গুলেন ব্যারি সিনড্রোম: নাম অপরিচিত, প্রাদুর্ভাব কম নয়
Published: 17th, October 2025 GMT
গুলেন ব্যারি সিনড্রোম বা সংক্ষেপে জিবিএস নামটি অনেকের কাছেই অপরিচিত ও দুর্বোধ্য। কিন্তু এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে নেহাত কম নয়। যেকোনো বয়সের শিশু-কিশোর বা নারী-পুরুষ যেকোনো সময় এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
কারণ কী
জিবিএসের মূল কারণ জীবাণুঘটিত হলেও প্রকৃতপক্ষে জীবাণু প্রতিরোধী ইমিউন সিস্টেমের অস্বাভাবিক আচরণের ফলে এ রোগের উৎপত্তি হয়।
‘ক্যাম্পাইলো ব্যাকটর জেজুনি’ নামের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত ‘ডায়রিয়ার রোগী বা ইনফ্লুয়েঞ্জা’ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত সর্দি-জ্বরের রোগীরা সাধারণত ‘জিবিএস’-এ আক্রান্ত হয়।
কীভাবে বুঝবেন
ডায়রিয়া বা ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের প্রায় দুই সপ্তাহ পর রোগী প্রথমে দুই পায়ে দুর্বলতা বোধ করে। এই দুর্বলতা বাড়তে থাকে এবং ওপরের দিকে বিস্তার লাভ করে মেরুদণ্ড, দুই হাত, বুকের মাংসপেশি এমনকি মুখের মাংসপেশিতে ছড়িয়ে পড়ে।
কখনো কখনো দুর্বলতা এত বেশি হয় যে রোগী হাত-পায়ের আঙুলও সামান্য পরিমাণ নাড়াতে পারে না। বুকের মাংসপেশির দুর্বলতার কারণে শ্বাসকষ্ট হলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালের ‘নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিটে’ স্থানান্তর করতে হয়।
জিবিএস রোগীর এত দুর্বলতা সত্ত্বেও সাধারণ অনুভূতি, স্মৃতিশক্তি, পায়খানা-প্রস্রাবের কোনো সমস্যা হয় না এবং রোগী কখনো অজ্ঞান হয়ে যায় না।
জিবিএসের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রায় ৮০ ভাগ রোগী সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করে।কী করবেন
জিবিএস আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করতে হবে। স্নায়ুরোগবিশেষজ্ঞ উপসর্গ, শারীরিক পরীক্ষা, এনসিএস নামক স্নায়ুর পরীক্ষা এবং মস্তিষ্কের সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড বিশ্লেষণ করে রোগটি নির্ণয় করেন।
রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস, নাড়ির গতি, রক্তচাপ ইত্যাদির প্রতি সার্বক্ষণিক লক্ষ রাখতে হয়। যদি শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, তবে তাৎক্ষণিকভাবে রোগীকে আইসিইউতে স্থানান্তর করতে হয়। নিয়মিত হাত-পায়ের ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রোগীকে দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে। এ রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা ব্যয়বহুল।
কোনো কোনো রোগীর আরোগ্য পেতে প্রায় এক বছর লেগে যায়। প্লাজমাফেরোসিস তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল। তবে আইভি ইমিউনোগ্লোবিনের খরচ ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা। উপসর্গ শুরুর দুই সপ্তাহের মধ্যে এ চিকিৎসা দিতে হয়।
চিকিৎসায় সফলতা
জিবিএসের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রায় ৮০ ভাগ রোগী সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করে, ৫-১০ ভাগ রোগীর কিছু না কিছু শারীরিক দুর্বলতা স্থায়ীভাবে থেকে যায় এবং ৫-৬ ভাগ রোগী মারা যায়।
সতর্কতা
সাধারণত কোনো ইনফেকশন যেমন ডায়রিয়া বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের দুই বা তিন সপ্তাহ পরে জিবিএসের লক্ষণ দেখা দেয়। কখনো কখনো ভ্যাকসিন দেওয়ার পরও জিবিএস হতে পারে। তাই এ ধরনের সংক্রমণের পর এমন উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
অধ্যাপক ডা.
