বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি
Published: 23rd, November 2025 GMT
আলোচনা
ফখরুল আমীন
সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকম্প আসলে সরাসরি আমাদের ক্ষতি করে না; ক্ষতি করে আমাদের বানানো স্থাপনাগুলোর। ভূমিকম্প মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় কাজ হলো স্থাপনাগুলো ঠিকঠাকভাবে, উপযুক্ত নিয়ম মেনে বানানো। যে ভবন ইতিমধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে, তার জন্য আলাদা চিন্তা আছে; আর ভবিষ্যতে যে ভবন হবে, তার জন্য আবার অন্য পরিকল্পনা দরকার। এখানে মালিকই সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার। কারণ ঠিকাদার, শ্রমিক বা কারিগরদের দক্ষতা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব তাঁরই। ভালো কারিগর খুঁজে এনে ঠিকঠাকভাবে কাজ করানো উচিত মালিকেরই কাজ।
ভবনের দুটি দিক—ডিজাইন আর ইমপ্লিমেন্টেশন। ডিজাইনে আমরা মোটামুটি মান বজায় রাখলেও কাজের মাননিয়ন্ত্রণে ঘাটতি থেকে যায়। নতুন ভবন আর পুরোনো ভবন—দুটির জন্যই আলাদা পরিকল্পনার
প্রয়োজন। তবে মানুষের প্রয়োজন একরকম আর ইঞ্জিনিয়ার ও পরিকল্পনাবিদেরা বলেন আরেকভাবে। অথচ সবার লক্ষ্য একই—কেউই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চান না।
অন্য দেশের নিয়ম আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় পুরোপুরি খাটে না। ইঞ্জিনিয়ারিং সমাধান সব ক্ষেত্রে সম্ভব হলেও অনেক সময় ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। মাইক্রোজোনিং করা কঠিন, যদিও বড় শহরগুলোতে প্রয়োজন। বিএনবিসি কোড অনেক বিষয় উল্লেখ করেছে; কিন্তু বাস্তবায়নটাই আসল চ্যালেঞ্জ। নানা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কারণে কাজ করা কঠিন, তবুও ধীরে ধীরে এগোতে হবে।
স্থাপনার ওজন কমানোও গুরুত্বপূর্ণ। ওজন যত কম, ক্ষতির আশঙ্কাও তত কম। জাপানে এখনো স্টিলের বিল্ডিং বেশি হয়। কারণ, সেগুলো ভূমিকম্পে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। ভূমিকম্প মোকাবিলায় সচেতনতা, সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, এ তিনটি বিষয় সবচেয়ে জরুরি।
সেখ ফরিদ আহমেদযুগ্ম সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়
এটি অনস্বীকার্য যে আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবেই উচ্চ ভূমিকম্পপ্রবণ। গবেষণালব্ধ তথ্য বলছে, আমাদের শহুরে ভবনগুলোর মধ্যে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বড় আকারের ভূমিকম্পের পর অগ্নিকাণ্ড প্রায় অবশ্যম্ভাবী এক ঝুঁকি, যা বহুলাংশে ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়ে দেবে। এই কাঠামোগত দুর্বলতার পেছনে রয়েছে প্রতিটি স্তরে জমে থাকা সমস্যা। এ ক্ষেত্রে প্রকৌশলীদের পক্ষ থেকে নির্মাণ কোড অনুযায়ী জ্ঞানের সঠিক প্রয়োগ জরুরি।
সরকারি প্রস্তুতির বিষয়ে আমাদের বাস্তবতাকে নির্মোহভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও আনসারের মতো প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত থাকলেও আমাদের এই বর্তমান সক্ষমতা একটি বৃহৎ মাত্রার ভূমিকম্প মোকাবিলায় পর্যাপ্ত নয়, এই সত্য আমাদের স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই। ভূমিকম্পের সময় জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিও বিদ্যমান।
তবে ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার আইন ও নীতিগত কাঠামো প্রণয়নে বদ্ধপরিকর। ভূমিকম্প–সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা এবং বিশেষত বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা একটি নিরাপদ অবকাঠামো নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। এই বিশাল সমস্যার সমাধানে শুধু রাষ্ট্রের ভূমিকা নয়, একটি সার্বিক ও সমন্বিত পদ্ধতি অপরিহার্য। শুধু রাষ্ট্রকে দোষারোপ না করে আমাদের প্রতিটি নাগরিককেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। ঝুঁকি মোকাবিলায় মাঠপর্যায়ে অংশীজনরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন—যেমন জরুরি সেবাদানকারী সংস্থা, ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও আনসার, মাঠপ্রশাসন, স্থানীয় নেতৃত্ব, রাজনৈতিক নেতারা, স্বেচ্ছাসেবক ও সামাজিক শক্তি, আমাদের নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবকেরা এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, উন্নয়ন সহযোগী ও এনজিও, লোকাল ও আন্তর্জাতিক এনজিও এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। সব অংশীজনের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া কোনো টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।
