ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে বিশ্ববাসীর কৌতূহল, ইরান ঠিক কীভাবে এ রকম জবাব দিচ্ছে? ইরানের ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য বেশি হচ্ছে, কিন্তু যেভাবে ইসরায়েলের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোম ভেদ করে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে, তাতে ইরানের সক্ষমতা মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, অর্থনৈতিকভাবেই–বা তারা কীভাবে এই যুদ্ধের সংস্থান করছে?

বিষয়টি হলো, ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের পর থেকেই ইরান যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূলে পরিণত হয়। বিশেষত তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে ইরানের বিপ্লবীদের হামলার পর পরিস্থিতির ঘোরতর অবনতি হয়। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে দেশটির ওপর।

মাঝে বারাক ওবামা এসব নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করলেও ২০১৮ সালে ট্রাম্পের প্রথম জমানায় আবারও নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো হয়। ফলে পশ্চিমা জনমনে ধারণা ছিল, ইরান হয়তো বেশি সময় পাল্টা আক্রমণের ধার বজায় রাখতে পারবে না। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে এখন পর্যন্ত ইরান পাল্টা জবাব দিয়ে যাচ্ছে। খবর আল-জাজিরা ও বিবিসির।

ইরানের অর্থনীতির ভিত যতটা না নীতিনির্ভর, তার চেয়ে বেশি নির্ভরশীল প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর। বিশ্বে সবচেয়ে বড় গ্যাস ও তেলের মজুদদারদের মধ্যে অন্যতম দেশটি হচ্ছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য বলছে, ২০২১ সালেও গ্যাস মজুতের দিক দিয়ে ইরান ছিল দ্বিতীয় আর তেলে তৃতীয় বৃহত্তম।

এই বিপুল সম্পদের একাংশের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে। এই দেশটি ঘেঁষেই রয়েছে হরমুজ প্রণালি—বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ। এই জলপথ দিয়েই প্রতিদিন বিশ্বে ব্যবহৃত তেলের ২১ শতাংশ সরবরাহ হয়।

তেল ও গ্যাস খাতে ইরানের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র নিজেও কিছু সময় ইরান থেকে তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য কিনেছে। এক দশক নিষেধাজ্ঞার পর ২০২০ সাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এমন কিছু ক্রয় তথ্য আমেরিকান কর্তৃপক্ষই প্রকাশ করেছে।

শুধু জ্বালানি নয়, কৃষিপণ্যেও শক্তিশালী ইরান। ইরান শুধু জ্বালানি বা খনিজ রপ্তানি করেই নয়, খাদ্যপণ্য ও কৃষিপণ্যের বাজারেও আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয়। দেশটি গম, যব, আপেল, কমলা, আখ, আলু, সবজি, মুরগির মাংসসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের উল্লেখযোগ্য রপ্তানিকারক।

এর পাশাপাশি সিমেন্ট, সার, রাসায়নিক পদার্থ, নির্মাণসামগ্রী, লৌহ-ধাতব পণ্য, টেক্সটাইল ও অস্ত্র রপ্তানিতেও আছে ইরানের সক্রিয় উপস্থিতি। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এসব খাতে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে—বলছে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার। বাংলাদেশের বাজারেও ইরানি আতর, রত্নপাথর কিংবা বিখ্যাত জাফরান নিয়মিতভাবে পাওয়া যায়।

পারস্য সাম্রাজ্যের দীর্ঘ ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তাদের পণ্যের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছে। বিবিসির সংবাদে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ও ওয়াশিংটনের অনেক কার্পেটের দোকানে ইরানের কার্পেট বিক্রি হয়। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এসব পণ্য সংস্কৃতির প্রতিনিধি হয়ে দূর দেশের বাজারে পৌঁছে যায় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

এ ছাড়া বিকল্প পথে বাঁচার চেষ্টাও করছে ইরান। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিনিময় প্রথা, হুন্ডি বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অঘোষিত বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে ইরান। আফগানিস্তান, সিরিয়া, তুরস্ক, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশ তাদের আঞ্চলিক বাণিজ্যবন্ধু। এই পদ্ধতিগুলো আইনিভাবে স্বীকৃত না হলেও নিষেধাজ্ঞার চাপে থাকা ইরানের জন্য এগুলো বিকল্প আর্থিক রসদ হিসেবে কার্যকর হয়ে উঠেছে।

