বলে না দিলে ছবি দেখে যে কেউ বলবে, এটি সুন্দরবনের দৃশ্য। খালের পাড়ে নরম পলিমাটিতে মাথা তুলেছে সারি সারি গোলপাতাগাছ। খাটো কাণ্ডের এই গাছ দূর থেকে দেখলে মনে হয় মাটি ফুঁড়ে নারকেলগাছের পাতার মতো অসংখ্য পাতা ওপরে উঠে এসেছে। বাতাস বইলে সেই পাতার গায়ে আলতো ঢেউ ওঠে। কেবল সুন্দরবন নয়, এই দৃশ্য এখন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের উপকূলীয় এলাকায় গেলেও দেখা যাবে।

সুন্দরবন এলাকার একমাত্র পাম পরিবারের এই উদ্ভিদ মিরসরাই উপকূলে পরীক্ষামূলকভাবে লাগিয়ে সফল হয়েছে বন বিভাগ। উদ্দেশ্য, উপকূলীয় নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা, আর সাগরের ভাঙন থেকে তীরভূমি রক্ষা। সুন্দরবনকে রীতিমতো দুর্ভেদ্য করে তুলেছে গোলপাতা। গোলপাতার বনে অনায়াসেই বাঘ লুকিয়ে থাকতে পারে বলে বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বনজীবী মানুষজন প্রতিবছর মধু আর গোলপাতা সংগ্রহ করেন বন থেকে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের সমুদ্র উপকূলে উত্তরে ইছাখালী ও দক্ষিণে ডাবল খালের মাথায় গিয়ে দেখা যায়, সমুদ্র উপকূলের চারটি শাখা খালের দুই পাড়ে অন্তত ৩ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে লাগানো হয়েছে গোলপাতা। দূর থেকে দেখে নারকেলগাছের চারার মতো মনে হওয়া গাছগুলোর উচ্চতা এখন ৬ থেকে ৭ ফুট। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, খালগুলোতে নিয়মিত জোয়ার–ভাটা হয়। জোয়ার-ভাটার পলিতেই বেড়ে উঠছে গাছগুলো।

উপকূলীয় রেঞ্জ কার্যালয় সূত্র জানায়, মিরসরাইয়ে সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠা জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তা বাঁধের বাইরে চরের ভাঙন রোধে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি ও নতুন চর জাগাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে উপজেলার ডোমখালি, মঘাদিয়া ও বামনসুন্দর বিট এলাকায় ৮২০ হেক্টর চরে বনায়ন করে রেঞ্জ কার্যালয়। বন বিভাগের সুফল প্রকল্পের আওতায় দুই বছর আগে কেওড়া ও বাইনগাছের চারার পাশাপাশি গোলপাতাগাছ লাগানো হয়।

গোলপাতার বৈজ্ঞানিক বা উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ‘নিপা ফ্লুটিকানস’। ইংরেজি নাম ‘নিপা পাম’। তাল, নারকেল, সুপারির মতো এটিও পাম পরিবারের উদ্ভিদ। তবে জন্মায় লবণাক্ত ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলী বনে। বাংলাদেশের সুন্দরবনে স্বল্প ও মধ্যম লবণাক্ত অঞ্চলে জন্মায় এটি। এর পাতা প্রায় ৩ থেকে ৯ মিটার লম্বা হয়। দেখতে অনেকটা নারকেলগাছের পাতার মতো। গোলপাতার কাণ্ড খাটো হয়। এর শিকড় জালের মতো মাটি আঁকড়ে থাকে।

এ ছাড়া ইছাখালী বিট অংশে ইছাখালী ইউনিয়নের চরাঞ্চলে চারটি শাখা খালের দুই পাড়ে ১০ কিলোমিটারজুড়ে খুলনার সুন্দরবন এলাকা থেকে আনা ২০ হাজার গোলপাতার বীজ ও বরিশাল থেকে আনা ১০ হাজার চারা লাগানো হয়। তবে শিকড় সংক্রমণে বরিশালের ১০ হাজার চারা নষ্ট হয়ে যায়। আর সুন্দরবনের ২০ হাজার বীজ থেকে চারা গজালেও দফায় দফায় ঘূর্ণিঝড়, ২০২৪ সালে ফেনী অঞ্চলে বন্যায় অর্ধেকের মতো গাছ নষ্ট হয়ে যায়। তবে এরপরেও প্রায় ১০ হাজার গোলপাতাগাছ টিকে রয়েছে।

ম্যানগ্রোভ বনের একমাত্র পাম প্রজাতি

গোলপাতার বৈজ্ঞানিক বা উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ‘নিপা ফ্লুটিকানস’। ইংরেজি নাম ‘নিপা পাম’। তাল, নারকেল, সুপারির মতো এটিও পাম পরিবারের উদ্ভিদ। তবে জন্মায় লবণাক্ত ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলী বনে। বাংলাদেশের সুন্দরবনে স্বল্প ও মধ্যম লবণাক্ত অঞ্চলে জন্মায় এটি। এর পাতা প্রায় ৩ থেকে ৯ মিটার লম্বা হয়। দেখতে অনেকটা নারকেলগাছের পাতার মতো। গোলপাতার কাণ্ড খাটো হয়। এর শিকড় জালের মতো মাটি আঁকড়ে থাকে। গোলপাতা দিয়ে গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজ যেমন ঘরের চালা, বেড়া ইত্যাদি তৈরি হয়। এর ফল সুস্বাদু। অনেকটা তালশাঁসের মতো। খেজুরের রসের মতো মিষ্টি রসও পাওয়া যায় গাছ থেকে। সুন্দরবন অঞ্চলে এ গাছের রস দিয়ে গুড় তৈরি হয়। বন কর্মকর্তারা বলছেন, মিরসরাই উপজেলার সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে নিয়মিত জোয়ার–ভাটা হওয়ায় এখানকার মাটি ও আবহাওয়া গোলপাতা জন্মানোর উপযোগী। এখানে এই উদ্ভিদের বিস্তারের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিক্রিয়া

