমলে আমরা দেখেছি, সীমাহীন দুর্নীতি থেকে লাভবান হওয়ার কারণে একটি নির্বাচিত সরকার স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল সেই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত এবং দুর্নীতি রোধে একটি রূপরেখা তৈরি করা। তা না করে অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের পরিকল্পিত, কিন্তু অবাস্তবায়িত প্রকল্প অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ছাড়াই বাস্তবায়ন করছে।
আরও পড়ুনবিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনার ইজারা দেওয়ার ঝুঁকিগুলো কী১৪ জুন ২০২৫৩.বাংলাদেশের জনগণ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, অদক্ষতা, অনিয়ম দেখতে দেখতে হতাশ। সরকারি প্রতিষ্ঠানে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা হতাশ হয়ে ভেবেছিলেন, সেবা খাত ব্যক্তি খাতে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে। ১৯৮০–এর দশক থেকে অসংখ্য রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বেসরকারীকরণ করা হয়েছে। তখন বলা হয়েছিল, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ঠিকমতো কাজ করে না, রয়েছে দুর্নীতি ও অদক্ষতা। কাজেই বেসরকারি ব্যাংক খুলতে হবে।
এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়ে গেল। এখন ৩৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ শীর্ষ খেলাপি ঋণের তালিকায় স্থান পেয়েছে। পাঁচটি খেলাপি ব্যাংককে একীভূত করে সেই সরকারি মালিকানায় এনে তাদেরকে আবার বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ এই সরকারি মালিকানার প্রতি অনাস্থা থেকেই এই ব্যাংকগুলোকে গঠন করা হয়েছিল।
একইভাবে চট্টগ্রাম বন্দর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ার টেকের কাছে ইজারা দেওয়া হলেও সেখানেও দুর্নীতি কমেনি। এখন বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দিলে এই দুর্নীতি বন্ধ হবে। এ রকম চিন্তা থেকেই দুই বছর আগে পতেঙ্গা টার্মিনালকে সৌদি কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। ১৫ মাস পরও এই টার্মিনাল থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো বিনিয়োগ হয়নি, কর্মদক্ষতাও বাড়েনি।
এরপরও অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রামের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছে ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার গত এপ্রিল মাসেই মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরে একটি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য জাপানি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। তবে টার্মিনালটি পরিচালনা করবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ। তাই এটা নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক হয়নি।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এখানেই থামেনি। লালদিয়া চরে আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার চুক্তি সম্পন্ন করেছে ডেনমার্কের কোম্পানি এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে এবং পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার চুক্তি করেছে সুইজারল্যান্ডের কোম্পানি মেডলগের সঙ্গে। কারণ হিসেবে বিদ্যমান দুর্নীতি বন্ধ করা ও দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, এতে কি দুর্নীতি বন্ধ হবে? এপিএম টার্মিনালসের মতো বৈশ্বিক কোম্পানি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে কী সাফল্য নিয়ে এসেছে? লাইবেরিয়ার মরোভিয়া বন্দর ইজারা নিয়ে এপিএম টার্মিনালস কেন আশানুরূপ দক্ষতা বাড়াতে পারেনি? উল্টো মাশুল কেন এত বেড়ে গেছে যে লাইবেরিয়ার আমদানি–রপ্তানি ব্যয়বহুল হয়ে গেছে? নাইজেরিয়ার আপাপা বন্দরের দুর্নীতি কেন বন্ধ হয়নি? তাহলে কি দুর্নীতির উৎস অনুসন্ধানেই সমস্যা রয়ে গেছে?
দুর্নীতির সঙ্গে এককভাবে কোনো ব্যক্তি যুক্ত থাকে না; বরং এটি একটি চক্রের কাজ, যারা নিজেদের মধ্যে যোগসাজশের মাধ্যমে দুর্নীতিকে টিকিয়ে রাখে। এ কারণে দুর্নীতি রোধের প্রসঙ্গ উঠলেই সব সময় উৎসের কাছে না গিয়ে ‘ঝোপে কোপ মেরে’ লোকদেখানোটাই অনেক দেশে মূল রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে একটা সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেলে শুধু নেতৃত্ব প্রতিস্থাপন করলেই সংস্কার সম্ভব হয় না, সে কারণেই একটি অপারেটর নিয়োগ দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা আদৌ সম্ভব কী না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় সবেচেয়ে বেশি। সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকার কারণে কোনো সরকার চাইলে রন্ধ্রে রন্ধ্রে জিইয়ে থাকা দুর্নীতির উৎস সমূলে উৎপাটন করতে পারে। সরকার যদি নিজে না চায়, তাহলে এই কাজ সম্ভব নয়। জনগণের দিক থেকে চাপ অব্যাহত থাকলে সরকার তার ‘অনাবিষ্কৃত সৃজনশীল’ পদ্ধতি সন্ধান করতে বাধ্য হতে পারে। অনেক সময় সরকার জানেই না তারা কতটা সৃজনশীল হতে পারে; জনগণ সরকারকে উপায় দেখতে বাধ্য করতে পারে।
আরও পড়ুনপ্রতিবেশীরা বন্দর ব্যবহার করলে আমরা লাভবান হব২৫ জানুয়ারি ২০১০৪.এপিএম টার্মিনালস ২০০১ সালে শত বছরের বেশি পুরোনো ডেনমার্কের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি মায়েরস্কের হাত ধরে স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে তারা বিশ্বজুড়ে ৭৪টি বন্দরে টার্মিনাল পরিচালনা করছে এবং বিভিন্ন দেশে কাজের অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে আগ্রহী।
তবে আফ্রিকান দেশগুলোতে এই কোম্পানির অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা এবং বন্দর পরিচালনার বাইরের দুর্নীতির উৎসগুলো অস্বীকার করে কি দুর্নীতি দূর করা সম্ভব?
