২০০৬ সালের কথা। রংপুরের মিঠাপুকুরের ময়েনপুর পূর্ব পাড়া গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র শাহিনুল ইসলাম (বকুল) শখের বশে দুটি হাঁস পালন শুরু করেন। দুটি হাঁস থেকে তাঁর খামারে হাঁসের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর তিনি গরুর খামার, হাঁড়িভাঙা আমের বাগান, শিল আলু ও মাছ চাষ করে এলাকায় তাক লাগিয়ে দেন। এরই মধ্যে এইচএসসি পাস করে শাহিনুল ভর্তি হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু কৃষি যাঁর প্রাণ, তাঁকে কি থামানো যায়!

হাঁড়িভাঙা আম ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করতে গিয়ে কৃষকদের দুঃখ-কষ্ট কাছ থেকে দেখেন শাহিনুল। কৃষকদের সংগঠিত করার তাগিদ অনুভব করেন তিনি। পরে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ময়েনপুর কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র’। এই সংগঠনের মাধ্যমে এক যুগের বেশি সময় ধরে গ্রামের কৃষকেরা সুবিধা পাচ্ছেন।

শাহিনুল ইসলাম বলেন, তাঁর বাবা আছাব উদ্দিনও একজন কৃষক। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তাঁর আত্মনির্ভর হওয়ার ইচ্ছা ছিল। শখের বশে শুরু হলেও ছয়টি শাহিওয়াল গরু পালন করে সাফল্য পান তিনি। তিন লাখ টাকা দিয়ে পুকুর ইজারা নিয়ে দুই বছরে ১১-১২ লাখ টাকা আয় করেন। গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর কৃষির প্রতি আলাদা টান অনুভব করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না খুঁজে কৃষিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। তিনি এখন কোয়েল পাখির ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন করছেন। এ ছাড়া দেশি মুরগির খামারও আছে তাঁর।

কৃষকের স্বার্থে সংগঠন

২০১২ সালে ২৫ সদস্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ময়েনপুর কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠার পরই কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি বিপণন, হর্টিকালচার সেন্টার, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এখানকার কৃষকেরা কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার, বিষমুক্ত ফল ও সবজি উৎপাদনসহ নানা বিষয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ পান। ২০১২ সালে কৃষি তথ্য সার্ভিস সংগঠনটিকে একটি ল্যাপটপ, প্রজেক্টর ও মিনি জেনারেটর দেয়। সংগঠনের সদস্যরা গ্রামের হাটবাজারে গিয়ে বায়োস্কোপ দেখানোর মতো করে কৃষি সমস্যার তথ্য প্রচার চালান।

২০১২ সালে ২৫ সদস্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ময়েনপুর কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠার পরই কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি বিপণন, হর্টিকালচার সেন্টার, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এখানকার কৃষকেরা কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার, বিষমুক্ত ফল ও সবজি উৎপাদনসহ নানা বিষয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ পান।

সম্প্রতি সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু কালাম মিয়ার সঙ্গে কার্যালয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, আলুর লেটব্লাইট রোগ, হাঁড়িভাঙা আমের মুকুল ঝরা, বেশি তাপমাত্রায় করণীয়, কোন জাতের ধানের ফলন বেশি, বালাইনাশকের সঠিক ব্যবহারের নিয়ম—এ রকম নানা বিষয়ে সাধারণ কৃষকেরা তাঁদের কাছে আসেন। তাঁরা পরামর্শ দেন, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করে দেন।

সদস্যদের তথ্য অনুযায়ী, সংগঠনের সদস্য কৃষক আছেন ১৫৮ জন। তবে উপকারভোগী কৃষকের সংখ্যা ১ হাজার ৭০০। সদস্যরা জানান, তাঁদের সঞ্চয় জমিয়ে আমবাগান ও মাছ চাষ করেন। লভ্যাংশের একটি অংশ কৃষকের চিকিৎসা, মেয়ের বিয়ে বা জরুরি প্রয়োজনে বিনা সুদে দেওয়া হয়।

২০২০ সালে করোনাকালে এলাকার কৃষকের উৎপাদিত ফসল বিপণনে কাজ করে সংগঠনটি। এতে স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তাদের ফুড হিরো পুরস্কার দেয়। আরেকটি সাফল্য হলো কৃষকের ফসল ঘরে তোলার সুবিধার্থে বিস্তীর্ণ মাঠ পাড়ি দিয়ে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ। ময়েনপুর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য সাজু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, জারুল্যাহপুর কুটি গুচ্ছগ্রামে রাস্তা না থাকায় কৃষকেরা ফসল ঘরে তুলতে খুব কষ্ট পেতেন। সংগঠনের মাধ্যমে কৃষকেরা রাস্তার জন্য জমি দেন।

স্থানীয় কৃষকেরা জানান, তাঁরা মাঠে ফসল ফলানো এবং সার ও কীটনাশক দেওয়া একই সময়ে করছেন। এতে ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে।

সব সময় কৃষকের পাশে শাহিনুল

রংপুর শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্ব ময়েনপুর গ্রামে একসময় তামাক ও ধানের প্রচুর চাষ হতো। তবে এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এনে দিয়েছে হাঁড়িভাঙা আম। সেলফ লাইফ কম হওয়ায় স্থানীয় অনেক কৃষক লোকসানে পড়তেন।

