Prothomalo:
2025-12-04@10:23:43 GMT

গুমাই বিলে ধানের ঘ্রাণ

Published: 4th, December 2025 GMT

হেমন্তের দুপুরটা ছিল শান্ত। হালকা বাতাসে দুলছিল পাকা ধান। দূরে শোনা যাচ্ছিল কাস্তে চালানোর শব্দ। সম্প্রতি রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলে ঢুকতেই মনে হলো, যেন কেউ সবুজ-সোনালি রং মিশিয়ে পুরো বিলটাকে এক বিশাল গালিচায় ঢেকে দিয়েছে।

এখন গুমাই বিলে চলছে ধান কাটার উৎসব। কোথাও ধান পুরো পেকেছে, কোথাও এখনো হালকা সবুজ, আবার কোথাও কাটা শেষ করে কৃষকেরা বস্তায় ধান ভরছেন। সব মিলিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কিষান-কিষানিরা। সবুজ পাহাড়ের কোলে জমে থাকা এই বিল বাংলাদেশের শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত। আজও সেই সুনাম বাঁচিয়ে রেখেছেন কৃষকেরা। শুধু ছন্দটা কখনো ওঠে, কখনো নামে।

এবার ধান কাটার উৎসব দেখতে সম্প্রতি গুমাই বিলে যাই। বিলের সুফিপাড়া অংশে ঘন খেত। মাঝখানে ইটের সরু রাস্তা। সেই রাস্তার এক কোনায় গা এলিয়ে বসে ছিলেন রাজ্জাক মিয়া। বয়স ষাটের কোঠায়। কিন্তু রোদে পোড়া ত্বক ও চওড়া কাঁধ দেখে মনে হয়, মাঠই তাঁকে শক্ত করে গড়েছে। কাস্তে হাতেই ছিল। ঘামে ভেজা গামছা কাঁধে। ধান কেটে একটু বিশ্রাম নিতে বসেছেন সবে। তাঁর পাশে বসতেই গুমাই বিলের গল্প যেন আরেকভাবে খুলতে লাগল। রাজ্জাক মিয়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় যা বলেছেন, তা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, এবার ফলন ভালো। গত দু-তিন বছর ঠিকমতো ধান পাননি। এবার বৃষ্টি হয়েছে পরিমাণমতো। তাই মাঠও ভরে উঠেছে ফলনে।

স্থানীয়দের কাছে গুমাই বিল মানেই ঐতিহাসিক এক জনপদ। কথিত আছে, ৫০ থেকে ৭০ বছর আগেও এক মৌসুমের ধানে দেশের মানুষকে দুই দিন খাওয়ানো যেত। হয়তো একটু বাড়িয়ে বলা, কিন্তু সত্য হচ্ছে, এই বিলের উর্বরতা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

কৃষকেরা বলছেন, গত কয়েক বছর প্রকৃতি একটু কম ‘দয়া’ করেছে। কখনো পানি ঠিকমতো থাকেনি, বৃষ্টি হয়েছে ভুল সময়ে। তার ওপর বাজারের দাম, সার-বীজের টানাটানি, মাঝেমধ্যে পোকামাকড়ের আক্রমণ—সব মিলিয়ে গুমাই বিলের কৃষকেরা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এ বছর দৃশ্য অন্য রকম। বিলের পশ্চিম দিকে গিয়ে দেখা গেল, ২০ থেকে ২৫ জন কৃষক তিন সারিতে দাঁড়িয়ে ধান কাটছেন। কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে যেন একটা যান্ত্রিক ছন্দ তৈরি হয়েছে। মানুষগুলোর মুখে খাটুনির ছাপ, কিন্তু তাতে দুঃখ নেই।

সেখানেই কথা হলো কৃষক বাচা মিয়ার সঙ্গে। বয়স তাঁর পঞ্চাশের কাছাকাছি। তাঁর শার্টের পকেটে পুরোনো মুঠোফোন। সেই মুঠোফোনে থাকা সময়ের ওপর চোখ রাখলেন। এরপর বললেন, ‘গুমাই বিলে চাষাবাদের জন্য পানি-মাটি দুটোই প্রকৃতির দান। এবারে আবার পুরোনো দিনের মতো ফলন হইছে।’

গুমাই বিলের চারটি এলাকা—কদমতলী, পূর্ব মরিয়মনগর, মধ্য মরিয়মনগর ও চন্দ্রঘোনা ঘুরে দেখা গেল, মূল কাজ চলে তিন পালায়। সকালে দল বেঁধে ধান কাটা, দুপুরে কাটা ধান বেঁধে স্তূপ করা, বিকেলে ধান শুকানো ও বস্তায় ভরা।

গুমাই বিলের মাটি নরম, আঠালো ও উর্বরতায় ভরপুর। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নেমে এই বিল ভরে ওঠে। পানি যতটা দরকার, ঠিক ততটাই ধরে রাখে। তারপর ধীরে ধীরে পানি সরে যায়। মাটি হয়ে ওঠে চাষাবাদের উপযোগী। চন্দ্রঘোনা এলাকার কৃষকেরা বললেন, বর্ষার পানি এ বছর বেশি হলেও সময়মতো নেমে গেছে, ফলে জমিতে রোগবালাইও তুলনামূলক কম ছিল।

