সুনামগঞ্জে এনসিপির ৭৭ সদস্যের কমিটি, আহ্বায়ক হাসন রাজার প্রপৌত্র
Published: 6th, November 2025 GMT
সুনামগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ৭৭ সদস্যের এ কমিটিতে মরমি কবি হাসন রাজার প্রপৌত্র ও হাসন রাজা ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান সাজাউর রাজা চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও রামেন্দু মজুমদারকে সদস্যসচিব করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার রাতে এনসিপির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই আহ্বায়ক কমিটি আগামী ছয় মাসের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে ২৯টি পদ ও সদস্যপদে রাখা হয়েছে ৪৮ জনকে। ২৯টি পদের মধ্যে আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব ছাড়া যুগ্ম আহ্বায়ক ৭ জন, যুগ্ম সদস্যসচিব ৭, সাংগঠনিক সম্পাদক ১২ এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক পদে ১ জনকে রাখা হয়েছে।
কমিটিতে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে আছেন শহীদুল ইসলাম, যুগ্ম আহ্বায়ক ইসহাক আমেনী, জুনাইদ চৌধুরী, শাহনুর আলম তালুকদার, আবদুর রহমান, হাসান আল মাসুম ও রুহুল আমীন; সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব আবু ছালেহ মো.
আহ্বায়ক দেওয়ান সাজাউর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সংগঠন গোছানোর পাশাপাশি আঞ্চলিক নানা দাবিতে আন্দোলন করছি। একই সঙ্গে নির্বাচনী প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে। উপজেলাগুলোয় নেতা-কর্মীদের সংঘটিত করে কমিটি করার কাজ চলমান।’
এর আগে গত ১৩ জুলাই দেওয়ান সাজাউর রাজা চৌধুরীকে প্রধান সমন্বয়ক করে সুনামগঞ্জে এনসিপির ৩১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। চার মাস পর আবার দেওয়ান সাজাউরকে প্রধান সমন্বয়ক থেকে আহ্বায়ক করে ৭৭ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হলো।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সদস যসচ ব এনস প সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
জে আলফ্রেড প্রুফ্রকের প্রেমগান
ভাষ্য
‘লেট আস গো দ্যান, ইউ অ্যান্ড আই, হোয়েন দ্য ইভনিং ইজ স্প্রেড আউট এগেইনস্ট দ্য স্কাই লাইক আ পেশেন্ট ইথারাইজড আপন আ টেবল...’—এই তিনটি চরণ, বলা চলে, রোমান্টিকতার স্বপ্ন ভেঙে ইংরেজি কবিতাকে দিয়েছিল নতুন যাত্রাপথের দিশা। অন্যভাবে বলা যায়, এই ত্রিচরণ ইংরেজি কবিতার বড় পালাবদলের যাত্রাবিন্দু। ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’ নামের এই কবিতা এমন সব উপাদান, এমন সব দৃশ্য ও চিত্রকল্প, এমন সব বিষয় ও ভাব-অভিভাব নিয়ে বিশ্বকবিতায় হাজির হয়েছিল, যা এককথায় যুগান্তকারী আর বৈপ্লবিক।
