এক দিনে পড়া যায় এমন পাঁচটি বাংলা উপন্যাস
Published: 20th, November 2025 GMT
১. অনুর পাঠশালা
মাহমুদুল হকের ‘অনুর পাঠশালা’ (যা আগে ‘যেখানে খঞ্জনা পাখী’ নামে পরিচিত ছিল) ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ৯১ পাতার একটি উপন্যাস। কাব্যধর্মী, মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজ-সচেতন এ উপন্যাসটিতে উচ্চবিত্তের এক বিশাল বাড়ির অভ্যন্তরে কিশোর অনুর বন্দিজীবন এবং তার মনোজগতের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা অত্যন্ত নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে। হাইকোর্টের প্রভাবশালী উকিল বাবার খুনে মনোবৃত্তি ও অতৃপ্ত মায়ের পরকীয়ার আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা অনু, সেই আস্থাহীন বৈভবের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি পেতে বাড়ির পাশের নিম্ন শ্রেণির বসতিতে পা বাড়ায়; যেখানে ফকিরা, গেনদু, টোকানি এবং বিশেষত চামারপাড়ার কিশোরী সরুদাসীর সাহচর্য তার কৈশোরিক চেতনায় এক ভিন্ন ‘পাঠশালা’ জগৎ খুলে দেয়। সরুদাসীর কাছ থেকে সে জীবন ও যৌনতার স্বাভাবিক পাঠ নেয়, যা তার উচ্চবিত্তের শুচিতাবোধের আবহে অনুপস্থিত। অনুর এই যাত্রা মূলত উচ্চবিত্তের ভড়ংপনা, হ্যাংলামির বিপরীতে নিম্নবিত্তের সহজাত আত্মমর্যাদার সূক্ষ্ম বৈপরীত্যকে উন্মোচন করে। উপন্যাসের শেষে অনু যখন সরুদাসীকে খুঁজতে গিয়ে তাকে এক হাড্ডিচর্মসার বৃদ্ধা হিসেবে আবিষ্কার করে, তখন পাঠকের মনে তীব্রভাবে প্রশ্ন জাগে যে কৈশোরের স্বপ্ন ও সৌন্দর্য কি কেবলই সময়ের হাতে লুণ্ঠিত এক বিভ্রম ছিল, নাকি এটি উচ্চবিত্তের চোখে দেখা নিম্নবিত্তের প্রতি এক নস্টালজিক মায়াজগৎ? মাহমুদুল হক এই উপন্যাসে কাব্যিক চিত্রকল্প ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা; দুইয়েরই সমন্বয় ঘটিয়ে সমাজ-সংস্কৃতি ও ব্যক্তির বৈপরীত্যকেই অনুর শিক্ষালয় রূপে তুলে ধরেছেন, যা তাঁর মন ভাবনাকে শিল্পে অনন্যতা দান করেছে।
২.উত্তর পুরুষ
রিজিয়া রহমানের ‘উত্তর পুরুষ’ (১৯৭৭) একটি নৃতাত্ত্বিক-ঐতিহাসিক উপন্যাস। ৮৮ পাতার এ উপন্যাসটি বাংলা কথাসাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে, যা মূলত পর্তুগিজ জলদস্যু ও বণিকদের উত্তর প্রজন্মের জীবন-সংকটকে উপজীব্য করে রচিত। উপন্যাসটি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে তার স্বতন্ত্র বিষয় নির্বাচন ও নির্মাণ-কৌশলের কারণে, যেখানে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বা কালাফিরিঙ্গি সমাজের বিপন্নতা ও অস্তিত্বের টানাপোড়েন নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় চরিত্র অ্যান্টনি ডিক্রুজ তার পূর্বপুরুষ ‘হার্মাদ’ গঞ্জালেসের অতীত আওড়াতে ভালোবাসে, কিন্তু তার সন্তান লিসি ও বনি ডিক্রুজ আধুনিক সমাজে চরম প্রতারণা, হতাশা ও নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার। লেখক ঐতিহাসিক সত্যকে কাহিনির কাঠামোর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে দেখিয়েছেন, গঞ্জালেসেরা যেমন একসময় এ দেশের সম্পদ ও নারী লুণ্ঠন করেছিল, ঠিক তেমনি তার উত্তরপুরুষেরা লুণ্ঠিত হচ্ছে। লিসি বন্দরে আসা নাবিক জেরি ফার্দিনান্দের ছলনায় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে আদিম দেহব্যবসায় লিপ্ত হয়, আর বনি ডিক্রুজ মাশোয়ার দ্বারা প্রতারিত হয়ে চোরাচালানের অভিযোগে ধরা পড়ে। ‘উত্তর পুরুষ’ পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তথাকথিত বিজয়ী পর্তুগিজ জাতির করুণ পরিণতি দেখায়। ডিক্রুজের ভিক্ষার হাত আর মেয়ে লিসির দেহপসারিনী হওয়ার মর্মান্তিক দৃশ্যে ইতিহাসের নির্মম প্রতিশোধ এবং পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত পরিস্ফুট হয়। উপন্যাসটি কেবল একটি বিশেষ জাতিসত্তার বিলুপ্তির আখ্যান নয়, বরং লুণ্ঠনকারী, অত্যাচারী জাতির প্রতি কালের বিচার এবং মানব অস্তিত্বের গভীর অর্থসংকটের এক অমোঘ দলিল।
