‘ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছিস তো, সাবধানে থাকিস’ মুঠোফোনে, ভিডিও কলে রোজ বলেন মা। কোনো কোনো দিন খুব বলতে ইচ্ছা করে, ‘মা, তোমার হাতের পেঁয়াজ দিয়ে দেশি ট্যাংরার ঝোল খেতে ইচ্ছা করছে।’ কিন্তু খাওয়ার কষ্ট হচ্ছে ভেবে মা কষ্ট পাবেন বলে বলা হয় না। মায়ের হাতে জাদু আছে। তেল পটোল, বেগুন তেল, ইলিশ মাছের ঝাল, কাঁঠালের বিচি দিয়ে ঘাটকোল, নারকেলের দুধ দিয়ে চিংড়ি মাছ, পায়েস কি যে চমৎকার রাঁধেন, ভাবলেই জিবে জল আসে।
আমাদের ভাইবোনকে ছেলেবেলা থেকেই মা অল্পে খুশি হতে, সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে শিখিয়েছেন। বোধ করি, এ কারণেই আমরা কখনো বাবার কাছে অহেতুক কোনো আবদার করিনি, করি না। বলা দরকার, কোনো আবদার করলে বাবা তা পূরণ করতে কখনো কার্পণ্য করেননি।
মাঝে মাঝে মাকে ভেবে মুগ্ধ হই। কী চমৎকারভাবেই না জীবনের সব শখ-আহ্লাদ নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন! লেখাপড়া জেনেও পরিবারের জন্য নিজের সব স্বপ্ন অন্তরাল করেছেন। দুই হাতে সংসার সামলেছেন। কখনো মুখ ফুটে নিজের দুঃখ, কষ্টের ঝাঁপি খুলে বসেননি। নরম স্বভাবের হওয়ায় কখনো কোনো কারণে কষ্ট পেলে সহসা চোখ জলে ভরে যায়। রাগ করলেও বেশি সময় ধরে রাখতে পারেন না। আমাদের মতের অমিল যে একেবারে হয় না, তা নয়; হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মা মান ভাঙান।
ছেলেবেলায় মাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হতো। আত্মীয়বাড়িতে গিয়েও তেমন থাকিনি কখনো। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে প্রথমবারের মতো বাড়ি ছেড়ে মেডিকেল ভর্তির কোচিং করতে যাওয়ার দিন ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। প্রথম দিকে মেসের রান্না খেতে কষ্ট হতো। কিন্তু মাকে কখনো বলিনি। দিন বাড়তে বাড়তে সব সয়ে গেছে। জীবন বোধ হয় এমনই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব অসহনীয়ও সয়ে যায়, অভ্যাস হয়ে যায়।
আমার জন্য কারণে–অকারণে মাকে কথা শুনতে হয়েছে। এখনো শুনতে হয়। পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করলে, কোনো ভুল করলে, দোষ করলে মাকে কথা শোনাতে কেউ ছাড়েননি কখনো। আজও ছাড়েন না। দশমিক দুই পাঁচ নম্বরের ব্যবধানে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ হারিয়ে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। মা তখনো ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। আজও প্রতিটি ইচ্ছায়, স্বপ্নে, পদক্ষেপে ভরসা ও অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে পাশে আছেন।
তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়ায় যুক্ত হয়েছি। ব্যাচমেটদের দুই-তিনজন গিটার বাজানো শিখবে বলে গিটার কিনল। আমার হারমোনিয়ামে গান গাওয়ার চর্চা ছিল। গিটার শেখারও ইচ্ছা হলো। তখন দুটি টিউশনি করি। দুই মাসের টাকা রাখলেই গিটার কেনা যাবে। বাবাকে বললেও টাকা দিতে আপত্তি করবেন না। কিন্তু নিজের টাকায় কেনার আনন্দ অন্য রকম। তবে টিউশনির টাকায় কিনতে হলে দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে। তত দিনে গিটারের নতুন ব্যাচ শুরু হয়ে যাবে। বন্ধুদের সঙ্গে এক ব্যাচে শেখা হবে না। কী করি? ভাবতে ভাবতে মায়ের কাছ থেকে ধার নেওয়ার ভাবনা এল মাথায়। মা সংসার খরচের টাকা থেকে প্রতি মাসে কিছু টাকা সঞ্চয় করার চেষ্টা করেন। পরিবারের ক্রাইসিস মোমেন্টের জন্য টাকাগুলো রেখে দেন। যদিও এ কথা আমি, বোন আর মা ছাড়া কেউ জানে না। অগত্যা মায়ের কাছে কথাটা পাড়লাম। এ–ও বললাম, টিউশনির টাকা থেকে মাসে মাসে কিস্তিতে শোধ করে দেব। কিন্তু মা রাজি হলেন না। তাঁর এক কথা, ‘ভালো করে পড়ালেখা কর। পরে কিনিস। তা ছাড়া অত টাকা আমার কাছে নেই।’ মন খারাপ হলো। মন খারাপের ব্যাপারটা ঠারেঠোরে বোঝানোর চেষ্টা করলেও মা পাত্তা দিলেন না। বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে ফেরার সময় গাড়িতে উঠে ভাড়া দিতে গিয়ে দেখি, মানিব্যাগে সাদা কাগজে মোড়ানো বেশ কিছু টাকা। কাগজটাতে লেখা, ‘ঠিকমতো পড়ালেখা করিস। গিটার শিখতে গিয়ে পড়ালেখার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।’
