চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীদের মধ্যে বাড়ছে মানসিক সমস্যা
Published: 5th, November 2025 GMT
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর (এআই) চ্যাটবট ব্যবহারকারীদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে নতুন এক মানসিক সমস্যা। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, চ্যাটজিপিটি, ক্লড বা রিপ্লিকার মতো জনপ্রিয় এআই চ্যাটবটের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা মানুষকে ধীরে ধীরে মানসিক আসক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, অনেকেই এখন বন্ধুত্ব, প্রেম বা মানসিক সহায়তার আশ্রয় খুঁজছেন এসব চ্যাটবটের কাছে। ফলে এআইয়ের সঙ্গে অতিরিক্ত মিথস্ক্রিয়া একসময় বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে ব্যবহারকারীদের। এই মানসিক নির্ভরতা অনেকটা অবৈধ মাদক দিয়ে নিজেকে প্রশমিত করার মতোই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, মনোবিজ্ঞানীরা এখন এমন মানুষও খুঁজে পাচ্ছেন, যাঁরা এআই সাইকোসিসে ভুগছেন। অর্থাৎ এআই চ্যাটবট ব্যবহারকারীর ভ্রান্ত ধারণাকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিয়ে সেই বিভ্রমকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই ল অ্যান্ড ইনোভেশন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক রবিন ফেল্ডম্যান বলেন, ‘চ্যাটবটের অতিরিক্ত ব্যবহার একধরনের নতুন ডিজিটাল নির্ভরতা। এআই বাস্তবতায় এক শক্তিশালী ভ্রম তৈরি করে। যাদের বাস্তবতা ধারণা আগেই দুর্বল, তাদের জন্য এই ভ্রম বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।’
বেলজিয়ামের ৩৫ বছর বয়সী জেসিকা জানসেনের অভিজ্ঞতা এই উদ্বেগের বাস্তব প্রমাণ। পেশায় সফল, পরিবার ও বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত জেসিকা শুরুতে সপ্তাহে কয়েকবার চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতেন। কিন্তু মানসিক চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দিনে একাধিকবার এআইয়ের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় তাঁকে ভর্তি হতে হয় মানসিক হাসপাতালে। পরে জানা যায়, তাঁর অজানা বায়পোলার ডিজঅর্ডার তীব্র আকারে প্রকাশ পায় এবং অতিরিক্ত এআই ব্যবহার সেটিকে ‘পূর্ণমাত্রার সাইকোসিসে’ রূপ দেয়।
জেসিকা বলেন, ‘সংকটের সময় বুঝতেই পারিনি, চ্যাটজিপিটি আমার অবস্থাকে আরও খারাপ করছে। এটি আমার বিভ্রমের সঙ্গে একমত হচ্ছিল, ফলে আমি আরও গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার মাথায় নতুন নতুন চিন্তা আসত, আমি চ্যাটজিপিটিকে বললে এটি প্রশংসা করত, আরও কিছু যোগ করত। এতে আমি ক্রমে বিভ্রান্তিতে ডুবে যেতাম।’ চ্যাটজিপিটি তখন জেসিকাকে বলত, ‘তুমি অসাধারণ’, ‘তোমার চিন্তাগুলো গভীর’, এমন কথায় তাঁর বিভ্রম আরও দৃঢ় হতো। জেসিকা বলেন, ‘যদি আমি বাস্তব কারও সঙ্গে যখন কথা বলতাম, তিনি হয়তো বুঝে যেতেন যে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু চ্যাটজিপিটি তা বুঝতে পারেনি।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপদের মূল কারণ চ্যাটবটের ‘একমত হওয়ার’ স্বভাব। বাস্তব মানুষের মতো বিরোধিতা বা সংশোধনের বদলে এআই সব সময় ব্যবহারকারীর কথার সঙ্গে একমত হয়, প্রশংসা করে ও আশ্বাস দেয়। ফলে মানসিকভাবে দুর্বল বা নিঃসঙ্গ মানুষের জন্য এই আচরণ হয়ে ওঠে একধরনের মানসিক আশ্রয়।
