বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের পাশেই অবস্থান করছে। তাই মাঝেমধ্যে কাঁপুনি অনুভূত হওয়া অবাক হওয়ার কিছু নয়। তবে গতকাল শুক্রবারের ভূমিকম্পটি নতুন বার্তা দিয়ে গেছে। আর নীতিনির্ধারকদের সামনে ঝুঁকি কমানোর জরুরি দায়িত্ব তুলে ধরেছে।

শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের ওই ভূমিকম্প নিয়ে দেওয়া এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেছে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতি। ওই দিনই দেওয়া এই বিবৃতিতে সই করেছেন সমিতির সভাপতি অধ্যাপক বদরুল ইমাম ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার জাহিদ।

নরসিংদীর মাধবদীতে আঘাত হানা ওই ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা। সারা দেশেই কম্পন অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের সময় অনেকেই আতঙ্কে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন। ভূমিকম্পের ঘটনায় শিশুসহ ১০ জন নিহত ও ৬ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি—পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে। ঢাকায় চার ও নারায়ণগঞ্জে একজন মারা যান। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে অনেকেই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন। এ ছাড়া কিছু ভবন হেলে পড়ে এবং ফাটল দেখা দেয়।

তীব্র কম্পন অনুভূত হওয়ার কারণ

বিবৃতিতে বলা হয়, শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটারের গভীরে একটি ভূকম্পন ঘটেছে। ভূমিকম্পটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ও অন্যান্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির তীব্রতা ছিল ৫ দশমিক ৫ থেকে ৫ দশমিক ৭, যা ছিল মাঝারি মাত্রার। এর কেন্দ্রস্থল ছিল নরসিংদী থেকে ১৪ কিলোমিটার পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিমে।

ভূমিকম্পটি পর্যবেক্ষণ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ভূকম্পনের গভীরতা তুলনামূলক স্বল্প হওয়ায় ভূমিতে সঞ্চারিত কম্পন শক্তিশালীভাবে অনুভূত হয়েছে।

ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বিবৃতিতে বলা হয়, এই অঞ্চলটি এমন একটি এলাকায় অবস্থিত, যেটি ইন্দো-বার্মা টেকটোনিক প্লেটের অংশভুক্ত। এটি শীতলক্ষ্যা নদীর ফল্ট লাইন বরাবর সংঘটিত হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, দেশে ভবিষ্যতেও এ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে লুকানো ফল্টগুলোর দ্রুত ম্যাপিং করে জাতীয় ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্রে গুরুত্বসহকারে যুক্ত করা প্রয়োজন।

ঢাকা ও আশপাশের এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এ ধরনের ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভূতত্ত্ববিদদের সক্রিয় অংশগ্রহণে বিস্তারিত মাইক্রোজোনেশন (ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় ভাগ করে ঝুঁকি নিরূপণ) জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশের অবস্থান খুবই জটিল

বিবৃতিতে বলা হয়, বিশেষজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদদের মতে বাংলাদেশের ‘জিওগ্রাফিক–জিওলজিক্যাল–টেকটোনিক’ অবস্থান খুবই জটিল। তবে বাংলাদেশ স্পটভাবে ‘সাবডাকশন’ সম্পর্কিত ‘প্লেট বাউন্ডারিতে’ অবস্থিত। ইন্ডিয়ান প্লেটটি বার্মিজ প্লেটের নিচে যাওয়া শুরু করছে কয়েক লাখ বছর আগে। এর ফলেই চট্টগ্রাম, সিলেটের পাহাড়গুলো তৈরি হয়েছে। প্লেট দুটোর চাপের এই কাণ্ড এখনো চলমান। তবে এর গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য আরও সমীক্ষা ও গবেষণা প্রয়োজন।

ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, ভূমিকম্পের যেহেতু কোনো আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া যাচ্ছে না, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে; তাই প্রস্তুতি না থাকলে ঝুঁকি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। জ্ঞান, পরিকল্পনা আর একটু অভ্যাস জীবন বাঁচাতে পারে। যদি স্কুল, অফিস বা পরিবারে নিয়মিত মহড়া করা যায়, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারবে এ পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। আর এখানেই সচেতনতায় সাফল্য।

বিবৃতিতে বলা হয়, আমাদের মনে রাখতে হবে ভূমিকম্প স্বাভাবিক একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের পাশেই অবস্থান করছে। তাই মাঝেমধ্যে কাঁপুনি অনুভূত হওয়া অবাক হওয়ার কিছু নয়। কিন্তু ভয় বা গুজব নয়, বরং তথ্য-উপাত্তই এখানে সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।

আরও পড়ুনসাড়ে ৩১ ঘণ্টায় চারবার ভূমিকম্প১ ঘণ্টা আগেযে বার্তা দিয়ে গেল

ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, ‘নরসিংদীর ভূমিকম্প আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল মোটেই স্থির নয়। আজকের ভূমিকম্প ভূগর্ভে চাপমুক্ত করেছে, এমনটি ভাবার অবকাশ নেই; বরং ধীরে ধীরে চাপ বাড়ছে এবং যেকোনো সময় এ ধরনের আরও ভূমিকম্প ঘটতে পারে। বাংলাদেশের ভেতর ও বাইরের ‘মধুপুর ফল্ট, ডাউকি ফল্ট, প্লেট বাউন্ডারি, আরাকান সাবডাকশন জোন’ আরও বড় মাত্রার ভূকম্পন তৈরি করতে পারে।

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থান করায় আগামী দশকগুলোতেও বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি থেকেই যাবে। আজকের ঘটনাটি বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন বার্তা এনে দিয়েছে আর নীতিনির্ধারকদের সামনে ঝুঁকি কমানোর জরুরি দায়িত্ব তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতি মনে করে, বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও দেশের বিভিন্ন খাতে টেকসই উন্নয়নের জন্য ভূতাত্ত্বিক জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভূতত্ত্ববিদদের সক্রিয় অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ জরুরি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ভ ম কম প ভ ম কম প র অবস থ ন অন ভ ত র এল ক ত হয় ছ এল ক য় হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভূমিকম্প আতঙ্কে’ রোববার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ

ভূমিকম্প নিয়ে উদ্বেগের কারণে রোববার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনের কার্যক্রম ও দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড চালু থাকবে।

শনিবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা কয়েক দফায় হওয়া ভূমিকম্পের কারণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এ জন্য আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেই বিবেচনা করে সোমবার আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব।’

শনিবার রাত সোয়া নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, রোববার শিক্ষার্থীদের পরিবহনসেবা বন্ধ থাকবে। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাস যথারীতি চালু থাকবে। স্থগিত করা পরীক্ষার নতুন সময়সূচি সংশ্লিষ্ট বিভাগ যথাসময়ে ঘোষণা করবে। এ ছাড়া সবাইকে প্রয়োজনীয় সতর্কতা মেনে চলারও অনুরোধ জানানো হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