চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। বিকেলের এই সময় সূর্য ঢলে পড়লেও ঘোমটার আড়াল থেকে চোখ মেলে থাকা লাজুক বউটির মতো আলোর আবরণে চারদিক জুড়ে থাকার কথা। কিন্তু আজ মহাশক্তিধর সুয্যিমামা নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছেন। আকাশও যেন নেমে আসছে উপুড় হয়ে।
একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থার রিসিপশনিস্ট আমি। সারাদিন অফিস করে বাড়ি ফিরে এই সময়ে ক্লান্ত শরীরে আরাম করে বসি। আমার একলা একার সংসারে হালকা বিষণ্নতায় ভুগি। একাকিত্বের যাতনা কমাতে টিভিতে সিরিয়াল দেখি। নয়তো বান্ধবীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলি। ইদানীং আরেকটা কাজে খুব সময় ব্যয় করা হয় আমার—ফেসবুকিং।
কয়েক মাস আগে আমার ছোটবোন স্পর্শিয়া আমাকে ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। প্রথম প্রথম আগ্রহ না পেলেও এখন বেশ ভালো লাগছে। ফেসবুকে ঢুকে কিছুদিন স্কুলের পুরোনো বান্ধবীদের খুঁজেছি। কারও শুধু ডাক নাম জানি। কারও ভালো নামে খুঁজেছি। মজার ব্যাপার হলো তাদের কয়েকজনকে পেয়েও গেছি। অনেক বছর পর দেখা বান্ধবীদের ছবিতে তাদের বয়সের সঙ্গে বদলে যাওয়া মুখের ছবি দেখে খুব হাসি পেয়েছিল আমার। বারবার দৌড়ে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখেছি। কারণ, নিজের ভেতরে আমি তেমন পরিবর্তন লক্ষ করি না। আমার মনে হয়, এখনো আমি সেই আগের মতোই আছি।
বান্ধবীদের বেশির ভাগের দেখি অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভরা সংসার। তাদের ফেসবুকে শুধু জন্মদিন, আকিকা, মিলাদ, বিয়ে, বাচ্চার মুসলমানি—এসব অনুষ্ঠানের রংচঙে ছবি। সেসব অনুষ্ঠানের ছবিতে কখনো দেখা যায় আস্ত গরু বা আস্ত খাসি পোজ দিয়ে আছে ছবির কেন্দ্রবিন্দুতে।
অনেক বছর পর দেখা বান্ধবীদের ছবিতে তাদের বয়সের সঙ্গে বদলে যাওয়া মুখের ছবি দেখে খুব হাসি পেয়েছিল আমার। বারবার দৌড়ে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখেছি। কারণ, নিজের ভেতরে আমি তেমন পরিবর্তন লক্ষ করি না।আমি নিজে যে নিরামিষাশী তা কিন্তু নয়। টেবিলে থাকলে মাছের পরে আমি মাংসও খাই। তবে খুব ভালোবেসে না। রাস্তায় উঁচু ভলিউমে হিন্দি গান বাজিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল। গাড়ির স্পিডের কারণে নাকি লাউড মিউজিকের কারণে জানি না, আমার পায়ের তলায় ঘরের মেঝেটা কেঁপে উঠেছে। অধিকাংশ মানুষ অন্যকে না দেখিয়ে, অন্যকে না জ্বালিয়ে নিজের আনন্দ ভোগ করতে পারে না। ভোগের ঊর্ধ্বে উঠে উপভোগের ঠিকানা জানে খুব অল্পসংখ্যক মানুষই। বলাকওয়া ছাড়া একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আমার বুক ভেঙে। কেন, কে জানে!