স্থানীয় কৃষক আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শাহিনুল রংপুরের বুড়িরহাট হর্টিকালচার সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে চারা করার জন্য কৃষকদের আমের বীজ দেন। বিনিময়ে কিউজাই, ব্যানানা, আম্রপালি, কাটিমন, বারি-৪ জাতের আমের চারা নিয়ে কৃষকের কাছে বিতরণ করেন। ফলে নানা জাতের আম উৎপাদনে কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। আমচাষিদের মধ্যে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতির প্রচলনও শুরু করেন তিনি।

ময়েনপুর ইউনিয়ন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শাহ আজিজ বলেন, এই ইউনিয়নে ২৫০ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি সম্প্রসারণ ও রংপুর হর্টিকালচার সেন্টার সাথি ফসল হিসেবে আমবাগানে আদা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে শাহিনুল ইসলাম ১৬ হাজার বস্তায় আদা চাষ করেন। তিনি উদ্যোগ নিয়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আদা চাষের জন্য ১০টি করে বস্তা ও বীজ দেন। এ কার্যক্রম সাড়া ফেলেছে। এ বছর ৭০ হাজারের বেশি বস্তায় আদা চাষ হয়েছে।

শাহিনুল জানান, কীটনাশক ছাড়া আলোর ফাঁদে পোকা দমন, ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনে পাচিংয়ের ব্যবহার ও ফুড ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম উৎপাদন করায় ২০১৬ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পান। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলায় বিভিন্ন পদকও পেয়েছেন।

রংপুরের বুড়িরহাট হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক মো.

আবু সায়েম প্রথম আলোকে বলেন, কৃষিক্ষেত্রে শিক্ষিত যুবকদের উন্মেষ ঘটছে—এর উদাহরণ শাহিনুল। বাণিজ্যিকভাবে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা।

কীটনাশক ছাড়া আলোর ফাঁদে পোকা দমন, ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনে পাচিংয়ের ব্যবহার ও ফুড ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম উৎপাদন করায় ২০১৬ সালে শাহিনুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পান।

আধুনিক কৃষিতে ঝোঁক

স্থানীয় কৃষকেরা জানান, ময়েনপুর কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রের কল্যাণে গ্রামের চিত্র অনেক বদলে গেছে। ২৮ জন কৃষক মৎস্য বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাছ চাষ করেছেন। মালচিং পদ্ধতিতে অসময়ের টমেটো, শসা, মরিচ চাষ করেও তাঁরা লাভবান হচ্ছেন।

কৃষক মাসুদ রানা বলেন, ৫১ শতক জমিতে টমেটো আবাদে তাঁর ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বিক্রি করে পেয়েছেন ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। কৃষক হাফিজুর রহমান বলেন, রমজান মাস যদি ফেব্রুয়ারিতে হয়, তাহলে শসা লাগাতে হবে ডিসেম্বরের শেষের দিকে। শসা রমজানে বাজারে আসবে এবং ভালো দাম পাওয়া যাবে। অন্যান্য সবজিরও অসময়ের চাষকৌশল শিখে গেছেন কৃষকেরা।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সংগঠনের সদস্যরা জানালেন, কৃষি তথ্য সার্ভিসের দেওয়া সরঞ্জামাদি ২০১৬ সাল থেকে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। তবে তাঁরা সংগঠনের তহবিল থেকে একটি ল্যাপটপ কিনেছেন। তাঁদের লক্ষ্য কৃষককে প্রযুক্তিবান্ধব করে তোলা।

ময়েনপুর কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র নিয়ে নিজের স্বপ্নের কথা জানালেন প্রতিষ্ঠাতা শাহিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে তাঁরা একটি কৃষি হাসপাতাল করতে চান। এখানে কৃষকের ফসলের সমস্যা নিয়ে গবেষণাগার থাকবে। একই সঙ্গে কৃষকের স্বাস্থ্যসুরক্ষার ব্যবস্থাও থাকবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ হ ন ল ইসল ম র ব যবহ র স গঠন র স ক ষকদ র চ ষ কর মৎস য উৎপ দ সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

১ সপ্তাহে ১৩ সেঞ্চুরি: আইপিএল নিলামের আগে চার–ছক্কার মহড়া

শুরুটা করেছিলেন উর্বিল প্যাটেল। ব্যস, এরপর যেন বাঁধ ভেঙে গেল! ভারতের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে এখন রোজই কেউ না কেউ ব্যাট হাতে বেধড়ক পেটাচ্ছেন বোলারদের।

কখনো অভিষেক শর্মার ব্যাটে ঝড় উঠছে, কখনোবা তাণ্ডব চালাচ্ছেন কিশোর বৈভব সূর্যবংশী। এমনকি নিজেকে প্রমাণের অপেক্ষায় থাকা সরফরাজ খান কিংবা অভিমন্যু ঈশ্বরনরাও পিছিয়ে নেই। সবাই যেন পাল্লা দিয়ে বোলারদের সীমানার ওপারে আছড়ে ফেলছেন।

ভারতের ক্রিকেটারদের কাছে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি শুধু একটি টুর্নামেন্ট নয়, এটি আইপিএলের টিকিট পাওয়ার বড় মঞ্চ। এখানে নজরকাড়া কিছু করতে পারলেই নিলামে দল পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুণ।

চেন্নাইয়ের জার্সিতে উর্বিল প্যাটেল

সম্পর্কিত নিবন্ধ