নরসিংদীতে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী সভা শেষে হামলায় অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সদর উপজেলার মেহেরপাড়া ইউনিয়নের শেখেরচর বাসস্ট্যান্ডে হামলার ঘটনা ঘটে। জামায়াত নেতাদের অভিযোগ, স্থানীয় যুবদল ও তাঁতী দলের দুই নেতার নেতৃত্ব হামলা হয়েছে।

আহত ব্যক্তিদের অনেকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সম্পর্কে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ফরিদা গুলশানারা কবির বলেন, মেহেরপাড়ায় হামলায় আহত ১৪ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৭ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

ওই ঘটনার পর গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে নরসিংদী শহরের ব্রাহ্মন্দীতে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে হামলার অভিযোগ করেন জামায়াতের জেলা সেক্রেটারি ও নরসিংদী-২ আসনের (সদরের একাংশ ও পলাশ উপজেলার একাংশ) প্রার্থী আমজাদ হোসাইন।

সংবাদ সম্মেলনে আমজাদ হোসাইন অভিযোগ করেন, ‘হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে মেহেরপাড়া ইউনিয়ন তাঁতী দলের সভাপতি বখতিয়ার হোসেন, যুবদল নেতা ইফতিখার আলমসহ অন্তত ৪০ জন রয়েছেন। এই ন্যক্কারজনক হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানাই।’

আমজাদ হোসাইন বলেন, শুরু থেকেই বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী তাঁদের সভায় বাধা দিচ্ছিলেন। তাঁর বক্তব্য চলাকালীনও মঞ্চের পেছনে গিয়ে তাঁকে গালিগালাজ করা হয়। স্থানীয় লোকজনের হস্তক্ষেপে সেখান থেকে সরে গেলেও সভা শেষে ফেরার পথে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা হামলা চালান। এ ঘটনায় তাঁদের ৩০ জন আহত হন। এ ছাড়া দলের আরও ৩ কর্মী এখনো নিখোঁজ।

এ বিষয়ে জানতে মেহেরপাড়া ইউনিয়ন তাঁতী দলের সভাপতি বখতিয়ার হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে মেহেরপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবদুর রশিদ মিয়া বলেন, উল্টো জামায়াতের হামলায় বখতিয়ারসহ তাঁদের পাঁচজন গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় তাঁরা আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।

নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সুজন চন্দ্র সরকার বলেন, ‘ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ঠিক কী ঘটেছে, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

শিল্পের দূষণে ডুবছে সাভার ও ধামরাইয়ের কৃষিজমি

মো. আলাউদ্দিনের কৃষক পরিচয় কত দিন থাকবে, তা অনিশ্চিত। ২০২৩ সালেও নিজের ৩১ শতক জমি থেকে তিনি ২৫ মণের মতো ধান পেয়েছিলেন। গত বছর ফলন ১৮ মণে নেমেছে। এ বছর চাষই করতে পারেননি।

ঢাকার ধামরাই উপজেলার ডাউটিয়া গ্রামের আলাউদ্দিন গত সেপ্টেম্বরের গোড়ায় বলেছিলেন, জমি থেকে পানি সরছে না। ধান ফলানো দূরের কথা, পচা পানির কারণে জমিতে নামাই যায়নি। নভেম্বরেও গিয়ে দেখা যায়, তাঁর জমির ওপর কালো পানিতে কচুরিপানা ভাসছে। অথচ এ জমি কিছুটা উঁচু জায়গায়।

আলাউদ্দিন অন্যের জমিতেও কাজ করতেন। এখন সে কাজ পাচ্ছেন না। পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন, কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘এখন চোখে অন্ধকার দেখি। পরিবার চালাব কীভাবে?’

