দুবেলা খাবারের টাকা ছিল না, পরতেন ছেঁড়া শার্ট, এখন তিনি বিচারক
Published: 3rd, December 2025 GMT
‘দুবেলা ভাত খাওয়ার টাকা ছিল না। ২০ টাকা খরচ করে কোনো রকম খেতাম। ভাতের সঙ্গে ফ্রি পাওয়া হোটেলের ডাল, সঙ্গে দু-একটা পেঁয়াজু—এটিই ছিল প্রতিদিনের মেনু। অর্থসংকটে কাপড়ও কিনতে পারিনি। ছেঁড়া কাপড় নিয়েই বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়গুলোকে মনে করে এসব কথা বলছিলেন মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। সম্প্রতি ১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে (বিজেএস) সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। গত সোমবার তিনি এ পদে যোগদান করেন। আনোয়ারা উপজেলার বরুমচড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের চাঁদুয়াপাড়া এলাকায় আবদুর রহমান ছেলে তিনি। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনিই সবার ছোট।
দেলোয়ারের বাবা আবদুর রহিম স্থানীয় একটি ভূমি অফিসের কর্মচারী ছিলেন। বড় সংসার আর বাবার স্বল্প আয়ের কারণে পরিবারে সব সময় অনটন লেগেই থাকত। অভাবের মধ্যেই বেড়ে উঠেছেন দেলোয়ার হোসেন। তবে দমে যাননি। অভাব মোচনে ছাত্র অবস্থায় করেছেন একাধিক টিউশনি।
দেলোয়ার হোসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০১৭ সালে ওই বিভাগ থেকে স্নাতক ও ২০১৮ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ছেঁড়া শার্ট থেকে কালো রঙের গাউন-কোট পরার এ যাত্রা কখনোই সহজ ছিল না তাঁর। পরপর তিনবার বিজেএসের মৌখিক পরীক্ষা দিয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। পরে চতুর্থবারে তিনি সফল হন।
‘অনুপ্রেরণা এসেছিল বাবার থেকে’
দেলোয়ারের বাবা ২০০১ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন। তবে প্রায়ই তাঁকে আদালতে যেতে হতো। অনেক সময় সঙ্গে দেলোয়ারকেও নিয়ে যেতেন তিনি। ২০১১ সালে দেলোয়ার যখন উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন তাঁর বাবার সঙ্গে আদালতে যান। সেদিন সুশৃঙ্খল ও গম্ভীর পরিবেশে আদালতের বিচারকাজ চলছিল। এজলাসে থাকা বিচারককে দেখিয়ে বাবা দেলোয়ারকে বলেছিলেন, ‘দেখিস, বিচারক হতে পারিস কি না!’
২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হই। এর মধ্যে বাবা মারা যান। তখন অনেক ভেঙে পড়ি। তবে মাথায় ছিল বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে। এরপর আবার চেষ্টা করে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে আইন বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাই। মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনবাবার সেই কথা আজও মনে পড়ে দেলোয়ারের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই দিন এ কথা শোনার পর বাবার স্বপ্ন পূরণে আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তির জন্য প্রস্তুতিও শুরু করি। তবে প্রথমবার সফল হতে পারিনি। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হই। এর মধ্যে বাবা মারা যান। তখন অনেক ভেঙে পড়ি। তবে মাথায় ছিল, বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে। এরপর আবার চেষ্টা করে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে আইন বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাই।’
জীবনের মোড় ঘোরানো বিকেল
সময়টা ছিল ২০০৪ সাল। দেলোয়ার হোসেন তখন বরুমচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। একদিন বিকেলে টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজেই গরুর জন্য ঘাস কেটে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। এর মধ্যেই দেখা হয় ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপক চৌধুরীর সঙ্গে। এর পরের দিন দেলোয়ারের বাবাকে ডেকে পাঠান দীপক চৌধুরী। দীপক চৌধুরী অনুরোধ করেন, দেলোয়ারকে যেন আপাতত খুব বেশি কাজ করতে দেওয়া না হয়। কারণ, সামনে প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষা। পরীক্ষার পড়াশোনায় যাতে দেলোয়ার বেশি মনোযোগী হয়।
দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত আমি নিজের ইচ্ছাতেই ঘাস কাটতাম। তবে ওই দিনের এ ঘটনা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ওই দিনের পর বাবা আমাকে কোনো কাজ করতে দিতেন না। তিনি দীপক স্যারের কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। ওই বছরের বৃত্তি পরীক্ষায় আমি পাসও করেছিলাম। আমার পড়াশোনার ভিত দীপক স্যারই গড়ে দিয়েছিলেন।’
অনটনের মধ্যেও যেভাবে পথচলা