ইরানের ভৌগোলিক অবস্থানও তাদের শক্তির অন্যতম উৎস। দেশটি এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ফলে তারা চাইলেই পূর্ব-পশ্চিম বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

ইরানে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার ইরাকের রাজধানী বাগদাদের সদর সিটিতে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্ব শরণার্থী দিবসে উদ্বাস্তু জীবনের ভাবনা

২০ জুন ছিল বিশ্ব শরণার্থী দিবস। সেই দিবস উপলক্ষে ১৯ জুন কক্সবাজার শহরে কোস্ট ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আমার যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়। সভায় ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দান: ভবিষ্যৎ ও চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

আলোচনা সভাটি ছিল মূলত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার অনিশ্চয়তা ও ক্যাম্পে শরণার্থীদের পরিপোষণের বার্ষিক বাজেট সংগ্রহ হ্রাসের উদ্বিগ্নতাকে ঘিরে। তার সঙ্গে আলোচনায় চলে ছিল ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বৃদ্ধি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নানান বিষয়ে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব। সম্প্রতি তহবিল ঘাটতির কথা বলে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম হ্রাস করায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্য থেকে নিযুক্ত শত শত শিক্ষকের চাকরিচ্যুতির বিষয়টিও আলোচনায় প্রাধান্য পায়।

সভায় বক্তাদের সমস্যার বিবরণ ও তালিকা পেশ ব্যতীত সমাধানের কোনো পথনির্দেশের হদিস পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া আলোচনা সভায় স্থানীয় জেলা প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা চোরাচালান রোধের রূপরেখার কিছুই জানা যায়নি। আলোচনা সভায় উখিয়া-টেকনাফের জনপ্রতিনিধিদের মুখে সবচেয়ে করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে রোহিঙ্গাদের অবাধে শ্রমমজুরিতে প্রবেশ ও হাটবাজারে অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারায় টেকনাফ-উখিয়া উপজেলার সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবন নির্বাহের অচলাবস্থা সৃষ্টির বিষয়টি নিয়ে।

সভায় জনপ্রতিনিধিরা আরও জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য দূষণের কারণে কৃষকদের কৃষি কাজে মারাত্মক পরিবেশদূষণের বাধা-বিঘ্নতা। এখনো ফয়সালা হয়নি একটানা কয়েক বছর ধরে নাফ নদীতে জেলেদের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় জেলেদের নিয়মিত মাছধরার কাজে বাধাগ্রস্ত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দারিদ্র্য ও হতাশায় জীবনধারণের বিষয়টিও আলোচনায় গুরুত্ব পায়। আলোচনা সভায় সরকারি কর্মকর্তাদের মুখেই শোনা গেছে সীমান্তে মাদক চোরাচালানে সীমান্ত পাহারাদারদের ব্যর্থতার কথা।

আলোচনায় আরও প্রকাশ পেয়েছে, রোহিঙ্গাদের পরস্পরের মধ্যে হানাহানি এবং রোহিঙ্গা কর্তৃক স্থানীয় বাসিন্দাদের জিম্মি করার মতো অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা। বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাসকারী স্থানীয় জনসংখ্যার তুলনায় অধিকসংখ্যক নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পবাসী কীভাবে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে জেলার সর্বত্র বেপরোয়াভাবে বিচরণ করছে এবং নানান পেশায়—ব্যবসায় যুক্ত হতে পারছে, তার কোনো ব্যাখ্যা স্থানীয় প্রশাসন থেকে জানা যায়নি। এতে স্থানীয় জনগণ উদ্বিগ্ন।

সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিদের বিবরণে প্রকাশ পেয়েছে, রোহিঙ্গা নারীদের নিয়ে কক্সবাজার পর্যটন এলাকায় ব্যভিচারী ব্যবসার চিত্র। এ আলোচনা সভায় যে চিত্র ফুটে উঠেছে—রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে নানা অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় জনমনে শঙ্কা বাড়া বৈ কমেনি। সরকারের উদ্যোগে রোহিঙ্গা ও ক্যাম্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি সব দপ্তরের প্রধান, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটির নেতা ও সাংবাদিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্ণিত সব সমস্যা সমাধানের জরুরি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি উঠেছে সভায়।