নভেম্বরেও গিয়ে দেখা যায়, তাঁর জমির ওপর কালো পানিতে কচুরিপানা ভাসছে। অথচ এ জমি কিছুটা উঁচু জায়গায়।

পাশেই সাভার উপজেলা। সেখানকার কলতাসুতি মৌজায় জাকির হোসেনের সঙ্গে কথা হয় গত ২২ সেপ্টেম্বর। তিনি এবার ২৮ শতক জমিতে ধান বুনেছিলেন। মাত্র ৩ শতকের ধান কাটতে পেরেছেন। জাকির বলেন, ‘বাকি জায়গার ধান কারখানার পানির ঢলে গাছসহ পচা কাদামাটিতে পড়ে গেছে। ধান যদি–বা হয়, অধিকাংশই চিটা।’

আলাউদ্দিন আর জাকিরদের জমির অদূরে ভিত উঁচু করে গড়ে উঠছে ছোট–বড় শিল্পকারখানা। সেগুলোর তরল বর্জ্য নিচের আবাদি জমিতে জমছে। মাটি হয়ে উঠেছে বিষাক্ত কাদা। তাতে শিল্পবর্জ্যের ঝাঁজালো গন্ধ। অনেক জমি ডোবায় পরিণত হয়েছে। ছোট কৃষকেরাই বেশি ভুগছেন।

গত সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ধামরাইয়ের ডাউটিয়া ও জয়পুরা মৌজার একাংশ এবং সাভার উপজেলার কলতাসুতি মৌজার বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখেছেন এই প্রতিবেদক। ডাউটিয়া-জয়পুরায় ছয় দিনে ৩০ জন এবং কলতাসুতিতে চার দিনে ২৫ জন কৃষকের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। এসব এলাকা থেকে সংগ্রহ করা মাটি, পানি ও ধানের নমুনা পরীক্ষা করিয়ে ক্ষতিকর রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সরকারি একাধিক দপ্তরের কর্মকর্তাদের সূত্রে পাওয়া তথ্যে গত ১০ বছরে উপজেলা দুটিতে কৃষিজমি কমার আর শিল্পকারখানা বাড়ার হিসাব পাওয়া গেছে। অপরিকল্পিত কলকারখানার আগ্রাসনে দূষণের ক্ষতির কথা উল্লেখ করে পরিবেশবিদ ও নগরবিদেরা বলেছেন, এই দূষণ নদীতে আর ফসলেও চলে যাচ্ছে।

উপজেলা ও জেলা প্রশাসন আর পরিবেশ অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করে শিল্পমালিক নিজ স্বার্থে পরিবেশ ধ্বংস করার সুযোগ পাচ্ছেন।আদিল মুহাম্মদ খান, অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কৃষকের দুঃখ

এলোপাতাড়ি শিল্পকারখানার কারণে কৃষকের ক্ষতির প্রকট চিত্র দেখা যায় ধামরাইয়ে, ডাউটিয়া ব্রিজ-সংলগ্ন কৃষিজমিতে। কৃষকেরা বলেন, ডাউটিয়া এবং লাগোয়া জয়পুরা মৌজার প্রায় ২০০ একর জমিতে ৮-১০ বছর ধরে পানি জমছে। সেই পানিতে মিশছে কারখানার তরল বর্জ্য। দুর্গন্ধ বর্জ্য মাটিতেও গেড়ে বসছে। বৃষ্টির পানি বেরোনোর পথ বন্ধ হচ্ছে, খাল-নালা ভরাট ও দখল হচ্ছে। জমিগুলো পরিণত হচ্ছে স্থায়ী ডোবায়। উঁচু কিছু জমিতে তাঁরা এখনো ধান বুনছেন। কিন্তু সে ধানে চিটার পরিমাণ বেড়ে গেছে। দুর্গন্ধ পানিতে নেমে কৃষকের চর্মরোগ হচ্ছে।

ধামরাই উপজেলার সদ্য বিদায়ী নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামনুন আহমেদ বলছেন, অভিযোগ পেলেই দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যেসব কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে, পানিনিষ্কাশনের লক্ষ্যে অবশ্যই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

তবে ডাউটিয়ার কৃষক নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘অনেকেই বলছিল সমাধান হইব। একবার চেয়ারম্যানেও বলছিল সমাধান কইরা দিব। কিন্তু কিছুই তো হয় নাই।’

সাভারের কলতাসুতি মৌজার কৃষকেরাও বলেছেন, ১০ বছরের বেশি হলো অধিকাংশ সময় তাঁদের জমি তলিয়ে থাকে। চাষাবাদ করা যায় না। অনেকেই তাই কারখানার মালিকদের কাছে জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন।