হঠাৎ এ অঞ্চলে গোলপাতার বাগান দেখে উচ্ছ্বসিত স্থানীয় বাসিন্দারাও। সাহেরখালী ইউনিয়নের ডাবরখালী খালের জাল ঠেলে মাছ ধরছিলেন মোহন চন্দ্র জলদাস। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে জানতাম গোলপাতা শুধু সুন্দরবনে হয়। এখন দেখছি আমাদের এলাকায় এ গাছে ভরে উঠছে। এখন এলাকায় বিভিন্ন পাখির আনাগোনা বেড়েছে।’

জানতে চাইলে উপকূলীয় বন বিভাগের মিরসরাই উপকূলীয় রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা শাহান শাহ নওশাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত খালপাড়ের মাটির বুনন টেকসই করে ভাঙন রোধ করতে, মিরসরাই উপকূলীয় এলাকায় জীববৈচিত্র্য বাড়াতে সুফল প্রকল্পের আওতায় পরীক্ষামূলকভাবে গোলপাতার বনায়ন করা হয়েছিল। সব উপযোগিতা থাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মনুষ্য সৃষ্ট নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে এখানে এখন গোলপাতার বন তৈরি হচ্ছে। সুন্দরবনসহ দক্ষিণবঙ্গের বাইরে দেশে গোলপাতার বন সম্প্রসারণে এটি চমৎকার উদাহরণ হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম রসর ই উপক ল র স ন দরবন লবণ ক ত উপক ল য় ন রক ল উদ ভ দ জন ম য়

এছাড়াও পড়ুন:

লোনাপানির সুন্দরবনের নিচে লুকিয়ে আছে মিঠাপানির ভান্ডার

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে পানি মানেই একরাশ তিক্ততার গল্প। নোনাজল, আর্সেনিক দূষণ, নদীর লবণাক্ততার বিস্তার—সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ বছরের বেশির ভাগ সময়ই নিরাপদ পানির সংকটে ভোগেন। খুলনা, সাতক্ষীরা আর বাগেরহাটজুড়ে চিংড়িঘের, ভাঙন, খরা ও লবণাক্ত নদীর পানি যেন জীবনের স্থায়ী সঙ্গী।

এই বাস্তবতার মধ্যে আন্তর্জাতিক একদল গবেষকের নতুন দাবি যেন উপকূলের বুকেই এক অচেনা আশার ঝরনা বইয়ে দিয়েছে। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, মাটির বহু গভীরে লুকিয়ে আছে দুটি বিশাল মিঠাপানির ভান্ডার। হাজার বছর আগের সেই পানি আজও প্রায় অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে।

গবেষণাটি গত শুক্রবার খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনসে প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ মেক্সিকো ইনস্টিটিউট অব মাইনিং অ্যান্ড টেকনোলজি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা খুলনা শহর থেকে সুন্দরবনের দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আধুনিক ভূ-তড়িৎ-চৌম্বকীয় প্রযুক্তি, ম্যাগনেটোটেলুরিক ব্যবহার করে ভূগর্ভের অভ্যন্তরীণ গঠন পরীক্ষা করেন।

সুন্দরবনে প্যালিও ওয়াটারের দুটি উৎস পাওয়া গেছে। প্যালিও ওয়াটার হলো প্রাচীন ভূগর্ভস্থ জল, যা হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আটকে থাকে। এটি প্রাচীন সুন্দরবনের বয়স ও গঠনের ধারণাকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। ইসমে আজম, সুন্দরবনবিষয়ক লেখক ও গবেষক

গবেষকদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খুলনার উত্তরের অংশে প্রায় ২০০ থেকে ৮০০ মিটার গভীরে বিস্তৃত আছে বিশাল এক মিঠাপানির স্তর। এটি প্রায় ৪০ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং পানির লবণাক্ততা এত কম যে সরাসরি মিঠাপানি হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই পানি তৈরি হয়েছিল শেষ বরফযুগে, যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ আজকের তুলনায় প্রায় ১২০ মিটার নিচে ছিল। তখন নদীগুলো গভীর উপত্যকা তৈরি করে সমুদ্রের দিকে ছুটে যেত এবং সেই বালুমিশ্রিত নদীপথে প্রবেশ করা বৃষ্টির পানি হাজার বছর ধরে ভূগর্ভে সঞ্চিত থাকত।

সুন্দরবনের ভেতরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় আরেকটি মিঠাপানির ভান্ডার। এটি আকারে তুলনামূলক ছোট এবং গভীরতাও কম, কিন্তু লবণাক্ততার মাত্রা এতটাই নিচে যে এ অঞ্চলেও নিরাপদ পানির আরেকটি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এই দুটি ভান্ডারের মাঝখানে আছে একটি প্রশস্ত লবণাক্ত পানির স্তর, যা গঙ্গার প্রাচীন নদীখাত ভরাট হয়ে তৈরি হয়েছে। বরফযুগের পর সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়তে শুরু করলে এই এলাকাগুলো লবণাক্ত কাদা-মাটিতে ঢেকে যায় এবং এখন তা স্থায়ী লবণাক্ত স্তর হিসেবে ভূগর্ভে রয়ে গেছে।

গুগল স্যাটেলাইট মানচিত্রে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিলুপ্তির পথে সুন্দরী হাঁস
  • সুন্দরবনের গল্প নিয়ে আসছেন শ্বেতা
  • লোনাপানির সুন্দরবনের নিচে লুকিয়ে আছে মিঠাপানির ভান্ডার