ইসলামি জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে যেসব মনীষী আপন প্রজ্ঞা ও লেখনী দ্বারা যুগান্তকারী প্রভাব রেখেছেন, হুজ্জাতুল ইসলাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহ.) তাঁদের অন্যতম। তাঁর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ছোট পুস্তিকা হলো কানুনুত তা’বিল বা ‘ব্যাখ্যার মূলনীতি’।

এই পুস্তিকায় তিনি ধর্মীয় জ্ঞান (নকল) ও যুক্তির (আকল) মধ্যে বাহ্যিকভাবে পরিলক্ষিত দ্বন্দ্ব নিরসনের একটি সার্বিক কাঠামো উপস্থাপন করেছেন। মূলত কিছু অধিবিদ্যা–সম্পর্কিত জটিল প্রশ্নের উত্তরে ইমাম গাজ্জালি নিছক উত্তর প্রদানের পরিবর্তে সেই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হওয়ার একটি বুদ্ধিবৃত্তিক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

প্রবন্ধটির সূচনা হয় কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন দিয়ে, যা তৎকালীন মুসলিম সমাজে আকল ও নকলের সমন্বয় নিয়ে সৃষ্ট গভীর জিজ্ঞাসারই প্রতিফলন। জিন ও ফেরেশতার রূপ পরিবর্তন, বারজাখের স্বরূপ এবং পরকালের বিভিন্ন সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়।

ইমাম গাজ্জালির মতে, ঐশী ধর্মীয় পাঠ্য ও মানবীয় যুক্তির সমন্বয়ের ক্ষেত্রে মানুষ পাঁচটি পথ অবলম্বন করে, যার মধ্যে রয়েছে দুটি প্রান্তিক, দুটি আংশিক ভারসাম্যপূর্ণ এবং একটি মধ্যমপন্থী দল।

এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে ইমাম গাজ্জালি একটি সামগ্রিক মূলনীতি উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি দেখান যে কোরআন-হাদিসের বাণী ও মানবীয় যুক্তির মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যে বৈপরীত্য দেখা যায়, তা নিরসনের চেষ্টায় মানুষ মূলত পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই বিভাজনই তাঁর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

ইমাম গাজ্জালির মতে, ঐশী ধর্মীয় পাঠ্য ও মানবীয় যুক্তির সমন্বয়ের ক্ষেত্রে মানুষ পাঁচটি পথ অবলম্বন করে, যার মধ্যে রয়েছে দুটি প্রান্তিক, দুটি আংশিক ভারসাম্যপূর্ণ এবং একটি মধ্যমপন্থী দল।

প্রথম ও দ্বিতীয় দল: দুই চরম প্রান্তিকতা

প্রথম দলটি হলো যারা কেবল ঐশী ধর্মীয় পাঠ্যের বাহ্যিক অর্থকেই আঁকড়ে ধরে। তারা যুক্তির চুলচেরা বিশ্লেষণকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে এবং যেকোনো আপাত অসম্ভব বিষয়কে কেবল ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ বলে ব্যাখ্যা করে। ইমাম গাজ্জালির ভাষায়, তারা ব্যাখ্যা ও গবেষণার বিপদ থেকে বাঁচতে গিয়ে ‘মূর্খতার চারণভূমিতে বিচরণ করেছে’।

যদিও তাদের বিশ্বাস নিরাপদ, কিন্তু তা জ্ঞানগত স্থবিরতার নামান্তর।

আরও পড়ুনইমাম তাবারি: জ্ঞানী, দুঃসাহসী, মর্মান্তিক জীবন০২ নভেম্বর ২০২৫

এর সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান দ্বিতীয় দলের, যারা যুক্তিকেই সর্বোচ্চ মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে। ধর্মীয় পাঠ্যের যে অংশ তাদের যুক্তির সঙ্গে মেলে, তা তারা গ্রহণ করে; অন্যথায় সেগুলোকে নবীদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বানানো মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না (নাউযুবিল্লাহ)।

ইমাম গাজ্জালি এই দলকে সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করেন, কারণ, তারা নবীদের সততার ওপরই আঘাত হানে, যা ইমানের মূল ভিত্তিকেই ধ্বংস করে দেয়।

