ছবি: হাসান মাহমুদ
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
শ্রীলঙ্কা যেভাবে উচ্চ সুদের ফাঁদে পড়েছে
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে শ্রীলঙ্কা আজ তার সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
২০২২ সালে বৈদেশিক ঋণে খেলাপি হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পেতে সরকারকে কঠোর মিতব্যয়ী নীতি (অস্টেরিটি) গ্রহণ করতে বাধ্য হতে হয়। এর ফল হিসেবে দারিদ্র্যের হার উদ্বেগজনকভাবে উঁচু রয়ে গেছে। ২০১৯ সালে সেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা এখন ২৪ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে।
একই সঙ্গে মাথাপিছু প্রকৃত জিডিপি ২০২৬ সালের আগে ২০১৮ সালের স্তরে ফিরবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। অপুষ্টি, উচ্চ যুব বেকারত্ব এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধির কারণে দেশটি যেন একটি পুরো প্রজন্মকে হারাতে বসেছে।
আসলে আকাশছোঁয়া সুদের হার, টানা মূল্যস্ফীতি হ্রাস এবং চলমান ঋণ-সংকট নিয়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এখন এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের সঙ্গে লড়ছে।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৫ সালের আগস্টের মুদ্রানীতি প্রতিবেদনে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের গভীরতা স্বীকার করা হয়েছে। টানা তিনটি প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি হার নীতিনির্ধারকদের ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার নিচে ছিল।
সর্বশেষ তথ্য বলছে, বছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক থাকার পর তৃতীয় প্রান্তিকে তা সামান্য ইতিবাচক হয়েছে। তবু মানদণ্ড সুদের হার (বেঞ্চমার্ক ইন্টারেস্ট রেট) এখনো ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশে আটকে আছে।
যখন উৎপাদন সম্ভাবনার নিচে থাকে অথবা মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার নিচে থাকে, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত সুদের হার কমানো।
শ্রীলঙ্কায় এখন মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যসীমার নিচে। ২০১৭ সালের পর থেকে কাজের সুযোগ ও জনসংখ্যার অনুপাত প্রায় ৪ শতাংশ কমে গেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, অর্থনীতি তার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে সুদের হার দুই অঙ্কের ঘরে রাখাটা বিপজ্জনক।
আরও পড়ুনগণ–অভ্যুত্থানের শক্তির ক্ষমতার এক বছরে শ্রীলঙ্কা কী পেল০৯ অক্টোবর ২০২৫তবে পাঠ্যবইয়ের যুক্তির বাইরে, শ্রীলঙ্কায় সুদের হার কমানোর আরও বাস্তব কারণ আছে। সেটি হলো ঋণ-স্থিতি। ঋণ-জিডিপি অনুপাত কেবল বর্তমান আয় ও ব্যয়ের ওপর নির্ভর করে না, বরং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও পূর্বে নেওয়া ঋণের ওপর ধার্য সুদের ওপরও নির্ভর করে।
অনুপাত যত বড়, এই বিষয়গুলোর প্রভাব তত বেশি। বর্তমানে ঋণ-জিডিপি অনুপাত প্রায় ১০০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সুদের হার কিছুটা বাড়লেই ঋণ-স্থিতি ও ঋণের চাপের মধ্যে বড় পার্থক্য তৈরি হতে পারে।
উপরন্তু উচ্চ ঋণগ্রস্ত দেশগুলো বহু বছর ধরে জানে, ঋণ-জিডিপি অনুপাত নির্ধারণে কেবল ঋণের পরিমাণ নয়, জিডিপির মানও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত একাধিক বেলআউট গ্রহণ এবং কঠোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের পর গ্রিস মোট ঋণ ১৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার কমিয়েছে। এটি জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। কিন্তু জিডিপি দ্রুত কমে যাওয়ায় ঋণ অনুপাত ৩০ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে গেছে।
