Prothomalo:
2025-11-05@13:36:25 GMT

ক্যানসার

Published: 5th, November 2025 GMT

শরীরে নয়, মনে, মগজে ও কাগজে; দেবেশ ওই খাঁ খাঁ মুল্লুকে, বাংলাবর্জিত, দূর উত্তর ভারতের দুর্গম এক গ্রামে, অর্বাচীন সে চলে যায় ভাগ্যান্বেষণে; চাঁদসী ডাক্তার হতে হবে তাকে, প্রয়োজন প্রশিক্ষণ; ফলে সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে দালালদের ট্যাঁকে টাকা গুঁজে ইছামতীর জল সাঁতরে রাতের অন্ধকারে আরও আরও ভাগ্যান্বেষীর সাথে তার সহগমন। পশ্চিমবঙ্গে কয়টা দিন ইতিউতি, তারপর ঠিকানা উত্তর ভারতের দুর্গম এক গ্রামে নরেনের চাঁদসী চেম্বার। সারা দিন নরেনের সাথে কম্পাউন্ডারি, রাতে মুদিদোকানাকৃতি নরেনের চেম্বারের পেছনে আন্দাজ চার ফুট বাই পাঁচ ফুট জায়গায় স্থাপিত স্ট্রেচারসদৃশ চৌকিতে ঘুম; অধিক অসুস্থ, কাহিল রোগী এলে নরেন ওই চৌকিতে শুইয়ে রোগীর নাড়ি টেপে; সেখানে ঘুমিয়ে প্রতিদিন একই স্বপ্ন দেখে দেবেশ—একটা পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে শায়িত সে, ঘুমাচ্ছন্ন তার শরীরটা টপকে বিরাটাকার একটি সাপ চলে যেতে থাকে পাহাড়ের খাঁজের গভীরে, জলশূন্য ঝরনারেখার দিকে; আর একটা বিপুল ব্যাঘ্র সাপটিকে পাকড়াও করে লেজ থেকে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে থাকে। এই স্বপ্নে শেষ রাতে নিত্য ঘুম ভেঙে গেলে তার মনে হয়, আগেও কি সে ঘুমিয়েছিল, নাকি তার জাগরণের মধ্যেই সাপটিকে বাঘে ধরে খায় আর তখন সে চিন্তায় উন্মূল হয়ে ভাবে, ‘বাঘে কি সাপ খায়’ এবং সেই বিজ্ঞানের অন্বেষণ বৃথা হয় বলে নরেনের কাছে বরং চাঁদসী চিকিৎসার কৌশল শিখে নিতে উদ্যমী হয় দেবেশ।

নরেনও ছিয়ানব্বই গ্রামেরই ছেলে। দেবেশদের সুধাসুন্দর গ্রামের উত্তরে বিলকাজলার পাড়ে হরগৌরীপুরে শ্মশানলাগোয়া নরেনদের বাড়ি; কৈশোরেই সাতক্ষীরার রাত্রির ইছামতীর জলে নরেনের সাঁতার, দেশত্যাগ। এখন সে চাঁদসী ডাক্তার ভারতের উত্তর প্রদেশের রবার্টসগঞ্জ গ্রামে। ডাক্তারি ও ওষুধের ব্যবসায় প্রসার ও প্রতিষ্ঠা, পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ে জমি ও সুরম্য দালান। ধীরে ধীরে মা–বাবা, ভাইবোনদের নিয়ে যায় দেশ থেকে। বৈধ ও অবৈধ রাষ্ট্রীয় কাগজপত্রে চালিত জীবন তার বেগতির নয়, যথেষ্ট সচ্ছল এবং উৎসবমুখরতায় হয়েছে নরেনের বিয়ে, অতঃপর সন্তানাদিও। পরিবার বনগাঁয়ের বাড়িতে, নরেন রবার্টসগঞ্জ থেকে মাসে একবার ছুটিতে আসে দু–তিন দিনের জন্য।

ফেসবুকের ফেনায় ভাসতে ভাসতে নরেনকে আবিষ্কার করে দেবেশ বেশ কিছুদিন হলো, যোগাযোগ, হালহকিকত লেনদেন চলে। নরেনের অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্প দেবেশ শুনে আপ্লুত হয়। নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ একাডেমিতে সদ্য চাকরিপ্রাপ্ত জওয়ানদের ইংরেজি ভাষার প্রশিক্ষকের চাকরিতে যা আয়-উপার্জন, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায়, অর্থনৈতিক মন্দায় ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন হয়ে দেশজুড়ে নানা সহিংসতার করুণ বাষ্পে আক্রান্ত হয়ে দেবেশের মন বিচলিতই শুধু হয় না, ছিয়ানব্বই গ্রামের আরও আরও অনেকের মতো বিপন্নতাবোধে জর্জরিত হয় এবং সে ভ্রমণের অছিলায় অফিসে দু-চার দিন-দশ দিন সরকারি ছুটি হলেই ভিসা নিয়ে অফিসকে না জানিয়েই বেশ ঘন ঘন ভারতে যেতে থাকে; কখনো বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে, কখনো একা-সূদুর অজন্তা ইলোরা, দার্জিলিং, সিকিম সীমান্তের কাছে বিজনবাড়ি কিংবা ঘুম স্টেশনে যাওয়ার স্মৃতি সঞ্চয়ের পাশাপাশি ভারতে পরিবারসহ মাইগ্রেট করে গেলে জীবন ও জীবিকার স্বরূপ কী হতে পারে, সে বিষয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও গোপন খানাতল্লাশি চালাতে থাকে, কেননা জন্মাবধি দেখা ছিয়ানব্বই গ্রামের নমশূদ্রদের নীরবে নীরবে বহুকাল ধরেই দেশ ত্যাগ করে ভারতে যাওয়া, কারও কারও এক পা বাংলাদেশে, এক পা ভারতে। তবে তাদের বেশির ভাগের কাছেই ভারত মানে পশ্চিমবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গের সীমানা অতিক্রম করে দিল্লি–বম্বের পথের দূরত্বও অনেকেরই কাছে কমে আসে। দেবেশও দেশত্যাগের পাপবোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চায় ক্রমেই; কিন্তু, সেটা মাতৃভূমির প্রকৃত সংকটে নাকি প্রায়ই জলকবলিত ছিয়ানব্বই গ্রামের ভাসমান কচুরিপানার মতো দেশত্যাগের নীরব স্রোতের অনুকূলে গা ভিজিয়ে দিয়ে, সেই মীমাংস তার অভিজ্ঞতালব্ধ নয়। হঠাৎ একদিন নৌবাহিনীর ঊর্ধ্বতন তাকে ডেকে পাঠায় এবং তার পাসপোর্ট দাখিল করতে আদেশ দেয়। দেবেশ যে পাসপোর্ট দাখিল করতে বাধ্য হয়, সেখানে তার পেশার স্থানে ইংরেজিতে ‘ফার্মার’ লেখা এবং একাধিকবার অফিস থেকে কোনো এনওসি না নিয়েই ভারতভ্রমণের চিহ্ন তাকে ‘র’-এর এজেন্ট বলে দোষী সাব্যস্ত এবং চাকরিচ্যুত করলে দুই নাবালক পুত্রসন্তান ও স্ত্রী দীপিকাকে নিয়ে বিপাকের অন্ত খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ ও বিপন্ন হয়। কাঁধে বয়সের ভার; পঁয়তাল্লিশ। এই বয়স নতুন কোনো চাকরির জন্য অনুপযোগী। তৎসত্ত্বেও বিভিন্ন এনজিও, বিচিত্র প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠিত পরিচিতজনদের কৃপাপ্রার্থী হয়ে কিছুকাল ঘোরাঘুরি করে ব্যর্থ দেবেশ সুধাসুন্দর গ্রামের বাজারে স্বর্গীয় পিতার স্মৃতিবিশিষ্ট জীর্ণ ও পরিত্যক্ত মিষ্টান্নের দোকানটিকে ঝেড়েমুছে ক্ষুদ্র কোনো ব্যবসার পরিকল্পনা করে দীপিকার সাথে ঘুমের বালিশে মিলিত হয়ে কসমেটিকস্, মনিহারি, হতে পারে ওষুধ; কিন্তু তার জন্য দীপিকার হাতের স্বর্ণের বালা আর সাববাক্সের গোপনে কাঁথা-কম্বলে জড়িয়ে রাখা সামান্য স্বর্ণের গহনাগুলো ব্যবসায়ে পুঁজির পক্ষে অপ্রতুল বিবেচিত হয়। স্বর্গীয় অধরচন্দ্র বিশ্বাস দেবেশকে ভিয়ানশিক্ষার ঝুলি না বর্তায়েই ওড়াকান্দির হরিচাঁদ ঠাকুরের তীর্থে যাত্রাকালে নৌবাহিনীর বহরের একটি গাড়িতে চাপা পড়ে পরলোকপ্রাপ্ত হলে নৌবাহিনী ক্ষতিপূরণস্বরূপ পরলোকপ্রাপ্তের সন্তান সদ্য এমএ শেষ করা অস্থিরমতি ও বাম রাজনীতির ঝাঞ্ঝাবাহী প্রবল যুক্তিবাদী দেবেশকে একটি চাকরি প্রদান করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সম্পন্ন করে। সেই চাকরি খুইয়ে তার দিকনিশানা মরুঝড়ের পরে মরুভূমির পথে দিগভ্রান্ত ক্যারাভানের মতো লুপ্ত হয়। তখন সে নরেনের সাথে ফেসবুকে বার্তাবিনিময় আরও সচল করে। ‘ভাইডি, হালে তো জল পাইনে আর.

