হুঁশিয়ারি বার্তা, চাই কার্যকর প্রস্তুতি
Published: 23rd, November 2025 GMT
দেশের বিভিন্ন স্থানে শুক্র ও শনিবার কয়েক দফা ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে। এই ভূমিকম্প আমাদের অপ্রস্তুত অবস্থাকে আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। শুক্রবারের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ১০ জন মানুষের মৃত্যু এবং ছয় শতাধিক মানুষের আহত হওয়ার ঘটনা শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপার নয়; এর চেয়েও বড় সমস্যা। এটা আমাদের নগর–পরিকল্পনা, অবকাঠামো, নিরাপত্তাব্যবস্থা ও জনসচেতনতার ভয়াবহ ঘাটতি।
শুক্রবারের ভূমিকম্পে যে হতাহত হয়েছে, তা মূলত রেলিং ও দেয়াল ধসে, ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া ও আতঙ্কে ছোটাছুটি করার কারণেই। অর্থাৎ কম্পনের তীব্রতার চেয়ে প্রস্তুতির অভাবই মানুষের প্রাণ কেড়েছে বেশি। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি মূলত মানবসৃষ্ট ভুলের ফল।
গবেষকেরা বলছেন, নরসিংদী ও আশপাশের অঞ্চলটি সাবডাকশন জোন—বার্মা প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। এই অঞ্চলে শত শত বছর ধরে শক্তি জমছে, যে শক্তি প্রায় ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটানোর ক্ষমতা রাখে। শুক্রবারের ভূমিকম্প সেই শক্তির সামান্য অংশমাত্র। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন—সামনে আরও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে এবং আমাদের প্রস্তুতি একেবারেই অপ্রতুল।
সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা শহর। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও অনিয়ন্ত্রিত নগরীগুলোর একটি ঢাকা; যেখানে ৯৫ শতাংশ ভবনই বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মিত হয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান যুগের ভবন এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার নতুন অনেক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে ভূমিকম্প–সহনশীলতার কোনো মানদণ্ডই বাস্তবে নিশ্চিত করা হয়নি। সরকারি ভবনও এর ব্যতিক্রম নয়। ভূমিকম্প প্রতিরোধ সক্ষমতা বাড়ানোকে এখনো ‘অতিরিক্ত খরচের বিষয়’ ভাবা হয়। তবে খরচ বাঁচাতে গিয়ে যে মানুষের জীবন বিপন্ন করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে, কোথায় অবস্থান করতে হবে, কোন জায়গা নিরাপদ—এসবই বেশির ভাগ মানুষের অজানা। স্কুল, কলেজ, অফিস, বাজার—সব জায়গায় নিয়মিত মহড়া চালু করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা যে ‘ন্যাচারাল হ্যাজার্ড গেম’ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটিও যুগোপযোগী করতে হবে। উদ্ধারকাজে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে কোনো লাভ নেই। এর বদলে অল্প বাজেটে নিয়মিত মহড়া, প্রশিক্ষণ, স্কুলভিত্তিক শিক্ষা এবং স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন অনেক বেশি কার্যকর হবে। জাপান, চিলি বা নেপালের অভিজ্ঞতা আমাদের দেখায়—প্রস্তুতি থাকলে প্রাণহানি অনেক কমে যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নগর–পরিকল্পনার সংস্কার করতে হবে। বর্তমান নগরায়ণকে ৫০–১০০ বছরের মধ্যে বদলানো কঠিন। কিন্তু যেসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলো দ্রুত তালিকাভুক্ত করে ভাঙা বা সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন সব নির্মাণে কঠোরভাবে বিল্ডিং কোড মানা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার, সিটি করপোরেশন, রাজউক—সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।
পরপর দুই দিনের ভূমিকম্প আমাদের আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে—সময় খুব বেশি নেই। আগামী ভূমিকম্প আরও তীব্র ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে। আমরা চাই না আবার কোনো রাফিউল, শিশু ফাতেমা বা কোনো পরিবারের স্বপ্ন এভাবে ধসে পড়ুক। এখনই বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা, নিয়মিত অনুশীলন ও কঠোর তদারকির মাধ্যমে ভূমিকম্পে ঝুঁকি কমানোর কাজ শুরু করতে হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না, কিন্তু প্রস্তুত থাকলে জীবন বাঁচানো সম্ভব—সংশ্লিষ্ট সবাইকে এটা অনুধাবন করতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ভ ম কম প প রস ত ত আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
আমরা কি জেনেবুঝে বিপর্যয় ডেকে আনছি
ঢাকার মাটির নিচে যে ভূতাত্ত্বিক শক্তি সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, তার সামান্যতম বিচ্যুতিতেও এই মহানগরী এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। এই কঠিন বাস্তবতায় শহরটিকে নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ না থাকলেও, এর ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। বিদ্যমান অবকাঠামোকে কেন্দ্র করেই আমাদের এমন উপায় বের করতে হবে, যা এই শহরকে নিরাপদ করতে পারে।
গত ৩০-৩৫ বছরে ঢাকা শহরের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে, যার একটি বড় অংশই হয়েছে নরম মাটির ওপর। বিশেষ করে, শহরের পূর্বাংশে প্রগতি সরণি থেকে বালু নদ পর্যন্ত এবং শহরের পশ্চিম অংশে শ্যামলী, বছিলার মতো এলাকাগুলো নরম মাটির স্তরের ওপর গড়ে উঠেছে। নরম মাটিতে নির্মিত অবকাঠামো ভূমিকম্পের সময় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। কারণ, এ ধরনের মাটি ভূকম্পন তরঙ্গকে বিবর্ধিত করে এবং তীব্র ঝাঁকুনিতে এর ভারবহন ক্ষমতা হারাতে পারে। এই অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ শহরকে একটি গুরুতর বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
