ইউক্রেন শান্তি আলোচনার ভবিষ্যৎ পথ অস্পষ্ট বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন দূতদের মধ্যে ‘যথেষ্ট ভালো’ আলোচনার পরেও কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

মঙ্গলবার ক্রেমলিনে পুতিনের সঙ্গে ঘন্টাব্যাপী বৈঠকের পর, মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার বৃহস্পতিবার ফ্লোরিডায় শীর্ষ ইউক্রেনীয় আলোচক রুস্তেম উমেরভের সাথে দেখা করার কথা রয়েছে।

বুধবার ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় ট্রাম্প জানান, পুতিন একটি চুক্তি করতে চান, কিন্তু  “সেই বৈঠক থেকে কী বেরিয়ে আসবে তা আমি আপনাকে বলতে পারছি না কারণ এটি করতে দুইজনের সময় প্রয়োজন।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘(ইউক্রেনের সাথে) বেশ ভালোভাবে কিছু সমাধান করেছে।’

বুধবার ক্রেমলিন জানিয়েছে, পুতিন ইউক্রেনের যুদ্ধের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে কিছু মার্কিন প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন এবং একটি সমঝোতা খুঁজে বের করার জন্য কাজ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু ‘এখনো সমঝোতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।’

উভয় পক্ষই ক্রেমলিনে তাদের আলোচনার সারমর্ম প্রকাশ না করার বিষয়ে একমত হয়েছে। তবে একটি মীমাংসার পথে অন্তত একটি বড় বাধা রয়ে গেছে; রাশিয়ার আংশিকভাবে দখল করা চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চলের ভাগ্য।

একজন রাশিয়ান কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ভূখণ্ডের ইস্যুতে ‘এখনো পর্যন্ত কোনো সমঝোতা খুঁজে পাওয়া যায়নি’, যা ছাড়া ক্রেমলিন ‘সঙ্কটের কোনো সমাধান’ দেখতে পাচ্ছে না।

ঢাকা/শাহেদ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইউক র ন

এছাড়াও পড়ুন:

ইলিশগন্ধা

অটো ছেড়ে বাড়িটার সামনে দাঁড়াতেই সন্ধ্যার অন্ধকারটা আকস্মিক এমন গাঢ় হয়ে নামল, মনে হলো গাছ থেকে ঝুপ করে একগুচ্ছ পাতা ঝরে পড়েছে মাথার ওপর। মফস্‌সলের সুনসান রাস্তার এক মাথায় পোড়া ইটের পুরাতন দেয়ালে ঘেরা বাড়িটা দেখেই মনে হলো, এক মুহূর্তেই চলে এসেছি সেই প্রাচীন কোনো সময়ের কোনো এক প্রাচীন নগরে। আজকাল এ ধরনের বিশাল বাড়ি আর দেখা যায় না, মফস্‌সল হলেও না। প্লট ভাগ করে আধুনিক বিল্ডিং তুলে ফেলে বা ডেভেলপার কোম্পানিকে দিয়ে দেয়।

বিশাল এলাকাজুড়ে তৈরি বাড়িটার দেয়ালের জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে এমন অবস্থা হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে বিশাল কাঠের দরজাটা ধরে রাখতে গিয়ে দেয়ালটা যারপনরাই ক্লান্ত। যেকোনো সময় দরজাসমতে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। সাবধানে কাঠের দরজাটায় ধাক্কা দিতেই সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা-ভাঙা বিকট ক্যাচক্যাচ শব্দ করে সেটা খুলে গেল। ভেতরে পা দিতেই কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। দরজা থেকে ইটের তৈরি সোজা একটা পথ চলে গেছে বাড়ির দিকে। সে পথের এক পাশে ছোট্ট একটা পুকুর, শানবাঁধানো ঘাট আর অন্য পাশে বাঁশঝাড়ের মাঝখানে শেওলা জমা দুটি কবর। শহরের বাড়িতে এ রকম কবর থাকার ব্যাপারটা আমার কাছে একদমই অপরিচিত। কবরের দিকে তাকিয়ে সামনে এগোতে গিয়ে ইটের রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম, ঠিক সময়ে হাতটা ধরে ফেলল মাহিন।

আমার বান্ধবী মাহিন, এই বিশাল এবং প্রাচীন বাড়ির মেয়ে। ওর জোরাজুরিতেই এখানে আসা। কবরের দিকে ইশারা করতেই মাহিন হাত নেড়ে বলল, এটার পেছনের গল্প বলব তোকে, আগে বাড়িতে ঢুকি।

