ভারত ও পাকিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন খেলা
Published: 6th, August 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের দৃশ্যত উন্নতি এবং ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লি সম্পর্কের অবনতি নিয়ে পাকিস্তানে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু উদ্দীপনার পাটাতন কি যথেষ্ট শক্তিশালী এবং সেটি কত দিন টিকবে? কিছু বিশ্লেষক এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের এই পরিবর্তনকে ‘জোটের পুনর্বিন্যাস’ এবং ‘দিক পরিবর্তন’ বলতে শুরু করেছেন। কিন্তু এই জোটের ‘পুনর্বিন্যাস’ অর্থ যদি হয় চীনের কাছ থেকে পাকিস্তানের সরে আসা, তাহলে আমার মনে হয়, এই বিশ্লেষকেরা সম্ভবত ঠিক বলছেন না।
এর কারণ হলো, চীন পাকিস্তানের জন্য নির্ভরযোগ্য অংশীদার ও মিত্র। পাকিস্তান অনেক জায়গায় অর্থনৈতিক প্রয়োজন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ পাকিস্তান।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ক্রমে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার দিল্লিতে ক্ষমতায় রয়েছে। তারা অব্যাহতভাবে তাদের সাম্প্রদায়িক সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব উসকে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ঠেকাতে হলে পারমাণবিক প্রতিরোধী ব্যবস্থার সঙ্গে সামরিক সরঞ্জামও প্রয়োজন।
এটা বলতেই হবে যে পাকিস্তানের জন্য কিছু সুযোগ এসেছে, যেটা জিরো সাম গেমের বা একজন জিতলে আরেকজন হারবে, এমন খেলার অংশ নয়। যুক্তরাষ্ট্র যেমন পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ‘হয় আমার পক্ষে, না হয় আমার বিরুদ্ধে’ এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে, চীন এ রকমভাবে দেখে না; বরং চীনের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি সূক্ষ্ম ও বাস্তববাদী। এর কারণ হলো চীন এখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যকে মূল মনোযোগের কেন্দ্রে রেখেছে।
পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো প্রায়ই চীনের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে; কিন্তু চীন মাত্র ৪০ বছরের মধ্যে কীভাবে ৮০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনল, এ বিষয়টিতে তারা নীরব থাকে। আমরা এখন দেখছি যে গাজায় যে জাতিগত নির্মূল যজ্ঞ চলছে, তাতে প্রায় সমগ্র পশ্চিমা ‘গণতন্ত্র’ ইসরায়েলের দুষ্কর্মের দোসর হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।
এখনকার বাস্তবতায় দুটি বিষয় পাকিস্তানের পক্ষে গেছে। প্রথমত, ইসলামাবাদ সঠিকভাবে ট্রাম্পের আত্মমুগ্ধতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। ট্রাম্পের নাম শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে। ২০২১ সালের আগস্টে কাবুল বিমানবন্দরের ‘অ্যাবি গেট’ বোমা হামলার একজন অভিযুক্তকে দ্রুত গ্রেপ্তার ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করেছে। এতে ‘কঠোর নেতা’ হিসেবে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি শক্তিশালী হয়েছে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন তড়িঘড়ি করে কাবুল ত্যাগ করছিল, তখন ওই হামলায় ১৩ জন মার্কিন সেনা এবং ২০০ আফগান নিহত হয়েছিলেন।