রাকিব আহসানঅধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকম্প প্রতিরোধে শুধু একটি ভবন শক্তিশালী হলেই চলবে না; পাশের ভবন দুর্বল হলে আমরাও ঝুঁকিতে পড়ব। তাই পুরো নগরের ভূমিকম্প-সহনশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবনে উপকরণের মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একই ডিজাইনের দুটি ভবনের একটি দাঁড়িয়ে আছে, আরেকটি ভেঙে পড়েছে—শুধু ম্যাটেরিয়াল কোয়ালিটির পার্থক্যের কারণে।
আমাদের দেশে ভবনগুলো অধিকাংশ রিইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে নির্মিত। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ দুটি—রড ও কংক্রিট। কংক্রিট একক উপকরণ নয়; এটি সিমেন্ট, বালু, পাথর, পানি ও অ্যাডমিক্সচার মিলিয়ে তৈরি। প্রতিটি উপকরণ ভালো হওয়া জরুরি হলেও তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক মিক্স ডিজাইন। বিশেষ করে পানির পরিমাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি বেশি হলে কংক্রিট ঢালাই সহজ হয়, কিন্তু এর স্ট্রেন্থ কমে যায়। এই জ্ঞান কংক্রিট প্রস্তুতকারী টেকনিশিয়ানের মধ্যে থাকা অপরিহার্য।
এ জায়গায় বড় ঘাটতি হলো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ। দেশে কংক্রিট টেকনিশিয়ানদের ট্রেনিং বা সার্টিফিকেশনের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই সারা দেশে ট্রেনিং ও সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কংক্রিটের প্রধান উপাদান সিমেন্ট—এ বিষয়ে আমাদের ধারণাগত ভুলও আছে। অনেকে মনে করেন কম্পোজিট সিমেন্ট কংক্রিটে ব্যবহার করা ঠিক নয়। বাস্তবে সারা পৃথিবীতে কম্পোজিট সিমেন্টই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি দিয়ে পর্যাপ্ত শক্তিসম্পন্ন কংক্রিট যেমন প্রস্তুত করা সম্ভব, তেমনি স্থায়িত্ব এবং পরিবেশগত দিক থেকেও এ ধরনের সিমেন্ট বেশি উপযোগী। আমাদের বিল্ডিং কোডে কংক্রিটের ন্যূনতম স্ট্রেন্থ ৩ হাজার পিএসআই বলা আছে। তবে শুধু নতুন অবস্থায় শক্ত হলেই চলবে না—দীর্ঘ মেয়াদে মরিচা ধরে দুর্বল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রোধে উচ্চমানের যথেষ্ট ঘনত্বসম্পন্ন কংক্রিট প্রয়োজন।
ইস্পাতের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কোম্পানি ভালো রড তৈরি করছে। কিন্তু সমস্যা হলো বিএসটিআইয়ের স্ট্যান্ডার্ড ও বিল্ডিং কোডের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে। কোডটি ২০০৯ সালের, আর স্টিল স্ট্যান্ডার্ড ২০২১ সালেও আপডেট হয়েছে। সেখানে উচ্চ স্ট্রেন্থের রডের স্পেসিফিকেশন আছে, যা কোডে উল্লেখ নেই। তাই বিল্ডিং কোডের দ্রুত আপডেট অত্যন্ত জরুরি। ভূমিকম্প প্রতিরোধী মেম্বার—বিম, কলাম এবং শিয়ার ওয়ালে—ডাকটিলিটি ক্লাস ডি রড ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এর জন্য টি/ওয়াই অনুপাত অন্তত ১ দশমিক ২৫ হতে হবে।
সব মিলিয়ে ভূমিকম্পঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়, মানসম্পন্ন উপকরণ, দক্ষ জনবল, আপডেটেড কোড এবং দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা।
ফাহমিদা গুলশানঅধ্যাপক, বস্তু ও ধাতবকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
আমি হাই স্ট্রেংথ রিবারের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলার আগে একজন ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে স্টিল উৎপাদনপ্রক্রিয়ার দিকে নজর কাড়তে চাই। কারণ, উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে স্টিলের গুণগত বৈশিষ্ট্য ও ভূমিকম্প প্রতিরোধক্ষমতার সরাসরি সম্পর্ক আছে।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডে ভূমিকম্পে একটি নির্মাণাধীন ভবন ধসে পড়ে। আশপাশের হাইরাইজ ভবনগুলো অক্ষত থাকলেও ওই নির্দিষ্ট ভবনটি পড়ে যায়। তদন্তে দেখা গেছে, ভবনের রিবার স্যাম্পলে স্টিলের কেমিক্যাল কম্পোজিশন ও মেকানিক্যাল প্রপার্টিজ—দুটিতেই উল্লেখযোগ্য ত্রুটি ছিল। অর্থাৎ ব্যবহার করা হয়েছিল সাবস্ট্যান্ডার্ড স্টিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সাবস্ট্যান্ডার্ড স্টিল কীভাবে আসে? পৃথিবীতে তিন–চার ধরনের টেকনোলজিতে স্টিল তৈরি হয়—ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (EAF), বেসিক অক্সিজেন ফার্নেস এবং ওপেন হার্থ ফার্নেস। যদিও বাংলাদেশ–ভারত–পাকিস্তানে ইনডাকশন আর্ক ফার্নেস রুটেও স্টিল উৎপাদন হয় ।