রাজনৈতিক দল নিজেরা আলোচনা করে কি সমঝোতায় যেতে পারে, অতীত কী বলে
Published: 6th, November 2025 GMT
জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এই আলোচনার আয়োজন সরকার করবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকেই করতে হবে। দলগুলো এক সপ্তাহের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারলে সরকার তার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে সমাধানের পথ খুঁজতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এই অনুরোধ জানানো হয়েছে গত সোমবার। এর মধ্যে তিন দিন পেরিয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত দলগুলোর মধ্যে আলোচনার কোনো ইঙ্গিত দেখা যায়নি। এমনকি অনানুষ্ঠানিক আলোচনারও কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সময়ের স্বল্পতা ও বাস্তবতা বিবেচনায় এবার নিজ উদ্যোগে রাজনৈতিক দল একসঙ্গে সংলাপে বসবে—এমন ভরসা পাচ্ছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদের পতনের পর জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কয়েকবার সংকট তৈরি হয়। এসব সংকট সমাধানে কখনো নিজ উদ্যোগে, কখনো প্রভাবশালী বাইরের দেশ এবং জাতিসংঘের উদ্যোগে সংলাপের আয়োজন হয়েছে। কিন্তু কোনো বারই এসব সংলাপে সমাধান আসেনি। বরং সংলাপের পর দেশ সংঘাতের পথে হেঁটেছে এমন নজিরই বেশি।
আরও পড়ুনউদ্বিগ্ন সরকার, দায়িত্ব দিল দলগুলোকে০৪ নভেম্বর ২০২৫ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা মাথায় রেখে রাজনৈতিক দল, সরকার ও নাগরিক সমাজ সবার মধ্যেই রাষ্ট্র সংস্কারের তাগিদ দেখা দেয়। এরপর সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থাসহ সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি কমিশন গঠন করে সরকার। সব সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই কমিশনের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
প্রায় সাড়ে আট মাস ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে টানা বৈঠক করে জুলাই সনদ প্রণয়ন করে ঐকমত্য কমিশন। অধিকাংশ দলই তাতে সই করে। কিন্তু এই জুলাই সনদের আলোকে কীভাবে সংস্কার বাস্তবায়ন হবে—এই বিষয়ে একমত হতে পারেনি দলগুলো। সরকারের উদ্যোগে সাড়ে আট মাসে যে ঐক্য মত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, তা এক সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলো করতে পারবে—এমনটা আশা করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। অতীতে হওয়া সংলাপগুলো ব্যর্থ হওয়া এই ধারণার জন্ম দিয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের তিনটি স্তর। এগুলো হচ্ছে—আদেশ জারি, গণভোট এবং আগামী সংসদকে নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার পরিষদের ক্ষমতা দেওয়া। এ তিনটি স্তর নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতপার্থক্য আছে। তবে মূল মতবিরোধ গণভোটের সময় এবং সংস্কার প্রস্তাবে ভিন্নমত রাখা না রাখা নিয়ে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংলাপ যেন এক চিরচেনা দৃশ্য—সংকট তৈরি হলে দলগুলো আলোচনায় বসে, আর সমঝোতা না হলে সেই সংলাপ হারিয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়। ১৯৮৮ সালের সামরিক শাসনের শেষ সময় থেকে ২০২৫ সালের বর্তমান উদ্যোগ পর্যন্ত সংলাপ হয়েছে বহুবার, কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে—সংলাপগুলো আসলে কতটা সমাধান দিয়েছে?