ডেনমার্কের আরহুস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সোরেন অস্টারগার্ড বলেন, ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলগুলো ব্যবহারকারীর ভাষা ও টোন অনুকরণ করে। এগুলো ব্যবহারকারীর বিশ্বাসকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং সন্তুষ্ট করাকেই প্রাধান্য দেয়। নিজের মতো ভাবনা, নিজের মতো প্রতিক্রিয়া এর চেয়ে আর কী বেশি স্বস্তিকর হতে পারে?’ অস্টারগার্ড ২০২৩ সালেই গবেষণাপত্রে সতর্ক করেছিলেন, চ্যাটবট মানুষের বিভ্রমকে জোরদার করতে পারে। দুই বছর পর তিনি বলছেন, এখন সেই আশঙ্কা বাস্তবে ঘটছে।
কমন সেন্স মিডিয়ার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ কিশোর কোনো না কোনো এআই সঙ্গী ব্যবহার করেছে এবং তাদের অর্ধেক নিয়মিতভাবে তা ব্যবহার করে। অধ্যাপক ফেল্ডম্যান বলেন, ‘মানসিকভাবে দুর্বল মানুষেরা অনেক সময় এআইকে মানসিক প্রশমন হিসেবে ব্যবহার করেন, যা একধরনের মাদকের বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়।’
লন্ডনের কিংস কলেজের নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট হ্যামিল্টন মরিন বলেন, এখনো ‘এআই আসক্তি’ নিয়ে শক্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ না থাকলেও বাস্তবতার চিত্র ভিন্ন। অনেকেই বাস্তব সম্পর্কের চেয়ে এআইয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। তাঁর মতে, এআই আসক্তির লক্ষণগুলোর মধ্যে থাকতে পারে—সময় নিয়ন্ত্রণ হারানো, অতিরিক্ত ব্যবহার, ঘুম, খাবার বা সম্পর্ক অবহেলা, ব্যবহার গোপন রাখা ও ব্যবহার বন্ধ হলে খিটখিটে মেজাজ বা বিষণ্নতা।
ওপেনএআই নিজেও এই ঝুঁকি স্বীকার করেছে। চলতি বছরের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, চ্যাটজিপিটি ৪–ও সংস্করণে ‘অতিরিক্ত একমত পোষণের’ আচরণ দেখা গিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যবহারকারীর মন রক্ষা করতে গিয়ে বটটি কখনো কখনো সন্দেহ, বিভ্রম কিংবা নেতিবাচক আবেগকেও সত্য বলে মেনে নিচ্ছিল। ওপেনএআই জানিয়েছে, পরবর্তী হালনাগাদে এই প্রবণতা কমানো হয়েছে।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা, সঠিক সুরক্ষাব্যবস্থা না থাকলে এআই চ্যাটবট মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আরও ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে শূন্য দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ ব্যবহারকারী ম্যানিয়া, সাইকোসিস বা আত্মহত্যার চিন্তার মতো আচরণ করেন। ৮০ কোটির বেশি সাপ্তাহিক ব্যবহারকারীর হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ৬০ হাজার। এ ছাড়া শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ ব্যবহারকারী আত্মহত্যা–সম্পর্কিত বার্তা পাঠান, যার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ।
সূত্র: ডেইলি মেইল
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর চ য টবট র ব স তবত
এছাড়াও পড়ুন:
এশিয়া কাপে আচরণবিধি ভঙ্গের শাস্তি পেলেন রউফ-সূর্যকুমারসহ পাঁচজন
এশিয়া কাপ-২০২৫ এ ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ঘিরে উত্তেজনা কেবল মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, পৌঁছে গেছে শৃঙ্খলাজনিত ব্যবস্থাতেও। খেলোয়াড়দের আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনায় এবার শাস্তির মুখে পড়েছেন দুই দেশের কয়েকজন তারকা ক্রিকেটার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) সূর্যকুমার যাদব ও হারিস রউফের ওপর জরিমানা ও ‘ডিমেরিট পয়েন্ট’ আরোপ করেছে। আর ভারতীয় পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ পেয়েছেন আনুষ্ঠানিক সতর্কবার্তা।