কারখানার পচা পানির কারণে ফসল হয় না, হুদাই খাজনা দিতে হয়। বাধ্য হয়ে কম দামেই বিক্রি করতেছি। চাষ করা গেলে বিক্রি করা লাগত নাসাইদুর রহমান, কৃষক, কলতাসুতি, সাভার, ঢাকা

এই কৃষকেরা বলেন, গাজীপুর ও সাভারের কিছু শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য তাঁদের মৌজার একটি খালের মধ্য দিয়ে বংশী নদীতে গিয়ে পড়ে। কিন্তু খালের বিভিন্ন স্থান দখল করে ভরাট করা হয়েছে। খালটি সরু হয়ে গেছে, গভীরতা হারিয়েছে। এখন এসব তরল বর্জ্য খাল উপচে আশপাশের কৃষিজমিতে জমা হচ্ছে।

বৃষ্টির পানিতে মিশে বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে, জমে থাকছে বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, কলতাসুতি মৌজায় ৩৯৫ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ৮০ হেক্টর জমি এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সাভারের সদ্য বিদায়ী ইউএনও মাহবুবুর রহমান বলেন, সরেজমিনে গিয়ে ভুক্তভোগী কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে দূষণকারী শিল্পকারখানাগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

কলতাসুতি গ্রামের কৃষক মো. আফাজ উদ্দিন বলেন, ‘সমাধান তো হয় না, খালি শুনি হইব। কারখানার পানিতে ক্ষতি হইতাছে আমাগো। পাইপ দিয়া পানি গাঙ্গে (নদীতে) ফালাইতে হবে।’

বৃষ্টির পানিতে মিশে বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে, জমে থাকছে বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, কলতাসুতি মৌজায় ৩৯৫ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ৮০ হেক্টর জমি এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।পানি আর মাটিতে যা পাওয়া গেল

প্রথম আলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সহযোগিতায় ডাউটিয়া এবং কলতাসুতি মৌজার কৃষিজমি ও আশপাশের পানির উৎস পরীক্ষা করিয়েছে। মাটি আর ধানও পরীক্ষা করা হয়েছে।

এ দুটি মৌজার মোট সাতটি জায়গা থেকে পানি, চারটি কৃষিজমি থেকে মাটি এবং দুটি জায়গা থেকে ধানের নমুনা নেওয়া হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে নমুনাগুলো দুটি পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। একটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এবং অন্যটি তাঁদের নির্বাচিত ঢাকার একটি বেসরকারি পেশাদার প্রতিষ্ঠানের। শেষেরটিতে শুধু ভারী ধাতুর পরীক্ষা করা হয়েছে।

ধামরাইয়ে বিসিক শিল্পনগরীসহ আশপাশের বিভিন্ন শিল্পকারখানার পানি পার্শ্ববর্তী ডাউটিয়া ও জয়পুরার কৃষিজমিতে গিয়ে পড়ছে। শিল্পনগরীর ড্রেন ও পাশের একটি সিরামিক পণ্য কারখানার ড্রেনের শেষ প্রান্তের পানি এবং একটি জমির জমা পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ (ডিও) কম পাওয়া গেছে। সিরামিক কারখানার পানিতে ফসফেটের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি এবং অ্যামোনিয়ার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত ছিল।

তবে সাভারে কলতাসুতির কৃষিজমির পানিতে ডিওর পরিমাণ প্রায় স্বাভাবিক পাওয়া যায়, যদিও ফসফেট, নাইট্রেট ও অ্যামোনিয়া ছিল বেশি। ডাউটিয়ায় তিনটি কৃষিজমিতে ফসফেট ও অ্যামোনিয়া বেশি ছিল।

কৃষিজমির মাটির নমুনায় বর্ষা মৌসুমে যেসব ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে, শুষ্ক মৌসুমে সেগুলো আরও এক থেকে দেড় গুণ বেড়ে যাবে। আর যে উপাদানগুলো বাড়া দরকার, সেগুলোর মাত্রা আরও কমে যাবে।অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান

নমুনা পরীক্ষার ফল দেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. ইনামুল হক জানান, ধামরাই ও সাভারের দুটি এলাকায় পানি জলজ জীবনের জন্য প্রায় প্রাণঘাতী পর্যায়ে চলে গেছে। তিনি প্রথম আলোকে আরও বলেন, পানিতে ডিওর পরিমাণ ২ পিপিএমের কম থাকলে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। আর কৃষিজমিতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফসফেট থাকলে শৈবালসহ বিভিন্ন উদ্ভিদ অতিরিক্ত বেড়ে যাবে। কৃষিজমিতে ৪-৫ মিলিগ্রাম ফসফেটের উপস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি। মাত্রাতিরিক্ত অ্যামোনিয়া থাকলে জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকা কঠিন হয়। নাইট্রেটের পরিমাণ বেশি হলে জলজ উদ্ভিদেরও টিকে থাকা কঠিন।

অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কৃষিজমির মাটির নমুনায় বর্ষা মৌসুমে যেসব ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে, শুষ্ক মৌসুমে সেগুলো আরও এক থেকে দেড় গুণ বেড়ে যাবে। আর যে উপাদানগুলো বাড়া দরকার, সেগুলোর মাত্রা আরও কমে যাবে।’

কমছে আবাদি জমি

ধামরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ উপজেলায় মোট কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৮০০ হেক্টর। প্রায় ২০০ হেক্টর বাদে সবটাতেই আবাদ হতো। আউশ, আমন ও বোরো ধান হয়েছিল ১ লাখ মেট্রিক টনের বেশি।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট কৃষিজমি ও আবাদি জমি দুটিই অনেক কমে গেছে। আবাদি জমি কমেছে ১ হাজার ১২৭ হেক্টর। এবার বোরো ও আউশ ধান হয়েছে পৌনে এক লাখ মেট্রিক টনের মতো। আমন ধান এখনো মাঠে রয়েছে। তবে তিন রকম ধানেরই উৎপাদন কমে আসছে। অবশ্য গম, ভুট্টা, শর্ষে, সবজিসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বেড়েছে।

সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ উপজেলায় মোট কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৩০৫ হেক্টর। এর মধ্যে ২১০ হেক্টর বাদে সবটাই ছিল আবাদি জমি। সে বছর আউশ, আমন ও বোরো ধান হয়েছিল ৩৬ হাজার মেট্রিক টনের মতো। এ ছাড়া দেড় লাখ মেট্রিক টনের বেশি সবজি হয়েছিল। কমবেশি শর্ষে, গম, পাট আর ভুট্টাও হয়েছিল।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট কৃষিজমি ও আবাদি জমি দুটোই অনেক বেশি কমে গেছে। আবাদি জমি কমেছে ২ হাজার ৫১০ হেক্টর। এবার আউশ, আমন ও বোরো ধান হয়েছে ৩৫ হাজার মেট্রিক টনের কিছু বেশি। তবে সবজি ও ভুট্টার উৎপাদন কিছুটা কমেছে।

বাড়ছে শিল্প, ছড়াচ্ছে দূষণ

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১–এর তথ্য অনুযায়ী, সাভার ও ধামরাই উপজেলায় ২০১৫ সালে শিল্পকারখানা ছিল ১ হাজার ৯৪টি। ২০২৫ সালে কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৩২।

কারখানাগুলো বড় অংশই তৈরি পোশাকের—১০ বছর আগে যেগুলোর সংখ্যা ছিল ৭৫৮টি, তার ৪০টির মতো বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্য শিল্পকারখানার মধ্যে রয়েছে ওষুধ, খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক পণ্য, চামড়াজাত পণ্য ও প্রক্রিয়াকরণ এবং ব্যাটারি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।

ট্যানারিশিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর দূষণ ছড়ায় বলে জানান গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জি কে এম মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ট্যানারি শিল্পাঞ্চল এখন সাভারে। ট্যানারি বর্জ্যের ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম সাভারের মাটিতে যুক্ত হচ্ছে। ডাইং আর ওষুধ কারখানাগুলো থেকে জমিতে যায় নিকেল ও সিসা। মাটি থেকে এসব ক্ষতিকর ভারী ধাতু শস্যে যাচ্ছে।

তুরাগ ও বংশী নদীর পানিতে পাওয়া ভারী ধাতুগুলো বর্ষাকালে কৃষিজমিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মাটি থেকে এগুলো শুষে নিচ্ছে ফসল। তিনি বলেন, ‘এর ফলে ফসলের গুণাগুণ পরিবর্তিত হচ্ছে, উৎপাদন কমছে এবং এই ভারী ধাতু ফসলে জমা হচ্ছে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শারমীন আক্তার দূষণ নদীতেও