২০২৪ সালের বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থানের পর এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। রাষ্ট্রভাবনার বিশেষজ্ঞরা, সব রাজনৈতিক দল, অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সব ব্যক্তি ও সংস্থার আর কোনো সংশয় নেই যে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি ক্রমে একটি একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে উঠেছিল। যার পরিণতি ঘটেছে একটি অভ্যুত্থানে।

এ অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার এক বছরের মাথায় বিশ্ব শরণার্থী দিবসের কথা ভাবতে গিয়ে আমার মনপ্রাণ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে তাঁদের কথা ভেবে, যাঁরা আমাদের দেশের, আমাদের পরিচিতজনেরা, বন্ধুরা; যাঁরা কিনা এক বছর আগে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, তাঁরা নিজ দেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা পরদেশে শরণার্থী হয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করবেন।

রোহিঙ্গারা তাদের রাষ্ট্র ও সেই রাষ্ট্রের জনগণ কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে, নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের অধিকার বঞ্চিত হয়ে, পরিশেষে উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও তার দলনেতা শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ প্রভৃতি বলে যে কৃতিত্বের দাবিদার হয়েছিলেন, ভাগ্যের কী করুণ পরিণতি, তাঁদের দলনেতাসহ অনেকেই আজ উদ্বাস্তু ও শরণার্থী!

এখন আমাদের সবার ভেবে দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে, একটি রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের হঠাৎ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার কারণ কোথায় নিহিত রয়েছে। আমাদের মধ্যে যাঁরা আকস্মিকভাবে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছেন, তার জন্য অনেকে ক্ষুব্ধ, অনেকে খুশিতে ডগমগ, অনেকে চোখের জলে ভাসছেন। কিন্তু আমার মন তাঁদের জন্য দুঃখে ভারাক্রান্ত। এই উদ্বাস্তু হওয়ার কারণ খুঁজে পেলে দেখতে পাব, রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার কারণের সঙ্গে আমাদের বারবার উদ্বাস্তু হওয়ার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।

আমার এই লেখায় উদ্বাস্তু বা শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতা, সেই দুঃসহ জীবনের ভার বা তার মর্মবস্তুর কোনো ছিটেফোঁটাও ব্যক্ত করতে পারব না। এখানে তা ব্যক্ত করার দুঃসাহস দেখানো আমার উদ্দেশ্যও নয়। কারণ সেই উদ্বাস্তু জীবনযাপনের সেই দুর্ভাগ্য আমার জীবনে কখনো নেমে আসেনি। একাত্তরে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার দুঃসহ-দুর্গম যাত্রার বিবরণ ও জীবনযাপনের কাহিনি বহু আমি পড়েছি; কিন্তু উদ্বাস্তু জীবনভোগী মানুষের অভিজ্ঞতার কিয়দংশও কারও জীবনচরিত পাঠে জানা যাবে না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। আমিও তা–ই মানি। আমি ভাবতে চাইছি, মানবজীবনে সেই উদ্বাস্তু জীবনযাপনের দুঃসহ-দুর্ভাগ্য যেন কারও জীবনে নেমে না আসে, তার কারণ ও করণীয় কি খুঁজে দেখতে।

তা বোঝার জন্য একটু পেছনে ফিরে তাকাতে চাই। ব্রিটিশ–শাসিত এই অখণ্ড বাংলার নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, যার প্রধান অংশ কৃষিজীবী ও বাঙালি মুসলমান, তারা মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র চাইলেন। অবশেষে ১৯৪৭ সালে শুধু পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে পারলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্নে বিভিন্ন জাতির মুসলমানদের মধ্যে ভাই ভাই সম্প্রীতি ও মর্যাদার সুর প্রধান হয়ে বাজলেও পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর সেই সুর ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। দেখা গেল পাকিস্তান রাষ্ট্রে পশ্চিম পাকিস্তানের নানান জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী ভূস্বামী ও সামরিক-বেসামরিক আমলারা রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদার হিসেবে এবং রাষ্ট্রের অধিকার ভোগে একই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পূর্ব বাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে কিংবা বাঙালি মুসলমানদের সমমর্যাদায় ও সম–অধিকারে একই পঙ্‌ক্তিতে বসাতে রাজি নন।

