ওষুধ শিল্পে সংস্কার: চীন ও ভারত যেভাবে সাফল্য পেয়েছে, আমরা কেন পারব না
Published: 2nd, April 2025 GMT
ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) উৎপাদন এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। চীন ও ভারত এই খাতে বৈশ্বিক নেতৃত্ব অর্জন করেছে। তাদের সফলতার পেছনে মূলত ছিল সরকারি প্রণোদনা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও নীতিগত সংস্কার। এ সাফল্যের পেছনের কৌশল ও বাস্তবতা আমাদের জানা দরকার। সেই সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে বোঝা দরকার, এই খাতে বাংলাদেশের অবস্থা যেখানে অতি মূল্যায়িত মুদ্রা ও সীমিত সরকারি সহায়তা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথমে চীনের দিকে তাকানো যাক। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো মূলত মৌলিক ওষুধ উৎপাদনের মাধ্যমে চীনের ফার্মাসিউটিক্যাল বুনিয়াদ তৈরি করে। এরপর ১৯৮০ ও ’৯০-এর দশকে দেং শিয়াওপিংয়ের অর্থনৈতিক সংস্কারে গঠিত স্পেশাল ইকোনমিক জোন বিনিয়োগের পথ খুলে দেয়। এই সময়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাল্ক ড্রাগস উৎপাদন শুরু করে, যা পরে বড় আকারের এপিআই রপ্তানিতে রূপ নেয়।
ভারতে স্বাধীনতার পর (১৯৫০-১৯৭০) পর্যন্ত উচ্চ শুল্ক আর আমদানি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প সুরক্ষিত রাখা হয়। এতে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে ফর্মুলেশন তৈরিতে দক্ষ হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের পেটেন্ট আইনে পণ্য পেটেন্টের বদলে কেবল প্রক্রিয়া পেটেন্টকে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণে দেশি কোম্পানিগুলো বিভিন্ন বিকল্প পদ্ধতিতে বিদেশি ওষুধ উৎপাদনে সক্ষম হয়। এই জেনেরিক ওষুধবিপ্লব এপিআই খাতকেও সমৃদ্ধ করে তোলে।
চীন ও ভারত উভয়েই তুলনামূলকভাবে শিথিল মেধাস্বত্ব (আইপি) সুরক্ষার সুবিধা নিয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে ২০০৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ট্রিপস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য করার আগপর্যন্ত স্থানীয় নির্মাতারা ভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিদেশি ওষুধের অনুলিপি তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। চীনে ২০০১ সালে ডব্লিউটিওতে যোগদানের আগে এ–সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ ছিল অনেকটাই দুর্বল। ফলে পেটেন্টমুক্ত হওয়ার আগেই ওই ওষুধ সহজেই পুনরুৎপাদন করা যেত।
২০০০-এর দশক থেকে চীন তার পঞ্চবার্ষিক জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় ফার্মাসিউটিক্যাল স্বনির্ভরতার ওপর জোর দেয়। ২০০৮ সালে চালু হওয়া ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মেজর প্রজেক্ট ফর ড্রাগ ইনোভেশন প্রচুর পরিমাণে গবেষণা ও উন্নয়নের অর্থায়ন করেছে। পাশাপাশি ‘থাউজেন্ড ট্যালেন্টস’ বা সহস্র মেধা কার্যক্রমের আওতায় বিদেশে কর্মরত বা অধ্যয়নরত উচ্চ দক্ষতার বিজ্ঞানীদের আকর্ষণ করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। স্থানীয় সরকারগুলোও নিম্নমূল্যের জমি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ছাড় এবং অতীতে অপেক্ষাকৃত শিথিল পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে খরচ কমিয়ে রাখে। বর্তমানে পরিবেশগত নিয়মকানুন কিছুটা কঠোর হয়েছে, তবে দীর্ঘদিনের শিথিলতার সুযোগ নিয়ে অনেক কোম্পানি উৎপাদন খরচ কমাতে পেরেছে।
চীন বিভিন্ন সময়ে ট্যাক্স রিবেট ও আর্থিক ভর্তুকি দিয়েছে এপিআই রপ্তানিকারকদের। বিশেষ করে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট ফেরতের সুবিধা, হাইটেক অঞ্চলের করছাড়, স্বল্প সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, এমনকি নির্দিষ্ট রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ালে অতিরিক্ত আর্থিক অনুদান—সব মিলিয়ে তাদের রপ্তানি ব্যয় অনেকাংশে কমে গেছে। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের মুদ্রা রেনমিনবি প্রায় ২৮ শতাংশ অবমূল্যায়িত ছিল। এর ফলে বিদেশি বাজারে চীনা পণ্যের দাম ছিল তুলনামূলকভাবে সস্তা। অনেক গবেষণা অনুযায়ী, চীনে এপিআই উৎপাদন খরচ ভারতের চেয়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কম।