৩. প্রদোষে প্রাকৃতজনশওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ (১৯৮৪) একটি সময় পরিভ্রমণকারী উপন্যাস। ১৯৭ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসটির ছোট পরিসরে বৃহৎ বঙ্গের আট শ বছর আগের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং মহাবিপ্লবের মুখে তাদের টিকে থাকার লড়াই ঠাঁই পেয়েছে। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দের এক চরম অস্থির সময়, যেখানে বর্ণপ্রথার বিষাক্ত ছোবল এবং সামন্ত রাজাদের অকথ্য নিপীড়নের সাক্ষী হয়েছে এই উপন্যাস। ‘প্রদোষ’ বা শেষ বিকেল, অর্থাৎ পতনোন্মুখ সেন রাজত্বের সেই ক্রান্তিকাল, আর ‘প্রাকৃতজন’ বা সাধারণ মানুষ; যারা সব যুগের মতোই শোষিত ও নীরব দর্শক, তারা এসেছে মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ ও তার স্ত্রী লীলাবতী অথবা বসন্তদাস ও মায়াবতীর মতো চরিত্রগুলোর মাধ্যমে। দুর্বল রাজা লক্ষ্মণ সেন এবং উদাসীন মন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্রের বিপরীতে প্রান্তিক মানুষগুলো যখন অন্ধকারে ডুবছে, তখন তাদের বিদ্রোহ আর টিকে থাকার স্পৃহাই হয়ে উঠেছে জীবনের প্রধান আয়োজন। এই উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তুর্কি মুসলিমদের (যবন) আগমনকে একটি রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে না দেখে আসন্ন সামাজিক বিপ্লব হিসেবে দেখা। এটি দেখায়, যখন সমাজের অভিজাত শ্রেণি (যেমন সামন্তরা) চূড়ান্ত নিপীড়ন চালাচ্ছে, তখন সাধারণ মানুষ এই নতুন শক্তিকে মুক্তির বা পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে বরণ করছে এক অনিবার্য অন্ধকার। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ তাই শুধুই ইতিহাস নয়, এটি সেই যুগের মানুষের মনস্তত্ত্ব, ধর্মীয় সংঘাত এবং এক ক্রান্তির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের হতাশা ও সাহসের এক প্রজ্জ্বলিত আখ্যান। এই উপন্যাস পাঠককে তার পূর্বপুরুষদের সংগ্রামের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত করবে।
৪. দিলুর গল্পরাহাত খানের কালজয়ী সৃষ্টি ‘দিলুর গল্প’ (১৯৮১) বাংলা শিশুসাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ৮৯ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসের প্রাণ হলো দিলু নামক চৌধুরীপাড়ায় সদ্য আসা এক সপ্তম শ্রেণির কিশোর। দিলু এমন এক চরিত্র, যাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। উপন্যাসের শুরুতেই লেখকের মনোমুগ্ধকর কাহিনি-বিন্যাস পাঠককে টেনে নিয়ে যায় শৈশবে। পাড়ার ছেলেরা যখন দিলুকে এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন দিলু অভিনব কৌশলে তাদের বন্ধুত্বের জালে বাঁধে। বাগানের আড্ডায় তার প্রথম বাক্যটিই ছিল—‘আমার পোষা বাঘটা হঠাৎ বেরিয়ে গেছে, তোমরা কেউ আমার বাঘটাকে দেখেছো?’ ছাগলের বদলে বাঘের কথা বলে সে কেবল আকবর, গজা ও সুনির্মলদের নীরবতা ভাঙতেই সক্ষম হয়নি, বরং তার এই সৃজনশীল চাতুর্য তাকে instantly কিশোর দলের সদস্য করে তোলে। এই একটি ঘটনাতেই দিলুর অনন্য ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। তবে দিলু শুধু একা নয়, চৌধুরীপাড়ার কিশোর দলের প্রতিটি সদস্যই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে অতুলনীয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো দলের প্রধান সাজাহান ভাই, যার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলার এক নিজস্ব ঢং। কাউকে তিরস্কার করার জন্য তার নিজস্ব শব্দমালা—যেমন ‘ইলিম্পু ডিলিম্পু য়েস্কট টস্কট’ (ইডিয়েট) এবং বকা দেওয়ার সময় ‘তুই একটা কাগজের খালি ঠোঙা, একটা থেঁতলানো কলার খোসা, পা পা ঝা (পাঁজির পা ঝাড়া)’—এই চরিত্রটিকে অবিস্মরণীয় করে তুলেছে। ব্রাঞ্চ আর মিল মিলিয়ে কাণ্ড-কারখানাকে ‘ব্রাঞ্চমিল’ বলার মতো উদ্ভাবনী ভাষা প্রয়োগ সাজাহান ভাইকে বাংলা শিশুসাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী চরিত্র করে তোলে। প্রদীপের মতো চরিত্রও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার কল্পনা করে কাহিনিতে হাস্যরসের নতুন মাত্রা যোগ করে। ‘দিলুর গল্প’ হাসির খোরাক, দুষ্টুমি, রোমাঞ্চকর অভিযান এবং সত্যিকারের বন্ধুত্বের এক অগভীর খনি। বইটি নিছক বিনোদন নয়, বরং শৈশবের সেই নির্ভেজাল সারল্য, কল্পনাবিলাস ও দলবদ্ধতার আনন্দকে তুলে ধরে।