১৯৭০ সালের পার্লামেন্ট  নির্বাচনে বাঙালিদের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিপুল বিজয় অর্জনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির সমমর্যাদা ও সম–অধিকারে রাষ্ট্রশাসনের অধিকার পাওয়া যখন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, তখন সেই ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার হীন চেষ্টা ও আঘাত থেকেই চরম বিরোধের সৃষ্টি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে সেই বিরোধ ও বাধা থেকেই অনিবার্য উঠেছিল সংঘর্ষ ও বিদ্রোহ। তখন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল একাত্তরের জনযুদ্ধ এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উদ্বাস্তু জীবনের সূত্রপাত। সব কথাই আমাদের সবার জানা কথা। আমাদের রাজনীতিবিদদের আত্মবিস্মৃত স্বভাবের চরিত্রের জন্যই এই জানা কথার পুনরাবৃত্তি। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের জনগণের কারও কারও উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার কারণ একই ঘটনার সূত্রে গ্রথিত।

১৯৭১ সালের জনযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর থেকে ১৯৯০ অভ্যুত্থান এবং ১৯৯১ থেকে ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান পর্যন্ত বাংলাদেশের সব জাতি-গোষ্ঠী, সব ধর্ম-বর্ণ ও ধনী-নির্ধন জনগোষ্ঠীর মানুষকে নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমমর্যাদা ও সম–অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করার ব্যবস্থাপনা থেকেই একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব ও ফ্যাসিবাদের জন্ম। রাষ্ট্রের সব জনগোষ্ঠীর ধর্ম–বর্ণ–জাতিনির্বিশেষে  যার যার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে একত্রে মিলেমিশে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রে বসবাস করার ব্যবস্থাপনা তৈরি করার শাসক শ্রেণির যে দায়িত্ব ছিল তার ব্যর্থতা থেকেই ফ্যাসিবাদের জন্ম। সেই গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের বহু বাসনার দানা বেঁধেছিল একাত্তরে।

যে রাজনৈতিক চর্চা ও রাষ্ট্রশাসনের ব্যবস্থা অন্য সবাইকে বঞ্চিত করার প্ররোচনা দেয়, নিজের ভাবাদর্শে ও মতবাদে মিলে যেতে জবরদস্তি ও বল প্রয়োগ করে, পরিশেষে রাষ্ট্রের অন্য সবাইকে মর্যাদা ও অধিকার দিতে অস্বীকার করে, সেই ধরনের রাষ্ট্র গড়ে তোলার চর্চার মধ্যেই নিহিত রয়েছে রাষ্ট্রের কারও না কারও উদ্বাস্তু হওয়ার বীজ। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানেই যার যার চিন্তা, যার যার ভিন্নতা ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই একটি জনগোষ্ঠীর একজন হয়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে নাগরিক অধিকার ভোগবাসনার বন্দোবস্ত।

বহু ব্যর্থতা ও ত্যাগের পর ২০২৪ জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্র গড়ে তোলার আবার সুযোগ এসেছে। আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জনগণ বহু জাতির, বহু ধর্মের এবং বহু বৈচিত্র্যের। যার যার সৌন্দর্য ও মর্যাদা তার তার। কারও শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করে অন্যদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, অন্যের অধিকার খর্ব করার চেষ্টা এবং সর্বোপরি সেই অপচেষ্টা রাষ্ট্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার চেষ্টার মধ্যেই নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। রাষ্ট্রের মাধ্যমে কোনো জনগোষ্ঠীর সব নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে নাগরিকের বিভিন্নতার বিসর্জনের প্রয়োজন পড়ে না। বিভিন্নতা নিয়ে নাগরিকের সমবিকাশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