কবিতাটি লেখা হয়েছিল বহুশংসিত আলোচিত ‘দ্য ওয়্যাস্ট ল্যান্ড’ কবিতারও ঢের আগে। ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’ নামের কবিতাটিকে বলা যেতে পারে ‘দ্য ওয়্যাস্ট ল্যান্ড’ কবিতারই মনোবীজ। অবশ্য এলিয়ট প্রথমে এর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রুফ্রক অ্যামাং দ্য উইমেন’।
১৯১৫ সালে ‘পোয়েট্রি’ ম্যাগাজিনে এটি প্রথম ছাপা হয়। দুবছর পর, ১৯১৭ সালে, এলিয়টের ‘প্রুফ্রক অ্যান্ড আদার অবজারভেশন’ বইতে স্থান পায়। কবিতাটি বিশ শতকের ইউরোপীয় আধুনিকতার অনেক বৈশিষ্ট্য ও কুলক্ষণ ধারণ করে আছে: ভাবের খণ্ডায়ন, হতাশা, বিশ্বাসের সংকট, জীবনের অর্থহীনতা, উদ্বেগ, অস্তিত্বের অসারতার অনুভূতি, সবকিছুতেই অনাস্থা, নৈরাজ্য আর দ্বিধা ও ভণিতা। ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল’এক জগতের আলেখ্য যেন। এলিয়ট তাঁর কবিতাবলিতে এসবেরই প্রতিভূ হিসেবে আধুনিক মানুষের ছবিটি এঁকেছেন, ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’ দিয়ে যার শুরু।
টি এস এলিয়টকে নিয়ে গৌরচন্দ্রিকা অনাবশ্যক। বিশ শতকের সবচেয়ে শংসিত-আলোচিত এই কবির খ্যাতি ও প্রভাব মৃত্যুর এত এত বছর পরেও অটুট। কেউ কেউ কবিতার বিশ শতককে ‘এলিয়টীয় শতক’ বলতে আগ্রহী।
‘জে আলফ্রেড প্রুফ্রকের প্রেমগান’ এলিয়টের প্রথম দিকে লেখা কবিতাবলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এ কবিতায় এলিয়টের কবিপ্রতিভা চূড়ান্ত স্ফূর্তি লাভ করেছে। কাব্যগুণে ও সিদ্ধিতে তাঁর অতি বিখ্যাত আলোচিত কবিতা ‘পোড়ো জমি’র চেয়ে ‘জে আলফ্রেড প্রুফ্রকের প্রেমগান’কে শ্রেয়তর বলে মনে করেন অনেকে। একে ‘পোড়ো জমি’ কবিতারই পূর্বরাগ বলেও গণ্য করা যায়। প্রায় একই কারণে তাঁর প্রথম দিককার কবিতা সংকলন ‘প্রুফ্রক অ্যান্ড আদার অবজারভেশন’ আধুনিক ইংরেজি কবিতার ইতিহাসে সবচেয়ে উন্মোচক ঘটনা। কেননা এটি ইংরেজি কবিতা ও বিশ্বকবিতার সবচেয়ে বড় বাঁকবদলের মাইলফলক;
ওয়ার্ডসওয়ার্থ, মিল্টন-কোলরিজদের লিগ্যাসি টেনে চলা প্রচল ইংরেজি কবিতার দুর্গচূড়ায় এই কবিতাই আধুনিকতার রক্তাপ্লুত ধ্বজাটি উড়িয়েছিল।
আধুনিকতাবাদ ছিল রোমান্টিকতাকে চুরমার করে দেওয়া এক নতুন মতবাদ; স্বস্তি-ভাবালুতার বিপরীতে চূড়ান্ত অস্বস্তি, চূড়ান্ত স্বপ্নভঙ্গ ও বিসর্জনের সূচক; এক টেকটোনিক চ্যুতি, এক প্যারাডাইম শিফট।
