রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুর-অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে জানিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। পাশাপাশি সরকারের অভিমত, পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধের সৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এ ঘটনা ঘটেছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এমন মন্তব্য করা হয়। বলা হয়, গত ছয় মাসে ৩২ নম্বর বাড়িটিতে কোনো ধরনের আক্রমণ, ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি। গত বুধবার রাতে এটি ঘটেছে পলাতক শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে যার দুটি অংশ আছে। 

একটি অংশ হলো, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা আত্মদান করেছেন শেখ হাসিনা তাদের অপমান করেছেন, অবমাননা করেছেন। শহীদের মৃত্যু সম্পর্কিত অবান্তর, আজগুবি ও বিদ্বেষমূলক কথা বলে পলাতক শেখ হাসিনা জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে অবজ্ঞা করেছেন ও অশ্রদ্ধা জানিয়েছেন। 

দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অমানবিক প্রক্রিয়ায় নিপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতায় থাকাকালীন যে সুরে কথা বলতেন গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়ার পরও তিনি একই হুমকি-ধমকির সুরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া প্রতিটি মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলে চলেছেন, হুমকি দিচ্ছেন। দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির হুমকি দিয়েছেন। 

মানুষের মনে জুলাই গণহত্যা নিয়ে যে ক্ষত রয়েছে সে ক্ষততে শেখ হাসিনা একের পর এক আঘাত করে চলেছেন। তাঁর এই সহিংস আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার দেশ ও জনগণের জানমালের রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্ক আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বাত্মকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার যথাযথ চেষ্টা করছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে একজন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি শেখ হাসিনা বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব। 

সরকার আশা করে, ভারত যেন তার ভূখণ্ডকে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এমন কাজে ব্যবহৃত হতে না দেয় এবং শেখ হাসিনাকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ না দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার  ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না। 

এতে বলা হয়, জুলাই হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিল তাদের বিচারকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। এই বিচার নিশ্চিত করে গণহত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কী কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা সরকার খতিয়ে দেখবে।
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ধ নমন ড গণঅভ য ত থ ন কর ছ ন সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নোবেল শান্তি পুরস্কার যেভাবে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিল ভেনেজুয়েলাকে

গত ১০ অক্টোবর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত।

মাচাদো নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পরপরই ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে গোপন ও প্রকাশ্য সামরিক আগ্রাসন বাড়াতে শুরু করেছে।

মাচাদোর নোবেল পাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিআইএকে দেশটিতে গোপন অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন।

অক্টোবরের শেষ দিকে বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভেনেজুয়েলার কাছাকাছি ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হচ্ছে। ১৩ নভেম্বর ট্রাম্পকে সামরিক অভিযানের বিভিন্ন বিকল্প সম্পর্কে অবহিত করা হয়।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভেনেজুয়েলায় সরকার উৎখাতের প্রচেষ্টা জোরদার করে। ‘অস্তিত্বহীন’ ‘কার্টেল দে লোস সোলেস’কে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করা হয়। দাবি করা হয় যে এর নেতৃত্বে রয়েছেন ভেনেজুয়েলা সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুনএ–ই যদি হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা...১২ অক্টোবর ২০২৫

একই সঙ্গে ওই অঞ্চলে একটি বিমানবাহী রণতরি পাঠানো হয়। শুরু হয় ভেনেজুয়েলার সরকারের বিরুদ্ধে ‘নতুন ধাপের’ অভিযান। যার মধ্যে রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও। ২০১৩ সাল থেকে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর নেতৃত্বে প্রশাসন দেশটির বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টি প্রতিহত করে আসছে। তারা ওয়াশিংটনের আঞ্চলিক হস্তক্ষেপেরও নিন্দা করেছে, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক অবস্থানের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে।

এখন ভাবা যাক, নোবেল কমিটি কাকে সম্মানিত করল! স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে, যিনি ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদ ও গণহত্যামূলক জায়নবাদকে সমর্থন করেন, এমন একজন রাজনীতিককে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার আগে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি নিশ্চয়ই দ্বিতীয়বার ভাববে। বিশেষ করে সেই পুরস্কারের জন্য যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও যথেষ্ট প্রচারণা চালিয়েছেন! যাঁরা দুজনেই আবার ঘৃণা ও যুদ্ধের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত।

যে পুরস্কার হেনরি কিসিঞ্জারের মতো যুদ্ধাপরাধীদের দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর মতো কিংবদন্তি অহিংস বিপ্লবী নেতাকে দেওয়া হয়নি, সে পুরস্কার অনেক আগেই তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তা ঘটেছে নোবেল কমিটি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদ ও সামরিক শক্তির হাতিয়ার হয়ে ওঠারও অনেক আগেই।