তৃতীয় ও চতুর্থ দল: ভারসাম্য খোঁজার অসম্পূর্ণ প্রচেষ্টা

তৃতীয় দলটি আকলকে মূল ভিত্তি ধরলেও দ্বিতীয় দলের মতো চরমপন্থী নয়। তারা ঐশী ধর্মীয় পাঠ্যকে সরাসরি অস্বীকার করার চেয়ে সেগুলোর কষ্টসাধ্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে।

তবে যখন ব্যাখ্যা অসম্ভব মনে হয়, তখন তারা বর্ণনাকারীকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দিয়ে হাদিসটি প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে অনেক সহিহ হাদিসও তাদের কাছে পরিত্যাজ্য হয়।

যদি মানুষ আকলের ব্যবহার না করত, তাহলে কখনোই বুঝতে পারত না—কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা? কে সত্য নবী আর কে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার।’

চতুর্থ দলটি তৃতীয় দলের বিপরীত। তারা ধর্মীয় পাঠ্যকে মূল ভিত্তি হিসেবে মানে এবং যুক্তিকে এর অনুগামী করে। কিন্তু যুক্তি ও দর্শনশাস্ত্রে তাদের জ্ঞান অগভীর হওয়ায় তারা অনেক সময় যৌক্তিকভাবে অসম্ভব বিষয়কেও সম্ভব বলে ধরে নেয়।

যেমন, আল্লাহর জন্য স্থান গ্রহণ বা আরশে অধিষ্ঠিত হওয়ার মতো বিষয়গুলোর বাহ্যিক অর্থকেই তারা গ্রহণ করে; কারণ, তাদের সীমিত আকল এর অসম্ভবতাকে অনুধাবন করতে পারে না।

পঞ্চম দল: সমন্বয়ের মধ্যমপন্থা

ইমাম গাজ্জালির মতে, পঞ্চম দলটিই সঠিক পথে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা সমন্বয় করেছে কোরআন-হাদিস ও আকলের মধ্যে। দুটিকেই গণ্য করেছে স্বতন্ত্র মূলনীতি হিসেবে।’

এই দলের বিশ্বাস হলো, প্রকৃত আকল ও সহিহ নকলের মধ্যে কোনো সংঘাত নেই।

ইমাম গাজ্জালি এই মতের পক্ষাবলম্বন করে বলেছেন, ‘শরীয়তের ক্ষেত্রে যে আকলের অবস্থান অস্বীকার করবে, সে তো খোদ শরিয়তকে অস্বীকার করছে। যদি যুক্তি ও বিবেকের ব্যবহার না করা হতো, তাহলে শরিয়তের সত্যতা অনুধাবন করা যেত না।

যদি মানুষ আকলের ব্যবহার না করত, তাহলে কখনোই বুঝতে পারত না—কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা? কে সত্য নবী আর কে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার।’

গাজ্জালি আরও বলেন, ‘আকল কীভাবে শরিয়তকে অস্বীকার করবে, অথচ শরিয়তের মানদণ্ড আমাদের সামনে স্পষ্টই হয়েছে আকলের মাধ্যমে।’ এই পথটিই সবচেয়ে সঠিক হলেও তিনি স্বীকার করেন যে এটি অত্যন্ত ‘কণ্টকাকীর্ণ’ ও ‘জটিল’।

আরও পড়ুন ইমাম গাজালি ও তাঁর শিক্ষাদর্শন১২ এপ্রিল ২০২৫মধ্যমপন্থীর জন্য গাজ্জালির তিন উপদেশ

এই কঠিন পথের পথিকদের জন্য ইমাম গাজ্জালি তিনটি অমূল্য উপদেশ প্রদান করেন, যা তাঁর জ্ঞানতাত্ত্বিক বিনয় ও প্রজ্ঞার পরিচায়ক।

প্রথমত, সবকিছু জানার আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করা। তিনি কোরআনের আয়াত ‘তোমাদেরকে খুব সল্পই জ্ঞান দান করা হয়েছে’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ৮৫) উদ্ধৃত করে বলেন যে জ্ঞানের অসীম সমুদ্রে মানুষের অবস্থান ক্ষুদ্র। সব বিষয়ের চূড়ান্ত মর্ম জানা মানুষের পক্ষে অসম্ভব।

