রাজশাহীতে আম কিনে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চারজনের তিনজনই গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। নিহত ব্যক্তিদের সবার পরিচয় জানা গেছে। তাঁদের মরদেহ নিতে নাটোর ও রাজশাহীতে অবস্থান করছেন বন্ধু ও স্বজনেরা।

নিহত ব্যক্তিরা হলেন ঢাকার মিরপুরের সাগর আহমেদ (৩০), কাজীপাড়ার শহিদুল ইসলাম (৩০) ও গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরের আতিক হোসেন (৩০)। তাঁরা তিনজনই গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সাগর আহমেদ ২০২১ সালে (৪৬তম ব্যাচ) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। অন্য নিহত ব্যক্তি নাটোর সদর উপজেলার বনবেলঘরিয়ার বাসিন্দা সিএনজিচালক মো.

বাবু (৪২)।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে নাটোর সদর উপজেলার বনবেলঘরিয়া এলাকায় নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কে একটি বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে তাঁদের মৃত্যু হয়। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ঝলমলিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুর রহমান ও নিহত সাগরের বন্ধু মাসুম আহমেদ।

নাটোরের বনবেলঘরিয়া এলাকায় নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কে বাসের ধাক্কায় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া সিএনজিচালিত অটোরিকশা

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

অপ্রিয় সত্য ও সহমর্মিতার গল্প

প্রথম আলোর সঙ্গে আমার প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক শুরু হয় ২০১৩ সালে। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার কিছুদিন পর মানবসম্পদ বিভাগ থেকে ফোনে জানানো হলো আবারও ভাইভা হবে এবং বলা হলো স্বয়ং সম্পাদক স্যার ভাইভা নেবেন। নির্দিষ্ট দিনে সময়মতো হাজির হলাম। একটা মিটিং রুমে ১৫-২০ জনের মতো প্রার্থীকে বসানো হলো। আমার ধারণা ছিল, একজন করে হয়তোবা সম্পাদক স্যারের সামনে প্রার্থীদের নেওয়া হবে। কিন্তু না, উনি নিজেই সেই রুমে এসে হাজির হলেন। সংক্ষিপ্ত পরিচয় পর্বের পর উনি আমাদের সঙ্গে গল্প করা শুরু করলেন। কাঙ্ক্ষিত ভাইভা আর শুরু হচ্ছে না। চাকরির ভাইভা বলতে যে বিষয়টার সঙ্গে আমরা সাধারণত পরিচিত, সে রকম কিছুর লক্ষণ দেখতে পারছি না।

উনি চাকরিপ্রার্থীদের নিজ নিজ জেলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, খেলাধুলা ইত্যাদি নিয়ে নিজে কথা বলছেন এবং সেসব বিষয়ে প্রার্থীদের মতামত জানতে চাচ্ছেন। এভাবে চলল প্রায় আধা ঘণ্টা। আমি খেয়াল করলাম, তিনি যখন কোনো বিষয়ে নিজে কথা বলছেন, তখন হালকা মেজাজে কথা বলছেন, কিন্তু সেই বিষয়েই যখন প্রার্থীদের মতামত জানতে চাচ্ছেন তখন ধীর, তীক্ষ্ণ ও মনোযোগী দৃষ্টিতে উত্তর শুনছেন। যেন প্রতিটি উত্তরের মধ্যে ভেতরের মানুষটাকেই যাচাই করছেন। তখনই আমার মনে হলো, ভাইভা আসলে অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে!

আমাদের বগুড়া জেলা থেকে চারজন প্রার্থী উপস্থিত ছিলাম। যথারীতি তিনি বগুড়া জেলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, খেলাধুলা সম্পর্কে নিজে বললেন এবং আমাদের মতামত শুনলেন। মাত্র কয়েক মাস আগেই চাঁদে একজন রাজনীতিবিদকে দেখার গুজব নিয়ে বগুড়ায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটে গেছে! কে কে চাঁদে সেই রাজনীতিবিদকে দেখেছি, জানতে চাইলেন। একজন বললেন, তিনি দেখেছেন! দ্বিতীয়জন বললেন অস্পষ্ট দেখেছেন, আরেকজন বললেন, তিনি চেষ্টা করেও দেখতে পাননি। আমি বললাম, আমি দেখিনি, দেখার চেষ্টাও করিনি। বললেন, কেন চেষ্টা করেননি? আমি উত্তর দিলাম, চাঁদে কোনো মানুষকে দেখা যাবে, এটা আমার বিশ্বাস হয়নি।

একপর্যায়ে সম্পাদক জানতে চাইলেন, বন্ধুসভা বগুড়ার কার্যক্রম কেমন চলছে? একজন বললেন, তাঁর জানা নেই। দুজন খুব উৎসাহ নিয়ে বললেন, স্যার, বগুড়া বন্ধুসভা খুব ভালো কাজ করছে, নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। কিন্তু আমি জানতাম, বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। বললাম স্যার, বন্ধুসভা বগুড়ার কার্যক্রম আগের মতো সক্রিয় নয়। তিনি বললেন, আপনি কেমনে জানেন? এবার আমি বিপদে পড়ে গেলাম! প্রথম আলোয় চাকরির ভাইভায় এসে কেমনে বলি আমি অন্য পত্রিকার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত! মনে হলো সত্য বলে বিপদে পড়লাম। বুকে সাহস নিয়ে এবার আরেকবার সত্যরই আশ্রয় নিলাম। বললাম, আমি বন্ধুসভার সদস্য। কিন্তু এখন অন্য পত্রিকার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, তুলনামূলকভাবে তাদের কার্যক্রম ভালো চলছে। আমি সেই পত্রিকার সংগঠনের কী পদে আছি জানলেন। বন্ধুসভার কার্যক্রম কেন আগের মতো সক্রিয় নয়, তার কয়েকটা কারণ শুনলেন। আমার উত্তর শুনে স্যার চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ভাইভা শেষে বগুড়ার চারজন প্রার্থী আমরা নিচে নেমে একসঙ্গে কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বললাম। অন্য তিনজনকেই খুব খুশি মনে হলো। তাঁরা সবাই আমাকে বললেন, ভাই, আপনি এটা কী করলেন! তাঁর নিজের পত্রিকার সংগঠন সম্পর্কে নেতিবাচক বললেন আবার এখন অন্য পত্রিকার সংগঠন করছেন, সেটাও বললেন—এভাবে চাকরি পাবেন? তাঁদের খুশি হওয়ার কারণ আমার বোধগম্য হলো। মনে হলো, হয়তো অপ্রিয় সত্য বলে ভুলই করলাম। খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আমি চাকরির আশা ত্যাগ করলাম।

কিন্তু কয়েক দিন পর মানবসম্পদ বিভাগ থেকে ফোন এল। বলা হলো, আমি চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছি! সেদিন বুঝেছিলাম—প্রথম আলো শুধু একটা প্রতিষ্ঠান নয়, এটা এক মূল্যবোধের নাম। এখানে সত্যকে কখনো ভয় পাওয়া হয় না। অপ্রিয় সত্য কেউ বললেও তাঁকে সম্মান করা হয়। যোগদানের পর সেই উপলব্ধি আরও গভীর হলো। অফিসের পরিবেশে দায়িত্ববোধ, পারস্পরিক সম্মান আর সহমর্মিতার যে মেলবন্ধন দেখেছি, তা অন্য কোথাও পাওয়া কঠিন। এর বাস্তব উদাহরণ আমি পেয়েছিলাম এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ে।

অফিসে আসার পথে আমি মোটরবাইক দুর্ঘটনার শিকার হই। গুরুতর আহত অবস্থায় আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সাত দিন আমি হাসপাতালে ছিলাম। সেই সাত দিন প্রতি রাতেই আমার এক সহকর্মী আমার পাশে থেকে দেখাশোনা করেছেন—নির্ঘুম, নিঃস্বার্থভাবে। অফিস ব্যবস্থাপক শরিফুল ইসলাম ভাই প্রতিদিন এসে খোঁজ নিয়েছেন, ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেছেন, নিশ্চিত হয়েছেন আমি ভালো চিকিৎসা পাচ্ছি কি না। হেড অফিস থেকে বিভাগীয় প্রধান থেকে শুরু করে অনেকেই ফোন করেছেন, সাহস দিয়েছেন, মনোবল জুগিয়েছেন। এক মাস অসুস্থতাজনিত ছুটিতে ছিলাম। অফিসের সংশ্লিষ্ট সবার অফুরন্ত আন্তরিক সহযোগিতায় পরবর্তী তিন মাস হোম অফিস করেছি। চিকিৎসা ব্যয়ের সিংহভাগ খরচ অফিস বহন করেছে। একটা মুহূর্তের জন্যও আমি নিজেকে একা মনে করিনি। অনুভব করেছি, যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, সেখানে সহকর্মীরা শুধু অফিসের সহকর্মী নন—সম্পাদক স্যার থেকে শুরু করে অফিস সহকারী সবাই মিলে যেন একটাই পরিবার।

সেই দুর্ঘটনা আমার শরীরে ক্ষত রেখেছিল, কিন্তু মনে গেঁথে দিয়েছিল এক অমূল্য শিক্ষা—প্রথম আলো শুধু খবরের কাগজ নয়, এটা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক প্রতিশ্রুতি। এখানে সততা যেমন মূল্যবান, তেমনি কর্মীর প্রতি দায়বদ্ধতাও গভীরভাবে অনুভূত।

আমার কাছে প্রথম আলো মানে শুধু কর্মস্থল নয়—একটি নৈতিক বিদ্যালয়। এখানে আমি শিখেছি, সত্য বলা ক্ষতি নয়, বরং সেটাই শক্তি। শিখেছি, দায়িত্ব মানে শুধু কাজ নয়—একে অপরের প্রতি যত্ন। আর সবচেয়ে বড় শিক্ষা—এখানে নেতৃত্ব আলোকিত হয় সততা, যোগ্যতা দক্ষতা আর সহমর্মিতায়।

আজ প্রথম আলো ২৭ বছরে পা রাখল। এই যাত্রায় আমি একজন ক্ষুদ্র কর্মী, তবু গর্বিত—এই আলোর মিছিলের অংশ হতে পেরে।

শুভ জন্মদিন প্রথম আলো।

তুমি ছড়াও সেই সত্যের আলো—যে সত্য এক করে মানুষকে, দায়িত্বে, ভালোবাসায় আর মানবিকতায়।

মাহমুদুল হাসান: সহকারী ব্যবস্থাপক (স্টোর, বিতরণ ও প্রশাসন), প্রশাসন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অপ্রিয় সত্য ও সহমর্মিতার গল্প
  • নারায়ণগঞ্জে নারী শ্রমিকের মৃত্যুতে দুই ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ সহকর্মীদের
  • ছুটি না পেয়ে অসুস্থ শ্রমিকের মৃত্যু, মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