কিন্তু নোবেল কমিটিকে নিয়ে সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে! কারণ, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মাচাদো ভেনেজুয়েলার এমন এক রাজনীতিক, যিনি ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের প্রতি অত্যন্ত অনুগত, গণহত্যামূলক জায়নবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং লাতিন আমেরিকায় ট্রাম্পের পুনর্দখল নীতির দৃঢ় সমর্থক। এসব ‘উজ্জ্বল যোগ্যতার’ কারণেই সুইডেন ও নরওয়ের পুরোনো বৈশ্বিক আধিপত্যের প্রতিনিধিত্বকারী ইউরোপীয় অভিজাত গোষ্ঠীর প্রবীণেরা তাঁকে এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছেন।

তথাকথিত বিরোধীদলীয় নেতাদের নোবেল দেওয়ার বড় সমস্যা হলো, এ স্বীকৃতির ফলে তাঁরা নিজেদের জনগণের কাছেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। যার উদাহরণ দেখা গেছে ইরানি বংশোদ্ভূত দুই মানবাধিকারকর্মী শিরিন এবাদি ও নার্গিস মোহাম্মাদির ক্ষেত্রে। নোবেল পাওয়ার আগে তাঁরা সত্যিই পরিবর্তনের জন্য প্রভাব ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিলেন। কিন্তু এ ধরনের ঝলমলে পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁরা নিজেদের দেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মুখপাত্রে পরিণত হয়েছেন।

আরও পড়ুনশান্তিতে নোবেল পুরস্কার বনাম সমরাস্ত্রের সম্ভার০১ জানুয়ারি ২০১৩কিসের ভিত্তিতে এই সম্মানিত করার ক্ষমতা

মাচাদোকে সম্মানিত করা নোবেল কমিটির সিদ্ধান্ত শুধু তথাকথিত ‘শান্তি পুরস্কার’ নিয়েই নয়, আরও অনেক বড় প্রশ্নের জন্ম দেয়।

যে পুরস্কার হেনরি কিসিঞ্জারের মতো যুদ্ধাপরাধীদের দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর মতো কিংবদন্তি অহিংস বিপ্লবী নেতাকে দেওয়া হয়নি, সে পুরস্কার অনেক আগেই তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তা ঘটেছে নোবেল কমিটি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদ ও সামরিক শক্তির হাতিয়ার হয়ে ওঠারও অনেক আগেই।

এই পুরস্কারের পেছনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে পদার্থ, রসায়ন ও অর্থনীতিতে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস; চিকিৎসাবিজ্ঞানে কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট; সাহিত্যে সুইডিশ একাডেমি এবং শান্তিতে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি।

এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম শুনতে যতটা সরকারি ও গৌরবময় মনে হয়, বাস্তবে দীর্ঘদিনের বিতর্কিত ও লজ্জাজনক সিদ্ধান্তের ইতিহাস তাদের সব বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে দিয়েছে। বিশ্বকে অবশ্যই নোবেল পুরস্কারের ধারণা ভেঙে ফেলতে হবে। এই পুরস্কার অনেক আগেই তার সব অর্থ ও গুরুত্ব হারিয়েছে। সাহিত্য ও শান্তি—উভয় ক্ষেত্রেই নোবেল কমিটির বহু সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অর্থহীন।

আরও পড়ুনগাজা যুদ্ধ থামিয়েও ট্রাম্প নোবেল পেলেন না কেন১২ অক্টোবর ২০২৫

নোবেল পুরস্কার আসলে একটি ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান, যা নিজেকে সর্বজনীন বলে জাহির করে পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার আধিপত্য রক্ষা করে যাচ্ছে। এই ভান আর মেনে নেওয়া যায় না।

গাজার দিকে তাকান, সেখানেই যেন আমাদের মানবতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আর শান্তির আহ্বানের মোট যোগফল দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে কি পুরস্কার দেওয়ার মতো কোনো কিছু অবশিষ্ট আছে? কিছুই নেই। ইউরোপের এই গোত্রীয় প্রদর্শনীর অবসান ঘটুক।

আজ বিশ্ব গভীর নৈতিক ও অস্তিত্বগত সংকটে নিমজ্জিত। নোবেল পুরস্কার এ সংকটের কোনো সমাধান নয়; বরং সেই সংকটেরই একটি উপসর্গ। আসুন, একে অপরকে পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করি। তার বদলে গাজা, সুদান ও বিশ্বের অন্য প্রান্তে পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসনে যাঁরা নিরপরাধ প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের জন্য কিছু সময় শোক পালন করি। ওই আগ্রাসন এখন ভেনেজুয়েলার দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে।

এই পৃথিবীতে আমরা ঠিক কী করছি! তা নতুন করে ভাবা ও পুনর্গঠন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারও কোনো নৈতিক অধিকার নেই অন্যকে সম্মানিত করার বা পুরস্কার দেওয়ার।

হামিদ দাবাশি লেখক, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নোবেল শান্তি পুরস্কার যেভাবে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিল ভেনেজুয়েলাকে