৫. ইস্টিশন৯২ পৃষ্ঠার হুমায়ূন আহমেদের ‘ইস্টিশন’ উপন্যাসটি (১৯৮৫) কেবল একটি কাহিনি নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের পাঠকের জন্য এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজ-সচেতন পাঠ, যা মফস্সলি জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চরম ট্র্যাজেডি ও মানবিক সম্পর্কের জটিলতা উন্মোচন করে। নান্দাইল রোড ইস্টিশনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত এই আখ্যানটি পাঠকের আকর্ষণকে ধরে রাখে ঘোরলাগা বর্ণনা কৌশল ও অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহে। উপন্যাসটি শুরু হয় ইস্টিশন মাস্টার আজহার উদ্দিনের সরল পারিবারিক জীবন দিয়ে; যেখানে রঞ্জুর ফেল করা, টগরের শিশুমনের কৌতূহল এবং ফুফাতো বোন কুসুমের অসাধারণ রূপ ও মেধা সহজ জীবনের ছন্দ প্রকাশ করে। আপাতদৃষ্টে সাধারণ এই কাহিনিতে হঠাৎ করেই মোড় নেয় মগরা ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হলে। এর মাধ্যমে নিভৃত গ্রামীণ জীবনে বহিরাগত আধুনিকতার প্রবেশ ঘটে, যা পরিণতিতে বিষাদ নিয়ে আসে। ‘ইস্টিশন’ উপন্যাসে কুসুমের সঙ্গে তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের সম্পর্ক, চীনা ইঞ্জিনিয়ারের হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সময়ে তরুণ ইঞ্জিনিয়ারসহ অন্যদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলা; আইনি প্রহসনের মতো বিরামহীন ঘটনাপ্রবাহ ট্র্যাজেডির নির্মম চিত্রায়ণকে স্বাভাবিক রেখেছে। উপন্যাস শেষে লেখক পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগায় যে কীভাবে একটি সরল ও নিষ্পাপ জীবন বহিরাগত ষড়যন্ত্রের শিকার হতে পারে। কুসুমের বিষাদময় নিয়তি এবং টগরের স্মৃতিচারণা পাঠককে একধরনের নিষ্ফল অপেক্ষা ও হারানোর বেদনার সঙ্গে পরিচিত করায়। মূলত হুমায়ূন আহমেদ এই উপন্যাসে মানুষের সরলতা, প্রেম, ঈর্ষা এবং শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের এক চরম পরিহাসকে একীভূত করেছেন। এটি কেবল একটি ইস্টিশনের গল্প নয়—এটি সেই মানবজীবনের গল্প, যেখানে প্রত্যেক মানুষ একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করে, কিন্তু প্রায়ই অপ্রত্যাশিত প্ল্যাটফর্মে এসে থমকে যায়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপন য স র প র ক তজন র গল প জ বন র প রক শ চর ত র ব পর ত মনস ত
এছাড়াও পড়ুন:
দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা তেঁতুলিয়ায়
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৩ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) সকাল ৯টায় তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার এই তাপমাত্রা রেকর্ড করে।
দিনাজপুর জেলা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘‘উত্তরের হিমেল বায়ু আজ থেকে আবারো কিছুটা সক্রিয় হচ্ছে। ফলে দিনাজপুরসহ আশপাশের জেলায় দিন ও রাতের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’’
দেশের কয়েকটি জেলার আজকের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা- দিনাজপুর ১৫.৬, রংপুর ১৭.৭, সৈয়দপুর ১৭.২, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) ১৬.০, ডিমলা (নীলফামারী) ১৬.০, বদলগাছি (নওগাঁ) ১৬.৬, রাজশাহী ১৫.২, বগুড়া ১৭.৬, চুয়াডাঙ্গা ১৫.৩, কুষ্টিয়া ১৬.৫ ও শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) ১৬.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ঢাকা/মোসলেম/রাজীব