ট্রাইব্যুনাল বললেন, আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য
Published: 23rd, November 2025 GMT
গুম-নির্যাতনের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি মামলায় গ্রেপ্তার ১৩ সেনা কর্মকর্তাকে ভার্চ্যুয়ালি হাজিরা দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবীর এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, এটি করা যাবে না। যেখানে সাবেক প্রধান বিচারপতি সশরীর হাজির হচ্ছেন, সেখানে সেনা কর্মকর্তাদের জন্য ছাড় কেন। আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
বিচারপতি মো.
সেনা কর্মকর্তাদের ভার্চ্যুয়ালি হাজিরার আবেদনের বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল মন্তব্য করলেও আদেশ দেননি। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে আগামী ৩ ডিসেম্বর।
আজ শুনানি শেষে দুপুরে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, তাঁরা (আসামি সেনা কর্মকর্তারা) ভার্চ্যুয়ালি হাজিরা দিতে চেয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন যে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি কারাগারে আছেন, তাঁকে হাজির হতে হয় সশরীর। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারক, সাবেক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী, বিভিন্ন পর্যায়ের আসামিরা নিয়মিত সশরীর হাজিরা দেন। এখানে ভিন্ন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যে কারণে বিশেষ বিবেচনায় কাউকে ভার্চ্যুয়ালি হাজিরা দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন দিতে হবে। এটা ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজন মনে করেন না। ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তারপরও আসামিপক্ষের আবেদন শুনবেন ট্রাইব্যুনাল।
অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্যআওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সংঘটিত গুম-নির্যাতনের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি মামলায় সাবেক ও বর্তমান ২৩ সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ২৮ জন আসামি। তাঁদের মধ্যে ১৩ সেনা কর্মকর্তা গ্রেপ্তার আছেন এবং বাকিরা পলাতক। আজ গ্রেপ্তার সেনা কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। সেনা কর্মকর্তাদের হাজিরা উপলক্ষে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সেনা, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও এপিবিএন সদস্যদের সতর্ক পাহারায় দেখা গেছে।
সেনা কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনালে আনা হয় সকাল ১০টায়। বেলা ১১টার দিকে তাঁদের ট্রাইব্যুনালে তোলা হয়। ট্রাইব্যুনাল বসেন ১১টা ২০ মিনিটে।
ট্রাইব্যুনালের কার্যতালিকায় দুই নম্বরে ছিল টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে (টিএফআই সেল) গুম করে রাখার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা। এ মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট আসামি ১৭ জন। গ্রেপ্তার আছেন ১০ জন। তাঁরা হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, মো. কামরুল হাসান, মো. মাহাবুব আলম ও কে এম আজাদ; কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন ও আনোয়ার লতিফ খান (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে); লে. কর্নেল মো. মশিউর রহমান, সাইফুল ইসলাম সুমন ও মো. সারওয়ার বিন কাশেম।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ এ মামলায় ৭ আসামি পলাতক। ৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের কার্যতালিকায় আজ ৩ নম্বরে ছিল জেআইসিতে গুম করে রাখার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলা। সে মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি ১৩ জন। গ্রেপ্তার আছেন তিনজন। তাঁরা হলেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক তিন পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী।
শেখ হাসিনা, তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ এ মামলার ১০ আসামি পলাতক। আগামী ৭ ডিসেম্বর এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি হবে।
গুম-নির্যাতনের এই দুই মামলার পলাতক আসামি শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতিদের নিয়ে অবমাননাকর ছবি-লেখা অপসারণের নির্দেশআন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারপতি-বিচারকদের নিয়ে অবমাননাকর ও ব্যঙ্গাত্মক সব ধরনের ছবি, লেখা অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনকে (বিটিআরসি) এ নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১।
আজ ট্রাইব্যুনাল বলেন, তাঁদের নজরে এসেছে এই ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে মনগড়া ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অবমাননাকর, অপমানজনক, তাচ্ছিল্যপূর্ণ ছবি ও তথ্য, মন্তব্য, বিবৃতি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সব ধরনের গণমাধ্যম থেকে সরাতে হবে। ট্রাইব্যুনালের ভাবমূর্তি, মর্যাদা ও সম্মানের ক্ষতি না করে এবং আইন লঙ্ঘন না করে গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে লেখা বা যেকোনো কিছু করার কথাও বলেন ট্রাইব্যুনাল।
অবমাননাকর ও ব্যঙ্গাত্মক এসব ভিডিও, ছবি ও লেখা অপসারণ করে আগামী ৩ ডিসেম্বর বিটিআরসির চেয়ারম্যান ও তথ্যসচিবকে প্রতিবেদন দিতে বলেন ট্রাইব্যুনাল।
‘আপনাকেও আসামি করা হতে পারে’আইন অনুসরণ না করে মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অভিযোগ করেছেন তাঁর বোন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাজনীন নাহার। ট্রাইব্যুনালে নাজনীন বলেন, জিয়াউল আহসানকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা কিংবা প্রসিকিউশনের লোকজনের বাইরে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিসও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় নাবিলা ইদ্রিসের সেখানে থাকার জন্য ট্রাইব্যুনালের অনুমতি ছিল কি না, সেটা তিনি জানেন না। জিজ্ঞাসাবাদের সময় জিয়াউলকে নাবিলা হুমকি দেন বলেও দাবি করেন এই আইনজীবী।