দ্বিতীয়ত, যুক্তির মৌলিক দাবিকে অস্বীকার না করা। তাঁর মতে, যুক্তি যদি মিথ্যা হতো, তবে তা দিয়ে নবুয়তের সত্যতাও প্রমাণ করা যেত না। যখন কোনো হাদিসের বাহ্যিক অর্থ স্পষ্ট যুক্তির বিরুদ্ধে যায়, তখন ব্যাখ্যা করা আবশ্যক হয়ে পড়ে।

যেমন, ইমাম গাজ্জালি উদাহরণ দেন, ‘কেয়ামত দিবসে মৃত্যুকে একটি দুম্বার সুরতে উপস্থিত করা হবে। এবং জবাই করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪,৭৩০)

গাজ্জালি বলেন, আমরা আকলের মাধ্যমে বুঝি যে মৃত্যু একটি বায়বীয় বা অবস্থাগত বিষয়, এর কোনো বস্তুগত শরীর নেই যাকে জবাই করা যায়। সুতরাং, এখানে অবশ্যই রূপক অর্থ গ্রহণ করতে হবে এবং এর ব্যাখ্যা অন্বেষণ করতে হবে।

প্রায় হাজার বছর পরেও ইমাম গাজ্জালির এই নীতি মুসলিম মননের জন্য এক অনিবার্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছে, যা বিশ্বাস ও যুক্তির মধ্যে একটি অর্থবহ সেতুবন্ধ রচনার শিক্ষা দেয়।

তৃতীয়ত, যখন কোনো আয়াত বা হাদিসের একাধিক সম্ভাব্য ব্যাখ্যা থাকে এবং কোনো একটিকে নিশ্চিতভাবে গ্রহণ করার দলিল না থাকে, তখন নীরবতা অবলম্বন করা। এসব জটিল বিষয়ে অনুমানের ভিত্তিতে আল্লাহর কালামের ব্যাখ্যা করাকে তিনি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলেছেন।

এ ক্ষেত্রে একজন জ্ঞানীর করণীয় হলো এটা স্বীকার করে নেওয়া যে বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু প্রকৃত অর্থও তার জানা নেই।

এই নীতিরই সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ ইমাম মালিক (রহ.

)-এর বিখ্যাত উক্তি, ‘আরশে আল্লাহর সমুন্নত হওয়ার বিষয়টি জ্ঞাত, কিন্তু এর স্বরূপ অজ্ঞাত। এর ওপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এর স্বরূপ নিয়ে প্রশ্ন করা বিদ’আত।’ (তাফসিরে কুরতুবি: ২/২১৯)

শেষ কথা

কানুনুত তা’বিল পুস্তিকায় ইমাম গাজ্জালি ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও জ্ঞানান্বেষণের একটি সামগ্রিক পথ বাতলে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে অন্ধ অনুকরণ ও লাগামহীন যুক্তিবাদ—দুটিই চরমপন্থা ও পরিত্যাজ্য। প্রকৃত জ্ঞান নিহিত রয়েছে নকল ও আকলের সতর্ক এবং ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয়ের মধ্যে।

যেখানে বাহ্যিক অর্থের সঙ্গে যুক্তির সংঘাত হয়, সেখানে ব্যাখ্যার দরজা উন্মুক্ত রাখতে হবে। আর যেখানে জ্ঞান সীমাবদ্ধ, সেখানে বিনয়ের সঙ্গে নীরবতা অবলম্বন করাই প্রজ্ঞার পরিচায়ক।

প্রায় হাজার বছর পরেও ইমাম গাজ্জালির এই নীতি মুসলিম মননের জন্য এক অনিবার্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছে, যা বিশ্বাস ও যুক্তির মধ্যে একটি অর্থবহ সেতুবন্ধ রচনার শিক্ষা দেয়।

[email protected]

আবদুল্লাহিল বাকি : লেখক, আলেম ও সফটওয়্যার প্রকৌশলী

আরও পড়ুনইজমা: ইসলামি আইনের অন্যতম ‘দলিল’২৬ নভেম্বর ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব হ য ক অর থ স ব ক র কর গ রহণ কর ভ রস ম য আল ল হ ল র মত র জন য অবস থ আকল র

এছাড়াও পড়ুন:

ইমাম গাজ্জালির ভারসাম্য ও মধ্যমপন্থা

ইসলামি জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে যেসব মনীষী আপন প্রজ্ঞা ও লেখনী দ্বারা যুগান্তকারী প্রভাব রেখেছেন, হুজ্জাতুল ইসলাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহ.) তাঁদের অন্যতম। তাঁর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ছোট পুস্তিকা হলো কানুনুত তা’বিল বা ‘ব্যাখ্যার মূলনীতি’।

এই পুস্তিকায় তিনি ধর্মীয় জ্ঞান (নকল) ও যুক্তির (আকল) মধ্যে বাহ্যিকভাবে পরিলক্ষিত দ্বন্দ্ব নিরসনের একটি সার্বিক কাঠামো উপস্থাপন করেছেন। মূলত কিছু অধিবিদ্যা–সম্পর্কিত জটিল প্রশ্নের উত্তরে ইমাম গাজ্জালি নিছক উত্তর প্রদানের পরিবর্তে সেই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হওয়ার একটি বুদ্ধিবৃত্তিক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

প্রবন্ধটির সূচনা হয় কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন দিয়ে, যা তৎকালীন মুসলিম সমাজে আকল ও নকলের সমন্বয় নিয়ে সৃষ্ট গভীর জিজ্ঞাসারই প্রতিফলন। জিন ও ফেরেশতার রূপ পরিবর্তন, বারজাখের স্বরূপ এবং পরকালের বিভিন্ন সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়।

ইমাম গাজ্জালির মতে, ঐশী ধর্মীয় পাঠ্য ও মানবীয় যুক্তির সমন্বয়ের ক্ষেত্রে মানুষ পাঁচটি পথ অবলম্বন করে, যার মধ্যে রয়েছে দুটি প্রান্তিক, দুটি আংশিক ভারসাম্যপূর্ণ এবং একটি মধ্যমপন্থী দল।

এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে ইমাম গাজ্জালি একটি সামগ্রিক মূলনীতি উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি দেখান যে কোরআন-হাদিসের বাণী ও মানবীয় যুক্তির মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যে বৈপরীত্য দেখা যায়, তা নিরসনের চেষ্টায় মানুষ মূলত পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই বিভাজনই তাঁর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

ইমাম গাজ্জালির মতে, ঐশী ধর্মীয় পাঠ্য ও মানবীয় যুক্তির সমন্বয়ের ক্ষেত্রে মানুষ পাঁচটি পথ অবলম্বন করে, যার মধ্যে রয়েছে দুটি প্রান্তিক, দুটি আংশিক ভারসাম্যপূর্ণ এবং একটি মধ্যমপন্থী দল।

প্রথম ও দ্বিতীয় দল: দুই চরম প্রান্তিকতা

প্রথম দলটি হলো যারা কেবল ঐশী ধর্মীয় পাঠ্যের বাহ্যিক অর্থকেই আঁকড়ে ধরে। তারা যুক্তির চুলচেরা বিশ্লেষণকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে এবং যেকোনো আপাত অসম্ভব বিষয়কে কেবল ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ বলে ব্যাখ্যা করে। ইমাম গাজ্জালির ভাষায়, তারা ব্যাখ্যা ও গবেষণার বিপদ থেকে বাঁচতে গিয়ে ‘মূর্খতার চারণভূমিতে বিচরণ করেছে’।

যদিও তাদের বিশ্বাস নিরাপদ, কিন্তু তা জ্ঞানগত স্থবিরতার নামান্তর।

আরও পড়ুনইমাম তাবারি: জ্ঞানী, দুঃসাহসী, মর্মান্তিক জীবন০২ নভেম্বর ২০২৫

এর সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান দ্বিতীয় দলের, যারা যুক্তিকেই সর্বোচ্চ মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে। ধর্মীয় পাঠ্যের যে অংশ তাদের যুক্তির সঙ্গে মেলে, তা তারা গ্রহণ করে; অন্যথায় সেগুলোকে নবীদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বানানো মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না (নাউযুবিল্লাহ)।