যে প্রকৃতিলগ্নতা, যে অলীক স্বপ্নমোহ, আশা-কল্পনার হর্ম্যমিনার ঘিরে যে ভাবকাতরতা ও সারল্য ছিল প্রচল কবিতার কুললক্ষণ, তার বিপরীতে ঘুরে এলিয়ট গড়ে তুললেন বহুগ্রন্থিল আর ক্রমজটিল এক কবিতাজগৎ।
কবিতার শুরুতেই এলিয়ট তাঁর ঈপ্সিত রমণীকে, যা আসলে তাঁর নিজেরই অপর সত্তা, বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তবে তারও আগে তিনি পাঠকের চোখ থেকে রঙিন চশমাটি খুলে নেন; পাঠকের পূর্বধারণা, অভ্যাস, স্বস্তি ও আবেশকে চুরমার করে দিয়ে কবিতার শুরুতেই এলিয়ট সন্ধ্যাকে তুলনা করেন ইথার-অবশ এক রোগীর সঙ্গে (একটা সময় ছিল যখন অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীকে অচেতন করতে ইথার প্রয়োগ করা হতো)। ‘লাইক আ পেশেন্ট ইথারাইজড আপন আ টেবল’ তারই ইঙ্গিতবাহী। এই একটিমাত্র চরণের মধ্য দিয়ে ইংরেজি কবিতায় এলিয়ট বয়ে আনলেন ‘কেউ যাহা শোনে নাই, কোনো এক বাণী’।
কবিতার প্রথম তিনটি চরণ চিরকালের মতো ঘুরিয়ে দেয় প্রচল ইংরেজি কবিতার গতিপথ। একে চালিত করে ফন্দি-ভণিতাময় আর ক্রমজটিল এক নগরজঙ্গলের দিকে; চালিত করে এক তাঁতাল বালুময় ঊষর মরুর পথে। চির–তুষারে ঢাকা এক মেরু-যবনিকার ঠিকানায়; যেখানে পুষ্পচয়নের আমন্ত্রণ নেই, করমর্দনের উষ্ণতা নেই, হৃদয়ের উত্তাপ নেই, মনোহর তাজা হাওয়া নেই, ছায়া নেই, ভরসা ও বরাভয় নেই। দুদণ্ড শান্তির জন্য জিরোবার এতটুকু অবকাশ নেই; প্রেম নেই, অভিজ্ঞান নেই; যেনবা সবদিকে ছড়ানো শুধু অস্বস্তির কাঁটা ও ক্যাকটাস। শুধু মেশিনগর্জন আর শ্রবণ বধির করা ক্রমাগত যন্ত্রকোলাহল।
‘হলদে কুয়াশা এসে পিঠ ঘষে জানালার কাচে, / হলদে ধোঁয়াটি এসে নাক ঘষে জানালার কাচে’—(দ্য ইয়েলো ফগ দ্যাট রাবস ইটস ব্যাক আপন দ্য উইন্ডো-পেনস, / দ্য ইয়েলো স্মোক দ্যাট রাবস ইটস মাজল অন দ্য উইন্ডো-পেনস...) বলামাত্র পাঠকের চোখ থেকে রঙিন চশমাটি খসে পড়ে, ঝরে পড়ে যাবতীয় অলস ভাবালুতা। সাদা চোখে পাঠক দেখতে পান দৃষ্টি-অশোভন এক রূঢ় ল্যান্ডস্কেপ; বাড়িঘর-কারখানার শত শত চিমনির ঝুল–কালিমাখা, (সুট্ দ্যাট ফলস ফ্রম চিমনিস...) ধোঁয়া আর ধূলিতে আবিল এক নগরনিসর্গ। হলদেটে পাঁশুটে ধোঁয়ায় ঢেকে আছে যার আকাশরেখা। সবখানে ব্যাপ্ত শুধু হতাশা, ক্রূরতা, দ্বিধা ও সন্দেহ; সবখানে সংশয় ক্লেদ ও বিবমিষা। হিয়েরোনিমুস বস-এর আঁকা এক নরক যেনবা; যা থেকে কোনো পরিত্রাণ নেই। এই কবিতা তাই প্রচল ইংরেজি কবিতার পদ্মবনে আচমকা ঢুকে পড়া এক মত্ত হস্তী।
ভবিষ্যকালের ইংরেজি কবিতার, সেই সঙ্গে বিশ্বকবিতারও, নতুন মন্ত্রবীজ হয়ে উঠল এই কবিতা। একই সঙ্গে দেখা গেল এলিয়ট নামের এক কবিতা-নৃপতির উষ্ণীষের চকিত ঝলক। কবিতাটি আধুনিক নগরজীবনের অন্তসারশূন্যতা আর অর্থহীনতা, ভানপটু কপটতা আর নিরাবেগ উদাসীনতারই এক নান্দীপাঠ যেন।
