Prothomalo:
2025-10-22@19:54:57 GMT

বাঙালির আরব্য রজনীর সন্ধানে

Published: 22nd, October 2025 GMT

পৃথিবীর পণ্ডিতদের মতে, আরবি ভাষার ‘আলিফ লায়লা’, বাংলায় ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’ নামক আশ্চর্য উপন্যাসের কিস্‌সাগুলো প্রাচীনকালের। তবে সামগ্রিক রূপটি গড়ে উঠেছে মধ্যযুগের বারো থেকে ষোলো শতকের মধ্যে। সময়টা ছিল আবার সারা দুনিয়ার রোমান্সমূলক আখ্যানের জন্মের কাল। আর পণ্ডিতদের কথা অনুযায়ী আরব্য রোমান্সগুলো গড়ে উঠতে প্রায় আট শ বছর সময় লেগেছিল এবং বিগত তিন শ বছর ধরে পশ্চিম দুনিয়া জয় করে বিশ্বসাহিত্যে ক্ল্যাসিক সৃষ্টি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে বিষয়বস্তুর দিক থেকে এত বিচিত্র কাহিনির সমাহার পৃথিবীর আর কোনো সাহিত্যে নেই। বিচিত্র সব জীবজন্তু, কৌতুক-কাহিনি, বাদশাহি বিষয়, অদৃষ্টের লীলা, ইসলাম ধর্মের খুঁটিনাটি ও বিশদ মহিমা, অভিযাত্রা, প্রেম-লালসা-স্বপ্ন প্রভৃতির সঙ্গে এতে রয়েছে বাস্তব জীবনেরও নানা বিষয়। মানুষের মূঢ়তা-মূর্খতা, দয়াদক্ষিণা, ইন্দ্রিয় রতি, নীতি-দুর্নীতি, ছলনা-প্রতারণা, আশা-নিরাশা, অভাব-অভিযোগ, মিথ্যাচার-ধূর্ততা, খুনখারাবি, উপকার-প্রত্যুপকার প্রভৃতি আরব্য রজনীর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বর্ণিত। সবচেয়ে আকর্ষণীয় যা রাজা-রাজকন্যার সমারোহ, জিন-ইফ্রিত-মন্ত্রসিদ্ধ আংটি, জাদুকর, জাদুর গালিচা, মায়ানগরী, মরু-বন-উপত্যকা-পাহাড়, ঘন নীল দরিয়া ইত্যাদির মিলিত রহস্যঘেরা কল্পজগৎ। এই কল্পজগতের মায়ায় পড়ে নারীতে অবিশ্বাসী বাদশাহ শাহারিয়ার জেগে জেগে রাতের পর রাত শুনেছেন কিস্‌সাগুলো; দণ্ডিত উজিরকন্যা নববধূ শেহেরজাদিকে খুন করার ফুরসতও পাননি। বরং এসব কিস্‌সার বদৌলতে শেহেরজাদি বাদশাকে তো বশ করলেনই, তার ওপর বেগম হলেন; আর বাদশার হাতে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে আরবের যত মেয়েকেও রক্ষা করলেন। আরব্য রজনীর চিরায়ত আবেদনের বাইরে এর বিশেষ গুরুত্ব মুসলমান-জগতের দিগন্ত উন্মোচনও, সে হিসেবে মুসলমানদের কাছে তার ঐতিহ্যিক ও সাহিত্যিক মূল্য একটু বেশি।

সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে বিষয়বস্তুর দিক থেকে এত বিচিত্র কাহিনির সমাহার পৃথিবীর আর কোনো সাহিত্যে নেই। বিচিত্র সব জীবজন্তু, কৌতুক-কাহিনি, বাদশাহি বিষয়, অদৃষ্টের লীলা, ইসলাম ধর্মের খুঁটিনাটি ও বিশদ মহিমা, অভিযাত্রা, প্রেম-লালসা-স্বপ্ন প্রভৃতির সঙ্গে এতে রয়েছে বাস্তব জীবনেরও নানা বিষয়।

তাহলেও বাঙালি মুসলমানের কাছে আরব্য রজনী এসেছে অনেক পরে; আর এই পরে আসার পেছনে মুসলমানদের সাহিত্যিক সমস্যাকে প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী আবির্ভাবের শত বছরের মাথায় আরব বণিকদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলাম প্রবেশ করে; তবে ধর্মমতের প্রসারে সুফিসাধকদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। বাংলায় ইসলামের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নসহ সমাজ-সভ্যতা ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব পড়তে সময় লাগে প্রায় পাঁচ শ বছর। এই সময়ের ভেতরে আরব্য রজনীকে তো পাওয়াই যায় না, বরং তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ষোলো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তা–ও আরব্য রজনীর সহস্র এক রাতের দুই শ চৌষট্টিটি কিস্‌সার একটির মাত্র কাব্যরূপের জন্য। এটি কবি দোনা গাজীর সৈফুল্-মুলুক ও বদীউজ্জমান।