আরও পড়ুনদলগুলো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে সরকার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবে০৩ নভেম্বর ২০২৫নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন ও রাজনৈতিক সমঝোতা
১৯৮৮ সালের নির্বাচনের পর সামরিক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পদত্যাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল আন্দোলনে নামে। আন্দোলনরত দলগুলো নিয়ে গড়ে উঠে তিনটি জোট। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট–দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত–দলীয় জোট এবং বাম ঘরানার দলগুলোর সমন্বয়ে পাঁচ–দলীয় জোট। এর বাইরে একই দাবিতে জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ আন্দোলন করেছিল, তবে তারা কোন জোটে ছিল না।
এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর জোট তিনটি আলাদা সমাবেশ থেকে একযোগে একটি ‘রূপরেখা’ ঘোষণা করে, যা তিন জোটের রূপরেখা নামে পরিচিত। যার মূল লক্ষ্য ছিল একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ গঠনের লক্ষ্যে এরশাদের পতন। রূপরেখা ঘোষণার দুই সপ্তাহ পরই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করে তাঁর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন এরশাদ।
এরশাদ সরকারের পতনের পর গণ-আন্দোলনের মধ্যেই প্রথম কার্যকর রাজনৈতিক সংলাপের নজির গড়ে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, বাম ও ইসলামি দলগুলো সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা ঠিক করতে একাধিক বৈঠকে বসে।
রূপরেখায় থাকা ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং সরকার গঠন করে। কিন্তু বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেনি। এরপর পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে নামে বিরোধী দলগুলো।
আরও পড়ুনদলগুলোকে আলোচনা করে মতৈক্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব দিল অন্তর্বর্তী সরকার০৩ নভেম্বর ২০২৫তিন জোটের রূপরেখা আলোচিত হলেও সেটিতে জোটগুলো কোনো স্বাক্ষর করেনি। ফলে এটি জাতীয় সনদে পরিণত হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হলে ১৯৯৪ সালের ৩১ আগস্ট জাতীয় সংসদে বিএনপির তৎকালীন নেতা প্রয়াত একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবদুস সামাদ আজাদের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু কোনো সমাধান আসেনি।
সে সময় কমনওয়েলথ মহাসচিব এনিয়াওকুর এমেকা ঢাকায় এসে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে তিনি তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান স্যার স্টিফেন নিনিয়ানকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংলাপ তত্ত্বাবধানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত নিনিয়ান দফায় দফায় বৈঠক করেন দুই পক্ষের সঙ্গে। তিনিও বাংলাদেশে সফল হননি।
আওয়ামী লীগসহ প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যে দিয়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসে। কিন্তু বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে এক মাসের মধ্যে সরকারের পতন হয়। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল হয়। জুনে আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ বাস্তবায়নে কেন এমন দুর্বোধ্য পথ০৩ নভেম্বর ২০২৫মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের সংলাপ
আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পরপর দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ২০০৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়। বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মানতে অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪–দলীয় জোট। তারা লাগাতার আন্দোলনে নামে। এর মধ্যে ২০০৬ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদ ভবনে সংলাপে বসেন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। দুই সপ্তাহে ছয়বার বৈঠকে মিলিত হন দুই নেতা। এই সংলাপে ১১ দফা প্রস্তাব পেশ করে আওয়ামী লীগ—যার মূল দাবি ছিল নিরপেক্ষ উপদেষ্টা পরিষদ গঠন ও বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন। কিন্তু নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকে। আন্দোলন, অবরোধ ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে তা ভেস্তে যায়।
সংলাপ ব্যর্থ হয়, এবং অচলাবস্থার জেরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়—একটি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়। দেশের দুই প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে কারাগারে বন্দী করা হয়।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে দুই নেত্রী মুক্তি পান। অবশ্য তখনো রাজনৈতিক সংকট পুরোপুরি কাটেনি। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী জিমি কার্টার ঢাকায় আসেন রাজনৈতিক সংলাপের মধ্যস্থতা করতে। তাঁর নেতৃত্বাধীন কার্টার সেন্টার তখন জাতিসংঘ ও কমনওয়েলথের সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। কার্টার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে ক্ষমতায় আসে।
আরও পড়ুনদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জামায়াতের০২ নভেম্বর ২০২৫তারানকোর উদ্যোগও ব্যর্থ
যে আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দুই দফা আন্দোলন করল, সেই দলটিই ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানিয়ে দেয় বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল।
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৩ সালের শেষদিকে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। ছয় দিন ঢাকায় অবস্থান করে ১০ ও ১১ ডিসেম্বর সংলাপ করেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। তৃতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি নিল ওয়াকারের উপস্থিতিতে। কোনো সংলাপই সফল হয়নি। নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্য বিরোধী দলগুলো হরতাল ও অবরোধ শুরু করে। শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও।
এর মধ্যেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৪৭ আসনে সহিংসতার মধ্যে ভোট হয়।
আরও পড়ুনবিএনপি সংস্কার ভেস্তে দিচ্ছে, জামায়াত নির্বাচন পেছানোর চেষ্টায়: নাহিদ ইসলাম০২ নভেম্বর ২০২৫রাতের ভোটে সংলাপ বিফলে
২০১৪ সালের ভোটের পর ২০১৮ সালের নির্বাচনও শেখ হাসিনার অধীনে আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর বিরোধিতায় নামে বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধীরা।
এর মধ্যে বিরোধী দলের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট এবং এবং কিছু বামপন্থী দল নিয়ে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নেতৃত্ব দেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক ড.
বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ সাত দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনের আগে ছোট পরিসরে আরও একটি সংলাপ হয় দুই জোটের মধ্যে।
২০১৮ সালের ওই নির্বাচন ‘রাতের ভোট’ হিসেবে পরিচিত পায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোট ২৯৩ আসনে জয়ী হয়। বিএনপিসহ বিরোধীদের মাঠে দাঁড়াতেই দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুনসনদ বাস্তবায়নে দ্রুত সিদ্ধান্ত, আরপিওতে পরিবর্তন আসছে০১ নভেম্বর ২০২৫এর বাইরে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ নিয়ে দু-দুবার ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেন। ২০২৩ সালেও নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে আরেক দফা সংলাপ করেন আবদুল হামিদ। তবে অতীতের আলোচনায় কোনো ফল পাওয়া যায়নি অভিযোগ করে বিএনপিসহ বিরোধীরা বর্জন করে।
১৯৯০ থেকে ২০২৫—বাংলাদেশে সংলাপ হয়েছে বহুবার, ব্যর্থতাও এসেছে বারবার। তবে প্রতিবারই সংকটের মুহূর্তে সংলাপই একমাত্র আশ্রয় হিসেবে ফিরে এসেছে রাজনীতিতে।
এবার যদি রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিকারের সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে, তবেই হয়তো তিন দশকের এই ‘আলোচনার ইতিহাস’ একবারের জন্য সাফল্যের গল্পে পরিণত হতে পারে।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এর আগে বিদেশিরা দূতিয়ালি করেও সংলাপ সফল করতে পারেনি। এবার রাজনৈতিক দল নিজে থেকে বসে সফল আলোচনা করতে পারবে—এটা দূরাশাই মনে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদ করার সময় দ্বিমত, ভিন্নমত দেখা গেছে। নোট অব ডিসেন্ট এর উদাহরণ। এত আয়োজন, সময় ব্যয়ের পরও বাস্তবায়নে একমত হতে পারেনি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো মিলে সমাধানে আসতে পারবে—এটা বিশ্বাস করা কঠিন। আর ঐক্য মত্য ছাড়া সংস্কার কতটা বাস্তবায়ন হবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আরও পড়ুনবিএনপির তৈরি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে: জামায়াত০১ নভেম্বর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক স ল প জ ল ই সনদ র তৎক ল ন সরক র র প দল য় জ ট র উদ য গ ক ষমত য় দলগ ল র দলগ ল ক ব এনপ র এরশ দ র ব যবস থ র পর খ র র জন ন র দল লক ষ য আওয় ম আবদ ল সমঝ ত সনদ ব র পতন ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
রাজশাহীতে ১০ মাসে ২৮ এইডস রোগী শনাক্ত, ওষুধের জন্য যেতে হয় বগুড়া
রাজশাহীতে চলতি বছরের ১০ মাসে নতুন করে আরো ২৮ জনের শরীরে এইচআইভি ভাইরাস (এইডস) শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে একজন তৃতীয় লিঙ্গের। এ সময়ের মধ্যে একজন মারাও গেছেন। আক্রান্তদের অধিকাংশের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
আক্রান্তদের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে একটি এইচআইভি টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সেলিং (এইচটিসি) সেন্টার রয়েছে। তবে, এখানে কাউন্সেলিং ছাড়া ওষুধ মেলে না। রোগীদের ওষুধ আনতে যেতে হয় বগুড়া। এ অবস্থায় রামেক হাসপাতালে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি চালু হতে পারে।
রামেক হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের তথ্য বলছে, ২০১৯ সাল থেকে এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত রাজশাহীতে এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৯৩ জন। এ সময়ের মধ্যে মারা গেছেন আটজন। চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ৩৪৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২৫ জন পুরুষ, দুইজন নারী ও একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষে শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি পাওয়া যায়। এ ভাইরাসে আক্রান্তদের অধিকাংশের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