নাগরিকের সমবিকাশের অধিকারহীনতা থেকেই জন্ম নেয় বৈষম্যের। অন্য অধিকাংশ মানুষকে অধিকারহীন করে তোলার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ফলে সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র কর্তৃক এই বৈষম্য সৃষ্টির ফলে প্রতিনিয়ত দেশের মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে যারা উদ্বাস্তু হচ্ছে, আমরা তাদেরকেই শরণার্থী দিবসের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করছি। কিন্তু যে মানুষটি বাপ-দাতার ভিটায় জন্ম নিয়ে, সেই পরিবেশের আলো–হাওয়ায় বেড়ে উঠে জীবন শুরু করেছিল, রাষ্ট্রের বৈষম্য-নীতির ফলে দারিদ্র্যের কশাঘাতে অনেকেই বাস্তুচ্যুত হয়ে কোনো বড় শহরের ফুটপাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে কিংবা কোনো বস্তির গলির আস্তানায় ঠাঁই নিতে হয়েছে। তারাও উদ্বাস্তু হওয়ার কম কিসে?

রাষ্ট্রের উন্নয়ন নীতির বৈষম্যের কারণে বেড়িবাঁধের অভাবে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে যার পৈতৃক বাস্তুভিটা ভাসিয়ে নিয়ে যাকে কোনো শহরের ফুটপাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে, সত্যিকার অর্থে সে–ও বাস্তুচ্যুত।

দেশের অভ্যন্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বা প্রাকৃতিক দুযোগের কারণে বা দারিদ্র্যের কারণে যারা উপকূল থেকে হোক কিংবা প্রত্যন্ত কোনো গ্রাম থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তারা সবাই উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তু হওয়া এসব নাগরিক যারা শহরের ফুটপাত বা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে, তারা রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও  রাষ্ট্রের সুশাসন দূরে থাক, সকল ধরনের শাসন ও সেবা থেকে বঞ্চিত।

রাজনৈতিক কারণে যারা উদ্বাস্তু হয়েছে, তারা কোনো না কোনো আইনের আওতায়, কোনো না কোনো কর্তৃপক্ষের বা সংস্থার সেবা পায়। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ও অতি দারিদ্র্যে পতিত হয়ে যারা উদ্বাস্তু হয়ে নিজেদের সমাজ ও গ্রাম হারিয়ে শহরের ফুটপাতে বিচ্ছিন্নভাবে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের উদ্বাস্তু জীবনের যাতনা কম নয়।

একাত্তরে উদ্বাস্তু হওয়ার মর্মে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সব নাগরিককে সমান মর্যাদা ও অধিকার না দিতে চাওয়া শাসকশ্রেণির উদ্যত ও বাড়াবাড়ির মধ্যে আমরা খুঁজে পাব। আমরা কি ২০২৪ সালে আমাদের প্রতিবেশী, পরিচিতজন ও বন্ধুদের উদ্বাস্তু হওয়ার পেছনের কারণ তাদের নিজেদের, নিজেদের দলের ও দলের নেতাদের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াইয়ের এবং অন্যদের বঞ্চিত করার রাজনৈতিক চর্চার ভুলের মধ্যে খুঁজে পেতে চেষ্টা করব না?

আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আমাদের নিজেদের উদ্বাস্তু হওয়ার কারণ খুঁজে দেখতে চেষ্টা করব। বর্তমানে, নতুন পর্যায়ের রাষ্ট্র গড়ার সন্ধিক্ষণে রাজনৈতিক কর্মী ও দলনেতারা যদি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হই, আমরা যদি আমাদের সমাজের বিভিন্নতাকে, বৈচিত্র্যকে সানন্দে মেনে নিয়ে সবাইকে সমান মর্যাদার চোখে সম–অধিকার নিশ্চিত করে রাষ্ট্র গড়ে তুলতে ব্যর্থ হই, এবং সেই অঙ্গীকার নিয়ে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনধারার চর্চা না করি, তাহলে একই সঙ্গে আমাদের উদ্বাস্তু হওয়ার বীজ আমরাই বপন করব।

মকবুল আহমেদ সাবেক অধ্যক্ষ ও লেখক

সম্পর্কিত নিবন্ধ