এ বিষয়ে প্রসিকিউশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য ভুক্তভোগীদের আনেন তদন্ত কর্মকর্তারা। আর নাবিলা ইদ্রিস ঘটনা সম্পর্কে জানেন।
একপর্যায়ে জিয়াউল আহসানকে নিয়ে একটি মন্তব্য করেন চিফ প্রসিকিউটর। সেই মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন নাজনীন নাহার। এরপর নাজনীনের উদ্দেশে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আপনাকেও (নাজনীন) আসামি করা হতে পারে।’ নাজনীন নাহার বলেন, করেন।
ট্রাইব্যুনালকে তাজুল ইসলাম বলেন, তাঁর (নাজনীন) সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে নানা জায়গায়। জিয়াউল একাই প্রায় এক হাজার মানুষকে হত্যা করেছেন।
পরে সংবাদ সম্মেলনে তাজুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ ফলপ্রসূ করার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা যাঁকে প্রয়োজন মনে করবেন, তাঁকেই পাশে রাখতে পারবেন। ভুক্তভোগীর মুখোমুখি হলে আসামি সত্য বলতে বাধ্য হন। এ রকম প্রক্রিয়া তদন্ত সংস্থা অনুসরণ করছে।
বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের চেষ্টান্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানের জন্য বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করার চেষ্টা করছেন তাঁর আইনজীবী নাজনীন নাহার। আরেকটি আবেদনে ট্রাইব্যুনালে নাজনীন বলেন, জিয়াউলের পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের আবেদন প্রক্রিয়ার করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষসহ কয়েক জায়গায় সই প্রয়োজন।
প্রচলিত আইন মেনে সেসব সই নেওয়ার অনুমতি দেন ট্রাইব্যুনাল।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত দ র ন জন ন ন হ র ম নবত ব র ধ র ঘটন য় কর র আইনজ ব ড স ম বর ব চ রপত অপর ধ র কর ছ ন মন ত র জ য় উল র জন য ব চ রক ব দ কর র আইন তদন ত সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ফিরে এল
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান আবার ফিরছে। এ–সংক্রান্ত বিধান পুনরুজ্জীবিত হলেও এখনই তা কার্যকর হচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরের নির্বাচন অর্থাৎ চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে তা প্রয়োগ হতে পারে।
প্রায় তিন দশক আগে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছিল। এ–সংক্রান্ত বিধান পুনরুজ্জীবিত করে গতকাল বৃহস্পতিবার রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আইনজীবীরা বলছেন, এ রায়ের ফলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান পুনর্বহাল হলো। যাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে।
ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনকে সংবিধান পরিপন্থী ও বাতিল ঘোষণা করে ১৪ বছর আগে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছিলেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল মঞ্জুর এবং এ-সংক্রান্ত রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন নিষ্পত্তি করে গতকাল
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিতে রায় দেন।
গতকাল সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটের দিকে প্রধান বিচারপতি ও অপর ছয় বিচারপতি এজলাসে আসেন। আসন গ্রহণের পর রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। বেঞ্চের অপর ছয় সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
রায়ে বলা হয়, সর্বসম্মতিতে আপিলগুলো মঞ্জুর করা হলো, সে আলোকে রিভিউ আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করা হলো। নথিদৃষ্টে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে আপিল বিভাগের রায়টি (২০১১ সালের রায়) একাধিক ক্রটিপূর্ণ। অতএব পর্যালোচনাধীন রায়টি (২০১১ সালের রায়) সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হলো।
১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধন আইনের ধারা ৩ দিয়ে সন্নিবেশিত হওয়া সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছেদ ‘২ক পরিচ্ছেদ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ সম্পর্কিত বিধানাবলি এ রায়ের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো বলে আপিল বিভাগ উল্লেখ করেন।
রায়ে আরও বলা হয়, এরূপ পুনরুজ্জীবন ‘পরিচ্ছেদ ২ক’–এ উল্লেখিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধানাবলির স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল নিশ্চিত করে। তবে পুনরুজ্জীবিত অনুচ্ছেদ ৫৮খ(১) এবং অনুচ্ছেদ ৫৮গ(২)–এর বিধানের প্রয়োগ সাপেক্ষে তা কার্যকর হবে। পুনর্বহাল ও পুনরুজ্জীবিত ‘পরিচ্ছেদ ২ক’–এ উল্লেখিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধানাবলি কেবল ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতে কার্যকর হবে।
ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনের বিধানে যা ছিলত্রয়োদশ সংশোধনী আইনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার–সংক্রান্ত ৫৮খ(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর বা মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে যে তারিখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কার্যভার গ্রহণ করেন, সেই তারিখ থেকে সংসদ গঠিত হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদের কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত মেয়াদে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, উপদেষ্টা নিয়োগ ইত্যাদি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ৫৮গ(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সংসদ ভেঙে দেওয়ার বা ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টারা নিযুক্ত হবেন।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কার্যকর কবে থেকেরায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছেন, রায়ে আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হলো। এটা কার্যকর হবে পরবর্তী সংসদ ভাঙার পরের ১৫ দিনের মধ্যে।
