জীবন এক অপূর্ব আয়না। যা আমরা করি, তাই ফিরে আসে আমাদের কাছে—ভালো হোক বা মন্দ। ইসলামি শিক্ষায় এই নীতিকে বলা হয় ‘আল-জাযাউ মিন জিনসিল আমল’, অর্থাৎ প্রতিদান কর্মের ধরনের সঙ্গে মিলে যায়। এটি শুধু একটি ধর্মীয় ধারণা নয়, বরং জীবনের গভীর সত্য।

মানুষ যেভাবে অন্যের সঙ্গে আচরণ করে, ঠিক সেভাবেই তার প্রতিদান পায়—এই দুনিয়াতে এবং আখেরাতেও। এই নীতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সুন্দর, ন্যায়সঙ্গত এবং আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ করে তোলে।

বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.

) এই বিষয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ভালো কাজের প্রতিদানও ভালো হয়, আর মন্দ কাজের প্রতিদান মন্দ।

মানুষ যেভাবে অন্যের সঙ্গে আচরণ করে, ঠিক সেভাবেই তার প্রতিদান পায়—এই দুনিয়াতে এবং আখেরাতেও। এই নীতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সুন্দর ও ন্যায়সঙ্গত করে তোলে।

যেমন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে গোপন রাখে বা তার দোষত্রুটি ঢেকে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে ঢেকে রাখেন। যে অসচ্ছল ব্যক্তির জন্য সহজ করে, আল্লাহ তার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে সহজ করেন। যে মুমিনের দুঃখ-কষ্ট দূর করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার একটি কষ্ট দূর করেন।

আরও উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, যে অনুতপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করে বা তার ভুল সংশোধনের সুযোগ দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার ভুল মাফ করেন। কিন্তু যে ভাইয়ের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন।

আরও পড়ুনভালো মুসলিম হওয়ার ১০ উপায়১০ আগস্ট ২০২৫

যে মুসলিমকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাকে কষ্ট দেন। যে ব্যক্তি কারো জন্য কঠিন করে, আল্লাহ তার জন্য কঠিন করেন। যে সাহায্যের সময় সাহায্যকারীকে ছেড়ে দেয়, আল্লাহ সাহায্যের সময় তাকে ছেড়ে দেন।

এই নীতি আল্লাহর শরিয়ত, তার তাকদির এবং তার প্রতিদান-শাস্তির ভিত্তি। এটি সাদৃশ্যের নিয়ম—একই ধরনের সঙ্গে একই ধরন মিলিয়ে দেওয়া। (ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওযিয়া, ই’লাম আল-মুয়াক্কিয়িন আন রাব্বিল আলামিন, ১/১২৩-১২৫, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯১)

এই সাদৃশ্যের সৌন্দর্য দেখুন আল্লাহর রহমতে। তিনি প্রতিদানকে কর্মের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন, যাতে মানুষ ন্যায়ের স্বাদ পায়। ভালো কাজের প্রতিদান ভালোই। কোরআন মাজিদে আল্লাহ বলেন, ‘ভালো কাজের প্রতিদান কি ভালো ছাড়া আর কিছু হতে পারে?’ (সুরা রাহমান, আয়াত: ৬০)

যে সুন্দর কাজ করে, আল্লাহ তার প্রতিদান আরও সুন্দর করেন। আরেক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সব আল্লাহর। যারা মন্দ কাজ করে তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে, আর যারা ভালো কাজ করে তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেওয়া হবে।’ (সুরা নাজম, আয়াত: ৩১)

ভালো কাজের প্রতিদান কি ভালো ছাড়া আর কিছু হতে পারে?কোরআন, সুরা রাহমান, আয়াত: ৬০

যারা ভালো করে, তাদের প্রতিদান ‘হুসনা’ বা সর্বোত্তম। আর যারা মন্দ করে, তাদের পরিণতি মন্দ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা মন্দ কাজ করে তাদের পরিণতি মন্দ হয়।’ (সুরা রুম, আয়াত: ১০)

এই সাদৃশ্য এতটাই নিখুঁত যে, ভালো কাজকারীদের প্রতিদান শুধু ভালো নয়, তার চেয়ে বেশি। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে হুসনা এবং তার চেয়ে অতিরিক্ত।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ২৬)

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হুসনা’ হলো জান্নাত, আর ‘অতিরিক্ত’ হলো আল্লাহর দিদার লাভ। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৮৪)

যারা দুনিয়ায় আল্লাহকে যেন দেখছেন এমনভাবে ইবাদত করেন, তাদের প্রতিদান আখেরাতে তাঁকে সরাসরি দেখা। এই সাদৃশ্য কত সুন্দর! ইহসান বা সর্বোত্তম কাজের সঙ্গে মিলে যায় সর্বোত্তম দর্শন।

আরও পড়ুনভালো প্রতিবেশী হওয়ার ১০ উপায়০৫ জুন ২০২৫

উল্টোদিকে, যারা আল্লাহর ভয় থেকে দূরে থাকে, তাদের হৃদয় সিলমোহর করা হয়। দুনিয়ায় তাঁকে দেখার বা অনুভব করার সুযোগ হারায়, আখেরাতে তাদের থেকে আল্লাহর দিদার হারাম করা হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘না, তারা সেদিন তাদের রব থেকে পর্দা করা থাকবে।’ (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত: ১৫)

এটি মন্দ কাজের সঙ্গে মিলে যাওয়া শাস্তি।

ইসলামে ইহসানের মর্যাদা অপরিসীম। আল্লাহ কোরআনে বারবার এর প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘ভালো করো, নিশ্চয় আল্লাহ ভালোকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৫)