ইতিহাসে গুমাই বিল

রাঙ্গুনিয়ার মানুষের মুখে শোনা যায়, কর্ণফুলীর উপনদীগুলোর পলি জমে কয়েক শ বছর আগে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে গুমাই বিল। বর্ষায় এই অঞ্চল নৌকার রাজ্য, শুষ্ক মৌসুমে দেখা দিত বিস্তীর্ণ উর্বর জমি। চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আলীউর রহমান তাঁর কর্ণফুলীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৪৫ সালের দিকে স্থানীয় আবদুল বারী তালুকদার গুমাই ঝিল সংস্কার করে কৃষির উপযোগী করে তোলেন। এর আগে ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সিনেটর রবার্ট মুন্দার ও পাকিস্তান সরকারের কৃষি উপদেষ্টা হাশেম মাহফুজ এই অঞ্চল পরিদর্শনের পর কর্ণফুলী থেকে খাল খনন শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতায় গুমাই বিলের পতিত জমি ধীরে ধীরে শস্যভূমিতে রূপ নেয়। শিরীষতলা, কুরমাই, হাসেম, কালাপানি—এমন বহু খাল-ছড়ার জালের ওপর দাঁড়িয়ে এই বিল হয়ে ওঠে রাঙ্গুনিয়ার কৃষির প্রাণকেন্দ্র। পাকিস্তান আমলের সরকারি জরিপের পর থেকেই জায়গাটি শস্যভান্ডার নামে পরিচিতি পায়। কয়েক দশক আগে বিলের আয়তন ছিল প্রায় ৪ হাজার হেক্টর; এখন তার কিছু অংশ দখলে গেছে, গড়ে উঠেছে ভবন।

ধান কাটার মৌসুমে গুমাই বিল যেন কৃষকের পাশাপাশি টিয়া পাখিরও আবাস। হেমন্তের দিনগুলোতে আকাশজুড়ে সবুজ টিয়ার ওড়াউড়ি দৃষ্টি কেড়ে নেয়। কখনো দলে দলে বাঁক কেটে ওড়া, কখনো নিচে নেমে পাকা ধানের শিষে ঠোকর, তারপর আবার উড়ে গিয়ে বসা কাছের শিরীষ বা কড়ইগাছে—এমন দৃশ্যের দেখা মেলে ধান কাটার দিনগুলোতে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এই ব ল

এছাড়াও পড়ুন:

গুমাই বিলে ধানের ঘ্রাণ

হেমন্তের দুপুরটা ছিল শান্ত। হালকা বাতাসে দুলছিল পাকা ধান। দূরে শোনা যাচ্ছিল কাস্তে চালানোর শব্দ। সম্প্রতি রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলে ঢুকতেই মনে হলো, যেন কেউ সবুজ-সোনালি রং মিশিয়ে পুরো বিলটাকে এক বিশাল গালিচায় ঢেকে দিয়েছে।

এখন গুমাই বিলে চলছে ধান কাটার উৎসব। কোথাও ধান পুরো পেকেছে, কোথাও এখনো হালকা সবুজ, আবার কোথাও কাটা শেষ করে কৃষকেরা বস্তায় ধান ভরছেন। সব মিলিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কিষান-কিষানিরা। সবুজ পাহাড়ের কোলে জমে থাকা এই বিল বাংলাদেশের শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত। আজও সেই সুনাম বাঁচিয়ে রেখেছেন কৃষকেরা। শুধু ছন্দটা কখনো ওঠে, কখনো নামে।

এবার ধান কাটার উৎসব দেখতে সম্প্রতি গুমাই বিলে যাই। বিলের সুফিপাড়া অংশে ঘন খেত। মাঝখানে ইটের সরু রাস্তা। সেই রাস্তার এক কোনায় গা এলিয়ে বসে ছিলেন রাজ্জাক মিয়া। বয়স ষাটের কোঠায়। কিন্তু রোদে পোড়া ত্বক ও চওড়া কাঁধ দেখে মনে হয়, মাঠই তাঁকে শক্ত করে গড়েছে। কাস্তে হাতেই ছিল। ঘামে ভেজা গামছা কাঁধে। ধান কেটে একটু বিশ্রাম নিতে বসেছেন সবে। তাঁর পাশে বসতেই গুমাই বিলের গল্প যেন আরেকভাবে খুলতে লাগল। রাজ্জাক মিয়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় যা বলেছেন, তা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, এবার ফলন ভালো। গত দু-তিন বছর ঠিকমতো ধান পাননি। এবার বৃষ্টি হয়েছে পরিমাণমতো। তাই মাঠও ভরে উঠেছে ফলনে।