২০১৮ সালে ভারী ধাতুর উপস্থিতি এবং জমির ব্যবহারে বদল নিয়ে একটি গবেষণা করেছিল ১০ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল। গবেষণাটির নাম ‘মনিটরিং অব হেভি মেটাল পলিউশন অ্যান্ড জিআইএস-ডিরাইভড ল্যান্ড ইউজ চেঞ্জেস ইন দ্য মেজর ইকোনমিক জোন অব বাংলাদেশ’।

গবেষক দলটি সাভারের আশুলিয়ায় ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ডিইপিজেড), পার্শ্ববর্তী তুরাগ এবং সাভার ও ধামরাইয়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বংশী নদীর ২০টি স্থানের পানির নমুনা পরীক্ষা করে। পরীক্ষায় তুরাগ নদের পানিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি সিসা ও নিকেল পাওয়া যায়। ১৮টি নমুনায় ক্যাডমিয়ামের মাত্রাও বেশি ছিল। সর্বোচ্চ ছিল ১৬ দশমিক ২ পিপিবি। যেখানে ডব্লিউএইচওর মান ৩ পিপিবি। বংশী নদীতে তিনটি ধাতুর উপস্থিতিই বেশি ছিল।

গবেষকদের একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শারমীন আক্তার বলেন, তুরাগ ও বংশী নদীর পানিতে পাওয়া ভারী ধাতুগুলো বর্ষাকালে কৃষিজমিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মাটি থেকে এগুলো শুষে নিচ্ছে ফসল। তিনি বলেন, ‘এর ফলে ফসলের গুণাগুণ পরিবর্তিত হচ্ছে, উৎপাদন কমছে এবং এই ভারী ধাতু ফসলে জমা হচ্ছে।’

রাষ্ট্র নিশ্চুপ, কৃষক নিরুপায়

পরিবেশবিদ ও নগরবিদদের মতে, সমস্যাটা হচ্ছে শিল্পকারখানাগুলো ইচ্ছেমতো গড়ে ওঠায় এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের বিধান না মানায়। তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন না করে কারখানার তরল বর্জ্য অবাধে ড্রেন, খাল আর নদী–নালার মধ্য দিয়ে কৃষিজমিতে ফেলা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা শিল্পকারখানার মালিকদের আইন না মানা এবং কৃষিজমি রক্ষায় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কার্যকর উদ্যোগের অভাবকে দায়ী করছেন।

পরিবেশবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান জোর দিলেন নিয়মিত তদারকি এবং বর্ষা আর শুষ্ক মৌসুমে পানি ও মাটি পরীক্ষা করার ওপর।

সাভার ইতিমধ্যে দূষিত হয়ে গেছে, ধামরাইও সেই পথে আছে উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আইন ও নীতি অনুসারে শিল্পকারখানা হবে নির্দিষ্ট এলাকায়, কিন্তু তা হচ্ছে না। সরকার কৃষিজমি সুরক্ষা আইন করতে যাচ্ছে। এমনিতেও বিদ্যমান কৃষিজমি ব্যবহার-সংশ্লিষ্ট আইনে এমন জমিতে শিল্পকারখানা করার সুযোগ নেই।

অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে আরও বলেন, যা হচ্ছে সবই গায়ের জোরে এবং প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। উপজেলা ও জেলা প্রশাসন আর পরিবেশ অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করে শিল্পমালিক নিজ স্বার্থে পরিবেশকে ধ্বংস করার সুযোগ পাচ্ছেন। আর অসহায় কৃষক প্রতিবাদ করছেন, কিন্তু রাষ্ট্র নীরব।

কলতাসুতির সাইদুর রহমান তাঁর আধা একর জমি বেচে দিয়েছেন, বাদবাকি ১৮ শতকের ক্রেতা খুঁজছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কারখানার পচা পানির কারণে ফসল হয় না, হুদাই খাজনা দিতে হয়। বাধ্য হয়ে কম দামেই বিক্রি করতেছি। চাষ করা গেলে বিক্রি করা লাগত না।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