চীন ও ভারত উভয় দেশেই এপিআই খাতকে আরও গতিশীল করে তুলতে স্বল্প সুদে ঋণসুবিধা, ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ও গবেষণা অনুদান চালু রয়েছে। চীনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কম সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রস্তাব করে। অন্যদিকে ভারতেও উৎপাদন খাতকে উৎসাহ দিতে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা হয়েছে, যাতে উদ্যোগী ব্যক্তিরা সহজ শর্তে মূলধন সংগ্রহ করতে পারেন। এ ছাড়া উভয় দেশেই গবেষণা ও উদ্ভাবন কর্মসূচিতে বড় অঙ্কের অনুদান দেওয়া হয়, যার ফলে নতুন পণ্য উন্নয়ন ও উৎপাদনপ্রক্রিয়া উন্নতকরণে অগ্রগতি সহজতর হয়। স্বল্পমূল্যের উৎসে অর্থায়ন সম্ভব হওয়ায় এপিআই নির্মাতারা দ্রুত প্রযুক্তিগত সম্প্রসারণ ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে পারছেন।
অবকাঠামো ও ইউটিলিটি খাতেও চীন ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। অনেক শিল্পপার্ক ও স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে উঠেছে, যেখানে কম খরচের জমি, সাশ্রয়ী মূল্যের বিদ্যুৎ এবং যৌথ সলভেন্ট পুনরুদ্ধার ও বর্জ্য নিষ্পত্তির সুবিধা রয়েছে। আমদানিপ্রক্রিয়া সহজ করায় এপিআই উৎপাদনের সরঞ্জাম ও কাঁচামাল আনা দ্রুততর হয়েছে। ২০১০ সালে চীনের জিএমপি নিয়মকানুন আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক আইসিএইচ কাঠামোয় যুক্ত হওয়ায় বিশ্ববাজারে চীনা এপিআই অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
এর ফলে চীন আজ বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ এপিআই রপ্তানির জোগান দেয়। গত দুই দশকে চীনা এপিআই রপ্তানি প্রায় ১০ গুণ বেড়ে গেছে। এই সাফল্যের পেছনে কর প্রণোদনা, বিশাল অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং তুলনামূলক কম উৎপাদন ব্যয় মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
ভারতে রিয়াল ইফেকটিভ এক্সচেঞ্জ রেট (আরইইআর) প্রতিযোগিতামূলক রাখতে রিজার্ভ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, তবে চীনের মতো ব্যাপক অবমূল্যায়ন সেখানে খুব একটা দেখা যায় না। ২০২০ সালে চালু হওয়া প্রোডাকশন-লিংকড ইনসেনটিভ (পিএলআই) স্কিমের অধীন নির্দিষ্ট এপিআই ও ইন্টারমিডিয়েট উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়। পরিবেশগত ছাড়পত্রের প্রক্রিয়াও দ্রুততর করা হয়েছে। নির্দিষ্ট উৎপাদন ও বিনিয়োগের শর্ত পূরণ করলে এপিআই/ইন্টারমিডিয়েটের জন্য প্রায় ১২ শতাংশ এবং ফারমেন্টেশন পণ্যের জন্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ফর্মুলেশন প্রাইসিং পলিসিতে সুবিধা, অবকাঠামো খাতে মর্যাদা প্রদান, বিদ্যুৎ ও পানি খরচ অর্ধেক করার প্রস্তাব ইত্যাদি উদ্যোগ রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশি টাকা (বিডিটি) অতি মূল্যায়িত। আইএমএফের হিসাবে এটি প্রায় ২৫ শতাংশ অধিক মূল্যে রয়েছে, যা রপ্তানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। রপ্তানি শক্তিশালী করতে মুদ্রার মান সমন্বয়ের সুপারিশ করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেনি। এর ফলে শিল্প খাত, বিশেষ করে এএপিআই উৎপাদন, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ এপিআই অ্যান্ড ইন্টারমেডিয়ারিজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাইমা) সরকারের সঙ্গে ২০১৮ সাল থেকে আলোচনা করছে। দেশে দৃশ্যমান কোনো উল্লেখযোগ্য করছাড়, ভর্তুকি বা প্রশাসনিক সুবিধা নেই। তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালালেও সময় উপযোগী সুনির্দিষ্ট নীতি বা আর্থিক প্রণোদনা এখনো সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করা যায়নি।
সব মিলিয়ে বলা যায়, এপিআই সেক্টরের বিকাশে চীন ও ভারত যে রূপরেখা অনুসরণ করেছে, তাতে অনেকগুলো বিষয় একত্রে কাজ করেছে, যেমন প্রাথমিক পর্যায়ে শিথিল পেটেন্ট আইন, সরকারি বিনিয়োগ, করছাড়, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো ও ইউটিলিটি পুঁজি এবং মানসম্মত নিয়ন্ত্রক কাঠামো। চীনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ, বড় শিল্পপার্ক ও অবমূল্যায়িত মুদ্রার প্রভাবে উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। অন্যদিকে ভারত প্রোডাকশন-লিংকড ইনসেনটিভসহ বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়ে নিজেদের এপিআই সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আর বাংলাদেশে অতি মূল্যায়িত মুদ্রা ও জুতসই সরকারি সহযোগিতার অভাবে এই খাত প্রত্যাশিত সাফল্য পাচ্ছে না।