স্থানীয়দের কাছে গুমাই বিল মানেই ঐতিহাসিক এক জনপদ। কথিত আছে, ৫০ থেকে ৭০ বছর আগেও এক মৌসুমের ধানে দেশের মানুষকে দুই দিন খাওয়ানো যেত। হয়তো একটু বাড়িয়ে বলা, কিন্তু সত্য হচ্ছে, এই বিলের উর্বরতা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

কৃষকেরা বলছেন, গত কয়েক বছর প্রকৃতি একটু কম ‘দয়া’ করেছে। কখনো পানি ঠিকমতো থাকেনি, বৃষ্টি হয়েছে ভুল সময়ে। তার ওপর বাজারের দাম, সার-বীজের টানাটানি, মাঝেমধ্যে পোকামাকড়ের আক্রমণ—সব মিলিয়ে গুমাই বিলের কৃষকেরা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এ বছর দৃশ্য অন্য রকম। বিলের পশ্চিম দিকে গিয়ে দেখা গেল, ২০ থেকে ২৫ জন কৃষক তিন সারিতে দাঁড়িয়ে ধান কাটছেন। কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে যেন একটা যান্ত্রিক ছন্দ তৈরি হয়েছে। মানুষগুলোর মুখে খাটুনির ছাপ, কিন্তু তাতে দুঃখ নেই।

সেখানেই কথা হলো কৃষক বাচা মিয়ার সঙ্গে। বয়স তাঁর পঞ্চাশের কাছাকাছি। তাঁর শার্টের পকেটে পুরোনো মুঠোফোন। সেই মুঠোফোনে থাকা সময়ের ওপর চোখ রাখলেন। এরপর বললেন, ‘গুমাই বিলে চাষাবাদের জন্য পানি-মাটি দুটোই প্রকৃতির দান। এবারে আবার পুরোনো দিনের মতো ফলন হইছে।’

গুমাই বিলের চারটি এলাকা—কদমতলী, পূর্ব মরিয়মনগর, মধ্য মরিয়মনগর ও চন্দ্রঘোনা ঘুরে দেখা গেল, মূল কাজ চলে তিন পালায়। সকালে দল বেঁধে ধান কাটা, দুপুরে কাটা ধান বেঁধে স্তূপ করা, বিকেলে ধান শুকানো ও বস্তায় ভরা।

গুমাই বিলের মাটি নরম, আঠালো ও উর্বরতায় ভরপুর। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নেমে এই বিল ভরে ওঠে। পানি যতটা দরকার, ঠিক ততটাই ধরে রাখে। তারপর ধীরে ধীরে পানি সরে যায়। মাটি হয়ে ওঠে চাষাবাদের উপযোগী। চন্দ্রঘোনা এলাকার কৃষকেরা বললেন, বর্ষার পানি এ বছর বেশি হলেও সময়মতো নেমে গেছে, ফলে জমিতে রোগবালাইও তুলনামূলক কম ছিল।

ইতিহাসে গুমাই বিল

রাঙ্গুনিয়ার মানুষের মুখে শোনা যায়, কর্ণফুলীর উপনদীগুলোর পলি জমে কয়েক শ বছর আগে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে গুমাই বিল। বর্ষায় এই অঞ্চল নৌকার রাজ্য, শুষ্ক মৌসুমে দেখা দিত বিস্তীর্ণ উর্বর জমি। চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আলীউর রহমান তাঁর কর্ণফুলীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৪৫ সালের দিকে স্থানীয় আবদুল বারী তালুকদার গুমাই ঝিল সংস্কার করে কৃষির উপযোগী করে তোলেন। এর আগে ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সিনেটর রবার্ট মুন্দার ও পাকিস্তান সরকারের কৃষি উপদেষ্টা হাশেম মাহফুজ এই অঞ্চল পরিদর্শনের পর কর্ণফুলী থেকে খাল খনন শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতায় গুমাই বিলের পতিত জমি ধীরে ধীরে শস্যভূমিতে রূপ নেয়। শিরীষতলা, কুরমাই, হাসেম, কালাপানি—এমন বহু খাল-ছড়ার জালের ওপর দাঁড়িয়ে এই বিল হয়ে ওঠে রাঙ্গুনিয়ার কৃষির প্রাণকেন্দ্র। পাকিস্তান আমলের সরকারি জরিপের পর থেকেই জায়গাটি শস্যভান্ডার নামে পরিচিতি পায়। কয়েক দশক আগে বিলের আয়তন ছিল প্রায় ৪ হাজার হেক্টর; এখন তার কিছু অংশ দখলে গেছে, গড়ে উঠেছে ভবন।

ধান কাটার মৌসুমে গুমাই বিল যেন কৃষকের পাশাপাশি টিয়া পাখিরও আবাস। হেমন্তের দিনগুলোতে আকাশজুড়ে সবুজ টিয়ার ওড়াউড়ি দৃষ্টি কেড়ে নেয়। কখনো দলে দলে বাঁক কেটে ওড়া, কখনো নিচে নেমে পাকা ধানের শিষে ঠোকর, তারপর আবার উড়ে গিয়ে বসা কাছের শিরীষ বা কড়ইগাছে—এমন দৃশ্যের দেখা মেলে ধান কাটার দিনগুলোতে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