গত সপ্তাহে জানালার টবে অর্কিডের একটি অবিশ্বাস্য সুন্দর ফুল ফুটেছে। সারা সকাল ধরে ভাবছি, মেসেঞ্জারে তৃণার পাঠানো মেসেজের উত্তর দেব। টুং করে আবার বেজে উঠেছে আমার মোবাইল। তৃণার মেসেজের উত্তর দেওয়ার জন্য মোবাইল হাতে নিয়ে ভুলে গেলাম তৃণাকে উত্তর লেখার কথা। ফেসবুকের হোম পেজে নানা রকম মানুষের পোস্ট দেখতে লাগলাম। অনেকে ছোট ছোট কৌতুক পোস্ট করে। বেশ সরস কথা দেখা যায় কোনো কোনোটায়। দু–একটায় সেন্স অব হিউমার চমৎকার। এই সব বিচিত্র ধরনের পোস্টের কারণে ফেসবুক আমার খুব ভালো লাগে। একসময় আমি কৌতুক খুব পছন্দ করতাম। হাসি কৌতুকের কথা ছাড়াও যখন–তখন খিলখিল করে হাসতাম। এখন আমার হাসিগুলো সব অন্য দেশে চলে গেছে। আমার হাসিরা এখন মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে ধুলার পাহাড়ে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। এখন ওদের ধরতে গেলে আমার চোখ জ্বালা করে ওঠে।
অন্যমনস্ক হয়ে মোবাইল স্ক্রিনে আঙুল নাড়তে থাকলাম। আবারও দেখতে পেলাম ভদ্রলোককে। চারটি সপ্তাহ ধরে যখনই আমি ফেসবুকে ঢুকি, তখনই ফেসবুক আমাকে এর বন্ধু হতে সাজেশন দিচ্ছে। প্রতিদিন। একটি নাম। সবার ওপরে। কয়েক দিন উপেক্ষা করেছিলাম। তারপর একদিন তার প্রোফাইলে ঢুকলাম। লোকটি দেখতে হ্যান্ডসাম। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি উজ্জ্বল। প্রতিটি ছবিতে ঠোঁটের কাছে একটা ভীষণ রোমান্টিক হাসি আছে। মার্জিত পোশাকে রুচির ছাপ স্পষ্ট। প্রোফাইলের পোস্ট পড়ে বুঝলাম, ভদ্রলোক লেখালেখি করেন। ভাবলাম, লেখক সাহেবের আমার কাছে কী চাই? আমি লিখি না। আমার সাহিত্যজ্ঞান স্কুল–কলেজে পড়া পাঠ্যপুস্তক পর্যন্তই সীমিত। তবু কি তিনি আশা করছেন আমি তার পাঠক হব? সে আমি হতে পারি। অসুবিধা নেই। ফেসবুক প্রোফাইল দেখে বুঝেছি, তিনি বেশ জনপ্রিয় লেখক। কিন্তু বুঝতে পারছি না জনপ্রিয় লেখককে আমার ফেসবুক বন্ধু সাজেশন পাঠাচ্ছে কেন, রোজ রোজ!
কয়েকবারই অ্যাড ফ্রেন্ড বাটনে চাপ দিতে গিয়ে আমি হাত সরিয়ে নিয়েছি। আমার মনে দুটো চিন্তা কাজ করেছে। এক নম্বর চিন্তা: তিনি যদি আমার বন্ধু রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট না করেন, তাহলে আমি অপমানিত বোধ করব। দুই নম্বর চিন্তাটা হাস্যকর, কিন্তু অমূলক নয়: যদি তার সঙ্গে আমার প্রেম হয়ে যায়? ইউটিউবে একটা ভিডিও ক্লিপে দেখেছি, মিথিলার দ্বিতীয় স্বামী সৃজিত মুখার্জি সাংবাদিকদের বলেছে মিথিলার সঙ্গে তার পরিচয়ের সূত্রপাত এভাবেই হয়েছিল, ফেসবুকে। আমার মনে হয়, ফেসবুকের শুধু যে ফেস আছে, তা–ই নয়। ব্রেনও আছে বলা যায়। সেই ব্রেন খাটিয়ে ঘটকালির কাজ করে যাচ্ছে অহরহ। প্রয়োজন হলে ডিভোর্সের জন্য উকিলের কাজও করতে পারে, সন্দেহ নেই।
চারটি সপ্তাহ ধরে যখনই আমি ফেসবুকে ঢুকি, তখনই ফেসবুক আমাকে এর বন্ধু হতে সাজেশন দিচ্ছে। প্রতিদিন। একটি নাম। সবার ওপরে। কয়েক দিন উপেক্ষা করেছিলাম। তারপর একদিন তার প্রোফাইলে ঢুকলাম। লোকটি দেখতে হ্যান্ডসাম।সার্চ বাটনে গিয়ে বিভিন্ন বানানে একটা নাম লিখতে লাগলাম—শাফায়াত হোসেন। যেকোনো বানানেই লিখি না কেন, অনেকগুলো মানুষের আইডি চলে আসছে সামনে। ছবি মিলিয়ে দেখেছি। এদের কেউ না। আমি যে শাফায়াতকে খুঁজছি, তিনি দেখতে যেমন, তেমন মুখের কাউকে পেলাম না। কে জানে, তিনি হয়তো মরুভূমির দেশে উটের জকির কাজ করেন। ফেসবুকিং করার মতন বিলাসিতা নেই তার জীবনে। আজকের মতো শাফায়াতকে খোঁজা বাদ দিয়ে আমি টুক করে ঢুকে গেলাম সুদর্শন লেখকের প্রোফাইলে। গতকাল তিনি একটা গল্প শেয়ার করেছেন। গল্পটা দেখছি একটা দৈনিকে ছাপা হয়েছে। আমি দৈনিক পত্রিকা কিনি না। পড়া হয় না। লেখক গল্পটা অনলাইনে পোস্ট করায় আমার জন্য ভালো হয়েছে। বিনা পয়সায় পড়ে ফেলতে পারব আজ।