চীনকে মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সামনে ঠেলে দিচ্ছে। ভারত এখন কোয়াডেরও সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এই জোটের অন্য দুই সদস্য হলো অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। এ কারণেই ব্রিকসে ভারতের সদস্যপদকে এশিয়ায় পশ্চিমা কৌশলগত কাঠামোর সঙ্গে অসাঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভারত এমন একটি পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে, যেখানে নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে; কিন্তু ভারতকে এখন এক পক্ষ বেছে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে।এরপর গত বছরের মে মাসে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে একটি সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত যখন পাকিস্তানি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানায়। মার্কিন সূত্র জানায়, ইসলামাবাদ দ্রুত ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায় এবং আত্মমুগ্ধ নেতা ট্রাম্পকে একটি ‘জয়’ উপহার দেয়। ট্রাম্প নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে উপস্থাপন করতে কখনো ক্লান্ত হন না। এ ঘটনায় তাঁর অহং ব্যাপকভাবে তৃপ্ত করেছিল।
অন্যদিকে মনে করা হয় যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন দুটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা ট্রাম্পকে রাগিয়ে তোলে। প্রথমটি হলো, ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রচারে ছিলেন, তখন মোদি তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ট্রাম্পের সঙ্গে একটি বৈঠক বাতিল করেছিলেন। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে ট্রাম্পের যে বিশাল অহংবোধ তাতে নিশ্চিতভাবেই আঘাত করবে।
ভারতের জন্য আরেকটি অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটে মে মাসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের সময়। সংঘাত যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় তার জন্য মার্কিন নেতারা টেলিফোনে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশ হোয়াইট হাউসকে জানায়, তারা উত্তেজনা প্রশমন করবে; কিন্তু ভারত থামেনি।
পাকিস্তান শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধেই সংযম দেখিয়েছে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
টেপরির গল্প
আমার ছোট বোন টেপরি যখন জন্ম নিল, তখন বাংলা সিনেমার চিরায়ত সেই দুটি অপশন আমাদের সামনে চলে এল। ‘আম্মা নাকি টেপরি?’ অর্থাৎ সেদিন হাসপাতালে কোনো টেরিবেরি হয়ে গেলে আজ টেপরির জন্মদিনটাই আম্মার নিরস মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিণত হতে পারত।
জন্মের সময় টেপরির নাক প্রচলিত অর্থে বোঁচা ছিল। এই কারণেই আমি এই নাম রেখেছিলাম দুষ্টামি করে। জন্মের পর ওর গায়ের রং শ্যামলা ছিল, চুল ছিল কোঁকড়ানো। এই তথ্য গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর দাদি মরাকান্না জুড়িয়ে দিলেন।
আমরা বুঝতেই পারছিলাম না, দাদির এই কান্নার কারণ কী! তারপর জানা গেল, ‘শ্যামলা মেয়েকে কেউ বিয়ে করে না’; ‘কোঁকড়ানো চুলের মেয়েদের স্বামীকপাল মন্দ হয়’...মূলত এসব ছাইভষ্ম ভেবে দাদি গঙ্গাকে আরও জলবতী করবার ব্রত নিয়েছিলেন।
মেয়ে ‘কালো’ নাকি ফরসা—এই বিষয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ১১৪ নম্বর কেবিনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করা কয়েক শ বছরের এক বৃদ্ধা আয়া আঙুল তুলে বললেন, ‘এই ম্যায়ার চুল পাতলা হইব, মাথার তালু ফরসা, মুখে-চোখে-গতরে কালা দাগগুনি সব প্যাটের ময়লা। ফুটব ফুটব গায়ের রং ফুটব!’
