সোনার দামের উল্লম্ফন আমাদের কী জানিয়ে দিচ্ছে
Published: 5th, November 2025 GMT
এ বছর সোনার দামের যে উল্লম্ফন দেখা গেছে, তা আমাকে একরকম দ্বিধায় ফেলেছে। দাম হু হু করে বাড়ল, আবার হঠাৎ করেই কমে গেল। এই উত্থান-পতনের ভেতর দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, হয়তো এই পতনই সোনার উড়ানের শেষ পর্বের শুরু।
আবার একই সঙ্গে মনে হয়, এটা কেবল সাময়িক একটা বিরতি। এরপর এক ধাক্কায় দাম আরও ওপরে উঠতে পারে। কারণ, বিশ্ব অর্থব্যবস্থা এখন এমন এক জটিল পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যার প্রতিফলন স্বাভাবিকভাবেই পড়ছে সোনার দামে।
অনেকের মতে, সোনার দাম এখন একধরনের বুদ্বুদের আচরণ করছে। বিগ টেক কোম্পানিগুলোর উত্থান টপকে এখন এটি নাসডাক সূচককেও পেছনে ফেলেছে। দাম বাড়ছে, তাই মানুষ আরও কিনছে—আবার কিনছে বলে দাম আরও বাড়ছে। এই চক্রটা তৈরি করেছে ‘ফোমো’ (ফিয়ার অব মিসিং আউট) বা সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার ভয়। ফলে তুচ্ছ খবরও এখন বাজারে উত্তেজনা ছড়ায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই উত্তেজনার আসল ভিত্তি কতটা মজবুত?
ইতিহাসে সোনা সব সময়ই ছিল নিরাপদ আশ্রয়। অর্থনৈতিক অস্থিরতা কিংবা মূল্যস্ফীতির সময় সোনার ওপর মানুষ ভরসা রাখে। সোনা সুদ দেয় না, কিন্তু টিকে থাকে টাকার মান রক্ষার প্রতীক হিসেবে। তবে এই ব্যাখ্যা দীর্ঘ মেয়াদে প্রযোজ্য; এই ব্যাখ্যা ২০২৫ সালে হঠাৎ করে দামের উল্লম্ফন বোঝাতে পারে না।
এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের ডলার দুর্বল হয়েছে, বন্ডের সুদের হারও নেমেছে। এতে বোঝা যায়, মূল্যস্ফীতি ও ভবিষ্যৎ মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা দুটোই কমছে। তাহলে এমন পরিস্থিতিতে সোনার দাম এত দ্রুত বাড়ছে কেন? এই প্রশ্ন থেকেই অনেক বিশ্লেষক বলছেন—এটা আসলে একটি বিনিয়োগ-বুদ্বুদ। তবে সোনার পক্ষে যুক্তিও কম নয়। আমি নিজেও কর্মজীবনে এমন সময় দেখেছি, যখন সোনায় আস্থা রাখাটা যথেষ্ট যুক্তিসংগত মনে হয়েছিল।
১৯৯৫-৯৬ সালে আমি গোল্ডম্যান স্যাকসের প্রধান মুদ্রা বিশ্লেষক ছিলাম। তখন থেকেই অনেকে বলছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বড় বড় অর্থনীতির সরকারি ঋণ দ্রুত বাড়ছে। অনেকের আশঙ্কা ছিল, সরকারগুলো হয়তো এই ঋণ মুদ্রার মান কমিয়ে সামাল দিতে চাইবে। তাই তখন সোনায় বিনিয়োগ ছিল একরকম স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত।
আমার সহকর্মী জেমস রিসডেল তখন একটি ‘আনকনস্ট্রেইন্ড টোটাল রিটার্ন মডেল’ শীর্ষক একটি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা ও পোর্টফোলিও বিশ্লেষণের ধারণা প্রকাশ করেছেন। সেখানে ভাসমান বিনিময় হারের যুগের নানা সম্পদ বিবেচনায় নেওয়া হয়। আশ্চর্যজনকভাবে, তাঁর বিশ্লেষণ বলেছিল, একটি ভারসাম্যপূর্ণ পোর্টফোলিওতে সোনার পরিমাণ প্রচলিত ধারণার চেয়ে অনেক বেশি হওয়া উচিত।
যখন অভিজ্ঞ বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিষয়টা আলোচনা করলাম, তাঁরা বললেন, এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন। তবু বিনিয়োগে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক উপাদান থাকে, যা বাজারের দিক নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। আমি যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ে কাজ করেছি, তাই বুঝি কেন চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বড় অংশ এখন সোনায় রাখছে। তাদের লক্ষ্য হলো ডলারনির্ভর বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার বিকল্প গড়ে তোলা। তারা ব্রিকস গোষ্ঠীর অন্যান্য দেশকেও এই পথে উৎসাহিত করছে।
তবে এর আরও সাধারণ ব্যাখ্যাও আছে। মুদ্রাবাজারে আমি শিখেছি, মুদ্রার দামে বাস্তব সুদের হার প্রভাব ফেলে। যখন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার কমায়, কিন্তু মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা খুব একটা কমে না, তখন ডলার দুর্বল হয়। আবার সুদহার বাড়ালে ডলার শক্তিশালী হয়। এই একই নিয়ম সোনার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। জি-৭ দেশগুলোর বাস্তব সুদের হার যখন একসঙ্গে কমে, তখন সোনার দাম বাড়ে।