গল্পের নাম ‘রিরংসা’, অনুস্বর দেওয়া খটমট এই শব্দ আমার জন্য নতুন। আমি শব্দের অর্থ না জানলেও গল্প পড়তে আরম্ভ করলাম। একটা মেয়েকে নিয়ে লেখা। প্রথম দুটি প্যারা পড়তেই কী যেন এক অদ্ভুত কারণে আমার মনে হতে থাকে, গল্পের মেয়েটি অন্য কেউ নয়, আমিই যেন। আর গল্পের মেয়ের প্রেম ছিল একজন কবির সঙ্গে। কবি তার প্রেমিকাকে বিয়ে করে সংসার করতে সাহস পায়নি, কিন্তু মেয়েটিকে নিয়ে সে চমৎকার সব কবিতা ও গান লিখেছিল। মেয়েটা ওর প্রেমিক কবিকে বারবার আশ্বস্ত করে বলেছিল, কোনো ভয় নেই, আমি শিক্ষিতা, একটা চাকরি ঠিক জুটিয়ে নিতে পারব। আর একটা ছেলে যেমন সংসারের জন্য আয়রোজগার করে, মেয়ে হয়ে আমিও সমান আয় করে পরিবার চালাতে পারব।
কিন্তু কবি তার প্রেমিকার কথায় ভরসা করতে পারেনি, অথবা কবি মানুষটি অত জলদি তার কবি মনকে হয়তো সংসারের শক্ত শিকে আবদ্ধ করে ফেলতে চায়নি! হয়তো কবিতার প্রয়োজনে তাকে অনেক রঙিন ফুলে মধু আহরণ করতে হতো! মেয়েটির কবি প্রেমিক তাকে বিয়ে করতে রাজি হলো না বলে অবশেষে নিম্নবিত্ত পরিবারের সবচেয়ে বড় মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক পছন্দে একজন প্রবাসীর সঙ্গে। চেনাজানাহীন একটা লোকের সঙ্গে হুট করে যথাসম্ভব স্বল্প আয়োজনে বিয়েও হয়ে যায় তার। বিয়ের পর দুই মাস একই সঙ্গে বসবাস করে প্রবাসী স্বামী নববধূকে দেশে রেখে আবার হারিয়ে গেল মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে, আলিফ লায়লার গল্পের সেই আরব দেশে। আর সেই থেকে নিরুপায়ের মতো মেয়েটা শূন্য চোখে অপেক্ষা করে আছে। অপেক্ষা করে আছে তার দুই মাস সহবাস করা স্বামীর সঙ্গে পুনরায় বসবাস করার আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে। অপেক্ষা করছে একটি নিজস্ব সংসারের জন্য, একটি পুরুষ মানুষের প্রেমের জন্য। অল্পবিস্তর সুখকর কামের জন্য। অপেক্ষা করে থাকে সন্তান ও পারিবারিক কলহের জন্য। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে মেয়েটি উন্মাদ হয়ে যেতে থাকে। একসময় মেয়েটির শরীর শুকিয়ে একটি শুকনো গাছ হয়ে যায়। তবু যখন গল্পের সেই মেয়ের স্বামী আর ফিরে আসে না, হয়তো তত দিনে সে মরুভূমিতে ৭০ জন হুরের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে; মেয়েটি তখন সেই স্বামীকে, অথবা স্বামীর আদলে অন্য কাউকে খুঁজে পেল একদিন।
বিয়ের পর দুই মাস একই সঙ্গে বসবাস করে প্রবাসী স্বামী নববধূকে দেশে রেখে আবার হারিয়ে গেল মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে, আলিফ লায়লার গল্পের সেই আরব দেশে। আর সেই থেকে নিরুপায়ের মতো মেয়েটা শূন্য চোখে অপেক্ষা করে আছে।সেটা ছিল এক অন্য রকম সকাল, অথবা এক নির্জন ভরদুপুর, কিংবা ক্লান্ত বিকেল; নতুবা ঝুম বৃষ্টির এক ঘন গভীর অন্ধকার রাত। সেদিন হঠাৎ দমকা হওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটা নেমেছিল পৃথিবীতে। শুকিয়ে গাছ হয়ে যাওয়া মেয়েটির পায়ের কাছে গজিয়ে উঠেছিল একটি চিকন লতা। দেখতে দেখতে চিকন সেই লতার গাত্রখানি প্রলম্বিত হলো, সেখানে দুটি হাত হলো, দুটি পা, এক জোড়া কামার্ত ঠোঁট, সুডৌল স্তন, ভারী নিতম্ব: অবিকল একটি নারী শরীর যেন। তৃষ্ণার্ত নারী শরীরটি মিলিত হলো এক তেজপূর্ণ সক্ষম পুরুষ শরীরের সঙ্গে। আবছায়া ভ্রমে সেই পুরুষকে মেয়েটির কাছে আপন মনে হয়। অন্ধকারে তাকে দুই মাসের চেনা স্বামীর মতো মনে হলেও আসলে লোকটি ছিল ওর ফিরে যাওয়া ভীরু ও অযোগ্য সেই কবি-প্রেমিক।
আমার ভালো লাগছিল লেখকের গল্প পড়তে। কিন্তু শেষের দিকে এসে কী যে সব শব্দ লিখেছেন তিনি? ছি! আমার গা গুলিয়ে উঠছে। লজ্জায় শরীর কেমন করছে। এসব কথা কেউ এমন সাধারণ প্রেমের গল্পে লেখে? এগুলো তো খারাপ ছেলেদের জন্য লেখা বইয়ের শব্দ। গল্পের নায়িকা ঝিনুকের সঙ্গে শুরুতে নিজেকে মিলিয়েছিলাম বলে এখন খুব রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। সিরিয়াস পাঠকদের নিয়ে এই এক সমস্যা, সব কাহিনির কোনো না কোনো চরিত্রের সঙ্গে ঠিক নিজেকে কল্পনা করে বসে থাকবে।