অনুমান করতে অসুবিধা নেই যে মুসলমান সভ্যতা ও পারস্য সংস্কৃতির মাধ্যমে ভারতের মতো বাংলায়ও আরব্য রজনীর কিছু কাহিনি প্রচার পেয়েছিল। তখন ছিল বাংলা ভাষায় মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার সূচনা-যুগ; ধর্মকেন্দ্রিক ও দেবদেবী-কথার বাইরে বাংলা সাহিত্যে তারা প্রথম মানুষকে উপজীব্য করে সাহিত্যচর্চায় আসেন। এর প্রধান কারণ, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস মতে দেবপরিকল্পনার সুযোগ নেই; তাই তাদের পক্ষে প্রচলিত ধারার সাহিত্য রচনাও সম্ভব ছিল না। অথচ মানুষের সাহিত্যিক ক্ষুধা নিবারণের জন্য নবগঠিত সমাজে সাহিত্যবস্তু প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাই মুসলমান সমাজে এই অভিনব রোমান্টিক প্রণয়কাব্য ধারার সূচনা করেন শাহ্ মুহম্মদ সগীর। এই ধারার প্রথম কাব্যকর্ম ‘ইউসুফ-জুলেখা’। প্রণয়কাব্য ধারার প্রায় সব আখ্যানই ছিল অনুবাদমূলক। দোনা গাজীও তাঁর কাব্যটি ফারসি থেকে অনুবাদ করেছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাংলা আরব্য রজনীর সূত্রপাত আরবি উৎস থেকে নয়, ফারসি ধারা থেকে। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রথম বাংলা আরব্য রজনীর যে মানুষ ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় হলো, সে মরুবাসী বেদুইনের নয়, বরং বসরা-বাগদাদ-দামেস্ক-কায়রো নিবাসী আরবের।

সহস্র এক আরব্য রজনীর গল্প থেকে পেইন্টিং, ১৯৩২। শিল্পী: ইভান বিলিবিন.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আরব য রজন র ম সলম ন আরব য র ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

বাঙালির আরব্য রজনীর সন্ধানে

পৃথিবীর পণ্ডিতদের মতে, আরবি ভাষার ‘আলিফ লায়লা’, বাংলায় ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’ নামক আশ্চর্য উপন্যাসের কিস্‌সাগুলো প্রাচীনকালের। তবে সামগ্রিক রূপটি গড়ে উঠেছে মধ্যযুগের বারো থেকে ষোলো শতকের মধ্যে। সময়টা ছিল আবার সারা দুনিয়ার রোমান্সমূলক আখ্যানের জন্মের কাল। আর পণ্ডিতদের কথা অনুযায়ী আরব্য রোমান্সগুলো গড়ে উঠতে প্রায় আট শ বছর সময় লেগেছিল এবং বিগত তিন শ বছর ধরে পশ্চিম দুনিয়া জয় করে বিশ্বসাহিত্যে ক্ল্যাসিক সৃষ্টি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে বিষয়বস্তুর দিক থেকে এত বিচিত্র কাহিনির সমাহার পৃথিবীর আর কোনো সাহিত্যে নেই। বিচিত্র সব জীবজন্তু, কৌতুক-কাহিনি, বাদশাহি বিষয়, অদৃষ্টের লীলা, ইসলাম ধর্মের খুঁটিনাটি ও বিশদ মহিমা, অভিযাত্রা, প্রেম-লালসা-স্বপ্ন প্রভৃতির সঙ্গে এতে রয়েছে বাস্তব জীবনেরও নানা বিষয়। মানুষের মূঢ়তা-মূর্খতা, দয়াদক্ষিণা, ইন্দ্রিয় রতি, নীতি-দুর্নীতি, ছলনা-প্রতারণা, আশা-নিরাশা, অভাব-অভিযোগ, মিথ্যাচার-ধূর্ততা, খুনখারাবি, উপকার-প্রত্যুপকার প্রভৃতি আরব্য রজনীর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বর্ণিত। সবচেয়ে আকর্ষণীয় যা রাজা-রাজকন্যার সমারোহ, জিন-ইফ্রিত-মন্ত্রসিদ্ধ আংটি, জাদুকর, জাদুর গালিচা, মায়ানগরী, মরু-বন-উপত্যকা-পাহাড়, ঘন নীল দরিয়া ইত্যাদির মিলিত রহস্যঘেরা কল্পজগৎ। এই কল্পজগতের মায়ায় পড়ে নারীতে অবিশ্বাসী বাদশাহ শাহারিয়ার জেগে জেগে রাতের পর রাত শুনেছেন কিস্‌সাগুলো; দণ্ডিত উজিরকন্যা নববধূ শেহেরজাদিকে খুন করার ফুরসতও পাননি। বরং এসব কিস্‌সার বদৌলতে শেহেরজাদি বাদশাকে তো বশ করলেনই, তার ওপর বেগম হলেন; আর বাদশার হাতে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে আরবের যত মেয়েকেও রক্ষা করলেন। আরব্য রজনীর চিরায়ত আবেদনের বাইরে এর বিশেষ গুরুত্ব মুসলমান-জগতের দিগন্ত উন্মোচনও, সে হিসেবে মুসলমানদের কাছে তার ঐতিহ্যিক ও সাহিত্যিক মূল্য একটু বেশি।

সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে বিষয়বস্তুর দিক থেকে এত বিচিত্র কাহিনির সমাহার পৃথিবীর আর কোনো সাহিত্যে নেই। বিচিত্র সব জীবজন্তু, কৌতুক-কাহিনি, বাদশাহি বিষয়, অদৃষ্টের লীলা, ইসলাম ধর্মের খুঁটিনাটি ও বিশদ মহিমা, অভিযাত্রা, প্রেম-লালসা-স্বপ্ন প্রভৃতির সঙ্গে এতে রয়েছে বাস্তব জীবনেরও নানা বিষয়।

তাহলেও বাঙালি মুসলমানের কাছে আরব্য রজনী এসেছে অনেক পরে; আর এই পরে আসার পেছনে মুসলমানদের সাহিত্যিক সমস্যাকে প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী আবির্ভাবের শত বছরের মাথায় আরব বণিকদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলাম প্রবেশ করে; তবে ধর্মমতের প্রসারে সুফিসাধকদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। বাংলায় ইসলামের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নসহ সমাজ-সভ্যতা ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব পড়তে সময় লাগে প্রায় পাঁচ শ বছর। এই সময়ের ভেতরে আরব্য রজনীকে তো পাওয়াই যায় না, বরং তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ষোলো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তা–ও আরব্য রজনীর সহস্র এক রাতের দুই শ চৌষট্টিটি কিস্‌সার একটির মাত্র কাব্যরূপের জন্য। এটি কবি দোনা গাজীর সৈফুল্-মুলুক ও বদীউজ্জমান।

অনুমান করতে অসুবিধা নেই যে মুসলমান সভ্যতা ও পারস্য সংস্কৃতির মাধ্যমে ভারতের মতো বাংলায়ও আরব্য রজনীর কিছু কাহিনি প্রচার পেয়েছিল। তখন ছিল বাংলা ভাষায় মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার সূচনা-যুগ; ধর্মকেন্দ্রিক ও দেবদেবী-কথার বাইরে বাংলা সাহিত্যে তারা প্রথম মানুষকে উপজীব্য করে সাহিত্যচর্চায় আসেন। এর প্রধান কারণ, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস মতে দেবপরিকল্পনার সুযোগ নেই; তাই তাদের পক্ষে প্রচলিত ধারার সাহিত্য রচনাও সম্ভব ছিল না। অথচ মানুষের সাহিত্যিক ক্ষুধা নিবারণের জন্য নবগঠিত সমাজে সাহিত্যবস্তু প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাই মুসলমান সমাজে এই অভিনব রোমান্টিক প্রণয়কাব্য ধারার সূচনা করেন শাহ্ মুহম্মদ সগীর। এই ধারার প্রথম কাব্যকর্ম ‘ইউসুফ-জুলেখা’। প্রণয়কাব্য ধারার প্রায় সব আখ্যানই ছিল অনুবাদমূলক। দোনা গাজীও তাঁর কাব্যটি ফারসি থেকে অনুবাদ করেছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাংলা আরব্য রজনীর সূত্রপাত আরবি উৎস থেকে নয়, ফারসি ধারা থেকে। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রথম বাংলা আরব্য রজনীর যে মানুষ ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় হলো, সে মরুবাসী বেদুইনের নয়, বরং বসরা-বাগদাদ-দামেস্ক-কায়রো নিবাসী আরবের।

সহস্র এক আরব্য রজনীর গল্প থেকে পেইন্টিং, ১৯৩২। শিল্পী: ইভান বিলিবিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