এম এস জহিরুল হক চৌধুরী, ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল, ঢাকা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ব এস র দ র বলত স ধ রণত
এছাড়াও পড়ুন:
রোগ নির্ণয়ের নামে অতিরিক্ত পরীক্ষা, প্রতিকার কোথায়!
স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। দেশে আধুনিক চিকিৎসাসুবিধা ও ডায়াগনস্টিক প্রযুক্তির উন্নতি যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যে হাসপাতাল নিয়ে ভয়ও তৈরি হয়েছে। কারণ, প্রায়ই শোনা যায় পরীক্ষা না করালে চিকিৎসক চিকিৎসা শুরু করেন না। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৬৭ শতাংশ মানুষকে নিজেদের পকেট থেকে দিতে হয়, যার মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ খরচ চলে যায় ডায়াগনস্টিক পরীক্ষায়।
জ্বর, সর্দি বা কাশির মতো সাধারণ অসুখ অনেক সময় বিশ্রামে বা সামান্য ওষুধে সেরে যায়। কিন্তু এখন দেখা যায়, জ্বর নিয়ে হাসপাতালে গেলে ধরিয়ে দেওয়া হয় পরীক্ষার দীর্ঘ তালিকা; যেমন সিবিসি, সিআরপি, ডেঙ্গু বা টাইফয়েড পরীক্ষা। সাধারণ জ্বরের রোগীদের প্রায় ৫৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই পাঁচটির বেশি পরীক্ষা লেখা হয়, যার খরচ দাঁড়ায় দুই থেকে তিন হাজার টাকা। একইভাবে বুক ব্যথার মতো সাধারণ উপসর্গেও ৬২ শতাংশ রোগীকে ইসিজি, সিবিসি, আলট্রাসনোগ্রাফি বা এন্ডোস্কোপির মতো পরীক্ষা করতে বলা হয়, যদিও অনেক সময় একটি সাধারণ অ্যান্টাসিডই যথেষ্ট হতে পারত।
স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এ ধরনের খরচ বড় চাপ তৈরি করে। একজন দিনমজুরের মাসিক আয় যদি ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা হয়, তাহলে একবার হাসপাতালে গিয়ে তিন বা চার হাজার টাকা খরচ করা তাঁর পক্ষে কঠিন। এর ফলে অনেকেই হাসপাতাল এড়িয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খান। এতে সাময়িক উপশম মিললেও গুরুতর রোগ শনাক্ত না হওয়ায় ভবিষ্যতে আরও বিপদের মুখে পড়েন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ মানুষ পরীক্ষার খরচের ভয়েই চিকিৎসা শুরু করেন না এবং ৩৩ শতাংশ প্রথমে ফার্মেসিতে যান, পরে জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসক দেখান।
কেন এত অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করানো হয়—এ প্রশ্নে বেশ কিছু কারণ সামনে আসে। কিছু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠালে কমিশন পান এবং কিছু ক্ষেত্রে এই কমিশনের হার ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। অন্যদিকে অনেক বেসরকারি কেন্দ্র দামি যন্ত্রপাতির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে থাকে।
অবশ্যই সব চিকিৎসক এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নন। অনেকেই দায়িত্ব নিয়ে রোগী দেখেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরীক্ষা দেন। একই উপসর্গে একাধিক সম্ভাব্য রোগ থাকতে পারে, তাই সতর্কতার জন্য কখনো কখনো অতিরিক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।
সমাধানের জন্য প্রয়োজন কঠোর তদারকি, স্বচ্ছ নীতিমালা ও সরকারি হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি। কোন উপসর্গে কোন পরীক্ষা লাগবে, তা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা উচিত। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ফি ও অতিরিক্ত চার্জ প্রকাশ্যে আনতে হবে এবং সেগুলো নিয়মিত নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। পাশাপাশি রোগীকেও সচেতন হতে হবে এবং প্রতিটি পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রশ্ন করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। নৈতিকতা, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার ভিত্তিতেই স্বাস্থ্যসেবা মানবিক ও কার্যকর হতে পারে।
ইব্রাহীম খলিল শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]