লেখককে বাদ দিয়ে এখন আমার নিজের ওপরই খুব বিরক্ত লাগছে। কয়েক মিনিটের একটা গল্প পড়তে গিয়ে কত কিছু ভেবে বসে আছি। উফ! আর কিছু ভাবতে চাই না। মোবাইল বন্ধ করে দিলাম। টার্ন অফ করার আগে ভালো করে আরেকবার লেখকের প্রোফাইল পিকচার দেখলাম। শিউরে উঠল আমার শরীর, বৃষ্টির স্পর্শে যেভাবে কেঁপে ওঠে মাঠের ঘাসের ডগা, সলজ্জ শিহরণে। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এই মুহূর্তে লেখকের চোখ দুটো কি আমাকে দেখে হাসছে? কিন্তু কেন? টের পেলাম আমার ভেতরের ঝিনুকটি তার বহুদিন বন্ধ করে রাখা ডালা দুটি আজ খুলতে চাইছে। অজানা অন্ধকার গহ্বরের অপ্রতিরোধ্য টানের মতো আমি তাকিয়ে আছি ছবিতে চোখ জোড়ার দিকে। কী অসম্ভব আকর্ষণ ওই চোখ দুটোতে! শিশুর মতো নিষ্পাপ অথচ বুদ্ধিদীপ্ত পাপে পূর্ণ হাসি লেগে আছে ওই চাহনিতে। ব্যাখ্যাতীতভাবে, আচমকা, আমার মনে হতে থাকে, আচ্ছা, অপরিচিত এই লেখকের প্রোফাইল পিকচারের চোখ দুটো কি মরুভূমিতে হারিয়ে থাকা আমার কাবিন করা স্বামীর? নাকি সটকে পড়া কাপুরুষ প্রেমিক কবির? চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছি না, শুধু এটুকু অনুভব করতে পারছি—লেখকের ওই চোখ দুটো তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম র জন য র পর দ র গল প আম র ম গল প র ফ সব ক ল আম র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রার্থী ঘোষণার পর বিএনপির কোন্দল প্রকাশ্যে
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন রাজশাহীর ছয়টি আসনেই প্রার্থী দিয়েছে। এ ছাড়া খেলাফত মজলিস রাজশাহী-১ বাদে পাঁচটি আসনে, বাসদ তিনটি, গণসংহতি আন্দোলন দুটি ও গণ অধিকার পরিষদ একটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) রাজশাহী-১, রাজশাহী-২ ও রাজশাহী-৬ আসনে প্রার্থী ঠিক রেখে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এতে জেলায় নির্বাচনী আমেজ তৈরি হয়েছে।
এদিকে বিএনপি ছয় আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে দলীয় কোন্দল প্রকাশ্যে আসা শুরু হয়েছে। রাজশাহী-২ (সদর) ও রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) বাদে বাকি চারটি আসনে প্রার্থী বদলের দাবি উঠেছে। রাজশাহী-১ আসনে বিক্ষোভ মিছিল, রাজশাহী-৩ আসনে বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ, রাজশাহী-৪ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীর লোকজনের বাড়িঘরে হামলার অভিযোগ এবং প্রার্থী বদলের দাবিতে সমাবেশ, রাজশাহী-৫ আসনে সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্য প্রার্থীর সমর্থকেরা।
প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনের কারণে বিএনপি কিছুটা অস্বস্তিতে আছে। ফেব্রুয়ারিতে প্রার্থী ঘোষণা করে প্রস্তুতিতে এগিয়ে আছে জামায়াতে ইসলামী। দলের নিশ্চিত বার্তা না পাওয়ায় তৎপরতা নেই জাতীয় পার্টির (জাপা)।
রাজশাহী-১ ( গোদাগাড়ী-তানোর)
আসনটিতে স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পাঁচবার করে, জামায়াতে ইসলামী একবার ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী একবার জয়ী হয়েছেন। অবশ্য ২০১৪–২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনটি নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। ২০০৮ সালের পর থেকে টানা আওয়ামী লীগই জিতেছে এই আসনে। ১৯৮৬ সালে জামায়াতের বর্তমান নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান এখানে বিজয়ী হন। তিনি এবারও জামায়াতের প্রার্থী।