বিশেষত আমাদের দেশে হাতে গোনা ২–১টা ইন্ডাস্ট্রি (EAF রুট) ছাড়া বাকি সব ইন্ডাস্ট্রিতে স্টিল তৈরি হয় ইন্ডাকশন ফার্নেস রুটে। দুঃখজনক হচ্ছে, এ রুটে স্টিলের কেমিক্যাল কম্পোজিশন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সালফার, ফসফরাসসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানগুলো থেকে যায় সহনীয় মাত্রার বেশি, যা স্টিলকে ভঙ্গুর করে। অর্থাৎ ডাকটিলিটি ও টাফনেস কমে যায়, যা ভূমিকম্পে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে।
আন্তর্জাতিক মান সংস্থাগুলো—এএসটিএম, আইএস, সিএসএ—এগুলোতে স্পষ্ট বলা আছে, স্টিল অবশ্যই বেসিক অক্সিজেন, ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস অথবা ওপেন হার্থ রুটে বানাতে হবে। ইন্ডাকশন ফার্নেসকে মেনশন করা হয়নি। বিএস অনুযায়ী এমনকি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে ক্রেতাকে জানাতেও হয় যে স্টিল কোন রুটে তৈরি।
বাংলাদেশে সমস্যা হলো ইন্ডাকশন ফার্নেস রুটে স্টিল তৈরি হলেও পরবর্তী রিফাইনিংয়ের জন্য ল্যাডেল রিফাইনিং ফার্নেস নেই। থাকলেও ব্যবহৃত হয় না অধিকাংশ কারখানায়। ফলে স্টিলের মান ব্যাচ ভেদে ওঠানামা করে। এক ব্যাচের টেস্ট রিপোর্টে গুণগত মান ঠিক থাকলেও পরের ব্যাচে তা না–ও থাকতে পারে।
এখন চিন্তা করুন, হাইরাইজ ভবন, সেতু ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এই অনিশ্চিত মানের রড ব্যবহার করা হলে কতটা ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই সমস্যার গোড়ায় যেতে হবে—মানসম্পন্ন স্টিল নিশ্চিত করা ছাড়া ভূমিকম্প প্রতিরোধ সম্ভব নয়।
আরও একটি বড় সমস্যা হলো সাধারণ মানুষের অজ্ঞানতা। অনেক মানুষ, যাঁরা নিজেদের বাড়ি নিজেরাই তৈরি করছেন, জানেনই না কোন ধরনের গুণগত মানসম্পন্ন রড কিনবেন। অথচ এ জায়গাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইশরাত ইসলামঅধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকম্প ও বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রি একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। ভবন নকশা ও নির্মাণে যাঁরা কাজ করেন—নগর–পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী, ডেভেলপার এবং ব্যক্তিগত মালিক—সকলেই এই প্রক্রিয়ার অংশ। ভবন নকশা নিয়ে প্রত্যেকেরই নিজের মতো দৃষ্টিভঙ্গি ও শক্ত মত আছে, যা সমন্বয়কে কঠিন করে তোলে।
আমরা যারা প্রকৌশলী, স্থপতি বা পরিকল্পনাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় ভূমিকম্পনিরোধী নকশার বিষয়ে কতটা শিখি—এটাই বড় প্রশ্ন। আমি নিজে আর্কিটেকচারে পড়েছি; কিন্তু ভূমিকম্প প্রতিরোধ নিয়ে ক্লাসে কিছুই শিখিনি। নগর–পরিকল্পনা বিভাগে Hazard and Disaster Management কোর্সে ভূমিকম্প বিষয়ে পড়ানো হয়। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া প্রফেশনাল ব্যক্তিরা প্রয়োজনীয় সমন্বিত জ্ঞান কতটা নিয়ে বের হন, সেটা অনিশ্চিত। আউটপুট বেজড এডুকেশনের যুগে আমাদের বিভিন্ন বিভাগ যেমন নগর–পরিকল্পনা, পুরকৌশল ও স্থাপত্য বিভাগকে যুক্ত করে অন্তত একটি সেমিস্টারে হলেও ভূমিকম্পনিরোধী নকশা শেখানোর ব্যবস্থা করা জরুরি। এরপর আছে ফিল্ডের কর্মীরা—রাজমিস্ত্রি, তাঁদের প্রশিক্ষণের কিছু উদ্যোগ আছে ঠিকই, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
ডেভেলপার ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন নির্মাণে আমরা দেখি—ড্যাপের ডেনসিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সবাই বোঝেন না। এসব আলোচনার আয়োজন মাঝেমধ্যে হয়; কিন্তু তা ধারাবাহিক নয়। বড় কোনো ভূমিকম্প বা দুর্ঘটনার পরই বিষয়গুলো নতুন করে সামনে আসে।
নির্মাণসামগ্রীর মান নিয়েও বড় সমস্যা আছে। মুনাফার চাপে অনেক সময় নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহৃত হয়। তাই শুধু সচেতনতা নয়, মানুষকে তাদের ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক দিকটি স্পষ্টভাবে বোঝানো জরুরি। সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হলো বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন। কোড আছে; কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই।
রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স ইউনিট কাজ করছে বটে; কিন্তু ভবন অনুমোদনপ্রক্রিয়ায় স্ট্রাকচারাল সেফটি এখনো নিশ্চিতভাবে যুক্ত হয়নি। আর্কিটেকচারাল ডিজাইন দেখা হয়, কিন্তু ভূমিকম্প বা দুর্যোগ-সংক্রান্ত অংশটা উপেক্ষিত থাকে।
এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ড ভূমিকম্পের সেকেন্ডারি হ্যাজার্ড—আমাদের দেশে ছোট ছোট আগুনেই আমরা কতটা বিপর্যস্ত হই, তা সবার জানা। ভূমিকম্প হলে অগ্নিকাণ্ড ঘটা স্বাভাবিক; কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি অত্যন্ত কম—ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত। আরেকটি বড় সমস্যা হলো অ্যাকাউন্টেবিলিটি। ভবন তৈরি হওয়ার পর দায়িত্ব কার—এটাই স্পষ্ট নয়। গবেষণায় সমাধানগুলো বহুবার দেওয়া হয়েছে; কিন্তু বাস্তবায়িত হয় না।
আবদুল্লাহ আল হোসাইন চৌধুরী, পিইঞ্জি.আহ্বায়ক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আজ আর অনুমানভিত্তিক নয়; এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত বাস্তবতা। সরকার বিভিন্ন সময় এই ঝুঁকি বিশ্লেষণ করেছে, যেমন কমপ্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (সিডিএমপি ২০০৯–২০১৫) ও আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট (ইউআরপি ২০১৫-২০২২)। ইউআরপিতে বুয়েট ও রাজউক অংশগ্রহণ করেছে। তারা স্পষ্ট করেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চল সক্রিয় সাইসমিক বেল্টের মধ্যে অবস্থিত। ভূমিকম্প ঘটাতে প্রধান ভূমিকা রাখে মধুপুর ও ডাউকি ফল্ট।
ইউআরপির রিপোর্টে বলা হয়েছে, মধুপুর ফন্টে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ২১ লাখ ভবনের মধ্যে সাড়ে ৮ লাখ ধসে পড়বে। ছয় লাখ আরসিসি স্ট্রাকচারের মধ্যে ৭৫ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মৃতের সংখ্যা আড়াই থেকে তিন লাখ ও আহত চার থেকে সাড়ে চার লাখ হতে পারে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলার ও পুনর্বাসনে প্রয়োজন হবে ৬২ বিলিয়ন ডলার। কবে বড় ভূমিকম্প হবে, তা বলা সম্ভব নয়। তবে গবেষণায় দুর্বলতা ও করণীয় চিহ্নিত হয়েছে। তাই ভয়ের পরিবর্তে প্রয়োজন বাস্তবসম্মত, গবেষণাভিত্তিক প্রস্তুতি। ইউআরপির (২০১৫-২০২২) অ্যাসেসমেন্টে ৩ হাজার ২৫২টি স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও ফায়ার স্টেশন পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৯৭টির প্রাথমিক মূল্যায়ন সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৭টি স্থাপনা দ্রুত রেট্রোফিটিং প্রয়োজন এবং ৪২টি দ্রুত ভেঙে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভবন অন্তর্ভুক্ত। প্রয়োজনীয় টাকার অভাবে রেট্রোফিটিং এখনো শুরু হয়নি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় বড় ভূমিকম্প হলে হাসপাতালে রোগী পৌঁছাতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা বিলম্ব হতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত রেসকিউ টিম, হেভি ইকুইপমেন্ট, ডগ স্কোয়াড, মেডিকেল টেন্টের অভাব আছে। গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রজেক্ট ও লাইফলাইন ফ্যাসিলিটিজের জন্য পারফরম্যান্স বেজড ডিজাইন বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। এতে ভূমিকম্প হলেও গুরুত্বপূর্ণ ভবন সেফ থাকবে এবং সেবা অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া ফায়ার বা ভূমিকম্পের সময় অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ডেডিকেটেড ট্রাফিক ব্যবস্থা নেই। আক্রান্ত এলাকায় দ্রুত ফায়ার সার্ভিস ও রেসকিউ কার্যক্রম নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নগর পরিকল্পনায় সাইসমিক রিস্ক মিটিগেশন, ফল্টলাইন মনিটরিং ও মাইক্রোজোনেশন স্টাডি জরুরি। বাংলাদেশে বিশেষ করে ফল্ট লাইন অঞ্চলে স্ট্রং মোশন স্টেশন আরও বাড়ানো উচিত। বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ণীত পিজিএ ম্যাপ বা স্পেকট্রাল অ্যাক্সেলারেশন ম্যাপ ছাড়া সঠিক ডিজাইন সম্ভব নয়।
আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট, প্রফেশনাল স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রশিক্ষণে কোড ও ডিজাইন–সংক্রান্ত বিষয় জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমটি বর্তমানে বন্ধ আছে। সরকারের উচিত ইউআরপির প্রস্তাবনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা। বিবিআরএ ও ইউআরপি অনুমোদন দিয়ে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি অনেক শক্তিশালী হবে।
মোহাম্মদ আবু সাদেকনির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর হাউসিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ
দেশের কোনো জাতীয় ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা নেই। ২০০৬ সালে একটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল—জাতীয় আর্থকোয়েক ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান গঠন করতে হবে, যার দুটি অংশ থাকবে: ঝুঁকি হ্রাস ও রেসপন্স পরিকল্পনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকি হ্রাসের জন্য খরচ করা এক টাকা, প্রতিক্রিয়ায় দশ টাকা বাঁচাতে পারে। তবে সরকারের নজর এখনো মূলত প্রতিক্রিয়ার দিকে; ঝুঁকি হ্রাস বা রিস্ক রিডাকশনে বিনিয়োগ হচ্ছে না।
ঐতিহাসিক উদাহরণ হিসেবে ১৯০৬ সালের সান ফ্রান্সিসকোর ভূমিকম্পে ক্ষতির ৯০ শতাংশ ছিল আগুনের কারণে। ঢাকাতেও একই সমস্যা দেখা দিতে পারে। শহরের অগণিত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ ঝুঁকিপূর্ণ, যা ভূমিকম্পের সময় আগুন বা বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, খরচ ছাড়াই পি-ওয়েভ ভিত্তিক আগাম সতর্কতা সিস্টেম ব্যবহার করে এগুলোকে নিরাপদ করা সম্ভব।
নির্মাণসামগ্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুটি ভাগ, ইঞ্জিনিয়ারিং মেটেরিয়াল (স্টিল, সিমেন্ট, পাথর) এবং আর্কিটেকচারাল মেটেরিয়াল (টাইলস, পার্টিশন, রং)। সিঙ্গাপুরের একটি উদাহরণ অনুযায়ী, খারাপ স্থাপত্য নকশার চেয়ে ভালো স্থাপত্য নকশার সঙ্গে কম শক্তিশালী কাঠামো বেশি কার্যকর। তাই প্রকৌশলী ও স্থপতিদের একসঙ্গে কাজ করা অপরিহার্য।
আমাদের দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা বিভাগের পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী নয়। বিশেষ করে আর্কিটেকচারাল মেটেরিয়ালগুলো নিয়ে কোনো আধুনিক বই নেই। দক্ষতা উন্নয়নও অপ্রতুল। রডমিস্ত্রিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও সুপারভাইজররা তা মানেন না। ফলে সেরা উপকরণ ব্যবহার করেও বিল্ডিং নিরাপদ হয় না। প্রকল্প ও প্রযুক্তির দিকেও নজর দিতে হবে। হালকা ওজনের নন-স্ট্রাকচারাল ইনফিল ওয়াল ব্যবহার করলে, ভবন সুরক্ষিত হয়। এতে খরচও কমে।
ভূমিকম্প–সহনশীলতা নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা, সাবসয়েল ইনভেস্টিগেশন, সঠিক ডিজাইন, বিল্ডিং পারমিট সিস্টেম এবং উপকরণের যথাযথ ব্যবহার একসঙ্গে থাকা উচিত। বর্তমান পারমিট–প্রক্রিয়া ও কোড আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আর্কিটেকচারাল ও স্ট্রাকচারাল পরিকল্পনা আলাদা হওয়ায় ভূমিকম্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না।
এ ছাড়া রুরাল হাউজিং কোড নেই। গ্রামে ইট ও টিন দিয়ে তৈরি বাড়ি সম্পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই দেশের প্রতিটি স্থানে নিরাপদ ও সহনশীল আবাসনের জন্য রুরাল হাউজিং কোড প্রণয়ন জরুরি। মিডিয়াও ভূমিকা নিতে পারে—গবেষণা ও প্রযুক্তি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
আকতার মাহমুদঅধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স
গত দুই–তিন দশক ধরে বাংলাদেশের নগরায়ণ এক রকম ধারা ধারণ করেছে। বড় শহর, ছোট শহর, মাঝারি শহর—সবখানেই দালানকোঠা নির্মাণের প্রবণতা বেশি। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই বাড়িঘরগুলো কতটা বিল্ডিং কোড মেনে বা মানসম্পন্নভাবে তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে একটি বিল্ডিং কোড তৈরি হয়েছে—২০০৯ সালে শুরু হয়ে ২০২০ সালে অনুমোদিত। এটি ছিল একটি বিস্তৃত ভলিউম, যেখানে বিল্ডিং মান রক্ষা ও নকশা–সম্পর্কিত প্রায় সব দিক অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু অনুমোদনের পাঁচ বছর পার হলেও বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) এখনো গঠন করা হয়নি। ফলে কোড বাস্তবায়নের মূল কেন্দ্র নেই এবং দেশের ভূমিকম্পঝুঁকি মোকাবিলায় কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।