আরেক জায়গায়, ‘আল্লাহ ভালোকারীদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৬৯)

এই ভালোবাসা এবং সাহচর্যই সর্বোচ্চ সম্মান।

দয়ালুদের প্রতি রহমান দয়া করেন। তোমরা যমিনের লোকদের প্রতি দয়া করো, আসমানের মালিক তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৯২৪

এই নীতি আমাদের জীবনকে শেখায় সহানুভূতি, ক্ষমা এবং উদারতা। যে দয়া করে, তার প্রতি দয়া করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দয়ালুদের প্রতি রহমান দয়া করেন। তোমরা যমিনের লোকদের প্রতি দয়া করো, আসমানের মালিক তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৯২৪)

যে খরচ করে, তার জন্য খরচ করা হয়। যে কৃপণতা করে, তার প্রতি কৃপণতা করা হয়।

জীবনে এই নিয়ম প্রয়োগ করলে সমাজ হয়ে ওঠে সুন্দর। একজন প্রতিবেশীকে সাহায্য করলে, সাহায্য ফিরে আসে। একজনকে ক্ষমা করলে, নিজের ভুল মাফ হয়। এটি শুধু ধর্মীয় নয়, মানবিক সত্য। দুনিয়ায় ছোট ছোট কাজের প্রতিফল দেখা যায়, আখেরাতে পূর্ণতা পায়।

এই শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি কাজ গণনা করা হয়। ভালো করলে ভালো পাব, মন্দ করলে সতর্ক হই। আল্লাহর রহমতে এই সাদৃশ্য আমাদের পথ দেখায় সঠিক জীবনের দিকে। চলুন, আমরা ইহসানের পথে চলি, যাতে প্রতিদান হয় সর্বোত্তম।

আরও পড়ুনমা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার কয়েকটি আয়াত ও হাদিস১৪ জুলাই ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আল ল হ ত র এই স দ শ য ত র জন য মন দ ক জ ক জ কর আম দ র এই ন ত স ন দর ক রআন ন আরও

এছাড়াও পড়ুন:

আইনি ব্যবস্থা নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে পারছে না

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নানা আইনি ব্যবস্থা থাকলেও তা কার্যত নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে খুব বেশি কাজে আসছে না। নারীর প্রতি সহিংসতার ধরন ও মাত্রা বর্তমানে বদলেছে। সহিংসতা প্রতিরোধে প্রতিবাদ করতে হবে, নিজেদের সচেতন হতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ-২০২৫ পালন শুরুর আগে গণমাধ্যমের নারী পাতার সম্পাদক এবং নারী বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আনোয়ারা বেগম মুনিরা খান মিলনায়তনে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।

সভাপতির বক্তব্যে মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘বর্তমানে নানা পশ্চাৎপদ অবস্থার মধ্যে মানুষের মধ্যে যে তার স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, এটি আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন। পরিবারে নারী-পুরুষের প্রতি পারিবারিক আচরণ পরিবর্তিত হবে, এটি স্বাভাবিক। তবে এই পরিবর্তন যেন মানুষকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।’

এ সময় পারিবারিক ও সামাজিক পরিবর্তনের দিকগুলো গণমাধ্যমকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার জন্য আহ্বান জানান মহিলা পরিষদের সভাপতি। তিনি বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আমাদের প্রতিবাদের রূপ ও ধরন বদলাবে। প্রতিবাদ করেই নারীর অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে হবে।’

সভায় স্বাগত বক্তব্যে মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন নীতিমালা গৃহীত হলেও বাস্তবে নারীর প্রতি সহিংসতা কমেছে, এমনটি বলা যাবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালনের একটি গুরুত্ব আছে।

মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এই নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালনকালে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে আমরা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে যে বার্তা দেব, যে কথাগুলো বলব এবং যে কর্মসূচিগুলো নেব ও বাস্তবায়ন করব, তা বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হবে। এর মধ্য দিয়ে আগামীর জন্য আবারও প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে। এবারের পক্ষের বিষয়বস্তু হচ্ছে সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধ করা।’

সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার ধরন ও মাত্রা বর্তমানে বদলেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে শক্তিশালী নারী আন্দোলন গড়ে তুলতে গণমাধ্যম সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সে জন্য গণমাধ্যমের সঙ্গে আজকের কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মহিলা পরিষদের প্রচার ও গণমাধ্যম সম্পাদক মাহফুজা জেসমিন। তিনি বলেন, দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নানা আইনি ব্যবস্থা থাকলেও তা কার্যত নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে খুব বেশি কাজে আসছে না। এ পর্যায়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা গণমাধ্যমই পারে অন্যায়ের প্রতিকারে সত্যকে সামনে নিয়ে আসতে।

সভায় মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন দৈনিক সংবাদের নাসরিন গীতি, আমার দেশ পত্রিকার এমরানা আহমেদ, উইমেন আই ২৪ ডটকমের রীতা ভৌমিক, আজকের পত্রিকার অর্চি হক, দৈনিক ইত্তেফাকের রাবেয়া বেবী, দেশ রূপান্তর পত্রিকার তাপসী রাবেয়া, মহিলা পরিষদের প্রচার ও গণমাধ্যম উপপরিষদ সদস্য তাসকিনা ইয়াসমিন, খবরের কাগজের মারওয়া জান্নাত মাইশা ও দৈনিক ভোরের ডাকের আবদুর রহমান মল্লিক। সভা সঞ্চালনা করেন মহিলা পরিষদের প্রচার ও গণমাধ্যম উপপরিষদ সদস্য সেবিকা দেবনাথ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