বর্তমান বাজারও তাই ধরে নিচ্ছে—কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো হয়তো এখন সুদ আরও কমাবে বা অন্তত আর বাড়াবে না। অথচ মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি কমে যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে সোনার দাম বাড়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়; বরং এটি ইতিহাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত কার যুক্তি ঠিক প্রমাণিত হবে অর্থাৎ দাম বাড়বে নাকি কমবে, তা কেউই বলতে পারে না।
জিম ও’নিল যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও গোল্ডম্যান স্যাকস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর
এছাড়াও পড়ুন:
পোশাকশিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিজিএমইএ-আইএমএফ বৈঠক
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মধ্যে পোশাকশিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি ও রূপান্তর নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বুধবার (৫ নভেম্বর) রাজধানীর উত্তরায় এই বৈঠক হয়।
আরো পড়ুন:
উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিজিএমইএ-এনপিও সমঝোতা স্মারক
শুল্ক হ্রাসে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই, আরো কমাতে আলোচনার পরামর্শ
বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এজেন্ডায় পোশাক খাতের অবদানকে উচ্চ প্রশংসা করে এবং শিল্প খাতের চলমান রূপান্তর প্রচেষ্টায় সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেয়।
বৈঠকে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান সভাপতিত্ব করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান, সহসভাপতি মো. রেজোয়ান সেলিম, সহসভাপতি ভিদিয়া অমৃত খান, পরিচালক নাফিস-উদ-দৌলা এবং পরিচালক ড. রশিদ আহমেদ হোসাইনী।
আইএমএফ প্রতিনিধি দলে ছিলেন সিনিয়র ইকোনমিস্ট কিয়াও চেন, সিনিয়র ইকোনমিস্ট রুইফেং ঝাং এবং ইকোনমিস্ট আয়া সাইদ।
আইএমএফের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পোশাকশিল্পের ভূমিকা, চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বৈশ্বিক অস্থিরতা সত্ত্বেও কিভাবে পোশাকশিল্প প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়।
বিজিএমইএ নেতারা জানান, প্রতিষ্ঠানটি এখন শ্রমনির্ভর মডেল থেকে বেরিয়ে এসে মূল্য সংযোজিত পণ্য, উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তিগত মানোন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, ম্যান-মেইড ফাইবার (এমএমএফ) ও টেকনিক্যাল টেক্সটাইল উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বৈঠকে এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য শুল্ক পরিবর্তন ও বাণিজ্য সুবিধা হ্রাসের বিষয়েও আলোচনা হয়। বিজিএমইএ নেতারা জানান, তারা সরকারকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (ইপিএ) সম্পাদনের পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে বাজারে প্রতিযোগিতা বজায় থাকে।
বিজিএমইএ নেতারা বৈঠকে শিল্প খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে ব্যবসা পরিচালন সহজীকরণ ও ব্যয় হ্রাসের ওপর জোর দেন। তারা উল্লেখ করেন, বোর্ড ইতিমধ্যে সরকারকে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের স্থিতিশীলতা, বন্দর ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি, কাস্টমস ও বন্ড প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং সুদের হার এক অঙ্কে রাখার বিষয়ে সুপারিশ করেছে। এছাড়া তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়ন দ্রুত সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেন।
ঢাকা/নাজমুল/সাইফ