আজ যে মন খারাপে, আনন্দ উদ্যাপনে গিটার বাজিয়ে দু–একটা গান গাইতে পারি, তা মায়ের জন্য। আমার কোনো ইচ্ছায়, শখে মা কখনো আপত্তি করেননি, করেন না। ঢাকা থেকে বাড়ি গেলে, না পৌঁছানো পর্যন্ত রাত জেগে অপেক্ষায় থাকেন। পছন্দের সব খাবার রান্না করে রাখেন। গরম ভাত হাঁড়ি থেকে নামিয়ে খেতে দেন। খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাশে বসে থাকেন। কোনো কোনো দিন মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা করে ‘এমনটা তুমি কেমন করে করতে পারো, মা!’ কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে কথাটা মাকে বলা হয়ে ওঠে না। হয়তো খুব ভালোবাসার মানুষকে সহজে ভালোবাসার কথা বলা যায় না।
আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, তখন বাড়িতে প্রথম আলো নেওয়া শুরু হয়। বাড়ির অনেকেরই বই, পত্রপত্রিকা পড়ার অভ্যাস আছে। আমি লিখতে ভালোবাসি। লেখালেখির বিষয়টাকেও মা আমার মতোই ভালোবাসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে তখন, প্রথমবারের মতো সুযোগ হয় প্রথম আলো অফিসে আসার। বিশ্বের বৃহত্তম বাংলা গণমাধ্যম। সেদিন থেকেই স্বপ্ন বুনতে শুরু করি। একদিন প্রথম আলোতে কাজ করব। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি আজ প্রথম আলোর কর্মী। আমার কোনো লেখা ছাপা হলে আমার পর আর যে মানুষটা খুশি হন, তিনি মা। ঘুম থেকে উঠে লেখা পড়ে ফোন করে ভালোলাগার কথা জানান। তখন কী যে ভালো লাগে! পৃথিবীতে মা–বাবাকে খুশি হতে দেখার মতো আনন্দ হয়তো আর কিছুতে নেই।
একটা তথ্য দিয়ে লেখা শেষ করি। বাড়ি গেলে কিংবা প্রয়োজন হলে এখনো মায়ের থেকে টাকা ধার নিই। টাকা হাতে পেলে কখনো কখনো শোধ করেও দিই। কিন্তু গিটার কেনার জন্য নেওয়া টাকা শর্তানুযায়ী টিউশনির টাকা থেকে প্রতি মাসে শোধ করা হয়নি। কিন্তু মা আমার সেই ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক’, যিনি কখনো কিস্তি পরিশোধের জন্য তাগাদা দেননি, দেন না। কখনো বলেননি, ‘না, হবে না, আগেরটা ফেরত দিসনি।’ এ নিয়ে বোনের যদিও গুরুতর অভিযোগ আছে। তার দাবি, মা আমাকে বেশি ভালোবাসেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল র জন য ট উশন
এছাড়াও পড়ুন:
জরাজীর্ণ ভোটকেন্দ্রের তালিকা চেয়েছে ইসি
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জরাজীর্ণ ভোটকেন্দ্র সংস্কার ও মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ বিষয়ে দেশের সব সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে তথ্য চেয়েছে সংস্থাটি।
বুধবার (৫ নভেম্বর) ইসির সিনিয়র সহকারী সচিব মো. নাসির উদ্দিন চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ তথ্য জানা গেছে।
আরো পড়ুন:
আজকের মধ্যে প্রবাসী ভোটারদের আবেদন তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ইসির
এনসিপিসহ ৩ দল পেল চূড়ান্ত নিবন্ধন
চিঠিতে জানানো হয়েছে, গত ২০ অক্টোবর ভোটকেন্দ্রের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর দেখা গেছে, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- যেগুলো ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে, বাউন্ডারি ওয়াল নেই, দরজা-জানালা নষ্ট বা জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে, কিংবা অল্প পরিসরে মেরামতের প্রয়োজন আছে। এসব কেন্দ্রের তালিকা নির্ধারিত ছক অনুযায়ী তৈরি করে ১২ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সহায়তা-১ শাখায় পাঠাতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট জেলা বা উপজেলা নির্বাচন অফিসগুলোকে এ তথ্য আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রেরণ করতে হবে। তালিকার হার্ড কপির পাশাপাশি নিকস ফন্টে সফট কপি জমা দিতে হবে।
ইসি বলছে, এই পদক্ষেপের লক্ষ্য হলো ভোটের দিন ভোটারদের জন্য নিরাপদ, সুষ্ঠু ও সহনশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা। জরাজীর্ণ বা অনুপযুক্ত ভবনে ভোটগ্রহণের কারণে যেন কোনো নিরাপত্তা বা প্রশাসনিক জটিলতা না হয়, সে বিষয়েও সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এই তথ্য সংগ্রহের পর দ্রুত সংস্কার কার্যক্রমের বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করবে ইসি।
ঢাকা/এএএম/মাসুদ