ততক্ষণে অন্ধকারটা আরও গাঢ় হয়ে নেমেছে। গাছের সারির মাঝ দিয়ে হেঁটে বাড়ির দিকে এগোচ্ছি আমরা, অন্ধকারে আরও বেশ কয়েকবার হোঁচট খেলাম। মুঠোফোন বের করে আলো জ্বালানোর কথা ভাবছিলাম, ঠিক তখনই বাগানের জায়গায় জায়গায় আলো জ্বলে উঠল। ঝকঝকে আলোতে বাড়ির বাইরের অবয়বটা পরিষ্কার হয়ে উঠল। পুরাতন ধাঁচের পোড়া ইটের দোতলা বাড়ি। বাইরের দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় পলেস্তারা খুলে ইট বের হয়ে গেছে, বাড়ির চারদিক ঘোরানো লোহার নকশাকাটা গ্রিলের বারান্দা। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠলে মাঝখানেই বড় দরজাটা হাট করে খোলা।

ধাক্কা দিতেই সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা-ভাঙা বিকট ক্যাচক্যাচ শব্দ করে সেটা খুলে গেল। ভেতরে পা দিতেই কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। দরজা থেকে ইটের তৈরি সোজা একটা পথ চলে গেছে বাড়ির দিকে। সে পথের এক পাশে ছোট্ট একটা পুকুর, শানবাঁধানো ঘাট আর অন্য পাশে বাঁশঝাড়ের মাঝখানে শেওলা জমা দুটি কবর।

চৌকাঠ পার হতেই মসলাভুনার তীব্র ঝাঁজ এসে নাকে লাগল। বাড়ির মূল দরজার সঙ্গেই রান্নাঘর। বাড়ির বাইরে যেমন উঁচু বারান্দা, সেই একই ধাঁচের বারান্দা ভেতরেও। রান্নাঘরের একটা জানালা ভেতরের বারান্দার দিকে খোলা, সেখান থেকেই রান্নার ঝাঁজ আসছে। জানালা দিয়ে ভেতর উঁকি দিতেই নিজের অজান্তে চোখ বড় হয়ে গেল আমার। রান্নাঘরে তিনজন মাঝবয়সী লোক। মাটির চুলায় বিশাল হাঁড়িতে রান্নাবান্না চলছে, তিনজনের মধ্যে একজন চুলার সামনে বসা, একজন বঁটি নিয়ে সবজি কাটছে আর আরেকজন মটরশুঁটি ছিলতে ব্যস্ত।

বাবা, মাহিনের ডাকে তিনজনই ফিরে আমাদের দিকে তাকাল। যে ভদ্রলোক রান্না করছিলেন, লুঙ্গির কোঁচায় হাত মুছতে মুছতে উঠে এলেন। তার পেছনে বাকি দুজন। হাত মুছতে মুছতেই বললেন, কী আশ্চর্য! মাহিন, তুমি আসবে সেটা আমাকে বলোনি কেন? সঙ্গে কি মেহমান?

আমাকে জানালে আমি গিয়ে স্টেশন থেকে তোমাদের নিয়ে আসতাম, পাশের ভদ্রলোক বললেন। আরেক ভদ্রলোক গলা উঁচু করে ডাকলেন, তোমরা সবাই কই? এই যে মাহিন এসেছে, সঙ্গে গেস্ট। তার ডাকে পাশের ঘর থেকে চার-পাঁচজন মহিলা একসঙ্গে হুড়মুড় করে বের হলো। মাহিনদের বড় পরিবার, ওর বাবা, মা, দুই চাচা, তাদের পরিবার, ফুফু, দাদি, সবাই মিলে অন্তত বিশ-বাইশজন হবে।

বাড়ির সবাই একসঙ্গে এত প্রশ্ন করতে লাগল আর মাহিন তাদের নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে আমার দিকে আর কারও নজর রইল না। এই ফাঁকে আমি বারান্দায় ঘুরে ঘুরে ঘরগুলো দেখতে থাকলাম। নিচতলায় চারদিকে চারটা ঘর, মাঝখানে বড় উঠান। রান্নাঘর, খাবারের ঘর, বসার ঘর আর একটা ঘরে ছোট ছোট তিনটা টেবিলের একটাতে টিভি, কয়েকটা চেয়ার, দেয়ালজুড়ে বইয়ের তাক আর পুরাতন সোফা, এটা সম্ভবত পড়ার ঘর। মাহিন আমার হাত ধরে পড়ার ঘরের সোফায় বসিয়ে দিল। এতক্ষণে মাহিনের বাবা জিজ্ঞেস করলেন, চা খাবে মামণি? সঙ্গে অন্য কিছু বানিয়ে দেব? আমি কিছু বলার আগেই মাহিনের মা বলল, চায়ে লেবু দিয়ো আর মুড়ি মেখে দিয়ো।

