দৈনন্দিন জীবনে খাবার গ্রহণ করা একটি সাধারণ কাজ হলেও, ইসলাম একেও ইবাদতের স্তরে উন্নীত করেছে রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ বা আদর্শের মাধ্যমে। খাবার ও পানীয় গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁর দেখানো আদব কেবল আধ্যাত্মিক পবিত্রতা নয়, বরং স্বাস্থ্যগত এবং সামাজিক শালীনতাও নিশ্চিত করে।

পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহতে উল্লিখিত খাবার গ্রহণের এই শিষ্টাচারগুলো একজন মুমিনকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করে এবং সমাজে তার ব্যক্তিত্বকে মার্জিত করে তোলে।

ইসলামি আইনে নবীজির খাবার খাওয়া

আভিধানিক অর্থে সুন্নাহ অর্থ হল রীতি, পদ্ধতি বা জীবনধারা। প্রাথমিক যুগে এটি রাসুল (সা.

) পদ্ধতিকে বোঝাত। খাবার গ্রহণের আদবগুলো ইসলামি আইনবিদ বা ফকিহদের পরিভাষায় সাধারণত ‘সুন্নাহ’ বা ‘মোস্তাহাব’ হিসেবে গণ্য, যা পালন করলে সওয়াব হয় এবং না করলে গুনাহ হয় না, তবে তা নবীজির অনুসরণের মাধ্যমে জীবনকে উন্নত করে।

নবীজির আহার ও পানীয় গ্রহণের নীতি

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওযি (রহ.) নবীজির খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের নীতি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর এই নীতিগুলো প্রমাণ করে যে, নবীজি কোনো ধরনের খাদ্যের প্রতি বাড়াবাড়ি বা অনীহা পোষণ করতেন না, বরং তিনি স্থানীয় সংস্কৃতি এবং স্বাস্থ্যগত বিবেচনাকে গুরুত্ব দিতেন। (যাদ আল-মা'আদ, ৪/২০১-২০৩, মুআসসাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত, ১৯৯৮)

আরও পড়ুননবীজি (সা.)-এর ‘পেটে পাথর বাঁধা’ হাদিসের ব্যাখ্যা কী২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

তিনি লিখেছেন:

স্থানীয় খাদ্যের প্রতি অনুরাগ: নবীজি তাঁর অঞ্চলের মানুষেরা যা খেতেন, তা-ই খেতেন। তিনি নিজেকে নির্দিষ্ট খাদ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন না।

খাবারের বৈচিত্র্য: তিনি একই ধরনের খাবারের ওপর নির্ভর করতেন না, বরং বিভিন্ন ধরনের খাবার গ্রহণ করতেন।

স্বাদের সমন্বয়: কোনো খাবারে যদি তীব্রতা থাকত, তবে তিনি তার বিপরীতধর্মী খাবার দিয়ে সেটি সংশোধন করে খেতেন। যেমন: তরতাজা খেজুরের উষ্ণতা তরমুজ দিয়ে প্রশমিত করতেন।

খাবারের দোষ না ধরা: তিনি কখনও কোনো খাবারের দোষ ধরতেন না। আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন, “নবীজি কখনও কোনো খাবারের দোষ ধরতেন না। যদি তাঁর রুচি হতো, তিনি তা খেতেন; আর যদি রুচি না হলে তা পরিত্যাগ করতেন এবং খেতেন না।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৪০৯)

পছন্দের খাবার: তিনি গোশত, মিষ্টিদ্রব্য ও মধু পছন্দ করতেন।

আনুষঙ্গিক দিয়ে রুটি: তিনি রুটি কোনো আনুষঙ্গিক খাবার (ইদাম) পেলেই খেতেন।

পছন্দের পানীয়: তাঁর কাছে ঠান্ডা মিষ্টি পানীয় প্রিয় ছিল। এর অর্থ হতে পারে পরিষ্কার সুস্বাদু পানি, অথবা মধু মিশ্রিত পানি, অথবা খেজুর বা কিশমিশ ভেজানো পানি।

পাত্র ঢেকে রাখা: তিনি রাতের বেলা পাত্র ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, এমনকি একটি কাঠি দিয়ে হলেও পাত্রের উপর আড়াল দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

খাবার গ্রহণের অপরিহার্য শিষ্টাচারসমূহ

ইসলামি সুন্নাহ অনুযায়ী আহারের শিষ্টাচারগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে সংক্ষেপে তুলে ধরা যায়:

প্রস্তুতি ও শুরু

খাবারের আগে হাত ধোয়া: রোগ সৃষ্টিকারী ময়লা ও জীবাণু থেকে হাত পরিষ্কার করতে খাবারের আগে হাত ধোয়া মোস্তাহাব। এটি স্বাস্থ্যবিধির অন্যতম অংশ।

