চট্টগ্রামে পুলিশের ওপর হামলা, গ্রেপ্তার ২
Published: 15th, January 2025 GMT
চট্টগ্রাম মহানগরের চান্দগাঁও থানার রাস্তার মাথা নামক চেকপোস্টে গাড়ি তল্লাশিকালে পুলিশ সদস্যদের উপর হামলার ঘটনায় ৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় জড়িত দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) রাত ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- বায়েজিদ কুঞ্জছায়া আবাসিক এলাকার মনছুর আহমেদ এর ছেলে মো.
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগ থেকে এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) সকালে পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চান্দগাঁও থানার এএসআই অসিত নাথ ফোর্সসহ কাপ্তাই রাস্তার মাথার মোহরা পুলিশ চেকপোস্টে ডিউটি করছিলেন। এ সময় তল্লাশিকালে মো. মোরশেদ ও মো. করিম নামের দুই ব্যক্তি পুলিশের উপর হামলা করে। এতে এক এসআইসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। তারা হলেন– এসআই মো. হাবিবুর রহমান, এএসআই অসিত নাথ, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার, মো. আমিরুল ইসলাম ও ফরিদ শেখ। পরে ওই দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, পুলিশের সরকারি কাজে বাধা প্রদান ও পুলিশের উপর আক্রমণ করে গুরুতর জখম করায় মোরশেদ ও করিমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকা/রেজাউল/ইমন
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
বিজয়যাত্রার সূচনা হলো সর্বাত্মক যুদ্ধে
‘৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিকেলে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে আমার দপ্তরে কাজ করছি। সন্ধ্যা ছয়টায় টেলিফোন বেজে উঠল। ফোন করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ। দিল্লি থেকে জানালেন, পাকিস্তান পশ্চিমে আমাদের বেশ কয়েকটি বিমানঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।’
এভাবেই ১৯৭১ সালে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটা বর্ণনা করেছেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। বিষয়টি কলকাতায় অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করার জন্য তাঁকে নির্দেশ দিলেন জেনারেল মানেকশ। লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা তা-ই করলেন। দ্রুত তিনি চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবকে ডেকে সব ফিল্ড কমান্ডারকে সতর্ক করে দিতে বললেন। সেই সঙ্গে একটি স্টাফ কনফারেন্স আয়োজন করতে বলে ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করতে নিজে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন রাজভবনে।
ইন্দিরা গান্ধী তখন ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের বিশাল জনসভায় ভাষণ শেষে রাজভবনে অবস্থান করছিলেন। সেখানে রাজ্যপাল এ এন ডায়াসের সঙ্গে সীমান্ত পরিস্থিতি ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচির অগ্রগতি বিষয়ে খোঁজখবর নেন। এরপর বক্তব্য দেন শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের এক বৈঠকে।
অরোরা রাজভবনে গিয়ে দেখেন ইন্দিরা গান্ধী বৈঠক শেষে নিজের কামরায় ফিরেছেন। দরজায় কড়া নেড়ে তিনি ভেতরে ঢুকে সেনাপ্রধানের বার্তা পৌঁছে দেন। তবে তিনি বুঝতে পারেন, ততক্ষণে মুখ্য সচিব এন সি সেনগুপ্তের মাধ্যমে জরুরি তারবার্তায় পাকিস্তানি বিমান হামলার খবর জেনে গেছেন ইন্দিরা গান্ধী।
এ বিষয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন তৎকালীন ভারতীয় উপসচিব ও পরে পররাষ্ট্রসচিব জে এন দীক্ষিত। তিনি লিখেছেন, ‘৩ ডিসেম্বর বিকেলের মধ্যেই মিসেস গান্ধী কলকাতায় তাঁর কাজ সারেন। একটি বিশেষ উড়োজাহাজে তিনি দিল্লির উদ্দেশে কলকাতা ছাড়েন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বা সাতটায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ডি পি ধর, পশ্চিমবঙ্গের দু-একজন রাজনীতিক এবং আমার ও পিটার সিনাইয়ের মতো মধ্য পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা, যাঁরা বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করেন।’
জে এন দীক্ষিত লিখেছেন, ‘বিমানটি লক্ষ্ণৌর কিছুটা পূর্বাকাশে পৌঁছালে পাইলট ডি পি ধরের কাছে এসে বলেন, তাঁকে একবার ককপিটে যেতে হবে। কারণ, দিল্লি থেকে একটি জরুরি বার্তা এসেছে, ধর সাহেবকে একটু কথা বলতে হবে। তিনি তিন থেকে চার মিনিট ককপিটে অবস্থান করে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে নিজের আসনে ফিরে এলেন।’ পাকিস্তানের হামলার বিষয়টি বর্ণনা করে জে এন দীক্ষিত লিখেছেন, ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ইতিমধ্যে পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছেন। পাকিস্তানের বিমান হামলার আশঙ্কায় ভারতের উত্তর ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকায়ই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
