গাড়ি থামিয়ে কাচে চাপাতির কোপ, একজন বলতে থাকেন, ‘গুলি কর, গুলি কর’
Published: 4th, December 2025 GMT
চট্টগ্রাম নগরে কাস্টমসের দুই কর্মকর্তার প্রাইভেটকার থামিয়ে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গাড়ি ভাঙচুর করে তাঁদের ‘গুলি করার’ হুমকিও দেওয়া হয়।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরের ডবলমুরিং থানার সিডিএ আবাসিক এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
গাড়িতে থাকা দুজন হলেন চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান খান ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) বদরুল আরেফিন।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অফিসের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তিনজন ব্যক্তি এসে আমাদের গাড়ি থামান। থামানোর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির কাচ ভাঙচুর শুরু হয়। একজন আরেকজনকে বলতে থাকেন, গুলি কর, গুলি কর। আমরা কোনোভাবে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়াতে থাকি। একটা গলির ভেতর ঢুকে প্রাণে বাঁচি।’
গুলি ছোড়া হয়েছিল কি না—জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘গুলির কোনো আওয়াজ আমরা শুনিনি। আসলে তখন আমরা শুধু দৌড়াচ্ছিলাম। গাড়ি ভাঙচুর করা হলেও আমরা কেউ গুরুতর আহত হইনি। কে বা কারা, কেন এই হামলা করেছে, তা আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারিনি।’
হামলাকারীরা সংখ্যায় তিনজন ছিলেন বলে জানান আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, তাঁরা একটি মোটরসাইকেলে করে আসেন। তাঁদের একজনের হাতে চাপাতি ছিল। গাড়ির কাছে এসে প্রথমে চাপাতি দিয়ে গাড়িতে কোপ দেন একজন। এরপর একজন গুলি করতে বলেন।
আসাদুজ্জামান বলেন, তাঁরা নিয়মিত কাস্টমসের বিভিন্ন অনিয়ম চিহ্নিত করে প্রতিদিন গড়ে ১০-১২টি মামলা করেন। এ কারণে তাঁরা নানা সময় হুমকিও পেয়েছেন। এই কাজ থেকে সরে আসার জন্যও তাঁদের অতীতে চাপও দেওয়া হয়েছে।
ঘটনার বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার মো.
তারেক মাহমুদ আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে একজন ফোন করে নিজেকে সাজ্জাদ পরিচয় দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন। তবে কোন সাজ্জাদ, তা বলেননি। আমাদের ধারণা, কাস্টমসে অনিয়ম ধরার কারণেই আজকের এই হামলা হতে পারে।’
জানতে চাইলে নগরের ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল আজাদ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলে আছি। বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করছি। তদন্ত করে জড়িতদের অবশ্যই চিহ্নিত করা হবে।’
এ ঘটনার আগে গত ৬ অক্টোবর হুমকির বিষয়ে বন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন রাজস্ব কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান খান। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, ৫ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে একজন ব্যক্তি ফোন করে ভয় দেখান, মেরে ফেলার হুমকি দেন।
বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তফা আহমেদ বলেন, তিনি ১২ দিন হলো এখানে এসেছেন। জিডির বিষয়টি তাঁর জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আস দ জ জ ম ন খ ন কর মকর ত ক স টমস
এছাড়াও পড়ুন:
মুসলিম সভ্যতায় কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা দেওয়া
আবু নুওয়াস হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর একজন কবি এবং আব্বাসি শাসনের প্রথম পর্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তার জন্ম ইরানের আহওয়াজ শহরে। তবে শৈশব, কৈশোর ও শিক্ষাজীবন কাটে ইরাকে বসরায়।