আরও পড়ুনভূমিকম্পে ঢাকার বড় বিপদ স্পষ্ট হচ্ছে৩ ঘণ্টা আগেঅবকাঠামোগত বিশৃঙ্খলা ঢাকার ঝুঁকিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে, যার মূলে রয়েছে বিল্ডিং কোডের (ইমারত বিধিমালা) নির্দেশনাকে প্রয়োগ না করতে পারার ব্যর্থতা। শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ ভবনই কোনো না কোনোভাবে ইমারত নির্মাণ আইন ও বিল্ডিং কোড অমান্য করে তৈরি হয়েছে, যা সেগুলোকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। খুব অল্পসংখ্যক ভবন তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হলেও, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যাই বেশি। বিল্ডিং কোডের এই পদ্ধতিগত লঙ্ঘন মূলত এর প্রয়োগ ও তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার অভাবকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যা একটি কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তাকে অপরিহার্য করে তুলেছে।
ঢাকাকে ভূমিকম্পের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত করতে একটি দ্বিমুখী কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য। একদিকে যেমন বিদ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, তেমনই ভবিষ্যৎ নির্মাণকাজ যেন সম্পূর্ণ নিরাপদ ও টেকসই হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। এই দুটি লক্ষ্য সামনে রেখেই আমাদের কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে।
এর জন্য প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো শহরের প্রতিটি ভবনের ভূমিকম্প ঝুঁকি মূল্যায়ন করা। মূল্যায়নের পর যেসব ভবনকে শক্তিশালী করা সম্ভব, সেগুলোকে রেট্রোফিটিং বা মজবুতকরণ করতে হবে। জাপানের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলো এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ করে তাদের পুরোনো ভবনগুলোকে সুরক্ষিত করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ভবনগুলোর ক্ষেত্রে এই মজবুতকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই; এটিই বিদ্যমান অবকাঠামোকে সম্ভাব্য ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ।
আরও পড়ুনশক্তিশালী কম্পন অনুভব করেছেন ঢাকার ১ কোটির বেশি মানুষ: ইউএসজিএস ২২ নভেম্বর ২০২৫ভবিষ্যতে ঢাকাকে নিরাপদ রাখতে নতুন নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে কোনো আপস করা চলবে না। নতুন সব নির্মাণকাজে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) কঠোরভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটলে চলবে না। এই কাজ কার্যকরভাবে সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি দ্রুত গঠন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি রাজউক, সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রতিটি সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, যেন তারা নিজ নিজ এখতিয়ারে বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারে।
সরকারি তদারকি–ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে এবং নির্মাণকাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ‘থার্ড-পার্টি মনিটরিং’ একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে।
দুর্যোগ–পূর্ববর্তী এই প্রস্তুতিগুলোর পাশাপাশি, দুর্যোগ–পরবর্তী উদ্ধারব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দেওয়াও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক হলেও সত্য, ঢাকায় দুর্যোগকালীন উদ্ধার সক্ষমতা এতটাই দুর্বল যে একটি ছোট আকারের দুর্যোগ মোকাবিলার জন্যও তা যথেষ্ট নয়। ফায়ার সার্ভিস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো এবং সিটি করপোরেশনের মতো সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। নিকট অতীতে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো ঘটনা আমাদের এই দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুনঢাকার প্রায় সব ভবনই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে: শামীমুজ্জামান বসুনিয়া২১ নভেম্বর ২০২৫যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অপ্রতুল, সেহেতু আমাদের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত এবং জীবনরক্ষাকারী কৌশল হলো একটি সুপ্রশিক্ষিত ও বিশাল স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তোলা। ভূমিকম্প–পরবর্তী উদ্ধারকাজে সহায়তার জন্য প্রচুর পরিমাণে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করতে হবে। এই অনিশ্চিত কিন্তু সম্ভাব্য দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন ও তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানই হতে পারে দুর্যোগ মোকাবিলার অন্যতম কার্যকর একটি উপায়।
ঢাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি অত্যন্ত গুরুতর এবং এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। তবে হতাশ না হয়ে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে এই ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব। বিদ্যমান ভবনগুলোর রেট্রোফিটিং, নতুন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোডের কঠোর প্রয়োগ এবং দুর্যোগ–পরবর্তী সময়ের জন্য একটি শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবকভিত্তিক উদ্ধারব্যবস্থা গড়ে তোলাই হলো সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ। এই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ কোনো বিকল্প নয়, বরং ঢাকার টিকে থাকার একমাত্র উপায়। এ বিষয়টি উপেক্ষা করে কি আমরা জেনেবুঝে বিপর্যয় ডেকে আনব?
● অধ্যাপক আকতার মাহমুদ: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক