প্রকাশ্যে পাথর লুট, নির্বিকার প্রশাসন
Published: 8th, March 2025 GMT
অসংখ্য শ্রমিক। কারও হাতে বেলচা, কারও হাতে কোদাল, কারও হাতে শাবল। সবাই মাটি খুঁড়ে বের করছেন পাথর। পাথরগুলো টুকরিতে করে নদের পাড়ে জড়ো করছেন। কয়েক শ বারকি নৌকাওয়ালা সেসব পাথর দরদাম করে কিনে নিচ্ছেন।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের (রজ্জুপথ) সংরক্ষিত বাংকার এলাকার প্রতিদিনকার চিত্র এটি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে প্রকাশ্যে পাথর লুটপাট চললেও স্থানীয় প্রশাসন নির্বিকার। স্থানীয়দের ধারণা, গত ছয় মাসে অন্তত ২০০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।
যোগাযোগ করলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহার পাথর লুটপাটের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত অভিযান চালিয়েও লুটপাট ঠেকানো যাচ্ছে না। ২৪ ঘণ্টা তো আর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যায় না। অভিযান চালাতে গেলে লুটপাটকারীরা সরে যায়। চলে এলে আবার পাথর উত্তোলন শুরু করে দেয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের একমাত্র রজ্জুপথটি দেশের সবচেয়ে বড় পাথরকোয়ারি ভোলাগঞ্জের পাশে অবস্থিত। রোপওয়ে এলাকাটি সংরক্ষিত বাংকার হিসেবে পরিচিত। ১৯৬৪ সালে ভোলাগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জের ছাতকে পাথর পরিবহনে স্থল কিংবা জলযানের বিকল্প হিসেবে রজ্জুপথ স্থাপন করা হয়। ১১৯টি খুঁটির মাধ্যমে তৈরি হয় রোপলাইন। ভোলাগঞ্জের রোপওয়ে এলাকাটি ৩৫৯ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এখানকার সামান্য উঁচু টিলার মতো ভূমি আর সমতল স্থানের নিচে আছে ছোট-বড় অসংখ্য পাথর।
নির্বিচার পাথর লুটগত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে সংরক্ষিত বাংকার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পাশের ধলাই নদের চর ধরে হেঁটে বাংকারের দিকে যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। তাঁদের হাতে বেলচা, কোদাল, শাবল, টুকরিসহ পাথর তোলার বিভিন্ন উপকরণ। অনেকে মাথায় করে খাবার ও পানি নিয়ে যাচ্ছেন। চরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ধলাই নদ কেউবা বারকি নৌকায়, কেউবা হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছেন।
অন্যদিকে বাংকার এলাকায় কয়েক হাজার শ্রমিক মাটি খুঁড়ে পাথর উত্তোলনে ব্যস্ত। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে শত শত গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব গর্ত থেকে তোলা পাথর স্তূপাকারে নদের পাড়ে রাখছেন অনেকে। সেসব পাথর কিনতে এসেছেন অনেক বারকি নৌকাওয়ালা।
ভোলাগঞ্জের দুজন বাসিন্দা জানান, আগে মানুষ আড়ালে-আবডালে পাথর তুলত। ৫ আগস্ট বাংকারের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) আবাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ভাঙচুর করা হয়। এর পর থেকে প্রকাশ্যে পাথর তোলা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের অভিযান চললে লুটপাটকারীরা সটকে পড়ে। অভিযানকারীরা চলে গেলে আবার লুটপাট শুরু হয়। দিনে পাথর উত্তোলন কম হলেও বিকেলের পর থেকে সারা রাত অবাধে চলে। রাতে এখানে অস্থায়ী খাবার ও চা–পানের দোকানও বসে।
বাংকার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রাতের বেলা টর্চ ও চার্জলাইট জ্বালিয়ে পাথর তুলে শ্রমিকেরা বারকি নৌকার মালিকদের কাছে বিক্রি করছেন। নৌকার মালিকেরা যা ১০ নম্বর সাইট এলাকায় ক্রাশার মিলমালিকদের কাছে বিক্রি করছেন। পরে সেসব পাথর মেশিনে ভেঙে ছোট করে পাথর ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। ওই ব্যবসায়ীরা ট্রাক ও পিকআপে পাথর দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান।
পাথর তোলায় নিয়োজিত ১২ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেন, রাতের বেলা কয়েক হাজার শ্রমিক এখানে পাথর তোলেন। একেকজন শ্রমিকের প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় হয়। বারকি নৌকাভর্তি বোল্ডার (বড় পাথর) ৫ হাজার, ভুতু (মাঝারি) ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার এবং সিঙ্গেল (ছোট পাথর) ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় শ্রমিকেরা বিক্রি করেন।
গত ছয় মাসে কী পরিমাণ পাথর লুট হয়েছে, এর কোনো পরিসংখ্যান স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নেই। তবে স্থানীয় লোকজন বলছেন, কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার পাথর বাংকার এলাকা থেকে লুট হয়েছে। এভাবে লুটপাট চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যে পুরো বাংকার এলাকা পাথরশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঠেকাতে পারছে না প্রশাসনআরএনবি জানিয়েছে, বাংকার এলাকায় নিরাপত্তা দিতে তাদের ৩০ সদস্যের দল রয়েছে। ১৫ দিন পর পর দলটির বদল হয়। ৫ আগস্ট তাদের আবাসনস্থল ভাঙচুর হওয়ায় এখন বাংকার এলাকা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদে অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে থাকেন। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বেলা পাঁচটা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে তাঁরা ওই ক্যাম্পে চলে আসেন। মূলত এর পর থেকে রাতভর পাথর লুটপাট চলে।
আরএনবির উপপরিদর্শক নাফিজ ইমতিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সীমিত সাধ্য অনুযায়ী তাঁরা পাথর লুটপাট ঠেকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। তবে রাতের বেলাই এখানে বেশি পাথর লুট হয়।
বৃহৎ বাংকার এলাকাটি সীমিতসংখ্যক সদস্যের পক্ষে পাহারা দেওয়া সম্ভব নয় বলে আরএনবির একটি সূত্র জানিয়েছে। তারা বলছে, বাংকার এলাকায় কোনো ছাউনি পর্যন্ত নেই। প্রচণ্ড গরমে দিনভর খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা দিতে হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা এখন কথা শুনতে চান না। তাই তাঁদেরও পিঠ বাঁচিয়ে কোনো রকমে চলতে হচ্ছে। চারপাশ নদীবেষ্টিত হলেও আরএনবির নিজস্ব কোনো নৌকা নেই। এতে যথাযথভাবে নিরাপত্তা দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। শিগগিরই এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা উচিত।
এ বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, পাথর লুট বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। প্রয়োজনে অভিযান আরও জোরদার করা হবে।
তবে স্থানীয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণে বাংকার এলাকায় লুটপাট বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট বিভাগের সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার। তিনি বলেন, হাজার হাজার মানুষ সরকারি হেফাজতে থাকা জায়গার পাথর প্রকাশ্যে লুটপাট করছে। প্রশাসন ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিষয়টি একেবারেই দুঃখজনক।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক র এল ক য় প রথম আল র পর থ ক ল ট হয় করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ হাজার থেকে কমে সাড়ে ৩ হাজারে নেমেছে সেবাগ্রহীতা
মুঠোফোন নম্বর ঠিক রেখে অপারেটর বদলে নেওয়ার (এমএনপি) সুবিধা সাত বছরেও খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি। শুরুতে মাসে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ এই সেবা নিতেন। এখন সেটা নেমে এসেছে সাড়ে তিন হাজারে।
রাজধানীর একটি হোটেলে আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ‘মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি (এমএনপি): চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক কর্মশালায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
মুঠোফোন নম্বর ঠিক রেখে অপারেটর বদলের সুবিধা জনপ্রিয় না হওয়ার পেছনে সাতটি কারণকে দায়ী করেন এমএনপি খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কারণগুলো হলো উচ্চ সিম কর, নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাধা, আবেদন বাতিলের উচ্চ হার, অপারেটরদের অসহযোগিতা, খুদে বার্তা বা এসএমএস জটিলতা, ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড)–সংক্রান্ত জটিলতা এবং মুঠোফোনে আর্থিক সেবা বা এমএফএস–সংক্রান্ত জটিলতা।
কর্মশালাটি আয়োজন করে টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ (টিআরএনবি)।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ২০১৮ সালের অক্টোবরে ঘটা করে এমএনপি সেবা চালু করে। এই সেবা নিলে গ্রাহক নম্বর ঠিক রেখে এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরে যেতে পারেন।
প্রথম বছরেই এমএনপি সেবায় সাড়া ছিল ভালো। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মে মাসে ১ লাখ ১১ হাজার ১২৭ জন গ্রাহক নম্বর একই রেখে অপারেটর বদল করেন। কিন্তু বছর ঘুরতেই সেই সংখ্যা নেমে আসে কয়েক হাজারে। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ মাসে এই সেবাগ্রহীতার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫২২ জনে।
এমএনপি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ইনফোজিলিয়নের টেকনিক্যাল লিড ওবায়দুল ইসলাম বলেন, বিশ্বের ৭২তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এমএনপি চালু হয়। প্রথম বছরে যেখানে সাত লাখ গ্রাহক এ সেবা গ্রহণ করেছিলেন, পরবর্তী ছয় বছরে সেই সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য কোনো বৃদ্ধি ঘটেনি। বর্তমানে ৯৭ শতাংশ গ্রাহক এমএনপি সেবা ব্যবহার করছেন না, যার প্রধান কারণ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণগত বাধা।
ইনফোজিলিয়নের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাবরুর হোসাইন বলেন, ‘গ্রাহকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি, কিন্তু নানা বিধিনিষেধে সেই স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাধাগুলো দূর করা গেলে পরোক্ষভাবে সরকারের রাজস্বও বাড়বে, পাশাপাশি গ্রাহক পাবেন সর্বোত্তম সেবা।’
কর্মশালায় টিআরএনবির সাবেক সভাপতি রাশেদ মেহেদী বলেন, এই সেবায় (এমএনপি) সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দেওয়া যেত। তৃতীয় পক্ষের নেটওয়ার্ক ব্যবহারযোগ্য হলে প্রতিযোগিতা বাড়বে।
কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন টিআরএনবি সভাপতি সমীর কুমার দে। এতে ইনফোজিলিয়নের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোস্তফা কামাল, টিআরএনবির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন প্রমুখ বক্তব্য দেন।
আরও পড়ুনমুঠোফোন নম্বর ঠিক রেখে অপারেটর বদলের সুযোগ, কিন্তু জনপ্রিয় হয়নি কেন৩১ মার্চ ২০২৫