সেখানে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি বিখ্যাত কারী ইয়াকুব হাজরামির কাছে কিরাত (কোরআনের পাঠরীতি) শেখেন।
কিরাত শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জনের পর উস্তাদ ইয়াকুব হাজরামি তাকে কাছে ডাকেন। নিজের আঙুল থেকে আংটি খুলে তার হাতে তুলে দেন এবং বলেন, ‘আজ তোমার কিরাতের পাঠ গ্রহণ সমাপ্ত হল। এখন তুমি কোরআনের পাঠরীতি সম্বন্ধে বসরা অঞ্চলের সবচেয়ে পণ্ডিত ব্যক্তি।’ (আবুল ফারাজ আসফাহানি, কিতাবুল আগানি, ১/১৩)
দক্ষ, যোগ্য ও শাস্ত্রীয় জ্ঞানে পাণ্ডিত্যের অধিকারী প্রিয় শিক্ষার্থীদের সম্মাননা, সংবর্ধনা ও ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য দোয়া করা ছিল মুসলিম সভ্যতায় সাধারণ রেওয়াজ।দক্ষ, যোগ্য ও শাস্ত্রীয় জ্ঞানে পাণ্ডিত্যের অধিকারী প্রিয় শিক্ষার্থীদের সম্মাননা, সংবর্ধনা ও ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য দোয়া করা ছিল মুসলিম সভ্যতায় সাধারণ রেওয়াজ। আবু হুরাইরা (রা.)–এর হেফজ শক্তি ও হাদিস সংরক্ষণের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নবিজি (সা.) দোয়া করেছিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৯)
তিনি ইবনে আব্বাস (রা.) এর জন্যও জ্ঞানের প্রাচুর্যর দোয়া করেছিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪৩)
পাঠ সমাপ্তি উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে সম্মাননা ও সংবর্ধনা দেওয়া হতো। তাদেরকে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী দিয়ে পুরস্কৃত করা হতো। এই ধরনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শিক্ষা ও সামাজিক জগতের মধ্যে সীমিত থাকতো বিষয়টা এমনও নয়। এর প্রভাব কখনো কখনো রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়াত।
আরও পড়ুনমুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা০৩ নভেম্বর ২০২৫আব্বাসি খলিফা মুতাওয়াক্কিল বিল্লাহ (মৃ. ২৪৭) এর পুত্র মুতাজ যখন পাঠ গ্রহণ সমাপ্ত করেন, তখন খলিফা অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পুত্রের উস্তাদ শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইমরানকে তিনি ৫ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) মূল্যের রত্ন উপহার প্রদান করলেন।
এই বিষয়টা তার অপর পুত্র মুনতাসির বিল্লাহ সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। ফলে পিতা পুত্রের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এক সময় সামরিক নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে মুনতারিস পিতাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। (বারা নাজ্জার রাইয়ান, মা জা তারিফু আনিল-ইহতিফাল বিল-খিররিজিন ফির হাজারাতিল ইসলামিয়্যাহ, আল জাজিরা।)
পাঠ সমাপ্তির পরে শিক্ষার্থীদের সম্মাননা প্রদানের অন্যতম মাধ্যম ছিল শাস্ত্রভেদে বিভিন্ন উপাধি ও লকব প্রদান। এই সব উপাধি সামাজিক পরিমণ্ডলে একজন শিক্ষার্থীর সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির পেছনের বিরাট ভূমিকা পালন করতো। উপাধির মাধ্যমে লোকে জ্ঞানের জগতে একজন শিক্ষার্থীর অবস্থানের অনুমান করে নিতে পারতো।
পাঠ সমাপ্তির পরে শিক্ষার্থীদের সম্মাননা প্রদানের অন্যতম মাধ্যম ছিল শাস্ত্রভেদে বিভিন্ন উপাধি ও লকব প্রদান। উপাধির মাধ্যমে লোকে জ্ঞানের জগতে একজন শিক্ষার্থীর অবস্থানের অনুমান করে নিতে পারতো।নির্দিষ্ট শাস্ত্রে অর্জিত জ্ঞানের পরিধি বিবেচনা করে এই সব উপাধি প্রদান করা হতো। শাস্ত্র ভেদে উপাধিও ভিন্ন রকমের হতো। হাদিসশাস্ত্রে বরেণ্যদের দেয়া হতো, ‘মুসনিদ’, ‘হাফেজ’, ‘হাকেম’ জাতীয় উপাধি।
ফিক্হ ও আইন শাস্ত্রের জন্য বরাদ্দ ছিল, ‘ইমাম’, ‘মুজতাহিদ, ‘শাইখুল ইসলাম’ উপাধি। চিকিৎসা শাস্ত্রের উপাধি হতো, ‘শায়খ’ ও ‘রাইস’ ইত্যাদি। আর বরেণ্য অভিজ্ঞ ও উস্তাদ চিকিৎসকদের বলা হতো, আশ শাইখুর রাইস!