[আসুন পাঠক, আগে টি এস এলিয়টের কবিতাটি একবার পড়ে নিই। অনুবাদককৃত কবিতাবিষয়ক ‘ভাষ্যে’র বাকি অংশ পড়ুন কবিতার শেষে]জে আলফ্রেড প্রুফ্রকের প্রেমগান
টি এস এলিয়ট
যদি জানিতাম, যারে আমি দিতেছি উত্তর
পুনরপি সে ফিরিবে এ মরজগতে
তবে ফের এই শিখা জ্বলিত না মোর
অপিচ কদাপি কেহ এ পাতাল হতে
জীবন্ত ফেরেনি; শুনি যাহা, আদতে তা সত্য যদি হয়
তব কাছে করিব বর্ণন আমি নিন্দাভীতি বিনা।
চলো তবে, তুমি আর আমি মিলে যাই,
যখন ছড়ানো সন্ধ্যা আকাশের গায়
টেবিলে শুইয়ে রাখা ইথার-অবশ এক রোগীর মতন;
চলো যাই, আধফাঁকা পথগুলো ক্রমশ উজিয়ে
একরজনীর সস্তা হোটেলে হোটেলে
অস্থির রাতের যত খয়া-খয়া প্রলাপ এড়িয়ে,
ঝিনুকশোভিত আর কাঠের কুচিতে ছাওয়া রেস্তোরাঁর ভিড়ে;
সেই সব পথের চলন ফন্দি আঁটা, একঘেয়ে তর্কের মতন,
যে পথেরা নিয়ে চলে তোমাকে নাছোড় এক জিজ্ঞাসার দিকে…
অহো, জানতে চেয়ো না, ‘এটা কী’?
যাই আর চলো গিয়ে দেখি।
ঘরটিতে মহিলারা আসে আর যায়
মিকেলেঞ্জেলোর কথা জিবের ডগায়।
হলদে কুয়াশা তার পিঠ ঘষে জানালার কাচে,
হলদে ধোঁয়াটি তার নাক ঘষে জানালার কাচে,
জিবেতে চাটল এসে গোধূলির যতগুলি কোণ,
থমকে দাঁড়াল শেষে নর্দমার খুঁটিগুলো ঘেঁষে,
পড়ুক পিঠেতে তার চিমনির যত কালি–ঝুল,
বারান্দা গলিয়ে সে একবার হঠাৎ লাফাল,
আর এই আশ্বিনের সুকোমল রাতখানি দেখে,
বাড়িটাকে এক পাক দিল আর ডুবে গেল ঘুমে
এবং আলবত সে তো পাবেই সময়।
হলদেটে সে কুয়াশা শার্সিতে পিঠ ঘষে ঘষে
চুপিসারে পথ বেয়ে চলে;
যে যে মুখ চেনো তুমি, সেসবের সঙ্গে তোমার
মোলাকাতযোগ্য এক মুখের আদল
গড়ে নিতে মিলবে সময়, ঠিকই মিলবে সময়;
মিলবে সময় ঢের হননের আর সৃজনের;
আছে পড়ে কত কাজ, সেসবের জন্য ঢের রয়েছে সময়,
আর যে হাতেরা এসে উঁচিয়ে প্রশ্ন এক ছুড়ে দেয় তোমার থালায়
সেসব হাতেও আছে অঢেল সময়,
সময় তুমিও পাবে, সময় আমিও পাব ঢের
এবং অযুতবার দ্বিধাচালে দোলার সময়,
এবং নিযুতবার দেখা আর যাচিয়ে দেখার,
টোস্ট আর চা খাওয়ার আগে।
ঘরটিতে মহিলারা আসে আর যায়
মিকেলেঞ্জেলোর কথা জিবের ডগায়।
আর আমি আলবত পাবই সময়
এ কথা ভাবতে ‘আমি পাব কি সাহস?’, ‘আমি পাব কি সাহস?’;
একবার পেছনে তাকিয়ে আর সিঁড়ি বেয়ে নামার সময়
গজিয়েছে টাক এক মাঝখানে চাঁদিতে আমার—
(বলবে সকলে: দেখো, কেমন পাতলা হয়ে যাচ্ছে ওর চুল)
আমার প্রভাতী কোট, চিবুক অব্দি ছোঁয়া আঁটসাঁট আমার কলার
আমার চারু ও শোভন নেকটাই,
তবু এটি গাঁথা আছে একটি মামুলি পিনে-স্থূল
(বলবে সবাই: ‘ওর হাত-পা সব কেমন মাজুল’)
তেমন সাহস কই
তোলপাড় করব নিখিল?