এস এম সাইফুর রহমান সভাপতি, বাংলাদেশ এপিআই অ্যান্ড ইন্টারমেডিয়ারিজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাইমা)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অবক ঠ ম আর থ ক স ফল য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এই ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ কলোনি’ হিসেবে লুণ্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজি পাচার ও অমানুষিক নিপীড়নের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল, সে সম্পর্কে নিচে কয়েকটি নজির উপস্থাপন করছি। এগুলো জানার পর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কারোরই পাকিস্তানপ্রেমী হওয়া অযৌক্তিক। কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবিরোধী হয়, সেটাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করলে দোষণীয় নয়। কিন্তু পাকিস্তান তো এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি।
১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ, কিন্তু উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তগুলো প্রমাণ করছে, কত নির্মমভাবে পাকিস্তানের শাসকমহল পূর্ব পাকিস্তানকে (‘পূর্ব বাংলা’ থেকে যার নাম ১৯৫৫ সালে হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’) বঞ্চনা, শোষণ, লুণ্ঠন, পুঁজি-পাচার ও বৈষম্যের শিকার করেছিল—
১. প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের ৭৫-৭৭ শতাংশই আসত পূর্ব বাংলার রপ্তানি পণ্য থেকে। ওই রপ্তানি আয়ের প্রায় পুরোটাই ১৯৪৭-৪৮ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নিতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল, তখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দ করা হলেও ১৯৪৭-১৯৭১ এই ২৪ বছরের শেষে এসেও কখনোই বছরে রপ্তানি আয়ের এক-পঞ্চমাংশও পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের ভাগে পায়নি, এই ২৪ বছরের গড় বার্ষিক হিস্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।
২. ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ২৪ বছরে ওই বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর ওই ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল দাতাদেশ ও সংস্থাগুলো নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি৩. পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল, তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতারা পেয়েছে, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা কবজা করে নিয়েছেন।
৪. ওই ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে।
৫. ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে।
৬. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানিদের অনুপাত কখনোই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি ৫ শতাংশেও পৌঁছায়নি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
৭. ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্পকারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকি ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা নয়তো অবাঙালিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্পকারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না।
৮. মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছিল পাকিস্তানে।
৯. ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা।
১০. যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার।
১১. পাকিস্তানের তিনটা রাজধানী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের বিপুল নির্মাণ ব্যয়ের সিংহভাগই বহন করেছিল পূর্ব পাকিস্তান।
১২. ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ ও এর শাখাগুলোতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে। এ কারণে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি ১৯৭০ সালে সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে ওই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হয়েছিল। উপরন্তু আর্থিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যার সমাধানে অর্থায়ন করতে বারবার অস্বীকার করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।
স্বাধীনতা-উত্তর ৫৪ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন বারবার বিঘ্নিত হলেও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৫ সালে ২ হাজার ৭৫০ ডলার ছাড়িয়েছে, অথচ পাকিস্তানের মাত্র ১ হাজার ৫৪৭ ডলার। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য কতখানি যৌক্তিক ছিল।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার সরকারের মতো ভারতের কাছে নতজানু হবে না, সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার প্রায় তিন পাশ ঘিরে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় না রাখলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি।
ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়