এইচটিসি সেন্টারে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন আসেন পরীক্ষা করাতে। সেখানে পজিটিভ ফল এলে রোগীদের কাউন্সেলিং দেওয়া হয়। বলা হয়, এইচআইভি পুরোপুরি নিরাময় না হলেও এটি এখন নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধ সেবনে আক্রান্তরা স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারেন।
এদিকে, রাজশাহীতে এইচআইভির ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা না থাকায় পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসার জন্য বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শজিমেক) যেতে হয়। সেখানে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। রাজশাহীতে একটি এআরটি সেন্টার (অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি সেন্টার) স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এইচটিসি সেন্টারে গত মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) সকালে গিয়ে দেখা যায়, এক কিশোরসহ চারজন পরীক্ষা করাতে এসেছেন। তাদের মধ্যে একজন তৃতীয় লিঙ্গর। সবার ফলাফল নেগেটিভ আসে।
২০১৯ সাল থেকে রামেক হাসপাতালে এইচআইভি পরীক্ষা শুরু হয়। প্রথম বছর ৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হলেও কারো দেহে ভাইরাস পাওয়া যায়নি। পরের বছর দুইজন আক্রান্ত হন। ২০২১ সালে ৮ জন, ২০২২ সালে ৮ জন, ২০২৩ সালে ২৪ জন, ২০২৪ সালে ২৭ জন এবং ২০২৫ সালে অক্টোবর পর্যন্ত ২৮ জনের শরীরে ভাইরাস শনাক্ত হয়।
হাসপাতালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে আক্রান্ত ২৭ জনের মধ্যে সমকামিতার মাধ্যমে সংক্রমিত হন ১৬ জন, যৌনকর্মীর মাধ্যমে ১০ জন এবং রক্ত থেকে একজন। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত শনাক্ত ২৮ জনের মধ্যে সমকামী সম্পর্কের মাধ্যমে সংক্রমিত হন ১৭ জন। এছাড়া যৌনকর্মীর মাধ্যমে ১০ জন ও রক্ত থেকে একজন আক্রান্ত হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এইচআইভি আক্রান্ত এক ব্যক্তি বলেন, “রোগটি জানার পর প্রথমে মনে হয়েছিল সব শেষ। পরে রামেকে কাউন্সেলিংয়ে এসে বুঝলাম, এটা এখন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। নিয়মিত ওষুধ নিলে ভালো থাকা যায়। তবে, রাজশাহীতে ওষুধের ব্যবস্থা না থাকায় বগুড়ায় যাওয়া কষ্টকর। এখানেই যদি ওষুধ পাওয়া যেত, আমরা অনেকটা স্বস্তি পেতাম।”
রামেক হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের কাউন্সিলর রেজাউল করিম বলেন, “২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১২ হাজার ৪৬৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯৩ জন এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ আত্মহত্যার কথাও ভাবেন। তাদের নিয়মিত কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মানসিকভাবে দৃঢ় থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।”
এইচটিসি সেন্টারের ফোকাল পারসন ডা. ইবরাহীম মো. শরফ বলেন, “অরক্ষিত যৌন সম্পর্ক, হোক নারী-পুরুষের মধ্যে বা পুরুষ-পুরুষের মধ্যে, এইচআইভি ছড়ানোর সবচেয়ে বড় কারণ এটি। এছাড়া গর্ভকালীন সময়, সন্তান জন্ম ও দুধ পান করানোর মাধ্যমেও মা থেকে শিশুর দেহে সংক্রমণ যেতে পারে।”
তিনি বলেন, “সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রতিবার যৌনমিলনের সময় কনডম ব্যবহার করা, একাধিক যৌনসঙ্গী এড়িয়ে চলা, রক্ত বা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আগে পরীক্ষা করা এবং ব্যবহৃত সুচ পুনরায় ব্যবহার না করাই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা।”
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএফএম শামীম আহাম্মদ বলেন, “আমাদের এখানে এইচআইভি টেস্ট হয়। রোগীদের কাউন্সিলিং করা হয়। এখানেই যেন চিকিৎসা হয়, তার জন্য আমরা একটি ট্রিটমেন্ট সেন্টার করার উদ্যোগ নিয়েছি। রুম রেনোভেশন হচ্ছে। খুব শিগগির হবে। আগামী একমাসের মধ্যেই হতে পারে। তখন আক্রান্তদের বগুড়া যেতে হবে না।”
ঢাকা/কেয়া/মাসুদ