একটি মিনিট, তাতে ভাবনার, যাচিয়ে দেখার,
রয়েছে সময় আর একটি নিমেষ এসে করবে সব ওলট-পালট
কেননা এদের খুব ভালো করে চিনি, আমি আলবত চিনি
চিনেছি এ ভোরগুলি, অপরাহ্ণ, গোধূলির ক্ষণ
কফির চামচে আমি পরিমাপ করেছি জীবন;
দূরের ঘরটি থেকে ভেসে আসা সুরের আড়ালে
পতনের লয়ে ক্রমে লীয়মান স্বর আমি চিনি
অনুমান করব কী করে তবে আমি?
আর ওই চোখগুলো চেনা খুব, সব কটি ভালোমতো চেনা—
পরিপাটি বাক্যে যারা তোমাকে সাজায়
এবং যখন আমি নিক্তিমাপা, পিনে গাঁথা ছটফট করি
আর যখন পিনগাঁথা হয়ে আমি দেয়ালে কাতরাই
কী করে করব তবে শুরু; ছুড়ে দেব
থুথুসহ আমার দিবস আর উপায়ের এঁটো অবশেষ?
আর আমি কী করে করব অনুমান?
আর ওই বাহুগুলো চেনা খুব, সব কটি চেনা—
বাজুবন্ধপরা ওই সাদা আর নগ্ন বাহু জোড়া
(তবে তারা, বাতির আলোয় দেখি, হালকা বাদামি লোমে ঢাকা!)
এ কি পোশাকবাহিত কোনো ঘ্রাণ
যা আমাকে করে আনমনা?
জোড়া বাহু টেবিলে এলানো, কিংবা, একটি শালে মোড়া
কী করে সাহস আমি পাব? আর—
করব কী করে আমি শুরু?
বলব কি, গোধূলিতে সরু সরু পথ ধরে গেছি আমি হেঁটে
এবং দেখেছি আমি, জানালার বাইরে মাথা, হাতাঅলা জামা গায়ে
নিঃসঙ্গ লোকেদের পাইপের ধোঁয়া উড়ে যেতে?...
সুমসাম সাগরের তলা চিরে ক্রমে ধাবমান,
এক জোড়া ভোঁতা থাবা যদি বা হতাম
এবং দিঘল সরু আঙুলের আলতো পরশে মসৃণ
অপরাহ্ণ, সন্ধ্যা, আহা, কী সুখে ঘুমায়!
ঘুমন্ত… ক্লান্ত…কিংবা ভণিতায় পার করে দিন,
তোমার–আমার পাশে সে এখন মেঝেতে সটান।
মনেতে পাব কি জোর, কুলফি বরফ, কেক, চা পানের শেষে,
একটি নিমেষ—একে ঠেলে দিতে এর নিজ সংকটের দিকে?
