পুকুর খননের আগ্রাসন থামাতেই হবে
Published: 9th, October 2025 GMT
‘ধান-চালের জেলা’ হিসেবে পরিচিত নওগাঁ দিন দিন তার কৃষি-ঐতিহ্য হারাচ্ছে। কৃষকদের একপ্রকার বাধ্য করে বা জোরপূর্বক ফসলি জমি ইজারা নিয়ে সেখানে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছেন প্রভাবশালীরা। একসময় যেখানে বোরো, আমন ধান, পাট ও শর্ষের মতো অর্থকরী ফসল ফলত, আজ সেখানে কেবলই মাছের চাষ। মাছ চাষও আমাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য জরুরি। কিন্তু কৃষি ও কৃষককে হুমকির মুখে ফেলে যেভাবে জেলাটিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে, তাতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
কৃষি দপ্তরের হিসাব অনুসারে, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এক দশকে জেলার প্রায় ৪ শতাংশ তিন ফসলি জমি পুকুরের পেটে চলে গেছে। বিশেষত রানীনগর ও আত্রাই উপজেলার মতো কৃষিপ্রধান এলাকায় এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। প্রভাবশালী মাছচাষিরা কৃষকদের জমির চারপাশে পুকুর খনন করায় উঁচু পাড়ের বহু কৃষকের জমিতে সারা বছরই পানি আটকে থাকছে। ফসল নষ্ট হওয়ায় তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন পুকুর খননকারীদের কাছে জমি ইজারা দিতে। কৃষকদের অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের (সাবেক সংসদ সদস্যদের) প্রশ্রয়ে এবং প্রশাসনের ‘ম্যানেজ’ করার মাধ্যমে যথেচ্ছভাবে এই পুকুর খনন চলছে। নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) স্বীকার করেছেন, ফসলি জমিতে পুকুর খনন ঠেকাতে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। দুর্বল নজরদারির সুযোগেও রাতারাতি পুকুর খনন হয়ে যায়।
বাণিজ্যিক মাছ চাষের জন্য শত শত কৃষককে ফসল আবাদ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অনেক কৃষককে এখন দিনমজুরি করে সংসার চালাতে হচ্ছে। ইজারার টাকা দিয়ে চাল-খড়-সবজি সবই কিনতে হচ্ছে। যে কারণে এক কৃষকের জিজ্ঞাসা, ‘খালি মাছ খ্যায়ে কি আমাগের প্যাট ভরবে?’ বিলে যত্রতত্র পুকুর খোঁড়ার কারণে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা জলাবদ্ধতাকে স্থায়ী রূপ দিচ্ছে। সরকারি সংস্থা বিএমডিএর জরিপ অনুযায়ী বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নিচে নামছে। উপরন্তু পুকুরের মাছের ঘা সারাতে ব্যবহৃত লবণের কারণে আশপাশের ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। আবাদি জমি কমে যাওয়ায় কৃষিশ্রমিকেরা বিশেষত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা কাজ হারাচ্ছেন, যা তাঁদের শহরমুখী হতে বাধ্য করছে।
মাছের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের কথা বলা হলেও তা তিন ফসলি জমিকে বলি দিয়ে সেটা হতে পারে না। প্রস্তাবিত ‘কৃষিজমি সুরক্ষা আইন ২০১৬’ অবিলম্বে পাস করে তিন ফসলি জমিতে পুকুর বা আমবাগানসহ যেকোনো ধরনের রূপান্তর আইনগতভাবে বন্ধ করতে হবে। বিদ্যমান ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩’ অনুযায়ী অন্যের জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো হোক। উন্নয়নের নামে সর্বনাশ বন্ধ করতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ক র খনন
এছাড়াও পড়ুন:
রংপুর-গাইবান্ধায় জনস্বাস্থ্য নিয়ে নতুন উদ্বেগ
উত্তরবঙ্গে রংপুর ও গাইবান্ধার মতো জেলায় মানুষের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপস্থিতি শনাক্তের ঘটনায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এর আগে দেশের ১৪টি জেলায় অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হলেও রংপুরে এই প্রথম সংক্রমণ দেখা দিল। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এই জীবাণু ছড়ানোর কারণ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সময়োপযোগী। তবে এটিও বলতে হয় যে অ্যানথ্রাক্সের মতো পুরোনো রোগ মোকাবিলায় আমাদের নজরদারি, সতর্কতা ও সমন্বিত উদ্যোগ এখনো যথেষ্ট নয়।
অ্যানথ্রাক্সের মতো রোগ সাধারণত মেহেরপুর বা সিরাজগঞ্জের মতো কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। এখন রংপুরের পীরগাছা, মিঠাপুকুর এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে অর্ধশতাধিক মানুষের শরীরে উপসর্গ দেখা যাওয়ার ঘটনা এ অঞ্চলের জনস্বাস্থ্যঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু ১০০ বছর পর্যন্ত মাটিতে টিকে থাকতে পারে। যখন গরু, ছাগল বা মহিষ চারণের সময় কচি ঘাসের সঙ্গে মাটি গ্রহণ করে, তখন তারা সংক্রমিত হয়। এরপর এই আক্রান্ত প্রাণীর মাংস, রক্ত বা পশমের সংস্পর্শে এলেই মানুষের মধ্যে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ঘটে। ওই সব এলাকায় গবাদিপশু কোথা থেকে আসছে, সেটি জানার চেষ্টা করছেন রোগতত্ত্ববিদেরা। এর মাধ্যমে হয়তো সংক্রমণের উৎস এবং তা নতুন এলাকায় ছড়ানোর কারণ জানা সম্ভব হবে।
অ্যানথ্রাক্স যেহেতু প্রাথমিকভাবে একটি প্রাণিজ রোগ, তাই এর মোকাবিলায় শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ নয়, প্রাণিসম্পদ বিভাগকেও সমানভাবে সক্রিয় হতে হবে। রংপুর-গাইবান্ধা অঞ্চলে গবাদিপশু কোথা থেকে আসে, সেই সরবরাহ শৃঙ্খলে কঠোর নজরদারি এবং নতুন এলাকায় প্রবেশের আগে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আক্রান্ত প্রাণীর লক্ষণ (যেমন জ্বর, শ্বাসকষ্ট, আলকাতরার মতো কালো রক্ত বের হওয়া) এবং মানুষের ত্বকের ক্ষতে সংক্রমণ (কালো ঘা) দেখা দেওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এই রোগ দ্রুত প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ায়, তাই আক্রান্ত পশুর দ্রুত টিকাদান ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য জরুরি সাধারণ জনগণ, কৃষক ও পশু পালনকারীদের মধ্যে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত পশু জবাই না করা এবং তার মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকার জন্যও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
অ্যানথ্রাক্স নিয়ে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার চেয়ে সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি। দেশের পুরোনো ও নতুন অ্যানথ্রাক্স-প্রবণ এলাকায় নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ যথেষ্ট নয়। নতুন করে সংক্রমণের কারণ অনুসন্ধানের ফলাফল দ্রুত প্রকাশ করে সে অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রাণিসম্পদ বিভাগকে সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তা করতে গিয়ে সময়ক্ষেপণ করার সুযোগ নেই।