..’

‘চলে আসো দেবেশদা, গায়ে-গতরে খাটলে উপায় ভগবান দেখাবেনই।’

নরেনও ছিয়ানব্বই গ্রামেরই ছেলে। দেবেশদের সুধাসুন্দর গ্রামের উত্তরে বিলকাজলার পাড়ে হরগৌরীপুরে শ্মশানলাগোয়া নরেনদের বাড়ি; কৈশোরেই সাতক্ষীরার রাত্রির ইছামতীর জলে নরেনের সাঁতার, দেশত্যাগ। এখন সে চাঁদসী ডাক্তার ভারতের উত্তর প্রদেশের রবার্টসগঞ্জ গ্রামে।

ছিয়ানব্বই গ্রামের অনেক ঘরেরই আরেকটি ঘর সীমান্তের ওপারে, সাতচল্লিশ–পরবর্তী নীরব এই দেশত্যাগের পাপ দেবেশ গায়ে জড়িয়েও স্বর্গে পদার্পণের অভিপ্রায়ে নিজেকে চূড়ান্ত প্রস্তুত করে; ভিসা নিয়ে বেশ কবার পশ্চিমবঙ্গে, বিহারে, উত্তর প্রদেশে—ভিসার উল্লেখিত একটানা নব্বই দিন পার হওয়ার দু-চার দিন আগেই আবার দেশে, কদিন স্ত্রী ও সন্তানের ওমে কাটিয়ে পুনর্গমন। এরই মধ্যে সেখানে অবৈধ প্রক্রিয়ায় দালাল ধরে নিজের আধার কার্ড ও সন্তানদের জন্মসনদ তৈরি করে ফেলে এবং স্বপ্ন দেখতে শুরু করে পুত্রদ্বয়কে বোলপুরে শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে পড়াবে। ধীরে ধীরে সুধাসুন্দর গ্রামের জমি-জিরেত-ভিটে বিক্রয় করে শান্তিনিকেতন–নিকটবর্তী কোনো গ্রামে জমি কিনে ছোট্ট একটা বাড়ি গড়তে পারলে জীবন বর্তে যাবে। কিন্তু বেশ কবার যাওয়ার পরও অস্থিরমতি ও গভীর যুক্তিবাদী দেবেশ নির্দিষ্ট কোনো জীবিকার সাথে নিজের পঙ্‌ক্তিবিন্যাস করে নিতে ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে এলে দীপিকা বলে, ‘তোমার আর যাওয়া লাগবে না। হাজার হোক, সেই তো বিদেশ, বিভুঁই।’ নিজের দেশ, নিজের মাটি, উঠোন...এই সব ছেড়ে...তার চেয়ে বাজারের দোকানটা খুলে বসলে হয়, কিছু না হলে চা-বিড়ি-সিগারেট-পানের দোকান।’

সার্বিক অক্ষমতা ও হতাশায় পর্যুদস্ত দেবেশের নিশ্বাস সুদীর্ঘ হয়। হাঁটুর ওপরে লুঙ্গি তুলে নিয়ে পুরোনো ঘুণে প্রাপ্ত চেয়ারের এককোণে বসে থাকে সারা দিন। উঠোনের পশ্চিমকোণের চালতাগাছ কী ঘন হয়ে উঠেছে! চালতার ঘন পাতার ভেতরে কোথা থেকে ভোকাট্টা হয়ে উড়ে আসা একটা রঙিন ঘুড়ি অর্ধেকটা শরীর সবুজে নিমজ্জিত করে ভেসে আছে। এ রকম কাটা ঘুড়ির পেছনে ছুটতে ছুটতে কতবার ভিনগাঁয়ে চলে গেছে শৈশবে, তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে দলছুট ছোট্ট পাখিটির মতো আবার নীড় খুঁজে নিয়েছে, মায়ের কোল খুঁজে নিয়েছে। আজ এই ঘুণেপ্রাপ্ত চেয়ারে বসে নিজেকে ওই ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো লাগছে, অনন্তের লাটাই থেকে যেন তার সুতো ছিঁড়ে কোন অজানা সীমান্তের পাড়ে পড়ে আছে অথবা সেই ভোকাট্টা ঘুড়িকে ধরতে গিয়ে সন্ধ্যার ভেতর সে আর বাড়ির পথ ঠাওরাতে পারছে না। গোলাঘরের পাশে আমলকীগাছটা আকাশের কাছাকাছি চলে গেছে আর দেবেশেরই লাগানো অমল মাধবীলতা গরুশূন্য গোয়ালঘরের চাল ছাপিয়ে, রান্নাঘরের চাল ছাপিয়ে নারকেলগাছ দুটোকে জড়িয়ে উঠে এসেছে ঘুমানোর ঘরের চালের ওপরে। বিপন্ন, বিধ্বস্ত ও বেকার দৃষ্টিতে এই সব সে দেখে আর তার মনে হয়, কোনো দোর্দণ্ড ঝড় এসে মাধবীলতার শিকড় উল্টে দিতে চাইছে, চালতাগাছটাকে ভোকাট্টা ঘুড়িসহ উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, আকাশের সাথে সুসম্পর্কে জড়িয়ে থাকা আমলকীগাছটাকে উৎপাটন করে ছুড়ে দিতে চাইছে কোনো অন্ধকার গর্তের ভেতর। সে প্রাচীন চেয়ার ছেড়ে নরম পদক্ষেপে আমলকীগাছের নিকটে গেলে দেখতে পায় গাছের গোড়ায় একটি পাখির বাসা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে, আর পড়ে আছে কতগুলো সাদা ডিম, অক্ষত কিছু, কতক ভাঙা; ডিমগুলো যেন বাবা অধরচন্দ্র বিশ্বাসের বানানো রসমালাইয়ের ছোট ছোট মিষ্টি, যেই সব রসমালাইয়ের মিষ্টি হাটবারে উপচে পড়ে কিনে নিত মানুষেরা; কেন যে বাবার কাছে একটু শিখে নেওয়া হয়নি সেই ভিয়েনকার্য বা বাবাই কেন যে তাকে সেই রসের ভিয়েনশিক্ষা দিয়ে যায়নি! বাবা হয়তো চেয়েছিল, ছেলে সুশিক্ষিত হয়ে বড় চাকরি করবে; কিন্তু তুখোড় যুক্তিবাদী দেবেশ নানা যুক্তির পাল্লায় পড়ে নিজের একাডেমিক পড়াশোনাটা যা লেজেগোবরে করেছিল, ওড়াকান্দির তীর্থযাত্রাকালে নৌবাহিনীর গাড়িবহরে চাপা পড়ে পরলোকপ্রাপ্ত না হলে দেবেশের কপালে নৌ-জওয়ানদের ইংরেজির প্রশিক্ষকের চাকরিটাও লেখা ছিল না; বাবার মৃত্যু দিয়ে লেখা হয়েছিল যে জীবিকা, তাও তো খোয়া গেল যুক্তিবাদী দেবেশের। এখন, এই সায়াহ্নে সমস্ত যুক্তি থেকে মুক্তি পেতে চায় সে। দেশত্যাগ তার কাছে এখন কোনো পাপ নয়, জন্মভূমি থেকে নাড়ীর উৎপাটন তার কাছে বিষাদের নয়, তারুণ্যের সমস্ত দেশাত্মবোধক গান এখন তার রক্তে স্তিমিত। সে মেনে নিতে চায়, মানুষ চিরকাল উদ্বাস্তু, মানুষের ইতিহাস স্থানান্তরের ইতিহাস। সে ফেসবুকে নরেনকে খুদে বার্তা পাঠায়, ‘এবার আর এদিক–সেদিক নয়, সোজা তোমার কাছে চলে আসতে চাচ্ছি। এখন তোমার হিল্লে।’

