গাজার ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে’ আসলে কী ঘটছে
Published: 3rd, December 2025 GMT
গাজায় সর্বশেষ যুদ্ধবিরতির দেড় মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক খাদ্য, ওষুধ, তাঁবু, জ্বালানি এবং অন্যান্য জরুরি পণ্য নিয়ে গাজায় প্রবেশ করার কথা ছিল। আমরা এখন সরকারি বিবৃতিতে প্রতিদিন শত শত ট্রাক ঢোকার কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ইসরায়েলের পক্ষে ছবি প্রকাশ করা হয়, সীমান্ত পারাপার নথিভুক্ত করা হয়, আর উৎসবের মতো করে জানানো হয় ত্রাণ বিষয়ে ঘোষণাগুলো।
ইসরায়েলি দখলদার কর্তৃপক্ষ ২৬ নভেম্বরের এক হালনাগাদে দাবি করেছে, ‘যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে ৪ হাজার ২০০ ট্রাক মানবিক সহায়তা নিয়ে গাজায় প্রবেশ করছে। এসব ট্রাকের ৭০ শতাংশ খাদ্য বহন করেছে… যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে ১৬ হাজার ৬০০টিরও বেশি খাদ্যবাহী ট্রাক গাজায় ঢুকেছে। ৩ লাখ ৭০ হাজার টনের বেশি খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে।’
আরও পড়ুনগাজায় যেভাবে ইসরায়েলের পরাজয় আর ফিলিস্তিনের পুনর্জন্ম হলো১৫ অক্টোবর ২০২৫এই বিবৃতি শুনলে মনে হতে পারে, গাজার ফিলিস্তিনিরা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো খাদ্যসুবিধা পাচ্ছে।
আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়, ইসরায়েল ঠিক কীভাবে ‘খাদ্যবাহী ট্রাক’ গুনছে। কারণ, বাস্তবে অনেক বাণিজ্যিক ট্রাক ঢুকলেও তাতে থাকে কম পুষ্টিগুণের খাবার।
মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোও এসব সরকারি হিসাব সন্দেহের চোখে দেখছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মতে, গাজায় প্রয়োজনীয় খাদ্যসহায়তার মাত্র অর্ধেক প্রবেশ করতে পারছে। ফিলিস্তিনি ত্রাণ সংস্থাগুলোর মতে, প্রয়োজনীয় সহায়তার মাত্র এক-চতুর্থাংশ ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে সেই সামান্য সহায়তারও অল্প অংশ পৌঁছায় বাস্তুচ্যুত, দরিদ্র, আহত এবং ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে। কারণ, গাজায় ঢুকতে সক্ষম হওয়া সহায়তার বড় অংশই যেন একধরনের ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’-এ হারিয়ে যায়।
সহায়তার প্যাকেট যখন কোনোভাবে দরিদ্র মানুষের হাতে পৌঁছায়, তখনো এর ভেতরে প্রতিশ্রুত জিনিসগুলো অনেক সময় থাকে না। উদাহরণ হিসেবে, আমার পরিবার একটি খাদ্যসহায়তার প্যাকেট পেয়েছিল, যাতে চাল, ডাল এবং ছয় বোতল রান্নার তেল থাকার কথা ছিল। কিন্তু খুলে দেখি, চাল-ডাল নেই, আর ছয় বোতলের বদলে মাত্র তিন বোতল তেল আছে।মানচিত্রে সীমান্ত থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষের শিবির পর্যন্ত দূরত্ব ছোট দেখালেও, বাস্তবে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত কারণে এটাই সবচেয়ে দীর্ঘ পথ।