বিসমিল্লাহ বলা: খাবার শুরুর আগে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা ওয়াজিব বা সুন্নাহ। রাসুল (সা.) বলেছেন, “যদি তোমাদের কেউ খাবারের শুরুতে আল্লাহর নাম বলতে ভুলে যায়, তাহলে যখন তার মনে পড়বে, তখন সে যেন বলে: বিসমিল্লাহি ফি আওওয়ালিহি ওয়া আখিরিহি (এর শুরু ও শেষে আল্লাহর নামে)।” (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৩৭৬৭)

খাওয়ার পদ্ধতি

ডান হাত ব্যবহার: কোনো ওজর বা অপারগতা না থাকলে ডান হাত দিয়ে খাওয়া সুন্নাহ। চামচ বা এ জাতীয় কিছু ব্যবহার করাও জায়েয, তবে আঙ্গুল দিয়েও খাওয়া যেতে পারে।

নিজের দিক থেকে খাওয়া: অন্যদের দিকে হাত না বাড়িয়ে বা থালার মাঝখান থেকে না নিয়ে নিজের সামনের অংশ থেকে খাওয়া উচিত।

আরও পড়ুনযে ৪টি পরীক্ষা নবীজি (সা.)–এর জীবনকে দৃঢ়তা দিয়েছে২২ জুলাই ২০২৫

উমর ইবনে আবি সালামাহ (রা.) বলেন, “আমি নবীজির তত্ত্বাবধানে থাকা এক বালক ছিলাম। খাবারের পাত্রে আমার হাত ঘোরাঘুরি করত। আল্লাহর রাসুল আমাকে বললেন, ‘হে বালক, আল্লাহর নাম নাও, ডান হাত দিয়ে খাও এবং তোমার সামনের দিক থেকে খাও।’ এরপর থেকে এটিই আমার খাবারের রীতি ছিল।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৩৭৬)

হেলান দিয়ে না খাওয়া: হেলান দিয়ে বা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে খাওয়া মাকরুহ (অপছন্দনীয়)। নবীজি বলেছেন, “আমি হেলান দিয়ে খাই না।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৩৯৮)

খাদ্যের মর্যাদা ও পরিমিতিবোধ

পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়া: যদি কোনো খাবার বা লোকমা পড়ে যায়, তবে তার থেকে ময়লা সরিয়ে তা খেয়ে নেওয়া উচিত এবং শয়তানের জন্য ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।

আনাস (রা.) বলেন, “নবীজি যখন খাবার খেতেন, তখন তিনি তাঁর তিন আঙ্গুল চেটে নিতেন এবং বলতেন, ‘তোমাদের কারও লোকমা যদি পড়ে যায়, তবে সে যেন তা থেকে ময়লা সরিয়ে খেয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য ছেড়ে না দেয়।’” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২০৩৪)

গরম খাবার না খাওয়া: খাবার কিছুটা ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। তিনি বলেছেন, “খাবার ততক্ষণ খাওয়া উচিত নয় যতক্ষণ না তার বাষ্প দূর হয়।” (সুনান বায়হাকি, হাদিস: ১৪৮৫৬)

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: খাওয়ার সময় ঢেকুর তোলা, থুথু ফেলা বা নাক ঝাড়া ইত্যাদি বা অন্যদের কাছে অপ্রীতিকর কাজ করা মাকরুহ।

পরিমিত আহার: অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকা সুন্নাহ।

খাবারের সমাপ্তি ও বিদায়

খাবার শেষে বিদায়: মেহমানের উচিত, খাবার শেষ হওয়ার পর প্রয়োজন না থাকলে বেশি সময় ধরে মেজবানের কাছে বসে না থেকে অনুমতি নিয়ে চলে যাওয়া।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “অতএব যখন তোমরা খানা খেয়ে নেবে, তখন চলে যেয়ো।” (সুরা আহজাব, আয়াত: ৫৩)

খাবার শেষে দোয়া: খাবার শেষ হলে আল্লাহর প্রশংসা করা ও দোয়া পাঠ করা সুন্নাহ।

যেমন: “আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আতআমানা ওয়া সাকানা ওয়া জাআলানা মিনাল মুসলিমিন” (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের আহার করিয়েছেন, পান করিয়েছেন এবং মুসলিম বানিয়েছেন)।

হাত ধোয়া ও কুলকুচি: খাবার শেষে হাত ধোয়া এবং কুলি করা সুন্নাহ।

এই শিষ্টাচারগুলো অনুসরণ করে একজন মুমিন খাবার গ্রহণকে সওয়াবের কাজে পরিণত করতে পারে।