‘দেবেশদা, তোমাকে আগেই বলেছি, পশ্চিমবঙ্গে কিছু হবে না। উত্তরে আসো, আমার সাথে কিছুদিন কাজ করো। তারপর নিজেই রোগী দেখতে পারবে। দোকান খুলতে পারবে।’

ভিসার একটানা নব্বই দিন পার হওয়ার দু-চার দিন আগেই আবার দেশে, কদিন স্ত্রী ও সন্তানের ওমে কাটিয়ে পুনর্গমন। এরই মধ্যে আধার কার্ড ও সন্তানদের জন্মসনদ তৈরি করে ফেলে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে পুত্রদ্বয়কে বোলপুরে শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে পড়াবে।

স্থির করে, খুব দ্রুতই ভিসা করে উত্তর প্রদেশে চলে যাবে; এরই মধ্যে দেশে ঘটে নতুন রূপকথা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপে ফ্যাসিস্ট আখ্যাপ্রাপ্ত সরকারপ্রধান পালিয়ে ভারত সরকারের আতিথেয়তা গ্রহণ করলে দেশবাসী ভারতবিরোধী নানা আন্দোলনে সরব হলে ভারতের সাথে দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের আয়নার পারদ খসে পড়ে; ভিসা বন্ধ হলো, মেডিকেল ভিসাও সাময়িকভাবে; আমদানি-রপ্তানিও বন্ধ। কিছুকাল পরে খুব সামান্য পরিমাণ মেডিকেল ভিসা অনুমোদন করলে দালালদের দৌরাত্ম্য যায় বেড়ে, ঘুষের অঙ্কে ঝুলে পড়ে মানুষেরা। এখন দেবেশকে ভারতে যেতে হলে অসুস্থ হয়ে যেতে হবে, জটিল রোগে আক্রান্ত হতে হবে, মেডিকেল ভিসা ছাড়া বিকল্প নেই। বানাতে হবে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর মেডিকেল সার্টিফিকেট। সুধাসুন্দর বাজারের কম্পিউটারের দোকানদার তপনই ভরসা; গত বিশ বছরে তার হাতে ছিয়ানব্বই গ্রামের সারি সারি মানুষ ভিসা–পাসপোর্ট করিয়েছে, অ্যাম্বাসির দরজায় আছে তার উষ্ণসম্পর্কের হাত, এই অসুখের দিনে সে-ই সর্বরোগবিশারদ, মহানুভব চিকিৎসক, সমস্ত রোগের সার্টিফিকেট করে দিতে পারছে লহমায়; ফলে তপনের কাছেই শেষমেশ, ‘দাও তো তপন, তোমার মতো করে কোনো একটা রোগ বানিয়ে, ক্যানসার-ট্যানসার বানিয়ে দাও। ভিসা পেলেই হলো।’

বেশ অনেক দিন পরে দেবেশের ফোনে ভিসা সেন্টারের বার্তা এল, ‘ইয়োর ভিসা অ্যাপলিকেশন হ্যাজ বিন প্রসেস্ড। প্লিজ কালেক্ট ইয়োর পাসপোর্ট বাই ইয়োরসেল্ফ’। অবশ্য এটা কিন্তু পরিষ্কার করে না যে দেবেশ ভিসাপ্রাপ্ত হয়েছে। দুরু দুরু বুকে ভিসা সেন্টারে উপস্থিত হয়ে পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর সে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাজিগর, জীবনের বাজি খেলায় বিজিতের অত্যানন্দে সম্বিৎশূন্য; যেন এই ভিসা দিয়ে সে কেবল ভারতে নয়, পৃথিবীর সকল দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে পৃথিবীর বাইরে কোথাও চলে যাবে, তাকে আর বেঁধে রাখতে পারবে না কেউ। কিন্তু পরক্ষণেই সে আবিষ্কার করে, ভারী লোহার শিকলে কোনো অন্ধকার বিষাদে তার পা দুটো ভীষণ বাঁধা পড়ে আছে।

ভিসা নিয়ে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায় দেবেশের। সুধাসুন্দর বাজারে পৌঁছাতে রাত আরও ঘন হয়। বাজারের সমস্ত দোকান বন্ধ হয়েছে, কোথাও কোলাহল নেই। কিছু সারমেয় দল বাজারের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সড়কের ওপরে শারীরিক কসরত করছে; সামরিক কসরত যেন, যেন শিগগিরই প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করবে তারা। সারমেয় দল দেবেশকে দেখে কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে, পরে পরিচিত গন্ধ পেয়ে থেমে যায়। কত দিন এই সব সারমেয় দলের সাথে বাজারের নির্জন রাতে বিচিত্র কেলিক্রিয়া করেছে দেবেশ। এখন তার মন জড়, কোনো খেলা নেই। তার উৎসব ও আহ্লাদ বাষ্প হয়ে মহাশূন্যে। ভারাক্রান্ত দেবেশ জনমানবহীন বাজারের অন্ধকার কেটে কেটে স্বর্গীয় পিতার বন্ধ, পরিত্যক্ত মিষ্টান্নের দোকানের সামনে এসে দেখতে পায়, অন্ধকারে নিমজ্জিত সামান্য প্রদীপের আলো জ্বালিয়ে তার পিতা স্বর্গীয় অধরচন্দ্র বিশ্বাস পাখির ডিমের মতো ছোট ছোট মিষ্টি বানাচ্ছে। ধীরে ধীরে দোকানের দিকে এগিয়ে গেলে মিষ্টি বানাতে বানাতে মৃদু মাথা তুলে স্বর্গীয় পিতা বলে, ‘শেষমেশ ক্যানসারের কাগজ দেখিয়ে ভিসা নিতে হলো তোমার!’

‘মেডিকেল ভিসা ছাড়া ভিসা দিচ্ছে না।’

‘তাই বলে ক্যানসার!’