ইমাম গাজ্জালি এই দলকে সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করেন, কারণ, তারা নবীদের সততার ওপরই আঘাত হানে, যা ইমানের মূল ভিত্তিকেই ধ্বংস করে দেয়।

তৃতীয় ও চতুর্থ দল: ভারসাম্য খোঁজার অসম্পূর্ণ প্রচেষ্টা

তৃতীয় দলটি আকলকে মূল ভিত্তি ধরলেও দ্বিতীয় দলের মতো চরমপন্থী নয়। তারা ঐশী ধর্মীয় পাঠ্যকে সরাসরি অস্বীকার করার চেয়ে সেগুলোর কষ্টসাধ্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে।

তবে যখন ব্যাখ্যা অসম্ভব মনে হয়, তখন তারা বর্ণনাকারীকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দিয়ে হাদিসটি প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে অনেক সহিহ হাদিসও তাদের কাছে পরিত্যাজ্য হয়।

যদি মানুষ আকলের ব্যবহার না করত, তাহলে কখনোই বুঝতে পারত না—কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা? কে সত্য নবী আর কে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার।’

চতুর্থ দলটি তৃতীয় দলের বিপরীত। তারা ধর্মীয় পাঠ্যকে মূল ভিত্তি হিসেবে মানে এবং যুক্তিকে এর অনুগামী করে। কিন্তু যুক্তি ও দর্শনশাস্ত্রে তাদের জ্ঞান অগভীর হওয়ায় তারা অনেক সময় যৌক্তিকভাবে অসম্ভব বিষয়কেও সম্ভব বলে ধরে নেয়।

যেমন, আল্লাহর জন্য স্থান গ্রহণ বা আরশে অধিষ্ঠিত হওয়ার মতো বিষয়গুলোর বাহ্যিক অর্থকেই তারা গ্রহণ করে; কারণ, তাদের সীমিত আকল এর অসম্ভবতাকে অনুধাবন করতে পারে না।

পঞ্চম দল: সমন্বয়ের মধ্যমপন্থা

ইমাম গাজ্জালির মতে, পঞ্চম দলটিই সঠিক পথে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা সমন্বয় করেছে কোরআন-হাদিস ও আকলের মধ্যে। দুটিকেই গণ্য করেছে স্বতন্ত্র মূলনীতি হিসেবে।’

এই দলের বিশ্বাস হলো, প্রকৃত আকল ও সহিহ নকলের মধ্যে কোনো সংঘাত নেই।

ইমাম গাজ্জালি এই মতের পক্ষাবলম্বন করে বলেছেন, ‘শরীয়তের ক্ষেত্রে যে আকলের অবস্থান অস্বীকার করবে, সে তো খোদ শরিয়তকে অস্বীকার করছে। যদি যুক্তি ও বিবেকের ব্যবহার না করা হতো, তাহলে শরিয়তের সত্যতা অনুধাবন করা যেত না।

যদি মানুষ আকলের ব্যবহার না করত, তাহলে কখনোই বুঝতে পারত না—কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা? কে সত্য নবী আর কে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার।’

গাজ্জালি আরও বলেন, ‘আকল কীভাবে শরিয়তকে অস্বীকার করবে, অথচ শরিয়তের মানদণ্ড আমাদের সামনে স্পষ্টই হয়েছে আকলের মাধ্যমে।’ এই পথটিই সবচেয়ে সঠিক হলেও তিনি স্বীকার করেন যে এটি অত্যন্ত ‘কণ্টকাকীর্ণ’ ও ‘জটিল’।

আরও পড়ুন ইমাম গাজালি ও তাঁর শিক্ষাদর্শন১২ এপ্রিল ২০২৫মধ্যমপন্থীর জন্য গাজ্জালির তিন উপদেশ

এই কঠিন পথের পথিকদের জন্য ইমাম গাজ্জালি তিনটি অমূল্য উপদেশ প্রদান করেন, যা তাঁর জ্ঞানতাত্ত্বিক বিনয় ও প্রজ্ঞার পরিচায়ক।

প্রথমত, সবকিছু জানার আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করা। তিনি কোরআনের আয়াত ‘তোমাদেরকে খুব সল্পই জ্ঞান দান করা হয়েছে’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ৮৫) উদ্ধৃত করে বলেন যে জ্ঞানের অসীম সমুদ্রে মানুষের অবস্থান ক্ষুদ্র। সব বিষয়ের চূড়ান্ত মর্ম জানা মানুষের পক্ষে অসম্ভব।