আরও পড়ুননবী হওয়ার আগে নবীজি (সা.) কি ‘পথহারা’ ছিলেন৬ ঘণ্টা আগে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খ ব র গ রহণ গ রহণ র আল ল হ নব জ র ইসল ম করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

১২ বছরে ৩০ প্রচেষ্টার পর অস্ট্রেলিয়ায় সেঞ্চুরি পেলেন রুট

অবশেষে জো রুটের লম্বা সময়ের অপেক্ষার অবসান হলো। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ১২ বছরের দীর্ঘ ‘সেঞ্চুরি খরা’ ভেঙে প্রথমবারের মতো তিন অঙ্কে পা রাখলেন। আজ বৃহস্পতিবার (০৪ ডিসেম্বর) বিকেলে গাব্বায় দিবা-রাত্রির টেস্টে ১৮১ বল খেলে পেলেন ক্যারিয়ারের বহু প্রতীক্ষিত মাইলফলক। যা তার টেস্ট ক্যারিয়ারের ৪০তম এবং আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ৪৯তম সেঞ্চুরি। এমন গুরুত্বপূর্ণ সেঞ্চুরি পেতে তাকে দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন সতীর্থ জ্যাক ক্রলি। যার সঙ্গে রুট গড়েছেন ১১৭ রানের গুরুত্বপূর্ণ জুটি।

পাঁচ ম্যাচের অ্যাশেজের এই সিরিজে রুটের ওপর ছিল অজস্র চাপ। গত কয়েক বছর ধরে দুর্দান্ত ধারাবাহিকতায় রেকর্ডের পর রেকর্ড ভাঙছেন তিনি। আধুনিক যুগের অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটার হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় সেঞ্চুরি! তা যেন ভাগ্য এড়িয়ে চলছিল। ১৬টি টেস্ট খেলে একবারও তিন অঙ্কে না পৌঁছানো, রুটের মতো মানের ব্যাটারের জন্য ছিল কিছুটা হতাশাজনকও।

আরো পড়ুন:

ওয়াসিম আকরামের রেকর্ড ভেঙে শীর্ষে স্টার্ক

আফ্রিদিকে পেছনে ফেলে ছক্কার বিশ্বরেকর্ড গড়লেন রোহিত

এমনকি কিংবদন্তি অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার ম্যাথিউ হেইডেন পর্যন্ত ঘোষণা দিয়েছিলেন- এই অ্যাশেজেও রুট যদি সেঞ্চুরি করতে না পারেন, তবে তিনি নাকি এমসিজিতে নগ্ন হয়ে হাঁটবেন! অবশেষে সেই অস্বস্তিকর আলোচনা ও বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটলো। কারণ রুট অস্ট্রেলিয়ায় পেলেন তার প্রথম টেস্ট শতক, আর হেইডেনও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছেন।

আগে ব্যাট করতে নেমে ৫ রানেই ২ উইকেট হারিয়ে বসে ইংল্যান্ড। সেই অবস্থায় ব্যাটিংয়ে নামতে হয়েছিল ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ককে। মিচেল স্টার্ক আবারও দুর্দান্ত শুরুর আঘাত হেনে ফেরান বেন ডাকেট ও অলি পোপকে শূন্য রানে। সেখান থেকে ক্রলিকে সঙ্গে নিয়ে ১১৭ রানের জুটি গড়ে দলকে খেলায় ফেরান রুট। ক্রলি যখন ৭৬ রানে আউট হয়ে যান, তারপরও রুট হ্যারি ব্রুক ও বেন স্টোকসকে সঙ্গে নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখেন এবং একাই হয়ে ওঠেন ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ের স্তম্ভ।

বিভিন্ন দেশে জো রুটের সেঞ্চুরি সংখ্যা:
ইংল্যান্ড – ২৪টি
ওয়েস্ট ইন্ডিজ - ৪টি
ভারত – ৩টি
নিউ জিল্যান্ড – ৩টি।
শ্রীলঙ্কা – ৩টি।
দক্ষিণ আফ্রিকা – ১টি
পাকিস্তান – ১টি
অস্ট্রেলিয়া – ১।

অবশেষে, রুটের নামের পাশে যুক্ত হলো অস্ট্রেলিয়াতেও এক সেঞ্চুরি। আর সেই সঙ্গে ইতিহাসে আরেকটি রেকর্ডও। ১২ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে যে মাইলফলক তিনি স্পর্শ করলেন, তা নিঃসন্দেহে তার টেস্ট ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিশেষ অধ্যায়ের একটি হয়ে থাকবে।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