হ্যাঁ, অনেক ট্রাক সীমান্ত পেরোলেও সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পরিবারগুলোর কাছে কখনো পৌঁছায় না। মানুষ ট্রাক ঢোকার খবর শোনে, কিন্তু কোনো ত্রাণ প্যাকেজ দেখতে পায় না। তারা টন টন ময়দা আসার কথা শোনে, কিন্তু রুটির দেখা পায় না। তারা ভিডিওতে ট্রাককে গাজার ভেতর ঢুকতে দেখে, কিন্তু সেই ট্রাকগুলোকে কখনো তাদের শিবিরে বা এলাকায় আসে না। মনে হয় সহায়তাগুলো যেন গাজায় ঢুকে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি রাস্তায় এই ‘নিখোঁজ’ ত্রাণ নিয়ে আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে। বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে—মানুষের হাতে পৌঁছানোর আগেই কিছু মৌলিক খাদ্যসামগ্রী স্থানীয় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলোর গায়ে স্পষ্ট লেখা ‘মানবিক সহায়তা—বিক্রয়ের জন্য নয়’। আমি নিজে দেখেছি, মানবিক সহায়তার লেবেলযুক্ত মুরগির ক্যান ১৫ ডলার করে বিক্রি হচ্ছে।
সহায়তার প্যাকেট যখন কোনোভাবে দরিদ্র মানুষের হাতে পৌঁছায়, তখনো এর ভেতরে প্রতিশ্রুত জিনিসগুলো অনেক সময় থাকে না। উদাহরণ হিসেবে, আমার পরিবার একটি খাদ্যসহায়তার প্যাকেট পেয়েছিল, যাতে চাল, ডাল এবং ছয় বোতল রান্নার তেল থাকার কথা ছিল। কিন্তু খুলে দেখি, চাল-ডাল নেই, আর ছয় বোতলের বদলে মাত্র তিন বোতল তেল আছে।
আরও পড়ুনগাজায় না খাইয়ে মানুষ মারা ও আমাদের বৈশ্বিক লজ্জা১৭ আগস্ট ২০২৫এটি শুধু দুর্নীতি নয়। দুই বছরের গণহত্যামূলক যুদ্ধের ফলে গাজার প্রশাসন কার্যত ভেঙে পড়েছে। প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। এখন সেখানে কোনো ঐক্যবদ্ধ কর্তৃপক্ষ নেই, নেই এমন কোনো শক্তি যা জননিরাপত্তা বা শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারে।
জাতিসংঘের ত্রাণ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯ মে থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত গাজার ভেতরে ৮ হাজার ৩৫টি ত্রাণবাহী ট্রাক তাদের গন্তব্যে পৌঁছায়। আর ৭ হাজার ১২৭টি ট্রাককে ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ বা ‘জোরপূর্বক’ আটকানো বা বাধাগ্রস্ত করা হয়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ট্রাকগুলো কোনো রাস্তা দিয়ে যাবে তা কঠোরভাবে নির্ধারণ করে, এবং অনেক সময় তাদের এমন রুট নিতে বাধ্য করে, যা বিপদে ভরা। কিছু রাস্তা শক্তিশালী স্থানীয় পরিবার অথবা পাড়া–কমিটির সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া ব্যবহার করা যায় না, কিছু রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করে সশস্ত্র গোষ্ঠী। এসব কারণে কয়েক কিলোমিটারের পথও অত্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে ওঠে।
এভাবেই ত্রাণ গাজার সেই ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’-এ হারিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। বিপদের কারণে ট্রাকগুলোর তারা সঙ্গে থাকতে পারে না, মাল খালাসের সময় তদারকি করতে পারে না। এ ছাড়া প্রতিটি চালান নজরদারি করার মতো পর্যাপ্ত কর্মীও নেই। স্থানীয় কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তারা এমন এক ব্যবস্থার ওপর ভর করে আছে, যেখানে বিদ্যমান অসংখ্য ফাঁকফোকর বিভিন্ন পক্ষ খুব দ্রুত নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায়।
এসবের মধ্যেও একটি বড় প্রশ্ন রয়ে যায়: এই সহায়তা নিখোঁজ হওয়ার ফলে প্রকৃত লাভবান হচ্ছে কারা?