মিসেস গান্ধীর বিমান লক্ষ্ণৌতে বিরতি দিয়ে দিল্লিতে অবতরণ করে। দিল্লিতে ফিরে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এরপর দেশবাসীর উদ্দেশে মধ্যরাতে বেতার ভাষণ দেন ইন্দিরা গান্ধী। সেই ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই, কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’
সর্বাত্মক অভিযান শুরু৩ ডিসেম্বরের এই হামলার আগের সাতটি সপ্তাহ তীব্র প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের গেরিলা আক্রমণ এবং বিভিন্ন সেক্টরে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর সীমান্ত চাপ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নাজেহাল করে ফেলেছিল। এর মধ্যে ২১ নভেম্বর যশোরের গরিবপুর-বয়রায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ অভিযানে পরাজিত হয় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ব্রিগেড। প্রত্যক্ষ এই সামরিক হস্তক্ষেপের পর পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ ভারতকে ‘আক্রমণকারী’ হিসেবে তুলে ধরে বিশ্ব-জনমত তৈরির জোর চেষ্টা চালাতে থাকেন। এর মধ্যেই ২ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানের সাতটি ফ্রন্টে বাড়তি তিন ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করে ভারত।
কৌশলগত এই টানাপোড়েন যখন তুঙ্গে, তখনই ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা ১৭ মিনিটে ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর, আগ্রাসহ সাতটি স্থানে অতর্কিতে একযোগে হামলা চালায় পাকিস্তান বিমানবাহিনী। এরপর রাত ৮টায় জম্মু ও কাশ্মীরে দক্ষিণ-পশ্চিম ছামব ও পুঞ্চ সেক্টরে ব্যাপক স্থল অভিযান শুরু করে।
বাংলাদেশের চলমান মুক্তিসংগ্রাম দমন করতে পাকিস্তানি বাহিনীর এই আক্রমণে মুক্তিযুদ্ধ নতুন মোড় নেয়। সেদিন রাতেই মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করে। গভীর রাতে ঢাকা এবং কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের ওপর হামলা চালায় ভারতীয় জঙ্গিবিমান। বিপর্যস্ত হয়ে যায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনী।
কৃষ্ণনগর, শিলিগুড়ি আর গুয়াহাটিতে ছয় ডিভিশন স্থলসৈন্যর সমাবেশ ঘটিয়েছিল ভারত। একই সঙ্গে বাংলাদেশের যোদ্ধাদের নিয়ে পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম, উত্তর, উত্তর-পূর্ব এবং পূর্ব সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে ভারতীয় সৈন্যরা। ৪ ডিসেম্বর খুব ভোর থেকেই স্থলবাহিনী একযোগে আক্রমণ চালায় পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর। শহরগুলোর বাইরে যেসব জায়গায় পাকিস্তানিরা ঘাঁটি গেড়েছিল, তার ওপরও অভিযান চালাতে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতের নৌবাহিনীর শক্তি এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা। মুক্তিযোদ্ধারা গোপন সহায়তা ও স্থানীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে যৌথ বাহিনীকে দ্রুত এগিয়ে যেতে সহায়তা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার ১৯৭১: ভেতরে বাইরে বইয়ে লিখেছেন, ৩ ডিসেম্বর শেষ রাতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী একত্র হয়ে যৌথভাবে আক্রমণ শুরু করার পর পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর যে কয়টি যুদ্ধবিমান ছিল, সেগুলো তারা যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেনি। ভারতীয় বিমানবাহিনী সেগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ করে বেশির ভাগই অকেজো করে দেয় অথবা সেগুলো ব্যবহার করার জন্য যেসব রানওয়ে ছিল, তা ধ্বংস করে ফেলে।
সব মিলিয়ে এই সম্মিলিত শক্তির মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান অল্প সময়েই দুর্বল হয়ে পড়ে। যুদ্ধ শুরুর পর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর বিজয় নিয়ে কোনো মহলে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। সেই মুহূর্তে চলতে থাকে কূটনৈতিক যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র ৪ ডিসেম্বর যুদ্ধের জন্য সরাসরি ভারতকে দোষী ঘোষণা করে জাতিসংঘকে অনুরোধ করে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকতে। এতে অধিকাংশের ভোটে ঠিক হয় যে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হোক। কিন্তু সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভেটো দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাকে সমর্থন করে পোল্যান্ড। ফলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় না।
৩ ডিসেম্বরের সর্বাত্মক যুদ্ধ এগিয়ে চলে বিজয়ের পথে।
তথ্যসূত্র:
১. প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪
২. একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি, সম্পাদক: সাজ্জাদ শরিফ, প্রথমা প্রকাশন
৩. ১৯৭১: ভেতরে বাইরে, এ কে খন্দকার, প্রথমা প্রকাশন
৪. যুগান্তর, ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১