মাহিনের বাবা-কাকারা আবার রান্নাঘরে চলে গেল আর বাড়ির মেয়েরা আবার টিভি দেখতে বসল। আমি আবার একটা ছোট ধাক্কা খেলাম। আমার মাথায় কী চলছে, সেটা মাহিন এতক্ষণে বুঝে গেছে। ও, তোকে বলা হয়নি, আমাদের বাড়িতে রান্নাবান্না করে ছেলেরা, মেয়েদের রান্নাঘরে যাওয়া প্রায় নিষিদ্ধ, খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল মাহিন। এটার পেছনেও কি গল্প আছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম। ঠিক তখনই মাহিনের দাদি বললেন, গল্প পরে হবে, আগে ওপরে গিয়ে বাইরের কাপড় ছেড়ে আসো।

মাহিনের বাবা-কাকারা আবার রান্নাঘরে চলে গেল আর বাড়ির মেয়েরা আবার টিভি দেখতে বসল। আমি আবার একটা ছোট ধাক্কা খেলাম। আমার মাথায় কী চলছে, সেটা মাহিন এতক্ষণে বুঝে গেছে। ও, তোকে বলা হয়নি, আমাদের বাড়িতে রান্নাবান্না করে ছেলেরা, মেয়েদের রান্নাঘরে যাওয়া প্রায় নিষিদ্ধ।

বাড়ির ওপর তলায় সবার শোবার ঘর। মাহিনের ঘরটা সামনের দিকে এক কোণে, ঠিক বাঁশঝাড় আর কবরের সোজাসুজি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই প্রথমে চোখ পড়ল রক্তলাল চাঁদ আর আরেকটু চোখ নামালেই ঠিক সামনে বাঁশঝাড়টার ফাঁক দিয়ে শেওলাধরা কবরগুলো। পরিবেশটা গা ছমছমে, ভুতুড়ে মনে হলেও কবরের গল্প শোনার ইচ্ছাটা আরও প্রবল হলো। মাথার মধ্যে কবর আর রান্নাঘর নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই নাকে এল ইলিশ মাছের গন্ধ। সারা দিনের জার্নির ধকল কাটাতে শরীর যে খাবার চাচ্ছে, সেটা ইলিশ মাছের গন্ধে বেশ ভালো করে টের পেলাম।

চায়ের কাপ হাতে নিতেই মাহিনের বাবা আবার পড়ার ঘরে এলেন।

মামণি, রাতে কী খেতে চাও?

ইলিশ মাছ আমি খুব পছন্দ করি। ইলিশ মাছ হলে আর কিছু লাগবে না আঙ্কেল। তবে কষ্ট না হলে এর সঙ্গে খিচুড়ি ভালো জমবে, কথাগুলো একটানে বলে ফেললাম।

আমার কথা শুনে মাহিনের বাবা কিছুটা বিব্রত হয়ে বললেন, এ বাড়িতে কেউ ইলিশ খায় না, ইলিশ রান্না হয় না। সবার চেহারায় একধরনের অস্বস্তি দেখে বিষয়টা নিয়ে আমিও আর কথা বাড়ালাম না।

রাতে খাবার টেবিলে আয়োজন দেখে সত্যি এ বাড়ির পুরুষদের প্রশংসা না করে পারলাম না। মাহিনের মাকে বললাম, সত্যি, আন্টি আপনারা খুবই সৌভাগ্যবান। এ রকম আমি কখনো কোথাও দেখিনি। বাড়ির ছেলেরা রান্না করছে আর মেয়েরা বসে বসে টিভি দেখছে আবার ইচ্ছেমতো খাবারের ফরমাশ দিচ্ছে। খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার।

মাহিনের মা শুকনো একটা হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে খেতে থাকল। তবে আমার কথার পিঠে কথা শুরু করল মাহিনের দাদি, আপু, এটা সৌভাগ্য না, এটা বলতে পারো অভিশাপ। এই সত্তর বছরের সংসারজীবনে একটা দিনের জন্যও নিজের সংসারে নিজের মতো করে রান্না করা দূরে থাক, রান্নাঘরেই ঢুকতে পারিনি। আমার মেয়েরা, ছেলের বউরা কেউ পারল না।

আমি ঠিক ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। বাড়ির পুরুষেরা রান্নার কাজে আপনাদের সাহায্য করছে, সেটা দারুণ ব্যাপার। কিন্তু তাতে করে আপনাদের রান্নাবান্না করা নিষেধ হবে কেন?