সিডিএমপি প্রজেক্টে প্রথমবারের মতো ভূমিকম্প–সংক্রান্ত একটি কম্প্রিহেনসিভ ধারণা তৈরি হয়। ধরা হয়, ঢাকায় ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে প্রস্তুত করার জন্য কন্টিজেন্সি প্ল্যান তৈরি করার কথা থাকলেও, জরিপে দেখা গেছে অধিকাংশ কর্মকর্তাই জানেন না তাঁদের জন্য কোনো পরিকল্পনা আছে। তাই ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি একেবারেই দুর্বল।
অধিকাংশ সময় ঝুঁকি মোকাবিলায় শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং সমাধানের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। অবশ্যই এটি গুরুত্বপূর্ণ—কেননা শক্তিশালী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে দুর্বল এলাকার বড় বড় ভবন তৈরি করা সম্ভব। তবে পরিকল্পনার দিক থেকে নগরায়ণের উপযোগী ভূমি চিহ্নিত করা এবং রিস্ক সেনসিটিভ মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা আবশ্যক।
দেশের সুষম নগর উন্নয়নের জন্য পৌরসভাগুলোর গুরুত্ব বাড়ানো জরুরি। যথাযথ কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা–সুবিধা তৈরি করে মানুষকে গ্রামীণ ও জেলা শহরে স্থায়ী করা যায়। এতে ঢাকার ওপর অতিরিক্ত চাপ কমবে। গবেষণায় দেখা গেছে, রেট্রোফিট করা সম্ভব হলেও রাস্তা ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক দুর্বল হলে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হয়। রাষ্ট্রকে অবশ্যই বিল্ডিং কোড প্রণয়ন ও প্রয়োগে দায়িত্ব নিতে হবে। ব্যক্তিপর্যায়ে নিজের প্লট ও ভবন নির্মাণে কোড মানা জরুরি, তবে রাষ্ট্রের দুর্বলতার কারণে দোষ শুধুই ব্যক্তির ওপর চাপানো যাবে না।
বিবিআরএ দ্রুত গঠন করা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর দায়িত্ব দেওয়া ও স্বেচ্ছাসেবক ভলান্টিয়ার তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ভলান্টিয়াররা যেকোনো দুর্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ঢাকা শহর ও অন্যান্য নগরের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য এই প্রস্তুতি অবিলম্বে নেওয়া আবশ্যক।
আদিল মুহাম্মদ খানসভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স।
অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে ভূমিকম্পঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতির মূল ভিত্তি হলো পরিকল্পনা। ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্কিটেকচার এবং সামাজিক–অর্থনৈতিক দিকের সঙ্গে সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা করা জরুরি। প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউট বারবার বলছে, ভূমিকম্পঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং প্রস্তুতি শুরু হতে হবে পরিকল্পনা থেকে। ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, টপোগ্রাফি এবং নগরের মাটির প্রকৃতি বিবেচনা করে ডেভেলপমেন্টের জন্য স্থান নির্বাচন করা আবশ্যক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের নগরায়ণ সবচেয়ে উপেক্ষিত। ১৯৮০–৯০-এর দশকের পরে স্বেচ্ছাচারী নগরায়ণ বিস্তার পেয়েছে—জলাভূমি ও নিচু ভূমি ভরাট করে বাড়ি ও বিল্ডিং তৈরি হয়েছে। এটি শুধু
ঢাকায় নয়, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ বা কুমিল্লা—সব জেলা শহরে লক্ষ করা যায়। আগের কোর সিটিগুলো ঐতিহাসিকভাবে উঁচু ভূমিতে থাকলেও, এখন লোভ বা ব্যবসায়িক স্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বেছে নেওয়া হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু ভূমিকম্পের সময় প্রতিক্রিয়া দেখানো নয়, বরং উন্নয়নের প্রক্রিয়াতেই নিশ্চিত করা উচিত। অনিয়মিত ডেভেলপমেন্ট এবং অনুমোদনহীন নির্মাণ রাষ্ট্রের অদৃশ্যতার কারণে হয়। ভূমিকম্পের ঝুঁকি শুধু বড় বিল্ডিং নয়, নন-ইঞ্জিনিয়ার্ড বসতি ও বস্তিতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সেখানে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন থাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সেফ আবাসন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। লো ইনকাম সেটেলমেন্টকে সামাজিক ও সাশ্রয়ী হাউজিংয়ে রূপান্তর করতে পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ ছাড়া উদ্ধার ও রেসকিউ কার্যক্রমের জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা ও ওপেন স্পেস নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পিত খোলা জায়গা ও খেলার মাঠকে ইভাকুয়েশন স্পেস হিসেবে ব্যবহার করা জরুরি, যা নগরায়ণে প্রায়ই উপেক্ষিত।