এই আসনে বিএনপির প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) শরিফ উদ্দিন। তিনি খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার মন্ত্রী প্রয়াত আমিনুল হকের ছোট ভাই। তাঁর মনোনয়ন নিয়ে ইতিমধ্যে মনোনয়নপ্রত্যাশী সুলতানুল ইসলামের সমর্থকেরা বিক্ষোভ করেছেন।এই আসনে বিএনপির নতুন মুখ চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) শরিফ উদ্দিন। তিনি খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার মন্ত্রী প্রয়াত আমিনুল হকের ছোট ভাই। আমিনুল হক ১৯৯৬ সাল থেকে টানা চারবার এমপি ছিলেন। এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেকেই ছিলেন। তাঁদের নিয়ে একত্রে কাজ না করতে পারলে পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হবে শরিফ উদ্দিনকে। ইতিমধ্যে মনোনয়নপ্রত্যাশী সুলতানুল ইসলামের সমর্থকেরা ১৪ নভেম্বর গোদাগাড়ীর মহিশালবাড়ী এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।
এই আসনে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) থেকে মাঠে আছেন দলটির জেলা আহ্বায়ক আফজাল হোসেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে আরিফুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) রাজশাহী মহানগরের সদস্যসচিব আতিকুর রহমান এই আসনে প্রার্থী হওয়ার আলোচনায় আছেন। গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মীর মো. শাহজাহানকে এই আসনে প্রার্থী করা হয়েছে।
রাজশাহী-২ (সদর)
এই আসনটি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি চারবার, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি তিনবার, আওয়ামী লীগ দুবার ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী একবার নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি আবারও প্রার্থী করেছে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমানকে (মিনু)। দলীয় মনোনয়ন পেয়ে ইতিমধ্যে তিনি প্রচার শুরু করেছেন।
এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী মহানগরের নায়েবে আমির মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। এ ছাড়া গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক মুরাদ মোর্শেদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. ফায়সাল হোসেন (মনি), খেলাফত মজলিসের মোহাম্মাদ উল্লাহ শাহীন, বাসদের জেলা সদস্যসচিব সামছুল আবেদীন এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন।
রাজশাহী–৩ আসনে শফিকুল হককে (মিলন) মনোনয়ন দেওয়ায় জেলা বিএনপির সদস্য রায়হানুল আলম ও সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী কবির হোসেনের ছেলে নাসির হোসেনের সমর্থকেরা রাজপথে আন্দোলন করছেন।রাজশাহী-৩ (পবা- মোহনপুর)
নগরের পাশের হওয়ায় এটিও গুরুত্বপূর্ণ আসন। এখানে আবারও বিএনপির টিকিট পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সম্পাদক শফিকুল হক (মিলন)। তাঁকে মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকে জেলা বিএনপির সদস্য রায়হানুল আলম ও সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী কবির হোসেনের ছেলে নাসির হোসেনের সমর্থকেরা রাজপথে আন্দোলন করছেন। প্রার্থী বদলের দাবিতে ইতিমধ্যে বিক্ষোভ মিছিল, রাস্তা অবরোধের মতো ঘটনা ঘটেছে।
এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী দলটির মহানগর ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। এ ছাড়া গণসংহতি আন্দোলন থেকে জুয়েল রানা, ইসলামী আন্দোলন থেকে ফজলুর রহমান এবং খেলাফত মজলিস থেকে গোলাম মোস্তফাকে প্রার্থী করা হয়েছে।
রাজশাহী-৪ (বাগমারা)