সেটা একটা লম্বা গল্প। এই রান্না না করার বিষয়টা যদি সুবিধা হিসেবেও ধরি, তাহলে এই সুবিধা পাচ্ছি একটা–দুইটা না, চারটা জীবনের বিনিময়ে। খাওয়া শেষ হলে আম্মার মুখে গল্পটা শোনা যাবে, মাহিনের ফুফু বললেন।

ছাদের মাঝখানে খেজুরপাতার পাটি পেতে বসল গল্পের আসর। মাহিনের দাদি শুরু করল: এই গল্প আমি শুনেছি আমার শাশুড়ির মুখে, উনি শুনেছেন ওনার সৎশাশুড়ির কাছে। ঘটনা তা–ও এক শ ত্রিশ বছর আগের। আমার শ্বশুরের বাবার দুই স্ত্রী। বড়জনের বয়স তখন আঠারো বা উনিশ হবে, আমার শ্বশুরসহ তার দুই ছেলেমেয়ে। আর ছোটজনের বয়স সবে চৌদ্দ, সে সন্তানসম্ভবা। শ্বশুরের বাবা বেশ কড়া মানুষ, ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করতেন, তার দাপটই ছিল আলাদা। স্ত্রীদের ভয়ানক শাসনে রাখতেন। পান থেকে চুল খসলেই শুরু হতো মারধর, নির্যাতন। বড়জনকে তো সামান্য কিছুতেই দিতেন তালাকের হুমকি। এর মধ্যে একদিন সকাল সকাল হাট থেকে বড় একটা ইলিশ মাছ নিয়ে উনি হাজির। বড় বউকে বললেন, ভালো করে বেগুন দিয়ে মাছটা রান্না করবি, আমি দুপুরে ফিরে যেন মাছ দিয়ে ভাত খেতে পারি। আর যদি কোনো উল্টাপাল্টা পাই, সোজা বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিব।

শ্বশুরের বাবা বেশ কড়া মানুষ, ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করতেন, তার দাপটই ছিল আলাদা। স্ত্রীদের ভয়ানক শাসনে রাখতেন। পান থেকে চুল খসলেই শুরু হতো মারধর, নির্যাতন। বড়জনকে তো সামান্য কিছুতেই দিতেন তালাকের হুমকি। এর মধ্যে একদিন সকাল সকাল হাট থেকে বড় একটা ইলিশ মাছ নিয়ে উনি হাজির।

আমার বড় শাশুড়ি মাছ কেটেকুটে ভালো করে রান্না করে পুকুরে গেলেন গোসল করতে। গোসল করে ভাত বাড়তে এসে দেখলেন, মাছের হাঁড়ি উল্টে পড়ে আছে। কয়েকটা টুকরা আধখাওয়া অবস্থায় মেঝের মাটির মধ্যে পড়ে আছে। মাছ খেয়ে গেছে বিড়ালে। এতে পরিণতি কী হতে পারে, সেটা আঁচ করে বড় বউয়ের শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল। অপমানের হাত থেকে বাঁচতে সে সিদ্ধান্তটা নিল দ্রুতই। আমার শ্বশুর তখন দুধের শিশু। তাকে ছোট বউয়ের জিম্মায় দিয়ে বড় শাশুড়ি হাঁটলেন বাঁশঝাড়ের দিকে, হাতে শক্ত রশি।

অনেকক্ষণ হয়ে গেল, বড় বউ ফিরছে না। এদিকে দুপুরে খাবার সময় হয়ে আসছে। বড় বউয়ের দেরি দেখে ছোট বউ প্রথমে গেল রান্নাঘরে। সেখানে মাছের এই দুরবস্থা দেখে তার হাত-পা আতঙ্কে ঠান্ডা হয়ে এল। বড় বু, বড় বু বলে খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়াল বাঁশঝাড়ের পাশে। উঁচু বাঁশের মাথায় বড় বুর লাশ ঝুলতে দেখে মাথাটা ঘুরে উঠল ছোট বউয়ের। তার কোলে তখন আমার শ্বশুর আর আরেক হাতে ধরা চার বছরের বড় মেয়েটা। ছোট বউ কাঁপা কাঁপা পায়ে দুই বাচ্চাকে নিয়ে ঘরে গিয়ে বসল। এই মাছ খাওয়ার অপবাদ যদি তার ঘাড়ে গিয়ে পড়ে, সেই চিন্তায় তার পাগলের মতো অবস্থা। অনেক ভেবে সে–ও সহজ সমাধান বের করল। বড় মেয়ের কোলে ছোট ছেলেটাকে দিয়ে বাইরে থেকে দরজার শিকল তুলে দিল। তারপর টালমাটাল পায়ে আরেকটা রশি হাতে নিয়ে সে–ও বাঁশঝাড়ের দিকে ছুটল।