এই রায় চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে কার্যকর হবে বলে মনে করেন আপিলকারী বিএনপির মহাসচিবের অন্যতম জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের পরে নতুন সরকার গঠিত হবে। সংসদ ভেঙে গেছে গত বছরের ৫ আগস্টের পর। সুতরাং ওই বিধান, অর্থাৎ যে বিধানটি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, এই বাস্তবতায় এটি কার্যকর করার সুযোগ নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন রিভিউ আবেদনকারী জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরও।
রায়ের প্রতিক্রিয়াতত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়ার পর দেশ গণতন্ত্রের মহাসড়কে হাঁটবে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে দেশের গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা হয়েছিল। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলে তা সাংবিধানিক হিসেবেই রায়ে ঘোষিত হলো।
একই আপিল বিভাগে তাঁর আগের রায়কে কলঙ্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ বলার ব্যাখ্যা জানিয়ে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ত্রুটিপূর্ণ ও কলঙ্কিত বলেই ওই রায় বাতিল করা হয়েছে। অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা কারণ ছিল, এই রায় লেখার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও তাঁর সহযোগীরা দণ্ডবিধির ২১৯ ধারায় অপরাধ করেছেন।
অন্যতম আপিলকারী সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যে রায় দিয়েছিলেন, তার মাধ্যমে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। যার ফলে গত তিনটি নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে।
রায়কে দেশের জন্য মাইলফলক বলে মন্তব্য করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। আপিলকারী বিএনপির মহাসচিবের এই আইনজীবী বলেছেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ফলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন। রায়ের ফলে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এসেছে।
বদিউল আলম মজুমদারসহ আপিলকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া বলেন, গতকাল দেওয়া রায়টি সামগ্রিকভাবে এই সময়ের পটভূমিতে খুবই ঐতিহাসিক। খায়রুল হকের নেতৃত্বে দেওয়া রায়টি ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল।
জুলাই সনদ ও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাজুলাই সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার যে রূপরেখা আছে, তার পরিবর্তন সম্ভব হবে কি না—জানতে চাইলে নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘পার্লামেন্টের কিছু ডিসকাশন থাকবে। ২০ বছর পরে জনগণ যদি মনে করে এই ব্যবস্থা পচে–গলে গেছে, এর থেকেও ভালো কোনো ব্যবস্থা গণতন্ত্র সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন, তাহলে অবশ্যই পার্লামেন্টের ডিসকাশন থাকবে।’
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, জুলাই সনদ চারটি বিকল্প দিয়ে গণভোটে পাঠানো হচ্ছে। এগুলো গণভোটে পাস হলে এবং নতুন সংসদের সংবিধান সংস্কার সভায় গৃহীত হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। তবে এটা নির্ভর করবে জুলাই সনদ গণভোটে পাস হলো কি না আর পাস হওয়ার পর সংবিধান সংস্কার পরিষদ তা গ্রহণ করবে কি না তার ওপর।
তত্ত্বাবধায়ক প্রবর্তন, বিলোপ ও পুনর্বহালনির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসংবলিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল। আইনটির শিরোনাম ছিল সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৯ সালে একটি রিট হয়।
রিটের শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট দেওয়া রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল থাকে। এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করে রিট আবেদনকারী পক্ষ। এই আপিল মঞ্জুর করে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ রায় দেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে (৪: ৩) ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন।
সেদিন সংক্ষিপ্ত আদেশে ওই ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তী দুটি (দশম ও একাদশ) জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে উল্লেখ করা হয়। তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদেশে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না। পূর্ণাঙ্গ রায় ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল।
এই রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী (২০১১ সাল) আনা হয়। এর আগে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে দেশে সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। আর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে।
২০২৪ সালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। একইভাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি রিভিউ আবেদন করেন। এর পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা মো. মোফাজ্জল হোসেন এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে পৃথক রিভিউ আবেদন করা হয়।
এ ছাড়া সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন এই মামলায় ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। শুনানিতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পর দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত তিনটি (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সাল) নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলেন আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবীরা।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়েছিল। এরপর গত ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। ১১ নভেম্বর শুনানি শেষে আপিল বিভাগ রায়ের জন্য গতকাল দিন ধার্য করেন। এদিন আপিল বিভাগের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাসংক্রান্ত বিধান পুনরুজ্জীবিত হলো।