এই তালিকায় দ্রুত লাভের আশায় থাকা ব্যবসায়ীরা আছে। আছে স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা অর্থের উৎস খুঁজছে। আর আছে স্বয়ং দখলদার শক্তি ও তাদের মিত্ররা, যারা রাজনৈতিক চাপ তৈরির হাতিয়ার হিসেবে ক্ষুধাকে ব্যবহার করতে চায়। সবাই মিলে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের যন্ত্রণাকেই পুঁজি করে লাভ তুলছে।
সমস্যা হচ্ছে, যুদ্ধবিরতির পর থেকে গাজায় যা ঘটছে তার প্রতি বৈশ্বিক মনোযোগ অনেক কমে গেছে। বিশ্বের মানুষ মনে করছে গণহত্যা শেষ হয়েছে, তাই আর জিজ্ঞেস করছে না—কেন সহায়তা ফিলিস্তিনিদের হাতে পৌঁছাচ্ছে না।
এদিকে নীতি ও রাজনৈতিক মহলেও ত্রাণ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা শুরু হয়েছে। যেন এটিই সংঘাতের স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু এ তো একটি পরিকল্পিত সংকট, যা ফিলিস্তিনিদের ওপর আরেক ধরনের সম্মিলিত শাস্তি হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব যখন আবারও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তখন শুধু ট্রাক নয়, গাজার সেই ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’-এ হারিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের এগিয়ে চলার শক্তিও।
আমাল আবু সেইফ, ফিলিস্তিনি লেখক ও গবেষক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র ভ তর পর ব র জন ত ক
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের রেকর্ড ২০৬ ছক্কার বছরে কে মারলেন কতটি
নিজেদের ছক্কার রেকর্ড বাংলাদেশ ভেঙেছে অনেক আগেই। কাল আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে বছরের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ নিজেদের রেকর্ডটাকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গেল। প্রথমবারের মতো এক পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশ মেরেছে ২০০ বা এর চেয়ে বেশি ছক্কা।
বাংলাদেশের আগের সর্বোচ্চ ছিল ১২২টি, মেরেছিল ২০২৪ সালে। এবার ২০৬টি ছক্কা এসেছে তানজিদ হাসান, লিটন দাসদের ব্যাট থেকে। ছক্কায় রেকর্ড গড়া বছরে বাংলাদেশের কার ব্যাট থেকে কতটি ছক্কা এল?
চলতি বছর টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে ১৮ জন ব্যাটসম্যান ছক্কা মেরেছেন। এর মধ্য টপ অর্ডারে খেলা চার ব্যাটসম্যান তানজিদ, লিটন, পারভেজ ও সাইফের ব্যাট থেকে এসেছে ১২৭টি ছক্কা।
এই তালিকায় সবচেয়ে বড় অবদান ওপেনার তানজিদ হাসানের। ৪১টি ছক্কা মেরেছেন এই ওপেনার, যা এক বছরে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছক্কা এসেছে আরেক ওপেনার পারভেজ হোসেনের ব্যাট থেকে, ৩৪টি।
সাইফ ১৫ ম্যাচে মেরেছেন ২৯টি ছক্কা, ২৩টি মেরেছেন লিটন। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান জাকের আলীর ব্যাট থেকে এসেছে ২৩ ইনিংসে ১৯টি ছক্কা। এরা ছাড়া ১০টির বেশি ছক্কা মেরেছেন শুধু তাওহিদ হৃদয়। এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ছক্কা মেরেছেন ১৪টি।
শামীম হোসেন ৯টি। ছক্কা মারার সংখ্যায় গত বছরের তুলনায় তানজিদ, লিটন, পারভেজদের উন্নতি হলেও হৃদয় ও জাকের এবার খারাপ করেছেন। গত বছর হৃদয় ও জাকের দুজনই ২১টি করে ছক্কা মেরেছিলেন।
আরও পড়ুনবিপিএল নিলাম নিয়ে লিটন, ‘স্রষ্টা মনে করেছেন ৭০ লাখ টাকা যথেষ্ট’১৩ ঘণ্টা আগেএ বছরে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ মোট রান তুলেছে ৪২২৯ (অতিরিক্ত বাদে)। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ রানই এসেছে ছক্কা থেকে। চলতি বছর নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি চারও মেরেছে বাংলাদেশ, ২৯৮টি।
২০২৫ সালে ছক্কায় বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচচলতি বছরে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মেরেছে অস্ট্রিয়া। ২৮ ম্যাচে দলটি ৩২৬টি ছক্কা মেরেছে। তালিকার ২ নম্বরে আছে পাকিস্তান, ৩৪ ম্যাচে পাকিস্তান ২৩৫টি ছক্কা মেরেছে। টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসাব করলে পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ ছক্কা মেরেছে বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন৫ ক্যাচ নিয়ে বিশ্ব রেকর্ডে তানজিদ১৫ ঘণ্টা আগে