যদিও কেঁদেছি আর করেছি উপোস, করেছি কান্না আর করেছি প্রার্থনা,
যদিও দেখেছি আমি মুণ্ড আমার (হালকা টাক গজিয়েছে তাতে)
বয়ে আনা হলো এক ঢাউস থালায়,
প্রেরিত পুরুষ নই; নেই কোনো মহিমার ছটা;
এবং আমার মহিমার ক্ষণ আমি নিভু নিভু জ্বলতে দেখেছি।
এবং দেখেছি আমি অনন্তের দ্বারী
আমার পাতলুনখানি টেনে ধরে হাসিতে লুটায়,
অল্প কথায় বলি, মনে বড় জেগেছিল ভয়।
শেষমেশ, এটাই হওয়ার ছিল তবে,
পেয়ালা, মোরব্বা আর চা পানের পর্ব শেষে
চিনেমাটির বাসনকোসন আর এসবের ভিড়ে আর
তোমাকে আমার বলা গল্পের ফাঁকে—
তবু, মিলত কি কোনো ফায়দা তাতে
দ্বিধা ঝেড়ে হাসিমুখে যদি আমি দিতাম প্রস্তাব,
পৃথিবীকে দুমড়ে এক পিণ্ডবৎ আকার দিতাম,
গড়িয়ে দিতাম একে নাছোড় দুর্মর এক প্রশ্নের দিকে,
আর বলতাম: ‘লাজারাস আমি, এসেছি মৃতের দেশ থেকে
এসেছি জানাতে সব, তোমাকে জানাব আমি সব’
আর সে রমণী যদি শিয়রে বালিশ পেতে বলে:
‘মোটেই তা নয় এটা,
আমি যা বলতে চাই, আদৌ তা নয়।’
এমনই হওয়ার ছিল তবে অবশেষে,
মিলত কি ফায়দা কোনো তাতে
সূর্যাস্ত, দেউড়ি–চাতাল আর ছড়ানো পথের শেষে
উপন্যাস, চা-পেয়ালা, মেঝেতে গড়ানো যত ঘাঘরা আর
এই যে, এই যে এটা, এরপরও বহু কিছু রয়েছে সেখানে?
যে কথা বলতে চাই, বলা অসম্ভব!
যেন এক জাদুর লন্ঠন নকশার মতো
পর্দাজুড়ে স্নায়ুগুলো ছড়িয়ে রেখেছে
কী লাভ, কিসের ফায়দা তাতে
যদি সে রমণী তার শিয়রে বালিশ পেতে, ছুড়ে ফেলে শাল
জানালার দিকে ঘুরে বলে:
‘এমনটা আদৌ আমি চাইনি বোঝাতে,
আদৌ তা নয় সেটা, আদৌ তা নয়।’
নই আমি হ্যামলেট, রাজার দুলাল
ছিল না কপালে সেটা লেখা;
শুধু এক পার্শ্বচর লর্ড, কাজ শুধু দল ভারী করা
কুমারে মন্ত্রণাদান, একটি-দুটি দৃশ্য তুলে ধরা
ধূর্ত, কূট, সতত সজাগ;
নগণ্য ও অভাজন ক্রীড়নক এক,
কোনো কাজে যদি লাগি, তবে ধন্য হই
মাথাটা কিঞ্চিৎ ভোঁতা, মুখে তবু বড় বড় বুলি
মাঝে মাঝে হতে হয় অন্যদের হাসির খোরাক, আর
কখনোবা হদ্দ বোকা বনে যেতে হয়
বয়স হচ্ছে… আমি যাচ্ছি বুড়িয়ে
পরব আমি পাতলুনের প্রান্ত মুড়িয়ে
টেরি কেটে ফেলব পেছনে? আর, ভয় পাব পিচ ফল খেতে?
পশমের সাদা পাতলুন পরে আমি হাঁটব সৈকতে।
শুনলাম কান পেতে, জলের পরিরা এসে মশগুল হলো গানে গানে
এ আশা করি না আমি, আমাকে শোনাবে তারা গান
দেখলাম, ঢেউশীর্ষে চড়ে তারা একে একে সাগরে মিলায়
চিরে চিরে চলে তারা তরঙ্গের সফেদ কুন্তল;
বায়ুর চাপড় লেগে ক্ষণে সাদা, ক্ষণে কালো জল।
আমরা কত না কাল কাটিয়েছি জলধির মহলে মহলে,
সাগরকন্যারা পাশে, পরেছে পাটল-লাল শৈবালের মালা
গেলাম অতলে ডুবে, যখন ভাঙাল ঘুম মানুষের গলা।