এখানে নতুন মুখ বাগমারা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডি এম জিয়াউর রহমান দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। সম্প্রতি থানায় পুলিশকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একটি জিডি হয়েছে। মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব কামাল হোসেনের সমর্থকদের বাড়িঘরে ককটেল বিস্ফোরণ, পুকুরের মাছ বিষ দিয়ে মারার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৬ নভেম্বর উপজেলার ভবানীগঞ্জে তাঁর মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে সমাবেশ হয়েছে।
এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী আবদুল বারী সরদার। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন থেকে আবু মুসা, খেলাফত মজলিস থেকে ফেরদাউসুর রহমান এবং বাসদ থেকে জেলা কমিটির সদস্য ফিরোজ আলম প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন।
রাজশাহী–৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলামকে বদলের দাবিতে মনোনয়নপ্রত্যাশী আবু বকর সিদ্দিক, ইশফাক খায়রুল হক ও প্রয়াত নেতা নাদিম মোস্তফার ছেলে জুলফার নাঈম মোস্তফার সমর্থকেরা নানা কর্মসূচি পালন করছেন।রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর)
এই আসনে আওয়ামী লীগ সাতবার, বিএনপি পাঁচবার এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী একবার নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি এবার জেলা কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম মণ্ডলকে মনোনয়ন দিয়েছে। এই আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু বকর সিদ্দিক, পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ইশফাক খায়রুল হক ও প্রয়াত নেতা নাদিম মোস্তফার ছেলে জুলফার নাঈম মোস্তফা। তাঁদের সমর্থকেরা নজরুল ইসলামকে জনগণ থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ আখ্যা দিয়ে দুই উপজেলায় সংবাদ সম্মেলন করেছেন। প্রার্থী বদলের দাবিতে মশালমিছিলও হয়েছে।
এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী জেলা সহ- সেক্রেটারি মো. নুরুজ্জামান লিটন। ইসলামী আন্দোলন থেকে রুহুল আমিন ও খেলাফত মজলিস থেকে আবদুল হামিদকে প্রার্থী করা হয়েছে।
রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট)
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ (চাঁদ) এই আসনে আবার মনোনয়ন পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ আমলে শেখ হাসিনাকে ‘কবরে পাঠানোর’ বক্তব্যে তাঁর বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা হয়েছিল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের পুরো সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল ১০২টি। জেলে থাকাকালে মা ও স্ত্রীকে হারিয়েছেন। বিএনপি তাঁর ওপর আস্থা রেখেছে। এখানেও বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও আবু সাঈদকে মনোনয়ন দেওয়ার পর তাঁরা কেউ এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে মাঠে নামেননি।
আওয়ামী লীগ আমলে শেখ হাসিনাকে ‘কবরে পাঠানোর’ বক্তব্যের কারণে আবু সাঈদের (চাঁদ) বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা হয়েছিল। সবমিলিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল ১০২টি। জেলে থাকাকালে মা ও স্ত্রীকে হারিয়েছেন।এখানে জামায়াতের প্রার্থী জেলা সহ- সেক্রেটারি নাজমুল হক। ইসলামী আন্দোলন থেকে আমিনুল ইসলাম এবং খেলাফত মজলিস থেকে তোফায়েল আহমদ এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন। এই আসন থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টির রাজশাহী বিভাগীয় সংগঠক ইমরান ইমন নির্বাচন করবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।