টেপরি বড় হতে থাকল, সেই শতবর্ষী আয়ার কথামতো আজ টেপরির চুলগুলোতে কেমন মিষ্টি অথচ আঁশটে গন্ধ, আর গায়ের রং? ওর গায়ের রং রুই মাছের ডিমের মতো, যখন তা ঢিমে আঁচে রান্না করা হয় সাত–আটটা কাঁচা মরিচের ভাপে।
এসব বাহ্যিক রূপবৈচিত্র্যের বাইরেও ও টেপরি, যে কিনা সকালে দাঁত মাজা বাদ দিয়ে আম্মার পাশে একটা ছোট বঁটি নিয়ে পেঁয়াজের পর পেঁয়াজ, রসুনের পর রসুন দফারফা করে।
এই তো কিছুদিন আগেও, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ পড়ার পর টেপরির সঙ্গে অনেক দিন কথা বলিনি। বলতে পারিনি। আমার ভেতর তখন কী হয়েছিল আমি আজও বুঝিনি। উপন্যাসে ছোট বোন রঞ্জু মারা গিয়েছিল। আর তার ভাই ‘খোকা’ ভেসে গিয়েছিল দেশ নামের একটা পুকুরের অনেক গভীরে। হয়তো এই দেশকে আমারও তখন একটা পুকুর মনে হয়েছিল।
একুশ মে, বারটা এক, একটা ছোট্ট কেক, আমরা চারজন। দেশলাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে মোমবাতিগুলো কেকের ওপর চোখ বন্ধ করে বসে ছিল নাগা সন্ন্যাসীদের মতো। কেকের ওপর আমার দেওয়া ‘টেপরি’ নামটাই লেখার কথা ছিল, কিন্তু সেটা বানান ভুল হয়ে ‘পেটরি’ হয়ে গেছে। এত চ্যুতি–বিচ্যুতির ভেতর আব্বা কেক মুখে নিয়ে বলে, ‘মা, তোমার হাত ধোয়া ছিল তো?’
পরিবারের আত্মীয় নাম্নী লোকেরা টেপরির জন্মদিনের কথা জানে নাকি জানে না, আমি জানি না। খেয়াল করলাম, তেমন কেউই টেপরিকে বারটায় কিংবা বারটা একে, এমনকি তিরিশেও উইশ করল না। এমন সময়ে টেপরির মোবাইলে একটা মেসেজ এল, কিন্তু সেটাও টেলিকম কোম্পানি থেকে। টেপরিও এসব বুঝে যাবে...এদের সবাইকে চিনে যাবে একদিন।
টেপরির ব্যাপারে একটা–দুটো বাক্য বলা অসম্ভব। সে হয়তো সেই বোনটা, যে টেলিফোনের অন্য পাশে বসে তার রাগের মাথায় ঘরছাড়া ভাইকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার জন্য হু হু করে কাঁদে।
অকারণ এই কান্নাপর্ব আমার যাপিত সময়ে সশস্ত্র হামলা করে, দেখি অপু আর দুর্গা কাশবনে ছুটছে, দূরে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে হারিয়ে যাচ্ছে রেলগাড়ি।
টেপরি বড় হয়ে গেল। বিস্ময়কর একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে কিশোরী থেকে তরুণী আর তারপর আরও ধীরে ধীরে ধীরে কোনো এক ‘নারী’ হয়ে উঠল ও।
আমি ওকে দেখি আর ভাবি, বিকেলের পর বিকেল। দেব দেব করে কোনো একটা বড়সড় গিফট আর দেওয়া হয়ে ওঠে না। এই মন ভোলানো ভাবনাগুলোই ওকে গিফট হিসেবে দেওয়া গেলে ভালো হতো।
কিন্তু এসব ভাবতে ভাবতে দাদির দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে টেপরির বিয়েটাও হয়ে গেল। আম্মার শরীর খারাপ থেকে খারাপতর হওয়ায় নিজের বিয়ের কাজও ওকেই করতে হলো।
বিয়ের আগের সময়গুলোতে আমাদের প্রিয় আব্বা হঠাৎ এক–দেড় মাসেই অনেকটুকু বুড়িয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে আমি বুঝলাম, আব্বা ইস্পাত কঠিন হলে এই একটা মাত্র বিষয়ে উনি প্রচণ্ড অসহায়বোধ করেন। বাবা–মেয়ের সম্পর্কটাই হয়তো এমন।
টেপরি এখন দূরে চলে যাবে আমাদের কাছ থেকে। আমাদের বাসাটা ‘পাখিহীন’ হয়ে কীভাবে টিকে থাকবে; আমি অফিসের ফাঁকে, রাস্তার জ্যামে, সিনেমা হলে সিনেমা শেষ হওয়ার পর, নদীর পাড়ের বাতাসে কিংবা মধ্যরাতের ছাদে হঠাৎ-বিঠাৎ সেইটাই ভাবি।