দ্বিতীয়ত, যুক্তির মৌলিক দাবিকে অস্বীকার না করা। তাঁর মতে, যুক্তি যদি মিথ্যা হতো, তবে তা দিয়ে নবুয়তের সত্যতাও প্রমাণ করা যেত না। যখন কোনো হাদিসের বাহ্যিক অর্থ স্পষ্ট যুক্তির বিরুদ্ধে যায়, তখন ব্যাখ্যা করা আবশ্যক হয়ে পড়ে।

যেমন, ইমাম গাজ্জালি উদাহরণ দেন, ‘কেয়ামত দিবসে মৃত্যুকে একটি দুম্বার সুরতে উপস্থিত করা হবে। এবং জবাই করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪,৭৩০)

গাজ্জালি বলেন, আমরা আকলের মাধ্যমে বুঝি যে মৃত্যু একটি বায়বীয় বা অবস্থাগত বিষয়, এর কোনো বস্তুগত শরীর নেই যাকে জবাই করা যায়। সুতরাং, এখানে অবশ্যই রূপক অর্থ গ্রহণ করতে হবে এবং এর ব্যাখ্যা অন্বেষণ করতে হবে।

প্রায় হাজার বছর পরেও ইমাম গাজ্জালির এই নীতি মুসলিম মননের জন্য এক অনিবার্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছে, যা বিশ্বাস ও যুক্তির মধ্যে একটি অর্থবহ সেতুবন্ধ রচনার শিক্ষা দেয়।

তৃতীয়ত, যখন কোনো আয়াত বা হাদিসের একাধিক সম্ভাব্য ব্যাখ্যা থাকে এবং কোনো একটিকে নিশ্চিতভাবে গ্রহণ করার দলিল না থাকে, তখন নীরবতা অবলম্বন করা। এসব জটিল বিষয়ে অনুমানের ভিত্তিতে আল্লাহর কালামের ব্যাখ্যা করাকে তিনি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলেছেন।

এ ক্ষেত্রে একজন জ্ঞানীর করণীয় হলো এটা স্বীকার করে নেওয়া যে বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু প্রকৃত অর্থও তার জানা নেই।

এই নীতিরই সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ ইমাম মালিক (রহ.)-এর বিখ্যাত উক্তি, ‘আরশে আল্লাহর সমুন্নত হওয়ার বিষয়টি জ্ঞাত, কিন্তু এর স্বরূপ অজ্ঞাত। এর ওপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এর স্বরূপ নিয়ে প্রশ্ন করা বিদ’আত।’ (তাফসিরে কুরতুবি: ২/২১৯)

শেষ কথা

কানুনুত তা’বিল পুস্তিকায় ইমাম গাজ্জালি ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও জ্ঞানান্বেষণের একটি সামগ্রিক পথ বাতলে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে অন্ধ অনুকরণ ও লাগামহীন যুক্তিবাদ—দুটিই চরমপন্থা ও পরিত্যাজ্য। প্রকৃত জ্ঞান নিহিত রয়েছে নকল ও আকলের সতর্ক এবং ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয়ের মধ্যে।

যেখানে বাহ্যিক অর্থের সঙ্গে যুক্তির সংঘাত হয়, সেখানে ব্যাখ্যার দরজা উন্মুক্ত রাখতে হবে। আর যেখানে জ্ঞান সীমাবদ্ধ, সেখানে বিনয়ের সঙ্গে নীরবতা অবলম্বন করাই প্রজ্ঞার পরিচায়ক।

প্রায় হাজার বছর পরেও ইমাম গাজ্জালির এই নীতি মুসলিম মননের জন্য এক অনিবার্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছে, যা বিশ্বাস ও যুক্তির মধ্যে একটি অর্থবহ সেতুবন্ধ রচনার শিক্ষা দেয়।

[email protected]

আবদুল্লাহিল বাকি : লেখক, আলেম ও সফটওয়্যার প্রকৌশলী

আরও পড়ুনইজমা: ইসলামি আইনের অন্যতম ‘দলিল’২৬ নভেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