স্বেচ্ছাচারী নগরায়ণ, ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) বৃদ্ধিসহ অনিয়ম রাষ্ট্রের অসতর্কতার কারণে। প্রফেশনাল আর্কিটেক্ট ও ইঞ্জিনিয়াররা ব্যবসায়িক স্বার্থে পেশাদার এথিকস উপেক্ষা করছেন। রাজধানীসহ বড় শহরে ৩০ বছর আগের মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান মানা হচ্ছে না, ফলে ঢাকার সমস্যা এখন সেকেন্ডারি সিটিতেও ছড়িয়ে পড়ছে।
রাষ্ট্র যদি প্ল্যানিংকে গুরুত্ব না দেয়, কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত না করে, এবং স্বেচ্ছাচারী ডেভেলপমেন্টকে নিয়ন্ত্রণ না করে, তবে বিপদ অব্যাহত থাকবে। ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে গভর্ন্যান্স, প্ল্যানিং, এনফোর্সমেন্ট এবং সামাজিক সমতা—সব মিলিয়ে সমন্বিত ব্যবস্থা প্রয়োজন।
বিভূতি সিকদারসহকারী অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারিবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে ভূমিকম্পঝুঁকি মোকাবেলায় একটি সমন্বিত ব্যবস্থা অপরিহার্য। এটি শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং বা স্থাপত্যের কাজ নয়, বরং পরিকল্পনা, প্রযুক্তি, আইন ও সামাজিক–অর্থনৈতিক দিকের সঙ্গে সমন্বিত একটি কম্প্রিহেনসিভ অ্যাপ্রোচ প্রয়োজন। ঢাকা শহরের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হলে বিপর্যয় অনিবার্য, তাই আগে থেকেই প্রশমন ও মিটিগেশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
প্রথমত, ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্ট্রাকচারাল দিককে প্রাধান্য দিয়ে, মানসম্পন্ন নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি শক্তিশালী রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক, রুলস ও লিগ্যাল কাঠামো থাকা আবশ্যক। পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ভূতত্ত্ব, ভূমিকম্প বিজ্ঞান, সিভিল ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং, স্থাপত্য এবং নগর পরিকল্পনা—এই ডিসিপ্লিনগুলোকে সমন্বিত করে কার্যক্রম করা দরকার।
দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসে সোশিও-ইকোনমিক ও শিক্ষামূলক দিক, প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ, সহনশীলতা ও টেকসই উন্নয়ন, গবেষণা ও উদ্ভাবনকে যুক্ত করা যেতে পারে। সাবন্যাশনাল পর্যায়ে সাইসমিক হ্যাজার্ড ম্যাপিং ও শক্তিশালী ভূমিকম্প সতর্কতাব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব। কমিউনিটি পর্যায়ে প্রস্তুতিমূলক নেটওয়ার্ক এবং শহুরে অঞ্চলে অনুসন্ধান, উদ্ধার ও চিকিৎসাসুবিধার পরিকল্পনা জরুরি।
একাধিক মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত করে ইন্টার-মিনিস্টেরিয়াল কো–অর্ডিনেশন মেকানিজম তৈরি করা যায়। এতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, অর্থ ও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। জাপানের উদাহরণ অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি স্থানান্তর, প্রযুক্তিগত অংশীদারত্ব ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উচ্চ মানের গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্রে যথাযথ অর্থায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। দুর্যোগকে ছোটভাবে দেখা যাবে না; প্রতিটি প্রস্তুতি পরিকল্পিত ও সমন্বিত হতে হবে।
রাইসা ইমরান চৌধুরীশিক্ষক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারিবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি কেবল কাঠামোগত বা স্ট্রাকচারাল দিকের ওপর নির্ভর করে না। অ-কাঠামোগত বা নন-স্ট্রাকচারাল প্রস্তুতিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি হলিস্টিকভাবে হওয়া উচিত, যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। আমাদের দেশে পলিসি ও নীতি রয়েছে—যেমন ২০০৯ সালে শুরু হওয়া বিল্ডিং কোড ২০২০ সালে রিভিশন হয়েছে, ড্যাপ এখন কার্যকর—কিন্তু এগুলোকে প্র্যাকটিসে রূপান্তর করার পদ্ধতি এখনো চ্যালেঞ্জের মধ্যে।