‘চারদিকে ক্যানসার, বাবা! মারাত্মক! মরণব্যাধির মড়ক।’

সারমেয়গুলো পুনরপি প্রচুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে দেবেশের দিকে এগিয়ে আসে আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে। চেনা সারমেয়দের কাছে সে কি অচেনা হয়ে উঠল? নিজেকে রক্ষা করতে দৌড়ে বাজারের মাথায় একটা ছোট্ট দোতলা ঘরের সামনে এসে পৌঁছায়; এই ছোট্ট দোতলা বাড়ির ওপরের ঘরটিতেই একসময় তাদের তারুণ্যের ‘যুক্তিবাদী সমিতি’র অফিস ঘর। এই ঘরে লেনিন, মার্ক্স। এখানে তারকোভস্কি, চ্যাপলিন। এখানেই তাদের চোখের সামনে ভার্জিনিয়া ডুবে গেছে একদিন, সমবেত অজস্র গীতবিতান। দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা দেবেশদেরই গড়ে নেওয়া। খুলনা ডকইয়ার্ড থেকে সস্তায় কেনা সিঁড়িটার লোহার পাতগুলো বয়ে এনেছিল দেবেশই। সারমেয় সমস্ত আবারও ঘেউ ঘেউ করে উঠলে সিঁড়ি টপকে অধুনালুপ্ত ‘যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘরের সামনের চিলতে বারান্দায় দাঁড়ায়। একদা এই বারান্দায় তর্কের ক্ষীপ্র প্রবাহ প্রচুর ছিল। এখন ঘরটি তালাবদ্ধ, কত দিন কারও পদস্পর্শের অভাবে বারান্দাটি কদর্য ও কুৎসিত হয়ে আছে। নিচে অনেকক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে অন্ধকারের ভেতর সারমেয় দল কোথায় যে হারিয়ে গেল! সেই হদিশ কিছুকাল করে নিষ্ফল হলে সিঁড়ি দিয়ে টুপ করে নেমে একদৌড়ে বাড়িতে চলে যাবে বলে প্রস্তুতি নিতেই পা বাড়ালে সে আবিষ্কার করে, সিঁড়িটা নেই, যেন কোনো অন্ধকার মহাশূন্যে উঠে এসেছে সে। নামার কোনো উপায় আবিষ্কারে ব্যর্থ দেবেশের রাত বাড়তে থাকার সাথে সাথে ঘরে ফেরার প্রয়োজনীয়তা প্রবল হয়। সিঁড়িটা নেই, তবু তাকে নামতে হবে। ক্যানসারের রিপোর্টের বদৌলতে প্রাপ্ত মেডিকেল ভিসার সিল লাগানো পাসপোর্টটি মুখে ধরে দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে অধুনালুপ্ত ‘যুক্তিবাদী সমিতি’র দোতলার কার্নিশ ধরে নামতে থাকে। কিন্তু দেবেশ যেন সাত আসমান ওপরে উঠে এসেছে। নিচের দিকে তাকালে থিকথিকে অন্ধকার, বিরাটাকার ম্যানহোল। সমস্ত পৃথিবী ডুবে যাচ্ছে যেন সেখানে। সে কোথায় নামবে? নিশানা বিলুপ্ত। ক্বচিৎ তার বোধ হয়, তিনজন মানুষ তার পা ধরে সযত্ন শূন্য ও অন্ধকারের নিরেট স্তর থেকে ভূমিতে নামাচ্ছে—নমশূদ্রদের ভূমিতে। ভূমির স্পর্শে তার শরীরের রক্তপ্রবাহে বিদ্যুৎ প্রতিপন্ন হলে দেবেশ চিনতে পারে, মানুষ তিনজন তাদের অধুনালুপ্ত ‘যুক্তিবাদী সমিতি’র সহযোদ্ধা—অনুপম, বিকাশ, কনক। সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রগতির ঝাঞ্ঝা তুলে বদলে দিতে চেয়েছিল সবকিছু, তারা স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্বপ্ন হয়ে যেতে চেয়েছিল একদিন। কিন্তু জীবন ও জীবিকার চপেটাঘাত বিকট, নির্মম! তাদের নীতির আন্দোলন লুপ্ত হয়েছে কত দিন আগেই। অধুনালুপ্ত ‘যুক্তিবাদী সমিতি’র বিগত ঘরটিকে দেখে বেকার স্মৃতিচারণা রহিত কিছু করার নেই।

এখন দেবেশকে ভারতে যেতে হলে অসুস্থ হয়ে যেতে হবে, জটিল রোগে আক্রান্ত হতে হবে, মেডিকেল ভিসা ছাড়া বিকল্প নেই। বানাতে হবে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর মেডিকেল সার্টিফিকেট। ‘দাও তো তপন, তোমার মতো করে কোনো একটা রোগ বানিয়ে, ক্যানসার-ট্যানসার বানিয়ে দাও। ’

অন্ধকারে ভূতের ছায়ার মতো অনুপম, বিকাশ, কনক দাঁড়িয়ে দেবেশের সামনে। হাঁপরের মতো বিরাট নিশ্বাস ছেড়ে অনুপম বলে, ‘একটা জলজ্যান্ত সুস্থ মানুষ তুমি। ক্যানসারের নকল মেডিকেল সার্টিফিকেট বানিয়ে ভিসা করে ভারতে যাচ্ছ! এই তোমার দেশপ্রেম, যুক্তির গরিমা?’

বিকাশের গলায় চিরকাল অলংকারের মতো লেগে থাকা কাশি, কিন্তু যক্ষ্মা নয়। কাশতে কাশতে বিকাশ বলে, ‘দেখো দেবেশ, জীবিকার সংকট আমাদের সবারই। স্বল্প পুঁজি নিয়ে তোমাদের পৈতৃক পুকুরে বিদেশি মাগুরের চাষ প্রকল্প নিয়ে চিন্তা করতে পারো। একসময় এ–ই তো তোমার স্বপ্ন ছিল, কোনো বেনিয়াদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে না বলে সংকল্প করেছিলে।’

কনক খুব দায়িত্ব নিয়ে জ্যেঠাবচনে বলে, ‘তুমি ব্ল্যাক বেঙ্গলের একটা খামার করো। সুস্থ মানুষ ক্যানসারের ভার বয়ে বেড়াবে কেন!’ বিগত যুক্তিবাদী বন্ধুদের কথায় দেবেশ কোনো রা করে না। জবাই করা মুরগির মস্তকটা সামান্য চামড়াসহ গলার সাথে যেরূপে ঝুলে থাকে, তার মুণ্ডুটাও সেইভাবে ঝুলে আছে শরীরের সাথে এবং ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেলে ঘড়ির কাঁটা একই স্থানে যেভাবে বাড়ি খেয়ে দুলতে থাকে, দেবেশও মুণ্ডুটাকে শরীরের সাথে সেইভাবে ঝুলিয়ে দোলাতে দোলাতে বাড়ির দিকে এগোয়।

দেবেশ তার সিদ্ধান্তে বিচিত্রতা ঘটাল না, বরং বুনো শুয়োরের মতো গো বাধল এবং দীপিকার কাছে যাবার সময় প্রতিজ্ঞা রেখে গেল, ‘এইবার কোনো ব্যবস্থা না করে ফিরব না।’ দেবেশের বুনো গোর অন্ধকারে দীপিকা বিশেষ বাতিঘর খুঁজে পেল না, পেল আশঙ্কাভাস, ‘ভিসার মেয়াদ শেষ হলে কী করবে?’

‘পাসপোর্ট সই করে পাঠিয়ে দেব বর্ডার থেকে। ভারতের পাসপোর্ট করে তবে ফিরব।’

দেবেশের কথায় দীপিকা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ‘আমাদের কোনো বিপদ–আপদ হলে, দেশের অবস্থা তো দিন দিন খারাপ হচ্ছে, জরুরি প্রয়োজন হলে তুমি আসবে কীভাবে? ওখানকার পাসপোর্ট কবে হয়, তার তো ঠিক নেই...।’

পরদিন সুপ্রভাতে যাত্রা। গৃহত্যাগের সময় দীপিকার চোখে জল রেখে, পুত্রদ্বয়ের চোখে মায়া ও করুণ কৌতূহল রেখে পাসপোর্ট ও ক্যানসারের নকল মেডিকেল সার্টিফিকেট সযত্ন ব্যাগে পুরে দেবেশ চলল সম্মুখসমরে। বর্ডারে ইমিগ্রেশন অফিসার জানতে চাইল, ‘কী অসুখ? কাগজ দেখাও।’

দেবেশের আনত মস্তক, চোখে–মুখে ফুটিয়ে নিল জরা-বিষণ্নতা, চোখে আর্দ্র আবহাওয়া ও বৃষ্টির পূর্বাভাস। বলল, ‘ক্যানসার।’ ইমিগ্রেশন অফিসার দেবেশের আনত মুখের দিকে একবার তাকাল, এরই মধ্যে পাসপোর্টে অ্যারাইভাল সিল সংযুক্ত করে দিয়েছে। সিল মারা চোরের মতো দেবেশ নিজ দেশ থেকে বিভুঁইয়ে প্রবেশ করল।

দুই.

কয়েকটা দিন দেশ থেকে এসে পশ্চিমবঙ্গে থিতু নানা পরিচিতজনদের সাথে এলোপাতাড়ি সময় কাটিয়ে এবং ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরির নানা পথ অনুসন্ধান করে উত্তর প্রদেশের রবার্টসগঞ্জে চাঁদসী ডাক্তার নরেনের শরণাপন্ন দেবেশ। কম্পাউন্ডারি শুরু, গভীর অনুধ্যান ও আগ্রহ নিয়ে চাঁদসী চিকিৎসাবিদ্যা রপ্ত করার গভীর অধ্যবসায়ে লিপ্ত হতে চায় দেবেশ। কিন্তু এমনিতেই বিভুঁই, তার ওপর ভিন ভাষার সংকট, দেশে রেখে আসা স্ত্রীর চিন্তাক্রান্ত চেহারা ও পুত্রদ্বয়ের অপাপলগ্ন মুখচ্ছবি, মায়া; তাকে অনুপলে আক্রান্ত ও ক্ষরণে ক্ষরিত করে, উদ্বিগ্ন করে স্বদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ইউটিউবে স্বদেশের সমস্ত খবর তার জানা হয়ে যায়—খুন, ধর্ষণ, সহিংসতা। বিচলিত ও বিপন্নতাবোধে আক্রান্ত দেবেশের চাঁদসী চিকিৎসা শিক্ষার অভিনিবেশ পর্যুদস্ত হতে শুরু করে অল্পদিনের মধ্যেই। নরেনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা ও ব্যবসার প্রসার গোপন হিংসায় দেখে নিয়ে উত্তর প্রদেশ থেকে আবার পশ্চিমবঙ্গে প্রত্যাগমন। কখনো হাবড়ার শিমুলের কাছে, কখনো কাঁচরাপাড়ায় রজতের কাছে, রানাঘাটে দিবেন্দ্যুর কাছে; কখনো মাছের আড়তে, বনগাঁ লোকালে যৌন ও চর্মের বটিকার হকারি, কখনো রাজমিস্ত্রির জোগাল... কিছুতেই স্থির হতে না পারা দেবেশের মানসিক অবস্থার পারদ দিন দিন নিম্নমুখী হতে থাকে; কিন্তু সে এবার পণ বেঁধেছে, একটা কিছু কর্ম নির্দিষ্ট করে, ভারতের পাসপোর্ট ট্যাঁকে গুঁজে তবেই স্বদেশে ফিরবে। কিন্তু সেই ফেরা হবে যুক্তিবাদী দেশপ্রেমিক দেবেশের নয়, নেড়ি কুকুরের মতো তাড়া খাওয়া দেশত্যাগেচ্ছু দেবেশের। ফিরবে স্ত্রী ও সন্তানদের ভারতবর্ষে আনার গেরিলা অভিযানে, রাতের অন্ধকারে বিক্রি করে দিয়ে আসবে পৈতৃক জমি-জিরেত-ভিটে। জমি বিক্রির বিষয়ে দেশের ঘনিষ্ঠজনদের সাথে গোপনে খোঁজখবর করতে শুরু করে এরই মধ্যে। কিন্তু তার বিবমিষা বাড়ে। তাদের হিন্দুপ্রধান ছিয়ানব্বই গ্রামে মুসলমানদের জমি কেনার সুযোগ নেই, দেশে টালমাটাল অবস্থা; ফলে এলাকার সচ্ছল হিন্দুরাও দেশ ছাড়ার চেষ্টায় রত; এমন সময় নতুন করে জমি কেনা চিন্তাতীত। জমি বা স্থাবর সম্পদের বেচাবিক্রি এলাকায় প্রায় বন্ধের খবর দেবেশের হৃৎপিণ্ড থেকে একটু একটু করে জল শুকিয়ে ফেলতে শুরু করে।

কোনো কিছুই স্থির করতে না পারা দেবেশ একদিন ক্যালেন্ডারের পাতার সাথে পাসপোর্টে সাঁটা ভারতীয় ভিসার তারিখ মিলিয়ে দেখে, আর মাত্র সাত দিন সে অবস্থান করতে পারবে ভারতে, তার পর থেকে ভারতে সে অবৈধ। সে দ্রুত সীমান্তে আসে, পূর্বে আশ্বাস দেওয়া দালালদের সন্ধান করে হয়রান, উদ্দিষ্টজনদের সে কিছুতেই খুঁজে পায় না। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের ভেতর হিমালয় থেকে আসা ভারী শীতার্ত বাতাস বইছে, ভারত ভিসার নিষেধাজ্ঞা দিলে সীমান্তে দালালির সাথে জড়িত মানুষেরা দিনের পর দিন মাছি বধ করে ক্লান্ত হয়ে অন্যান্য পেশার সন্ধানে ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে, ফলে পরিচিত কোনো দালালকে সে আবিষ্কার করতে পারে না। হাবড়ার শিমুল ফোনে একজন দালালের সন্ধান দেয়, বনগাঁর বাটার মোড় পার হয়ে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে রাত্রি ঘন হয়ে এলে সেই দালালের সাথে দেবেশের সাক্ষাৎ হয়, কিন্তু ব্যর্থতায় পর্যবসিত। বর্ডারে এখন ভয়াবহ কড়াকড়ি, অবৈধ উপায়ে পাসপোর্টে সাইন করে ইমিগ্রেশনে টাকা ঢেলে ডিপারচার সিল মেরে পাসপোর্ট দেশে পাঠানোর দুঃসাহস কেউ করতে চায় না। আরও আরও দালালের সন্ধান করতে করতে ভিসার মেয়াদ অতিক্রান্ত হলে ভারতবর্ষে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য হয় সে। পরিচিতজনেরা পরামর্শ দিল, ‘আবার উত্তর প্রদেশে চলে যাও, চাঁদসী শেখো মন দিয়ে, তোমার তো আধার কার্ড আছেই।’ কেউ বলল, ‘বম্বেতে চলে যাও, সেখানে অনেক কাজ। আয় হলে টাকা ঢেলে দ্রুত পাসপোর্ট করে নেবে।’

কখনো হাবড়ার শিমুলের কাছে, কখনো কাঁচরাপাড়ায় রজতের কাছে, রানাঘাটে দিবেন্দ্যুর কাছে; কখনো মাছের আড়তে, বনগাঁ লোকালে যৌন ও চর্মের বটিকার হকারি, কখনো রাজমিস্ত্রির জোগাল... কিছুতেই স্থির হতে না পারা দেবেশের মানসিক অবস্থার পারদ দিন দিন নিম্নমুখী হতে থাকে।

দেবেশ হাওড়া স্টেশনে চলে যায়, মানুষের জঙ্গলে। একটা আশ্চর্য মেশিন থেকে যেন পোকার মতো যান্ত্রিক কোনো বস্তু বের হয়ে এখানে ছোটাছুটি করছে। তার নিজেকেও একটা পোকা মনে হতে থাকে। দেশ থেকে আনা টাকাপয়সা তার নিঃশেষ হয়েছে, উত্তর প্রদেশে যাওয়ার টিকিটের টাকাও নেই, আর পেটের ক্ষুধাও তো ছুটি নিয়ে কোনো অন্তপুরে লুকিয়ে থাকে না। ফলে পকেটের শেষ কয়টা টাকা দিয়ে সামান্য খাবারে হাওড়ার প্ল্যাটফর্মে দু-তিন দিন পার হলো। পশ্চিমবঙ্গের পরিচিতদের ফোন করে কোনো কর্জও পেল না। প্ল্যাটফর্মের থামের সাথে হেলিয়ে পড়া বিধ্বস্ত দেবেশ দেখে, অনেক অনেক সাহায্যপ্রার্থী মানুষ নানা প্রকার জরাজীর্ণ ওষুধের প্রেসক্রিপশন ও মেডিকেল রিপোর্ট দেখিয়ে হাত পেতে দিচ্ছে মানুষের কাছেঅ তারও শরীর যেহেতু বর্তমান, ক্ষুধারূপ অবাধ্য দাঁতাল পেট কামড়ে ধরে। নিরুপায় দেবেশ ভিসা করার সময় করা ক্যানসারের যে নকল রিপোর্ট ও প্রেসক্রিপশন তৈরি করেছিল, তা ব্যাগ থেকে বের করতে উৎসাহী হয়। বের করে, কিন্তু থমকে যায়, কেননা কাগজপত্র তো বাংলাদেশি চিকিৎসকের। সাহায্যকারী কোনো দরদি যদি আগ্রহ করে তার অসুখের কাগজপত্রে চোখ বোলাতে চায়; তখন তো মুশকিল হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে এসে ভিক্ষা করছে, গুপ্তচর! নয়তো... পুলিশ পর্যন্ত গড়ালে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে নিশ্চিত জেল।

হাওড়া স্টেশনের রাত কখনো গভীর হয় না, এখানে চব্বিশ ঘণ্টাই দিন। তবু স্টেশনের ঘড়িতে রাতের প্রহর হলে সে সিদ্ধান্ত নেয়, পাসপোর্ট, ভিসা, ক্যানসারের নকল রিপোর্ট, গায়ের ভদ্রস্থ পোশাক ফেলে দিয়ে সে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যাবে। তার সাথে কোনো রাষ্ট্রের পরিচয়পত্র থাকবে না, তার কোনো সীমান্তরেখার প্রতি কুর্নিশ থাকবে না, কেবল থাকবে মানুষের মতো তার শরীর উন্মাদের বেশে আধারিত; সে পাগল, ভবঘুরে, জাতভ্রান্ত, কুলভ্রান্ত, মহাবিশ্বের নাগরিক। কেবল তার ওই ঝোলার মধ্যে গেরিলা যোদ্ধার গ্রেনেডের মতো লুকানো থাকবে মুঠোফোনটি। নিজের অবস্থা ও অবস্থান না জানালেও দেশে স্ত্রী-সন্তানের সংবাদ যেন রাখতে পারে।

তিন.

দেবেশ এখন মানুষ নয়, মানুষের মতো এক প্রাণীর চরিত্রে অভিনেতা। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, ছিন্নমূল; পোশাক কমতে কমতে নাঙ্গা হয়েছে, জাঙ্গিয়াসদৃশ একটা প্যান্ট শরীরের অবশিষ্টমাত্র। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে নিজেকে অতীব শক্তিশালী ও স্বাধীন সত্তার কোনো অলৌকিক প্রাণী ভাবতে শুরু করে। এই স্বরচিত পাগলবেশ তাকে যে আবরণ দিয়েছে, সেই বেশের ভেতরে তার সমস্ত সংশয় ও জড়তা লুকিয়ে রাখতে পারবে; এখন তার কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, নাম নেই, বয়স নেই, এমনকি সুনির্দিষ্ট ভাষাও নেই। বাংলা–হিন্দি–ইংরেজি মিলিয়ে নিজেকে রক্ষা করার অস্ত্র হিসেবে একটা সংকর ভাষা তাকে সত্যিকারের বদ্ধ উন্মাদ বলে প্রতিষ্ঠা দেয় এবং সেই উন্মাদব্রতে হাওড়া স্টেশনে তার কাল অতিবাহিত হতে থাকে। এখন তাকে বিশেষ খাবার চাইতে হয় না মানুষের কাছে, কোনো খাবারের দোকান বা রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে জুটে যায় খাবার, তাতে উদোরের আগুনে জল; তবু এই যে সে নিজেকে আত্মপরিচয়হীন করার পরও বয়ে বেড়াতে হয় ভয়, যেহেতু বিভুঁই এবং এই ভারতরাষ্ট্রেরও রয়েছে নীতি ও রাজনীতি, অভিবাসননীতি। যদি কখনো উন্মোচিত হয়ে পড়ে কোথাও তার অভিনীত চরিত্রের ভেতরে আচ্ছাদিত তার অবৈধ অভিবাসী পরিচয়।

হাওড়া স্টেশনে চব্বিশ ঘণ্টাই দিন। তবু স্টেশনের ঘড়িতে রাতের প্রহর হলে সে সিদ্ধান্ত নেয়, পাসপোর্ট, ভিসা, ক্যানসারের নকল রিপোর্ট, গায়ের ভদ্রস্থ পোশাক ফেলে দিয়ে সে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যাবে। তার সাথে কোনো রাষ্ট্রের পরিচয়পত্র থাকবে না, কোনো সীমান্তরেখার প্রতি কুর্নিশ থাকবে না।

দিন অতিবাহিত হতে থাকলেও দিনের দৈর্ঘ্য ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে দেবেশের, সুস্থ মানুষের মতো কোনো পরিকল্পনা তার মাথায় আর বাসা বাঁধে না। উন্মাদের চরিত্রে অভিনয় করতে করতে সে নিজেকে প্রকৃত জ্ঞানশূন্য ভাবতে শুরু করেছে। তবু অবচেতনে দেশ, স্ত্রী ও সন্তান তাকে ফিরিয়ে নিতে হাতছানি দিলে সে নিরুপায়, ফেরার বৈধতা সে তো হারিয়েছে। পথ এখন গহিন, বিএসএফের গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে যাওয়ার ভয় নিয়ে রাতের অন্ধকারে সাতক্ষীরার ইছামতী নদী সাঁতরে দেশে ফেরার পথে ঝাঁপিয়ে যে পড়বে; কী–ই বা করবে দেশে ফিরে, বরং পাগলবেশে কালাতিপাত করে গুপ্তচরের মতো কোনো জীবিকার সন্ধান করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে দালাল ধরে ভারতীয় পাসপোর্ট করে সম্মানিত ভারতীয় নাগরিক হয়ে পেট্রোপল-বেনাপোল পার হয়ে দেশে গিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আবার ফিরে আসবে ভারতে। বোলপুরে জমি কিনবে, শান্তিনিকেতনের হাওয়ায় সন্তানদের ফুসফুস ফুলিয়ে রাখবে।

রাত হলে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের নির্জনে কোনো একটা মোটা থামের আড়ালে ফ্রি ওয়াইফাই জোনের সুবিধা নিয়ে তার জীর্ণ ঝুলির ভেতর থেকে মুঠোফোন বের করে পরিচিতজনদের সাথে বার্তা বিনিময় করে, কাজের সন্ধান করে। ইউটিউবে দেশের খবর জানে। হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ বক্সে দেখতে পায় দুদিন আগের পাঠানো দীপিকার বার্তা, ‘বড় মণির এক সপ্তাহ ধরে জ্বর, কিছুতেই সারছে না। বাজারের পঙ্কজ ডাক্তারের ওষুধ খাওয়াইছি, কোনো গতি হচ্ছে না। ছেলে নেতায়ে পড়ছে দিন দিন...সদরে নিয়ে যাব, হাতে তেমন টাকাও নেই।’

দীপিকার পাঠানো বার্তায় দেবেশের হৃদয় কম্পিত হয়, উন্মাদের আবরণ থেকে বের হয়ে আসতে চায় তার পিতৃত্ব; দৌড়ে শিয়ালদহ গিয়ে বনগাঁ লোকালে চড়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে সুধাসুন্দরে ফিরে জরাক্রান্ত সন্তানের মাথার কাছে পাখির ডিমের মতো দুটো গরম রসমালাই নিয়ে বসে থাকতে তার সাধ হয়। কিন্তু বিষণ্নতা তাকে জাপটে ধরে, যেন তার হাতে–পায়ে লোহার বেড়ি! আন্দামানের জেলে সে বন্দী হয়ে আছে।

ভারাক্রান্ত দেবেশের চোখের পাতা ভারী হয়ে ঘুম আসতে চায়, স্টেশনে আসা-যাওয়া করা ট্রেনের হুইসেলে চোখের ক্লান্ত পাতারা পরস্পর মিলিত হতে চেয়েও পারে না। কিন্তু ঘন-আঠালো ঝিমুনি তার চোখ ছেড়ে যায় না, ঘুমাচ্ছন্নতায় ঘোর আসে। ঘোরের মধ্যে সে দেখতে পায়, নির্জন প্ল্যাটফর্মের মৃদু আলোর ভেতর দিয়ে অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে সরিয়ে একটা বালক এগিয়ে আসছে তার দিকে। বালকের হাতে একটা পাখির খাঁচা। খাঁচায় গোলাপি রঙের একটি ছোট্ট পাখি। পাখিটি অচেনা, কোনো দিন গোলাপি রঙের পাখি দেখেনি সে; আর ততটাই ক্ষুদ্র সে পাখি। চড়ুই, টুনটুনি বা কাকটুনটুনির চেয়েও ছোট। ছোটবেলায় একবার পাখির ডিম পারতে গিয়ে অসচেতনতায় ভাঁটপাতায় নকশিকাঁথার সেলাইয়ের মতো বাঁধা একটা টুনটুনি পাখির বাসা ভেঙে ফেলে দেবেশ, সম্পূর্ণ উড়তে না জানা টুনটুনির এক ছোট্ট বাচ্চা সেই বাসা থেকে ধপাস পড়ে যায়। দেবেশ বাচ্চা টুনটুনিটিকে ধরার অভিপ্রায়ে অগ্রসর হলে, বাচ্চা টুনটুনিটা সংক্ষিপ্ত উড়াল দেয়। দেবেশ আরেকটু এগোয়, বাচ্চা টুনটুনি আবারও উড়াল দেয়। আবারও দেবেশের নীরব পদক্ষেপ, আবারও উড়াল, পাখিটির পেছনে পেছনে সারা দিন, সূর্যেরও পরিক্রমা অন্তে; দেবেশ বুঝতে পারে, পাখিটির পেছনে ছুটতে ছুটতে সে এক গহিন জঙ্গলের ভেতরে চলে এসেছে। এমন ঘন-গহিন জঙ্গল তাদের গ্রামে বা আশপাশে দেখেনি কোনো দিন। দিনালোক অবসান হতে থাকলে বালক দেবেশ বাড়িতে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়। কিন্তু কোন পথে ফিরবে, সেই পথ আবিষ্কার করতে পারে না। সারা দিন পাখিটির পেছনে দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত এবং দিনান্তে বাড়িতে ফেরার পথ নির্ণয়ে অপারগতা ও ভয়ে আক্রান্ত দেবেশ, জঙ্গলের একটা সুউচ্চ গাছের গুড়িতে হেলিয়ে বসে। তখনো গোধূলির শেষ সূর্যরেখার মোলায়েম আভা জঙ্গলের ঘন বৃক্ষলতার ঝালর কেটে এসে পড়ছে দেবেশের মুখে। ক্লান্তিতে তার ঝিমুনি আসে। আচম্বিতে অনুভূত হয়, তার ডান কাঁধের ওপরে একটা ছোট্ট পাখি এসে বসেছে। এ তো সেই ছোট্ট টুনটুনি, সারা দিন যাকে আয়ত্তে আনার জন্য হয়রান হয়েছে। পাখিটি, স্বেচ্ছায় এসে তারই কাঁধের ওপর অবতরণ করেছে। ছোট্ট পাখি, অতিকায় ক্ষুদ্রতর বাচ্চা পাখিটিকে দুহাতে ক্রোড়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে এবং অনাবিল আদরে পাখিটিকে ভালোবাসতে থাকে। পাখিটির শরীরে আঙুল বোলাতে বোলাতে সে আবিষ্কার করে, পাখিটির গায়ের রং বদলে যাচ্ছে। গোলাপি, লাল, হলুদ, বেগুনি—নানা বর্ণিলতায় পাখিটির বিচিত্র মূর্তি দেবেশকে বিহ্বল করে। পাখিটি ধীরে ধীরে ডানা ঝাপটায় আর ডানা ক্রমেই বড় হতে থাকে, বড় হতে হতে বিরাটাকার। তারপর পাখিটি তার বিরাট ডানা দেবেশের দিকে প্রসারিত করে, দেবেশ সেই বিরাটাকার ডানায় চড়ে বসে। পাখিটি সন্ধ্যার অন্ধকারে উড়াল দিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে মুহূর্তেই দেবেশকে তাদের বাড়ির উঠোনে পৌঁছে দেয়।

প্ল্যাটফর্মের নির্জনে দেবেশ তার ঝিমুনির মধ্যে চিনতে পারে, পাখির খাঁচা হাতে বালকটি তারই জ্বরাক্রান্ত বড় পুত্র অরিজিৎ আর তার হাতের খাঁচার মধ্যে গোলাপি রঙের ছোট্ট একটা পাখি। অরিজিৎ বলে, ‘বাবা, বাড়ি যাবা না? তোমারে নিতে আইছি, এই পাখির ডানায় উঠে বসো। তোমারে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই।’

‘এতটুকু পাখির ডানায় কীভাবে চড়ব রে, মণি...?’

খুব চড়া যাবে, একটা ডানায় তুমি, অন্যটায় আমি। মা আমাদের একসাথে দেখলে খুব খুশি হবে।

দেবেশের মনে হয়, এ এক অসীম কালো সমুদ্র, অন্তহীন, অগাধ। এইখানে অনন্ত পারাপার। এই অকূলে মানুষ সতত ভাসমান, এপার-ওপার নেই। মানুষ কোথাও যাচ্ছে না। কূলের রৌরব সন্ত্রাসীদের তাড়া খেয়ে এই অনন্ত বিস্তীর্ণ জলমহলে, রক্তের ভেতরে মাইগ্রেশনের ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে বছরের পর বছর।

বালকটি খাঁচার দুয়ার খুলে দিলে পাখিটি তার ডানা মেলে ধরে। ডানা ক্রমেই বিরাট হতে থাকে। বিরাট ডানা দুটোর একটিতে অরিজিৎ বিমানের পাইলটের মতো বসে ডাকে, ‘বাবা, ওঠো।’ দেবেশ আড়মোরা ভেঙে, কেবলই সেই ডানায় উড়তে যাবে, তখন বিকট ও কর্কশ হুইসেল দিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে দেবেশের ঘুমঘোরকে তছনছ করে দেয় একটি ট্রেন।

ততক্ষণে রাত অন্ধকারযাপনে ক্লান্ত, প্রভাতের সূর্যকুসুমের কাছে আত্মসমর্পণ করে আসন্ন আলোর জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে হাজার হাজার বছরের পুরোনো গুহায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকলে, আলোর আগমনের আগেই বিদায়ী অন্ধকারের আবডালে দেবেশ তার মলিন ঝুলির ভেতর থেকে মুঠোফোন বের করে হোয়াটসঅ্যাপের পর্দায় চোখ রাখে, ‘বড় মণির অবস্থা ভালো ঠেকতেছে না। চোখের তারা উল্টায়ে যাচ্ছে। তুমি কোন খাঁ খাঁ মুল্লুকে? আমি কী করব একা একা?’ দীপিকার খুদে বার্তা পাঠান্তরে দেবেশ এক অসহায় মৃগশাবক! রাক্ষসের অরণ্য থেকে ছুটে আসা আততায়ী শিকারির ছুড়ে দেওয়া অযুত শরে বিদ্ধ তার হৃৎপিণ্ড। বিভুঁইয়ে পলাতক, আত্মপরিচয় গোপনকারী, স্বরচিত বিবর্ণতাবিশিষ্ট উন্মাদ বেশ, ভবঘুরের মলিন আবরণ থেকে এক সন্তানবৎসল পিতার মূর্তি ক্রমেই জেগে উঠতে থাকে। তার কাছে তখন পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশন, কাঁটাতার, বিপৎসংকুল সাঁতার তুচ্ছ হয়ে যায়। বিদ্যুচ্চালিত সে তখন, হাওড়া থেকে পদব্রজে শিয়ালদহ, বসিরহাট লোকাল; বসিরহাটের সীমান্তে রাত্রির ঘনত্বের জন্য অপেক্ষা; অতঃপর সীমান্তের দিকে দুরন্ত অশ্বারোহী সে, যুদ্ধের ময়দানে তার অমিত বিক্রম, প্রতিপক্ষের আগ্নেয়াস্ত্রের দিকে বুক পেতে দিতে নির্ভয়, সে বীর, জয়াকাঙ্ক্ষী, আর কোথাও কিছুর বাধ তার মানবার নয়। সে ছুটবে, টপকাবে সীমান্ত, সাঁতরে আলোকের দেশে যাবেই।

ইছামতীর কালো জলের কাছে যখন সে পৌঁছাল এবং তখন সে পাসপোর্টহীন ভিসাহীন, পরিচয়হীন; উন্মাদবেশের জীর্ণতা খুলে ফেলল, পরিধেয় সামান্য মলিন বস্ত্রের ওজন থেকে শরীরকে মুক্ত করল। কেবল ঝুলির ভেতর থেকে মুঠোফোনটা বের করে পলিথিনে জব্দ করে জড়িয়ে নিল। এখন সে অধিকতর আদিম, জাতি–গোত্র, দেশ, সীমান্ত, পাসপোর্ট, ভিসার ঊর্ধ্বে, পৃথিবীর জন্মলগ্নের সহচর। এখন সে জলের, হাওয়ার, অন্ধকারের এবং ওজনহীন।

মুঠোফোনটা বাঁ হাতে উঁচিয়ে ধরে ইছামতীর কালো জলে লাফ দেয় দেবেশ, অতীব শীতল সেই জল, যেন এস্কিমো দেশ। জল কেটে কেটে এগোতে থাকে, সাঁতরে মাঝনদীতে এসে পড়লে তার মনে হয়, ইছামতীর মাছেরা, অন্তর্লীন জলজ প্রাণীসমস্ত যেন তারই মতো আদিম মানুষ হয়ে সাঁতরে তাকে অতিক্রম করে বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে ভারতের দিকে এগোচ্ছে। দেবেশের মনে হয়, এ এক অসীম কালো সমুদ্র, অন্তহীন, অগাধ। এইখানে অনন্ত পারাপার। এই অকূলে মানুষ সতত ভাসমান, এপার-ওপার নেই। মানুষ কোথাও যাচ্ছে না। কূলের রৌরব সন্ত্রাসীদের তাড়া খেয়ে এই অনন্ত বিস্তীর্ণ জলমহলে ভাসমান, রক্তের ভেতরে মাইগ্রেশনের ইতিহাস বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বছরের পর বছর। তাকে মধ্য ইছামতীতে রেখে সারি সারি মানুষের সাঁতার ভারতপাড়ের দিকে অগ্রসরমান; দেবেশকে এগোতে হবে অপর পাড়ের দিকে। যেদিকে তাদের শূদ্রভূমি, জ্বরে আক্রান্ত বেঘোর সন্তান শুয়ে আছে মৃত্যুর পাশবালিশ জড়িয়ে, পাশে তার নিরুপায় স্ত্রী ও ছোট পুত্র অরিন্দম—অগ্রজের অকাল প্রস্থানের পথে পড়ে থাকা পুজোর বাসি ফুলের মতো চুপসে দেখছে—দেবতারা হাসতে হাসতে অমৃতলোকের দিকে উড়ে যাচ্ছে। দেবেশকে ইছামতীর আর সামান্য জলপথ অতিক্রম করতে হবে, তখন মর্ত্যে দেবতা বা দৈত্যের বিকট হাসির শব্দের মতো বীভৎসতায় গর্জে ওঠে ইছামতীর জলে টহলরত বিএসএফের বন্দুকের বারুদ।

ভোরের সূর্যের রক্তিম আলো এসে ইছামতীর রক্তাক্ত জলে মিশে গেছে। রক্তে ভাসা নদী থেকে ছ্যাঁচরাতে ছ্যাঁচরাতে আহত দেবেশ ডাঙায় ওঠে। নদীর উঁচু পাড়, হামাগুড়ি দিয়ে সেই উঁচু পাড়ের দিকে উঠতে থাকে সে আর তার পেছনের ছ্যাঁচরানো পথে রক্তরেখায় অনন্ত এক মহাসড়ক রচিত হতে থাকে। সেই সড়ক দিয়ে পৃথিবীর মানুষেরা চিরকাল উদ্বাস্তু হয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে গমনাগমন করবে। সে যখন উঁচু পাড়ের কাছাকাছি আসে, দেখে, বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বাঁধা চকচকে রাস্তায় সারিবদ্ধ বর্ডার গার্ডের গাড়িবহর চলে যাচ্ছে। বাঁধের চূড়ায় মাথা রেখে এলিয়ে পড়ে দেবেশ। তার চোখ দুটো বুজে আসছে। অর্ধনিমীলিত চোখে সে দেখতে পায়, বর্ডার গার্ডের গাড়ির চাকায় পিষ্টে যাচ্ছে ভোরের সূর্যের পবিত্র চেহারা। আর চকচকে রাস্তার ওপরে পিষ্টে যাওয়া সূর্যের ছিটকে পড়া আলোয় পাখির ডিমের মতো অসংখ্য রসগোল্লা গড়াগড়ি খাচ্ছে। বর্ডার গার্ডের গাড়িবহরের চলন্ত চাকার ফাঁক দিয়ে দেবেশ দেখতে পায়, বেড়িবাঁধের সড়কের ওপারে স্বর্গীয় পিতা অধীরচন্দ্র বিশ্বাসের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার দুই পুত্র অরিজিৎ ও অরিন্দম।

দেবেশ চেষ্টা করে তার শরীরটাকে বর্ডার গার্ডের গাড়ির চাকার নিচে ছুড়ে দিতে, যেন বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার সন্তানদের একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় আগত সূর্যের দিনে। কিন্তু তার সন্তানেরা এখনো নাবালক, এই সমস্ত সে ভাবতে থাকে এবং ততক্ষণে তার শরীরের তেজ ভেজা ছাইয়ের গহিন স্তরে চাপা পড়ে গেছে। এরা জোয়ান হতে হতে বর্ডার গার্ডের গাড়ির চাকারা দেবেশের রক্তকে ভুলে যাবে। দেবেশ টের পায়, শরীরটা ততক্ষণে প্রোথিত হয়ে গেছে মাটির গভীরে যেখানে, সেখান থেকে বিষাদবৃক্ষ জন্মাবে চিরদিন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ধ স ন দর গ র ম র বর ড র গ র ড র গ ড় প ল য টফর ম র স বর গ য় প ত ঘ উ ঘ উ কর ল র ভ তর র সন ত ন সন ত ন র জট ল র গ দ শত য গ ও সন ত ন র ত র অন ত র ভ তর র সমস ত র র পর র অন ধ র ন রব দ ন আগ র জন য র রক ত ব র কর উন ম দ ট নট ন পর ক র র র জন প ত হয় র জন ত অর জ ৎ ঙ গল র র স মন র র মত পর চ ত ন র জন তর থ ক ম র মত ত র মন এখন স র করত ব যবস অবস থ র ওপর অনন ত এখন ত র একট সরক র একদ ন ত রপর

এছাড়াও পড়ুন:

রুবাবা দৌলাকে নিয়ে রসিকতা, ভুল–বোঝাবুঝিতে পোস্ট সরালেন ইরফান সাজ্জাদ

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালনা পরিষদের পরিচালক হয়েছেন করপোরেট ব্যক্তিত্ব ও ক্রীড়া সংগঠক রুবাবা দৌলা। সম্প্রতি বোর্ড সভায়ও অংশ নিয়েছেন তিনি। তাঁর এই দায়িত্ব গ্রহণকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিনন্দন ও আলোচনা—দুটোই চলছে।

অভিনেতা ইরফান সাজ্জাদ ফেসবুকে রুবাবা দৌলার একটি স্থিরচিত্র পোস্ট করে লিখেছিলেন, ‘এরপরও যদি পোলাপান পারফরম্যান্স না করতে পারে, তাহলে আর আশা নাই।’

পোস্টটি ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ইরফান এটিকে রসিকতা বলতে চাইলেও অনেকেই মন্তব্য করেছেন, এমন রসিকতা ভুলভাবে ব্যাখ্যা হওয়ার সুযোগ রাখে।

করপোরেট ব্যক্তিত্ব ও নারী ক্রীড়া সংগঠক রুবাবা দৌলা

সম্পর্কিত নিবন্ধ