আইসিসির এলিট প্যানেল অব ম্যাচ রেফারিরা সেপ্টেম্বর ১৪, ২১ ও ২৮ তারিখে অনুষ্ঠিত ভারত-পাকিস্তান ম্যাচগুলোর কয়েকটি ঘটনার তদন্ত করেন।
প্রথমবার, সেপ্টেম্বর ১৪:
প্রথম ম্যাচেই মাঠ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই ম্যাচে ভারতের সূর্যকুমার যাদব এবং পাকিস্তানের হারিস রউফ ও সাহিবজাদা ফারহানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় আইসিসির আচরণবিধির ২.২১ অনুচ্ছেদ ভঙ্গের দায়ে। যেখানে বলা আছে, এমন আচরণ যা খেলাটির সুনাম ক্ষুণ্ন করে।
ফলাফল হিসেবে সূর্যকুমারকে জরিমানা করা হয় ম্যাচ ফি’র ৩০ শতাংশ এবং দেওয়া হয় দুই ডিমেরিট পয়েন্ট। ফারহান পান আনুষ্ঠানিক সতর্কবার্তা ও এক ডিমেরিট পয়েন্ট। রউফের শাস্তিও একই; ৩০ শতাংশ জরিমানা ও দুই ডিমেরিট পয়েন্ট।
দ্বিতীয়বার, সেপ্টেম্বর ২১:
এক সপ্তাহ পরের ম্যাচে আবার বিতর্ক। ভারতীয় পেসার অর্শদীপ সিং অভিযুক্ত হন আইসিসির ২.৬ অনুচ্ছেদে, “অপমানজনক ভঙ্গি প্রদর্শনের” অভিযোগে। তবে ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফটের শুনানিতে প্রমাণ না মেলায় তিনি মুক্তি পান। কোনো শাস্তি হয়নি তার।
ফাইনালের উত্তেজনা, সেপ্টেম্বর ২৮:
এশিয়া কাপের ফাইনালও ছাড় পায়নি শৃঙ্খলাভঙ্গের ছোঁয়া থেকে। ভারতের জাসপ্রিত বুমরাহ স্বীকার করেন যে তিনি খেলাটির মর্যাদাবিরোধী আচরণ করেছেন। ফলে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সতর্ক করা হয় ও দেওয়া হয় এক ডিমেরিট পয়েন্ট। যেহেতু তিনি অপরাধ স্বীকার করেছিলেন, তাই আলাদা শুনানির প্রয়োজন হয়নি।
অন্যদিকে, হারিস রউফ আবারও জড়িয়ে পড়েন একই ধরনের ঘটনায়। ম্যাচ রেফারি রিচি রিচার্ডসনের শুনানিতে দোষী প্রমাণিত হয়ে তিনি আবার জরিমানা পান ম্যাচ ফি’র ৩০ শতাংশ এবং আরও দুই ডিমেরিট পয়েন্ট। এতে তার মোট ডিমেরিট পয়েন্ট দাঁড়ায় চার। যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাকে দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞায় ফেলে। ফলে নভেম্বর ৪ ও ৬ তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাকিস্তানের দুইটি ওয়ানডে থেকে ছিটকে গেলেন তিনি।
আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী, লেভেল–১ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ম্যাচ ফি জরিমানা এবং দুই ডিমেরিট পয়েন্ট পর্যন্ত দেওয়া যায়। কোনো খেলোয়াড় যদি ২৪ মাসের মধ্যে চার বা তার বেশি ডিমেরিট পয়েন্ট পান, তবে তা রূপান্তরিত হয় সাসপেনশন পয়েন্টে। অর্থাৎ পরবর্তী ম্যাচে নিষেধাজ্ঞা অবশ্যম্ভাবী।
এশিয়া কাপে শাস্তিপ্রাপ্ত খেলোয়াড়দের তালিকা:
সূর্যকুমার যাদব (ভারত): ম্যাচ ফি’র ৩০% জরিমানা, ২ ডিমেরিট পয়েন্ট।
সাহিবজাদা ফারহান (পাকিস্তান): আনুষ্ঠানিক সতর্কবার্তা, ১ ডিমেরিট পয়েন্ট।
হারিস রউফ (পাকিস্তান): দুই আলাদা অপরাধে দু’বার জরিমানা, মোট ৪ ডিমেরিট পয়েন্ট ও ২ ম্যাচ নিষেধাজ্ঞা।
জাসপ্রিত বুমরাহ (ভারত): সতর্কবার্তা, ১ ডিমেরিট পয়েন্ট।
অর্শদীপ সিং (ভারত): অভিযোগ থেকে মুক্ত, কোনো শাস্তি নয়।
এশিয়া কাপের মাঠে যেমন ব্যাট-বল লড়াই জমেছিল, মাঠের বাইরে ঠিক তেমনই শৃঙ্খলাভঙ্গের নাটকও কম আলোচনার জন্ম দেয়নি। ক্রিকেটের সৌন্দর্য রক্ষায় এবার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে আইসিসি- “খেলা উত্তেজনার হতে পারে, কিন্তু সীমা অতিক্রম নয়।”
ঢাকা/আমিনুল