এটুকু বলে দাদির গলা ধরে আসে। উনি মাথা নিচু করে নিস্তব্ধ হয়ে যান। বাকি অংশটা বলেন ফুফু: এদিকে দুই বাচ্চার কান্নার আওয়াজে পাশের বাড়ির লোকজন এসে দেখে সরকার বাড়ির দুই বউ বাঁশঝাড়ে ফাঁস নিয়েছে। এরপর তাদের কবর দেওয়া হয় সেই বাঁশঝাড়েই।

এর কয়েক মাস পরে দাদার বাবা আবার বিয়ে করে আর সেই বড় মার মুখেই আমার দাদি এই গল্প শোনে। দুই স্ত্রীর মৃত্যুর পর বড় আব্বা কঠিন নিয়ম চালু করেন। সেটা হলো, বাড়ির বউরা কেউ আর রান্নাবান্না করবে না। সে নিয়ম এখনো চলে আসছে, এবার ফুফু থামলেন।

ওই যে বাগানের ওই কোনায় যে হরিফলের গাছ দেখতে পাচ্ছিস, সেটা কিন্তু আমাদের গল্পের সেই ছোট বউয়ের হাতে লাগানো গাছ, এবার মাহিন মুখ খুলল। এ ঘটনার পর এই বাঁশঝাড় আর মৃত্যু ঘিরে অনেক গল্প প্রচলিত হয়ে গেল। তার মধ্যে একটা হলো, যেদিন এই দুই বউ মারা গেল, সেদিন রাতেই আকাশে বড় করে দেখা দিল রক্ত চাঁদ। এর কয়েক বছর পরে যখন আরেকবার আকাশে রক্ত চাঁদ এল, তখন এই বাড়ির চারদিক ইলিশ মাছের গন্ধ ম ম করে উঠল। আর ওই হরিফলগাছের মগডালে দুটি যমজ ছেলেশিশুকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল। ধারণা করা হয়, ছোট বউয়ের গর্ভে যমজ ছেলে ছিল। পরে চন্দ্রগ্রহণের রাতে ইলিশের গন্ধ পাওয়া বা গাছের ডালে যমজ শিশুর বসে থাকা, এসব মুখে মুখে চাউর হয়েছে। বলতে পারিস মিথ। কেউ কেউ তো সন্দেহ করে, সরকার সাহেবই দুই স্ত্রীকে পিটিয়ে মেরে এসব গল্প ফেঁদেছিল।

মাহিনের গল্প শেষ হতেই ছাদের পরিবেশটা ভারী হয়ে এল, সবাই কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ হয়ে গেল। নিস্তব্ধতা ভেঙে দাদি বললেন, যাও সবাই ঘুমাতে যাও। অনেক রাত হয়েছে।

ঘরে ফিরেই মাহিন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। এত ক্লান্ত থাকার পরেও আমার কিছুতেই ঘুম এল না। ঘুরেফিরে মাথায় সেই দুই অভাগা কিশোরীর কথা ঘুরপাক খেতে থাকল। পুরো ঘটনাটা আরেকবার ভাবতেই কেমন দমবন্ধ হয়ে এল।

ধীর পায়ে জানালার গোড়ায় এসে বসলাম। লোহার শিকের মাঝখানে মুখটা গলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে খোলা বাতাসে লম্বা একটা শ্বাস নিলাম। আস্তে আস্তে চোখ খুলে যখন আকাশের দিকে তাকালাম, ততক্ষণে পুরা চাঁদটাই টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। রক্তলাল চাঁদের নিচেই হরিফলগাছের মগডালে বসে আছে নগ্ন দুটি শিশু। চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তাদের। অপুষ্ট দুটি শরীর, হাঁপরের মতো তাদের পাঁজর ওঠানামা করছে, যেন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