শুরু থেকে শেষ অব্দি এলিয়টের অসাধারণ কল্পনাপ্রতিভা যেন শতডানা বিস্তার করে আছে এ কবিতায়। এলিয়ট এতে কোনো সময়-সংগতি মেনে চলেননি; যেনবা ইচ্ছা করেই স্বাভাবিক যুক্তিপরম্পরা ভেঙে দিয়েছেন। কবিতাটি তাই একের পর এক আপাত বিসদৃশ ইমেজে এগিয়ে যেতে থাকে। ক্যাওস আর হারমোনি এখানে পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলে। পরস্পরের প্রতিপক্ষ বা অ্যাডভারসারি হিসেবে নয়, বরং অযূথ ব্যক্তিমানুষের অল্টার ইগো হিসেবে জায়গা বদল করে চলে।
আসলে প্রুফ্রক কোনো চরিত্র নয়, বরং নিছকই একটি নাম; দ্বিথাথরথর এক সত্তা কেবল। কবিতার শুরুতেই টেবিলে শায়িত ইথার-অবশ রোগীর সঙ্গে তুলনীয় যে সান্ধ্য মুহূর্তের নাটকীয় বর্ণনা পাই, তা আসলে জে আলফ্রেড প্রুফ্রকের অর্ধচেতন মনেরই প্রতিরূপ। প্রুফ্রকের সিদ্ধান্তহীন, দ্বিধাকম্পিত মনটাও অলস-বিবশ সন্ধ্যাটির মতোই অসাড়তালিপ্ত।
প্রুফ্রক নিজেকে মনে করে, আধুনিক নগরনাট্যের ট্র্যাজিকমিক্যাল হিস্ট্রিক্যাল অরোমান্টিক এক চরিত্র। নিজেকে তার হাস্যাস্পদ, নিকৃষ্ট এক ভাঁড় বলে মনে হয়; অন্য সবার চোখে সে এক কাপুরুষ বা ঊনপুরুষ। তার স্বগতোক্তির মধ্যে যে ‘আমি’ ও ‘তুমি’, তা আদতে তার নিজেরই দুই বিভক্ত সত্তা। সে জানে, আপন মনোনরকের বাইরে কখনো গীত হবে না তার প্রেমগান।
কুতর্কের মতন ছড়ানো ক্লান্তিকর একঘেয়ে পথ, কুয়াশা-বেড়ালের ছবি, বাইবেলের জন দ্য বাপ্তিস্ত্, লাজারাস, মিকেলেঞ্জেলো, সাগরতল, জলধিমহল, পাটল-লাল শৈবালের মালাশোভিত গান ও সন্তরণপটু সাগরকন্যাদের দল আর শেক্সপিয়ারের নাটকের কুশীলবেরা—সবাই যুগপৎ ভিড় করে আসে তার মনে। বড় বেশি নিস্তরঙ্গ, অকিঞ্চিৎকর আর একাকিত্ব-ধূসর এক জীবন বয়ে চলাই তার নিয়তি: ‘এন্ড ওয়াচ্ট দ্য স্মোক দ্যাট রাইজিজ ফ্রম দ্য পাইপ্স অব লোনলি মেন ইন শার্ট-স্লিভ্জ, লিনিং আউট অব উইন্ডোজ?’
পানসে, পাণ্ডুর, একঘেয়ে, নিরুৎসব জীবন তার আত্মনিগ্রহ আর অবদমনের নিগড়ে বাঁধা। আদ্যন্ত নৈরাশ্যমলিন, নিরুদ্যম, বিষণ্ন আর করুণ সে জীবন। প্রুফ্রক তাই কোনো বিষয়ে একটিবারও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারে না। তার অপৌরুষলাঞ্ছিত জীবন এমনই নগণ্য আর দ্বিধাথরথর যে সামান্য একটা পিচফল খেতেও তার সাহসের দরকার পড়ে। তাই সে বলে: ‘কফির চামচে আমি পরিমাপ করেছি জীবন’(আই হ্যাভ মেজার্ড আউট মাই লাইফ উইথ কফি স্পুনজ)—মানসিক মৃত্যুরই অপর নাম যেন। আর প্রুফ্রক এক জীবন্ত লাশ; সদা পুনরাবৃত্তিময় এক অলাতচক্রের ভেতর দিয়ে সে কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছে তার নিজেরই লাশ।
অন্য আলোর সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে যুক্ত হোন এইখানে ক্লিক করে