মুসলিম সভ্যতায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সম্মাননা প্রদানের জন্য পোশাক প্রদানের রেওয়াজও ছিল। ইমাম আবু হানিফার প্রধানতম শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) প্রথম পোশাক প্রদানের প্রচলন করেন। তারপর থেকে ‘পোশাক’ প্রদানের ধারাবাহিকতা শহরে শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এবং উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীকে সংবর্ধনা প্রদানের জন্য ‘তাইলাসান’ ব্যবহার হতে থাকে।
তাইলাসান হল এক ধরনের উলের বৃত্তাকার সবুজ পোশাক, যার নিচের দিক খোলা থাকে। কেউ কেউ বলেছেন, তাইলাসান কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয়। এটা শরীর আবৃত করে নেয়। তবে এতে সেলাই বা কাটছাঁটের কোনো কাজ থাকে না। (রজম আবদুল জাব্বার ইবরাহিম, আল মুজামুল আরাবি লি-আসমায়িল মালাবিস, ‘তাইলাসান’ ভুক্তি দ্রষ্টব্য)
কোনো কোনো অঞ্চলে উস্তাদ নিজের পরনের পোশাক খুলে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীকে পরিয়ে দিতেন এবং মাথায় তুলে দিতেন ‘কালিস’ টুপি।
আরও পড়ুনজ্ঞানচর্চায় বৃত্তি পেতেন সব ধর্মের মানুষ১৬ আগস্ট ২০২৫কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা প্রদানের আরেকটি মাধ্যম ছিল ‘শাহাদাতুল ইজাজাহ’ বা সনদপত্র প্রদান। সনদে পঠিত বিষয়, উস্তাদের নাম, জ্ঞানার্জনে তার যোগ্যতা ও দক্ষতার বিষয় উল্লেখ করা থাকতো। এর পাশাপাশি থাকতো শাস্ত্রীয় শিক্ষকদের নাম সম্বলিত ধারাবাহিক সনদ।
এই সনদ সমাজে তাদের জ্ঞানার্জনের স্বীকৃতির পেছনে ভূমিকা পালন করতো। এর মাধ্যমে শাস্ত্রীয় জ্ঞানে অভিজ্ঞ একজন শিক্ষার্থী পাঠদানের অনুমতি পেতো। এবং তার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের সনদ প্রদানের যোগ্যতা অর্জন করতো।
আব্বাসি খলিফা আল-মুকতাদির বিল্লাহর নির্দেশে চিকিৎসা শাস্ত্রে সনদ প্রদান ও অনুমোদন গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়।অন্যান্য শাস্ত্রে পাশাপাশি চিকিৎসা শাস্ত্রে সনদ গ্রহণ ও উস্তাদের অনুমতি অর্জনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হতো। প্রাথমিক যুগে মুসলিম সমাজে চিকিৎসাশাস্ত্র অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চর্চা করা হতো। পরবর্তীতে তা ধীরে ধীরে পাঠ-গ্রহণ, নিরীক্ষণ এবং অনুমোদনের মাধ্যমে একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার আওতায় আসে। (আল মুসতাশফায়াতুল ইসলামিয়্যাহ ফিল আসিমাতির মিসরিয়্যাহ, আল হিলাল-২০০৯, পৃষ্ঠা: ৭১)
আব্বাসি খলিফা আল-মুকতাদির বিল্লাহর নির্দেশে চিকিৎসা শাস্ত্রে সনদ প্রদান ও অনুমোদন গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। তখন থেকেই পাঠ সমাপ্ত করে একজন নবীন চিকিৎসককে পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতার প্রমাণ করে সনদ অর্জনের ধারাবাহিকতার সূচনা হয় এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা একটি প্রতিষ্ঠিত রীতিতে পরিণত হয়। (ড. আমের নাজ্জার, ফি তারিখিত তিব্বি ফিদ দাওলাতিল ইসলামিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৮৮-৮৯।)
ইসলাম জ্ঞানার্জনকে সকলের জন্য আবশ্যক করেছে। মুসলিম সমাজে সর্বদা শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একজন যোগ্য শিক্ষার্থীকে যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান ও সংবর্ধনা দানেও কখনো কসুর করেনি।
আরও পড়ুনযেভাবে গড়ল ইসলামি জ্ঞানচর্চার অর্থনৈতিক ভিত্তি১০ আগস্ট ২০২৫