অ-কাঠামোগত প্রস্তুতি কয়েকটি মূল ক্ষেত্রে প্রয়োজন। প্রথমত, সচেতনতা। স্টেকহোল্ডার ম্যাপিং জরুরি, যেখানে প্রফেশনাল, একাডেমিয়ান, আর্কিটেক্ট, সিটি করপোরেশন, হাসপাতাল—সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জনগণকে ভূমিকম্প ঝুঁকি ও প্রতিকারের বিষয়ে সচেতন করা মূল। দ্বিতীয়ত, প্রথম সাড়াদানকারী বা ফার্স্ট রেসপন্ডারদের প্রস্তুতি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স তাদের ইকুইপমেন্ট এবং প্রশিক্ষণের ঘাটতির কারণে সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়। উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিউনিটি সদস্যদেরও সমন্বিত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তৃতীয়ত, সরঞ্জাম ও পরিকল্পনা। ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ এবং সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো সময়সাপেক্ষ এবং দেশে সীমিত। চতুর্থত, একাডেমিক ভূমিকা। শিক্ষাবিদ ও গবেষকেরা আউটকাম-বেজড এডুকেশনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। গবেষণার ফলাফল ব্যবহার করে প্রস্তুতি কার্যক্রম আরও কার্যকর করা সম্ভব। পঞ্চমত, বিনিয়োগে সমন্বয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সেক্টরের মধ্যে সমন্বিত বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রস্তুতি কার্যক্রমকে আরও ফলপ্রসূ করা যায়।
স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কমিউনিটি পর্যায়ে ট্রেনিং ও ড্রিলের মাধ্যমে প্রস্তুতি চর্চা বজায় রাখা জরুরি। পিরিয়ডিক ফ্রেশার ট্রেনিং এবং মানসম্মত ম্যানুয়াল তৈরি করলে প্রস্তুতি নিশ্চিত করা সম্ভব।
অংশগ্রহণকারীফখরুল আমীন, সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
সেখ ফরিদ আহমেদ, যুগ্ম সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়
রাকিব আহসান, অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
ফাহমিদা গুলশান, অধ্যাপক,বস্তু ও ধাতবকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
ইশরাত ইসলাম, অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
আবদুল্লাহ আল হোসাইন চৌধুরী, পিইঞ্জি. আহ্বায়ক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স
মোহাম্মদ আবু সাদেক, নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর হাউসিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ
আকতার মাহমুদ, অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স
আদিল মুহাম্মদ খান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স। অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিভূতি সিকদার, সহকারী অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারিবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাইসা ইমরান চৌধুরী, শিক্ষক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারিবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র ভ ম কম প ভ ম কম প র স ড ভ লপম ন ট ব যবহ র কর ন শ চ ত কর আম দ র দ শ ভ ম কম প ব ভ ম কম প স অপর হ র য আম দ র ব ম হ ম মদ আর ক ট ক ন র জন য র প রস ত প রস ত ত ক ঠ ম গত সমন ব ত ক র যকর নগর য ণ সহনশ ল ক ত কর পর য য কম প জ প রক র অন ম দ ত ম লক থ কল ও উপ ক ষ ড জ ইন দ র বল ন র পদ ক জ কর সবচ য় ত করত সমস য ন করত সরক র ভবন ন ভবন র ড কশন
এছাড়াও পড়ুন:
নারায়ণগঞ্জে কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ, দগ্ধ ৬
নারায়ণগঞ্জে একটি সিমেন্ট কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে ছয়জন দগ্ধ হয়েছেন। তাদের রাজধানী ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ভর্তি করা হয়েছে।
শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বন্দর থানা এলাকার মদনগঞ্জে ঘটনাটি ঘটে।
আরো পড়ুন:
ভূমিকম্পে হুড়োহুড়িতে আহত ২৯ শ্রমিক এখনো হাসপাতালে
হাসপাতালের কর্মচারীকে মারধরের প্রতিবাদে মানববন্ধন
দগ্ধরা হলেন- ফেনীর নাহিদ হাসান (২২), পাবনার কামাল হোসেন (৪৫), নোয়াখালীর তাইজুল ইসলাম (৩৫), জামালপুরের ফেরদৌস (৩৫), কুষ্টিয়ার তোরাব আলী (৫৫) এবং নারায়ণগঞ্জের আতিকুর রহমান (৪২)।
দগ্ধদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া মো. রহিম জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সিমেন্ট কারখানায় বয়লার থেকে বিস্ফোরণ হয়। পাশে থাকা ছয়জন দগ্ধ হন। দ্রুত তাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান জানান, ছয়জনের শরীররই মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়েছে। শ্বাসনালীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের চিকিৎসা চলছে।
ঢাকা/অনিক/মাসুদ