অর্থনীতি ঋণজট থেকে বের হওয়া যায় প্রবৃদ্ধি দিয়ে, অনন্ত কঠোরতা দিয়ে নয়। শ্রীলঙ্কা এর ব্যতিক্রম নয়। লক্ষ্যসীমার নিচে মূল্যস্ফীতি, স্থিতিশীল বৈদেশিক হিসাব এবং এখনো সূচনামাত্র বৃদ্ধি—এই সব অবস্থায় ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ হার রাখা অনৈতিক।শ্রীলঙ্কা একই সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। মন্দার সময় উচ্চ সুদের হার ঋণের খরচ বাড়ায় এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে দমন করে। অর্থনীতিতে এটাই সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার নামে কঠোরতা আরোপ যদি প্রবৃদ্ধির সুযোগ নষ্ট করে দেয়, তবে তা আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়ায়।
উচ্চ সুদের হার রাখলেও দাম বেশি কমে না, কারণ শ্রীলঙ্কায় পরিবারের মোট খরচের এক-তৃতীয়াংশের বেশি খাবারের পেছনে যায়। আর খাবারের দাম দেশীয় চাহিদা নয়—বিশ্ববাজার ও সরবরাহ পরিস্থিতির ওপর বেশি নির্ভর করে।
শ্রীলঙ্কার জন্য আরও বাস্তবসম্মত লক্ষ্য হওয়া উচিত। দেশটির উচিত অর্থপ্রবাহের ভারসাম্য স্থিতিশীল রাখা এবং মূলধনপ্রবাহের ওঠানামা এড়িয়ে চলা। কিন্তু যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য সত্যিই বৈদেশিক ভারসাম্য হয়, তবে তাদের জনসমক্ষে দেওয়া বিবৃতি তা স্পষ্টভাবে বোঝায় না।
আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৫ সালের চলতি হিসাব ঘাটতি নয়, উদ্বৃত্ত থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে। অর্থাৎ দেশটি বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে না, বরং জমাচ্ছে। ঋণ পরিশোধের পরও বছরের প্রথম দিকে সরকারি মোট রিজার্ভ ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি পৌঁছেছে। ২০২২ সালের শুরুর দিকে বড় হারে মুদ্রা অবমূল্যায়ন হওয়ার পর রুপি স্থিতিশীল রয়েছে।
মোটকথা, কোনো সম্ভাব্য অর্থায়ন সংকটের প্রমাণ নেই, যা আকাশছোঁয়া সুদের হারকে যৌক্তিক করতে পারে। অর্থনীতিতে অতিরিক্ত তারল্য থাকায় এখনই মুদ্রানীতি শিথিল করার জন্য পরিস্থিতি উপযুক্ত।
নীতিনির্ধারকেরা বলেন, ‘বিশ্বে অনিশ্চয়তা বাড়ছে’, তাই সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু এই যুক্তি ঠিক নয়। আসল বিষয় হলো এখন সুদের হার কত; আগে কত ছিল, তা বড় কথা নয়। সুদের হার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ হলে বিনিয়োগ কমবেই। এখানে এক বছর আগে হার তার চেয়ে বেশি ছিল কি না, সেটা কোনো কাজে আসে না।
উচ্চ সুদের হার ও বাড়তে থাকা বৈদেশিক রিজার্ভ শ্রীলঙ্কার বিদেশি পক্ষের স্বার্থ দেশের মানুষের ও ব্যবসার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু যদি অত্যন্ত কঠোর মুদ্রানীতি নতুন সংকট সৃষ্টি করে এবং আরেকটি ডিফল্ট হয়, তাহলে বিদেশি ঋণদাতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মূল্যস্ফীতি বা বৈদেশিক ভারসাম্য স্থিতিশীল করার বদলে, উচ্চ সুদের হার অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বিলম্বিত করছে এবং সরকারি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য এখনো দেরি হয়ে যায়নি। কয়েক বছরের স্থিত বা কমতে থাকা উৎপাদনের পর, ২০২৫ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ৪ দশমিক
৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি দেখাচ্ছে, সঠিক মুদ্রানীতির মাধ্যমে নতুন বৃদ্ধি সম্ভব।
অর্থনীতি ঋণজট থেকে বের হওয়া যায় প্রবৃদ্ধি দিয়ে, অনন্ত কঠোরতা দিয়ে নয়। শ্রীলঙ্কা এর ব্যতিক্রম নয়। লক্ষ্যসীমার নিচে মূল্যস্ফীতি, স্থিতিশীল বৈদেশিক হিসাব এবং এখনো সূচনামাত্র বৃদ্ধি—এই সব অবস্থায় ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ হার রাখা অনৈতিক।
● অর্জুন জয়দেব ভারতের আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমির পরিচালক; অহিলান কাদিরগামার জাফনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার এবং জে ডব্লিউ ম্যাসন নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির জন জে কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
স্বত্ব : প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