বাংলাদেশে এর আগে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির অভিজ্ঞতা সন্তোষজনক নয়; যেমন আদানির চুক্তি ও মেট্রোরেলের চুক্তি গোপন ছিল। যখন অভিজ্ঞতা বলছে যে এগুলোতে দেশীয় স্বার্থবিরোধী শর্ত ছিল, তখন জনগণকে এই চুক্তি অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে বলা কী অমর্যাদাকর নয়?
বাংলাদেশে দুর্নীতি বন্ধ এবং কর্মদক্ষতা বাড়ানোর দাবি শ্রমিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (১৪টি শ্রমিক ইউনিয়নের একটি ফেডারেশন) সম্প্রতি বন্দর এলাকায় প্রতীকী অবরোধ করেছে। তারা জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও টার্মিনালে উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু তারা মনে করে, কাস্টমসের দুর্নীতি বন্ধ না হলে বন্দরের দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলছে, তাহলে কেন এর ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়া হবে?
যারা বিদেশি কোম্পানির কাছে টার্মিনাল ইজারা দিতে চায়, তারা চুক্তির বিরোধিতাকারীদের দুর্নীতির জন্য দায়ী করছে। কিন্তু তারা দুর্নীতির উৎস বন্ধের কার্যকর উপায় ব্যাখ্যা করে না। তাহলে শুধু ব্যবস্থাপক পরিবর্তন করে কি দুর্নীতি রোধ করা যাবে?
আরও পড়ুনবন্দর পরিচালনা বিদেশিদের দেওয়া কতটা যৌক্তিক১৯ মে ২০২৫৫.ডিপি ওয়ার্ল্ডের প্রধান দপ্তর দুবাইতে। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শুরু হয়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে একটি স্থানীয় বন্দর পরিচালনা শুরু করে। নিজেদের সৃজনশীলতা ব্যবহার করে, অন্য গ্লোবাল অপারেটরদের কাছ থেকে শেখে, এক্সপার্ট নিয়োগ দিয়ে তারা একটি গ্লোবাল অপারেটর হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে এবং বর্তমানে ৮০টি দেশে তারা কাজ করে।
এসব রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগের কথা তুললেই কেউ কেউ বলেন যে আমাদের পুঁজি নেই, আমাদের জাতীয় সক্ষমতা নেই। জাতীয় সক্ষমতা কীভাবে অর্জন করতে হয়, এ প্রসঙ্গে কথা বলতে তাঁদের কখনোই দেখা যায় না। বিষয়টি যে বিদেশি কোম্পানির প্রতি অবিশ্বাস বা অমূলক সন্দেহপ্রসূত নয়, বরং জাতীয় সক্ষমতা অর্জনের তাগিদ, কথাটা খুব সন্তর্পণে আড়াল করে রাখা হয়।
এটা ঠিক যে সক্ষমতা অর্জনের পথ কঠিন। তবে আমরা দেখলাম, সরকার উদ্যোগ নিয়ে নিউমুরিং টার্মিনালে জাহাজ অপেক্ষার সময় শূন্যে নামিয়ে এনেছে; বহুদিন ধরে বন্দরে মূল্যবান জায়গা দখল করে রাখা কনটেইনার, স্ক্র্যাপ মালামাল সরাচ্ছে। এগুলো নিয়ে সরকার যখন গর্ব করে, তখন আমরাও আশা দেখি।
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বহুদিনের সমস্যা যে সমাধান করা যায়, তা সরকার নিজেই দেখিয়ে দিল। তাহলে আমাদের বন্দর কেন বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দিতে হবে? দায়িত্ব নেওয়ার ভয়ে? সৃজনশীলতা ব্যবহারের ভয়ে? যাঁরা এখন দায়িত্ব নিয়ে ইজারা দিচ্ছেন, তাঁরা হয়তো কিছুদিন পর বিদেশে ফিরে যাবেন। এভাবে দেশের সক্ষমতা অর্জনের দায় তাঁরা কেন এড়িয়ে যাচ্ছেন?
ড. মোশাহিদা সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব