আর্নল্ড টয়েনবি ও দাইসাকু ইকেদা বিশ শতকের দুজন বিশিষ্ট মনীষী, চিন্তাবিদ ও ভাবুক। ভৌগোলিক পরিচয়ের দিক থেকে টয়েনবি পশ্চিমের দুনিয়ার আর ইকেদা পূর্ব এশিয়ার। টয়েনবির মূল পরিচয় ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক এবং ইকেদা বৌদ্ধ চিন্তাবিদ, শান্তিপ্রবক্তা ও লেখক। পরিচয়গত নানাবিধ পার্থক্য সত্ত্বেও দুজনের চিন্তা, কর্ম ও জীবনদর্শনের মিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়।

টয়েনবি ও ইকেদা দুজনেই ছিলেন জ্ঞানপিপাসু, ইতিহাসসচেতন, মানবতাবাদী, যুদ্ধবিরোধী ও বিশ্বমৈত্রীর দূত। নিজেদের লব্ধজ্ঞান ও মনীষার মাধ্যমে তাঁরা জীবনভর মানবিক মূল্যবোধ, অহিংসা, সহনশীলতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের উদ্বোধন ঘটিয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। বিগত শতকের শেষার্ধে এই দুই মনীষীর মধ্যকার বৈঠক ও সংলাপ ছিল জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতের সবচেয়ে বড় ঘটনা। টয়েনবির আমন্ত্রণে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সালে দুজনের মধ্যে একাধিক দীর্ঘ বৈঠক ও আলাপচারিতা হয় লন্ডনে টয়েনবির বাসভবনে। এতে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল সভ্যতার উত্থান-পতন, বিশ্বযুদ্ধ ও শান্তিসংকট, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, মানবতার ভবিষ্যৎ, পূর্ব ও পশ্চিমের দর্শনের মেলবন্ধন; ধর্ম, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ; শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মানবপ্রগতি প্রভৃতি। আলাপচারিতায় দুজনের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও যে ঐকমত্য দেখা যায়, তা ছিল বিস্ময়কর।

তখন পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় চলমান রয়েছে পশ্চিমের নেতৃত্ব। আলাপচারিতায় টয়েনবি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নেতৃত্বের ব্যাপারে। ইঙ্গিতটা ছিল এমন—পূর্ব এশিয়া অচিরেই পশ্চিমের কাছ থেকে নেতৃত্ব গ্রহণ করবে। এমন প্রত্যাশার কারণও তিনি তুলে ধরেছিলেন। অন্যদিকে ইকেদার সঙ্গে টয়েনবি সহমত পোষণ করেছিলেন যে নতুন শতাব্দীতে মানবজাতি রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে ঐকমত্যে পৌঁছাবে। অবশ্য ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ে টয়েনবির তুলনায় ইকেদা বেশি আশাবাদী ছিলেন। তিনি ধারণা করতেন, মানবজাতির মধ্যে এই পরিবর্তন আসবে নিজেদের সম্মিলিত উদ্যোগে ও স্বেচ্ছায়। আর এই পরিবর্তন হবে সমতার ভিত্তিতে, কারও ওপরে জোরজবরদস্তি ছাড়াই। টয়েনবিও এমন পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেননি, তবে তাঁর কথা ছিল এই পরিবর্তনের জন্য মানবজাতিকে উচ্চ মূল্যও দিতে হবে। দুই চিন্তাবিদের এমন ভাবনা ও ফারাকের পেছনের কারণকে তাঁদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন ইতিহাসবিদেরা। একইভাবে সাহিত্য ও শিল্প বিষয়েও টয়েনবি ও ইকেদার স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ও ঐকমত্য দেখা গেছে আলাপচারিতায়, যা পরবর্তীকালে লেখক, শিল্পী ও চিন্তাবিদদের বেশ প্রভাবিত করেছিল।

আর্নল্ড টয়েনবি ও দাইসাকু ইকেদা বিশ শতকের দুজন বিশিষ্ট মনীষী, চিন্তাবিদ ও ভাবুক। ভৌগোলিক পরিচয়ের দিক থেকে টয়েনবি পশ্চিমের দুনিয়ার আর ইকেদা পূর্ব এশিয়ার। টয়েনবির মূল পরিচয় ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক এবং ইকেদা বৌদ্ধ চিন্তাবিদ, শান্তিপ্রবক্তা ও লেখক।

আলাপচারিতায় মানবজীবনে সাহিত্যের প্রভাব প্রসঙ্গ তুলেছিলেন ইকেদা। সাহিত্যের ভূমিকা নিয়ে ইকেদা বেশ প্রভাবিত ছিলেন জাঁ পল সার্ত্র দ্বারা। সার্ত্রের জিজ্ঞাস্য প্রসঙ্গেই তাঁর আলোচনার সূত্রপাত যে ভুখা-নাঙ্গা মানুষের জন্য সাহিত্যের দায় কী? ইকেদা দেখেছেন সাহিত্যশিল্পে সামাজিক দায় স্বীকার করে কিছু লেখক সৃষ্টিশীল কাজে নিযুক্ত, অনেকে আবার এই ধরনের দায়কে উপক্ষো করে শুধু শিল্পসৃষ্টিতে মশগুল রয়েছেন। তাঁদের ধারণা, শিল্পসৃষ্টি ছাড়া সাহিত্যের দ্বিতীয় কোনো দায় নেই। টয়েনবি ইকেদার প্রসঙ্গকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে সাহিত্যসৃষ্টির সঙ্গে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতিতুলনা করেন। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক গবেষণাই-বা ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য কী মঙ্গল বয়ে আনে? টয়েনবির নিজের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন জোটানো যদি গবেষণার প্রধান লক্ষ্য হয় আর সে লক্ষ্য অর্জনে যদি গবেষণাকর্মের ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে বৈজ্ঞানিক গবেষণাও নিরন্ন মানুষের দাবি মেটাতে ব্যর্থ হয়—আদতে কোনো কাজে লাগে না। টয়েনবির কথা তাই সীমিত উদ্দেশ্যে কর্মে আত্মনিয়োগ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পথে পঙ্গুত্ব বই নয়। তাই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তখনই সম্ভব হয়ে ওঠে, যখন মননশীল কৌতূহল মেটানোর জন্য গবেষণাকর্মটি হাতে নেওয়া হয়। পৃথিবীর প্রায় সব আবিষ্কার সাধিত হয়েছে উপযোগ কিংবা উদ্দেশ্য ছাড়াই—অবশ্য পরে তা মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হয়েছে। বিজ্ঞানের এই আপাতবিরোধী সত্যকে সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য বলে টয়েনবির দাবি।

প্রসঙ্গক্রমে টয়েনবি টেনে এনেছেন লিও তলস্তয়কে। উনিশ শতকের খ্যাতিমান এই রুশ কথাসাহিত্যিকের প্রভাব ছিল দুনিয়াব্যাপী। বিশেষ করে তাঁর সাহিত্যকর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পৃথিবীর ধনী ও ক্ষমতাশালীদের একটা বড় অংশ। যাঁরা মনুষ্যত্বের দায় কাঁধে নিয়ে নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোসহ নানা সামাজিক সংস্কারে এগিয়ে এসেছিলেন। টয়েনবি দেখিয়েছেন, তলস্তয়ের সৃষ্টির দুটি পর্যায়ের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের রচনা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও শিল্পসৃষ্টির তাগিদে; আর দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনা ছিল সামাজিক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে রচিত। প্রথম পর্যায়ের রচনাগুলোর শিল্পমান যেমন উঁচুস্তরের ছিল, সামাজিক দিক থেকেও ছিল আধিপত্যবিস্তারী। সেই তুলনায় সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে কিংবা সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে লেখা দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনায় যেমন সাহিত্যমূল্য শিথিল ছিল, তেমনি সামাজিক উপযোগ মেটাতেও ততটা প্রভাববিস্তারী ছিল না। প্রথম পর্যায়ের রচনার এমন প্রভাবের জন্য টয়েনবি শিল্পগুণকেই কৃতিত্ব দিয়েছেন।

তবে টয়েনবি এটাও উল্লেখ করতে ভোলেননি যে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট সরকার যে তলস্তয়কে গ্রহণ করেছিল, তিনি সাহিত্যশিল্প নিয়ে মতাদর্শ পরিবর্তনকারী দ্বিতীয় পর্যায়ের তলস্তয়। শিল্পসাহিত্যের ব্যাপারে কমিউনিস্টদের মতাদর্শ হচ্ছে এর সামাজিক উপযোগ। অবশ্য ‘সামাজিক কল্যাণ’ ধরনের উপযোগ তলস্তয়ের মতাদর্শের চেয়েও সংকীর্ণ বলে উল্লেখ করেন টয়েনবি। কারণ, কমউনিস্টদের সামাজিক কল্যাণের অর্থ হচ্ছে সাম্যবাদী আদর্শ এবং কমিউনিস্ট সরকারের প্রসার। তাই টয়েনবির পর্যবেক্ষণে এমন সাহিত্যের ফলাফল হচ্ছে শিল্পসৃষ্টি ও সামাজিক প্রভাবের দারুণ অবনতি। তাই কমিউনিস্ট আদর্শে লিখিত তৎকালীন সাহিত্যকে তিনি নিষ্প্রভ ও অকার্যকর বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে কমিউনিস্ট সরকার শিল্পসৃষ্টির অভিপ্রায়ে রচিত তৎকালীন সাহিত্যকে শুধু নিরুৎসাহিত করত না, বরং পার্টির নীতিবহির্ভূত সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকদের নির্যাতন করতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। সোভিয়েত সরকারের শিল্পসাহিত্য-সংক্রান্ত নীতির ব্যাপারে টয়েনবির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে ইকেদা সহমত পোষণ করে ঔপন্যাসিক আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিনের প্রসঙ্গটি টেনে আনেন। রচনা নিষিদ্ধসহ জেল-জুলুম, রাজনৈতিক দমনপীড়ন; এমনকি দেশ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত সোলঝেনিৎসিনকে সইতে হয়েছিল। ইকেদা সোলঝেনিৎসিনের এই পরিণতিকে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ওপর সরকারি নীতির বলপ্রয়োগের পরাকাষ্ঠা বলে অভিমত দেন।

বিগত শতকের শেষার্ধে এই দুই মনীষীর মধ্যকার বৈঠক ও সংলাপ ছিল জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতের সবচেয়ে বড় ঘটনা। টয়েনবির আমন্ত্রণে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সালে দুজনের মধ্যে একাধিক দীর্ঘ বৈঠক ও আলাপচারিতা হয় লন্ডনে টয়েনবির বাসভবনে। আলাপচারিতায় দুজনের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও যে ঐকমত্য দেখা যায়, তা ছিল বিস্ময়কর।

এ প্রসঙ্গে টয়েনবির আরও মত যে বিপ্লব-পূর্ব সাম্রাজ্যবাদী জার সরকারও সাহিত্যিকদের স্বাধীনতা পছন্দ করত না; বরং লেখকদের স্বাধীনতায় সরকারপক্ষ আতঙ্কিত থাকত। তারপরও জার সরকার লেখকদের উৎপীড়নের নীতি গ্রহণ করেনি, কারণ তারা জানত এতে হিতে বিপরীত হবে। অন্যদিকে লেখকদের সৃজনী প্রেরণার প্রকাশস্বরূপ রচিত সাহিত্যের প্রভাবকে টয়েনবি ‘রাশিয়ার সাহিত্য-ইতিহাসের শিক্ষা’ বলে গণ্য করেছেন। বিষয়টাকে আপাতবিরোধী স্বীকার করে সৃজনী প্রেরণাকে মানুষের অধ্যাত্মজীবনের উৎসজাত বলে দাবি তাঁর।

ইকেদারও ওই একই কথা যে শিল্পীকেও বিজ্ঞানীর মতো আধ্যাত্মিকভাবে স্বাধীন হতে হয়। সামাজিক দায় লেখকের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে বরং তাঁর রচনা সাহিত্য পদবাচ্য না–ও হতে পারে। সেদিক থেকে সৃজনশীল প্রতিভাজাত স্বতঃস্ফূর্তভাবে রচিত সাহিত্য ভুখা-নাঙ্গা মানুষের জন্য কাজের কাজ করতে পারে। প্রসঙ্গত, ইকেদা রাজনৈতিক শাসনের সঙ্গে সাহিত্যশিল্পের বিচার-বিশ্লেষণের অবতারণা করে মার্ক্সবাদী কিংবা খ্রিষ্টবাদী সাহিত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে দেখান যে বিপ্লবোত্তর অর্ধশতকেও ফিওদর দস্তয়েভস্কির রচনার সমান উঁচু মানের সাহিত্য রাশিয়ায় রচিত হয়নি।

১৯৭৩ সালের লন্ডন বৈঠকে দাইসাকো ইকেদা (বামে) ও আর্নল্ড টয়েনবি.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ রহণ কর উদ দ শ য শ শতক র প রসঙ গ ঐকমত য র জন য কর ছ ন এই পর করত ন ম নবজ সরক র এমন প উপয গ

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন রেজা কিবরিয়া

বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া। তিনি হবিগঞ্জ-১ (আজমিরীগঞ্জ-বাহুবল) আসন থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে চান।

বুধবার প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রেজা কিবরিয়া।

উল্লেখ্য, বিগত ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে একই আসনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকেই নির্বাচন করেছিলেন।

এদিকে হবিগঞ্জ-১ আসনটি এখন পর্যন্ত ফাঁকা রেখেছে বিএনপি। দলটি এখনো এ আসনে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেনি।

রেজা কিবরিয়া গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক, গণঅধিকার পরিষদ ও এর বিভক্ত দল আমজনতার দলের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