ছেঁড়া শার্ট ও জীর্ণ প্যান্টে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটলে চড়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন দেলোয়ার হোসেন। অনটনের মধ্যেই প্রস্তুতি নেওয়ার পর যখন তিনি আইন বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন, সেদিনই বাবার হাসিমুখ স্মৃতিতে ভেসে উঠেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি ও এলএলএম পড়ার পুরো সময়ই ছিল লড়াইয়ের। বাবার অনুপস্থিতিতে সংসারের খরচ জোগাতে প্রতিদিন টিউশনি করতে হতো দেলোয়ার হোসেনকে। তবে এত কিছুর মধ্যেই পরিবার থেকে বিভিন্ন আশ্বাস পেতেন। মা ও ভাইবোনেরা টাকার চিন্তা না করে জজ হতেই হবে—এমন উৎসাহ দিতেন। পরিবারের এ মনোবলই তাঁকে সামনের দিকে নিয়ে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পাস করার পর ২০১৯ সালে ১৩তম বিজেএস দেওয়ার সুযোগ পান। তবে সেবার সফল হননি। এরপর ১৪, ১৫, ১৬তম—প্রতিবারই মৌখিক পরীক্ষা থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। এরপরও তিনি মনোবল হারাননি।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর তাঁর বন্ধুরা তাঁকে শক্তি জুগিয়েছেন। তাঁরা টাকাপয়সার দুশ্চিন্তা না করে চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলতেন। সেই অকৃত্রিম ভালোবাসা তাঁকে নতুন সাহস দেয়। টিউশনি কমিয়ে পূর্ণ মনোযোগ দেন ১৭তম বিজেএসের প্রস্তুতিতে।
অবশেষে ২০২৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কাঙ্ক্ষিত দিন আসে দেলোয়ারের। ফলাফলের তালিকায় নিজের নাম দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। চোখের সামনে বারবার বাবার মুখ ভাসছিল সেদিন। দেলোয়ার বলেন, ‘এই যাত্রায় পরিবার, বড় ভাই, বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে শক্তি দিয়েছে। তাদের প্রতি আমি চিরঋণী।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ক ষ বর ষ আইন ব ভ গ ভর ত র ব চ রক পর ক ষ ব জ এস পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দিয়ে গর্ববোধ করার কথা জানালেন রেজা কিবরিয়া
রেজা কিবরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দিলেন। আজ সোমবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দলটিতে যোগ দেন।
আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া। তিনি গণ অধিকার পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলেন। গত মাসের শুরুর দিকে তাঁর বিএনপিতে যোগ দেওয়ার খবর সামনে আসে। এখন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দিলেন।
বিএনপিতে যোগ দিতে পেরে গর্ববোধ করার কথা জানান রেজা কিবরিয়া। তিনি বলেন, বিএনপি দুবার ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের হাত থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছে। একবার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান করেছিলেন, আরেকবার খালেদা জিয়া। এটা বিএনপির একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা। এমন উদাহরণ অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না। এসব কারণে তিনি বিএনপির প্রতি আকৃষ্ট হন। জিয়াউর রহমানকে তাঁর আদর্শ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
রেজা কিবরিয়া বলেন, বিএনপির নেতৃত্ব দেশের নতুন প্রজন্মের সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে। বিএনপির আগের ভিশন নেই, অনেক কিছু বদলে গেছে।
অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তাঁরা অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত যে, রেজা কিবরিয়া আজ তাঁদের মাঝে এসে তাঁদের দলে যোগ দিয়েছেন। তিনি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে রেজা কিবরিয়াকে তাঁদের দলে স্বাগত জানাচ্ছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য মেধাবী নেতৃত্ব ও প্রতিভাবান মানুষ প্রয়োজন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রেজা কিবরিয়ার বিএনপির পতাকাতলে আসাকে তাঁর দল স্বাগত জানাচ্ছে। অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
রেজা কিবরিয়া হবিগঞ্জ-১ আসন থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে চান। আগামী সংসদ নির্বাচনে জন্য গত মাসের শুরুতে বিএনপি যে ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে, সেখানে হবিগঞ্জ-১ আসনটি ফাঁকা রাখা হয়।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রেজা কিবরিয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে একই আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন। এর আগে তিনি গণফোরামে যোগ দেন। পরে দলটির সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর রেজা কিবরিয়াকে কেন্দ্র করে দলটি দুইভাগে বিভক্ত হয়। পরে তিনি ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদ গঠন করেন। তিনি দলটির প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক হন। সেখানেও তাঁকে কেন্দ্র করে দলটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এরপর তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। এবার তিনি বিএনপিতে যোগ দিলেন।
আরও পড়ুনবিএনপিতে যোগ দিয়েছেন রেজা কিবরিয়া০৫ নভেম্বর ২০২৫