যুক্তরাষ্ট্র সব মিলিয়ে ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করল। এটি এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অন্য সব দেশের ওপর আরোপ করা শুল্কের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ভারতের ওপর আমেরিকার এই অপ্রত্যাশিত শুল্কারোপ দুই দেশের সম্পর্ককে বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাবে বলে বলা হচ্ছে।

এর মধ্য দিয়ে যে বিষয়টা স্পষ্ট, তা হলো: ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোর’ সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর চেয়ে নিজেদের দেশে উৎপাদন (অনশোরিং) বাড়াতে বেশি আগ্রহী।

বুধবার যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয়, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানির কারণে ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। ভারতের ওপর আগে থেকেই ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানো ছিল। এখন সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে।

আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক এক যুক্তিহীন ও ভয়াবহ উন্মাদনা২৮ জুলাই ২০২৫

এই সিদ্ধান্তে অনেক বিশেষজ্ঞই বিস্মিত হয়েছেন। কারণ ভারতই প্রথম কয়েকটি দেশের মধ্যে ছিল যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় বসেছিল। এমনকি ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একে অপরের প্রতি বারবার প্রকাশ্যে প্রশংসা করেছেন। নিজেদের ‘বন্ধু’ বলেও অভিহিত করেছেন।

এই মুহূর্তে ব্রাজিল ছাড়া আর কোনো দেশ এত বেশি শুল্কের মুখে পড়েনি। এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশন অব কানাডার কৌশল ও গবেষণা বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিনা নাজিবুল্লাহ বলেছেন, ‘বাণিজ্য আলোচনা ভেঙে যাওয়া ছিল সত্যি অপ্রত্যাশিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটি দুই দেশের সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময়। এটি সম্ভবত বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত। এখন ভারত এমন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে পড়ে গেছে যারা কোনো চুক্তি ছাড়াই সবচেয়ে বেশি শুল্কের মুখোমুখি হয়েছে। এখন দরকার বাস্তবভিত্তিক কিছু পদক্ষেপ, যাতে আবারও পারস্পরিক আস্থা গড়ে তোলা যায়।’

যদিও এই ৫০ শতাংশ শুল্ক আগামী তিন সপ্তাহ পর থেকে কার্যকর হবে এবং তা হঠাৎ করেই এসেছে বলে মনে হচ্ছে, তবে গত কয়েক সপ্তাহে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা থেকে দুই দেশের মতবিরোধের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল।

গত সপ্তাহেই ট্রাম্প হুমকি দেন, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও অস্ত্র কেনার জন্য তিনি ভারতকে শাস্তি দেবেন। বাণিজ্য আলোচনা অচলাবস্থায় পড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত—দুই দেশকেই ‘মৃত অর্থনীতি’ বলে উল্লেখ করেন।

আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক আরোপ, বাংলাদেশের সামনে পথ কী১৬ মে ২০২৫আলোচনা থেমে গেছে

গত বছর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ২১২ বিলিয়ন ডলার যার মধ্যে প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ভারতের পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগেই বলেছিলেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি এই বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন ডলারে নিতে চান।

রয়টার্স জানিয়েছে, শুল্ক নিয়ে আলোচনার সময় ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তাব দিয়েছিল, তারা মার্কিন শিল্পপণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক তুলে নেবে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি পরিমাণে প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি পণ্য কিনবে। এমনকি ভারতের অভ্যন্তরীণ চাপ থাকা সত্ত্বেও আমদানি করা গাড়ির ওপর কর কিছুটা কমানোর কথাও তারা বিবেচনা করেছিল।

তবে ভারত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, কৃষিপণ্য ও দুগ্ধজাত পণ্যের ওপর শুল্ক তারা ওঠাবে না। এই দুটি খাত ভারতীয় রাজনীতিতে অত্যন্ত সংবেদনশীল, কারণ এসব খাতে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ কাজ করে। এমন অবস্থান কানাডাসহ আরও কিছু দেশেরও রয়েছে।

আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক উন্মাদনায় এলোমেলো বিশ্ববাণিজ্য১০ এপ্রিল ২০২৫কূটনৈতিক মাত্রাও আছে

এই পুরো আলোচনাটি কেবল বাণিজ্যকেন্দ্রিক নয়। এর পেছনে কিছু ভূরাজনৈতিক বিষয়ও রয়েছে বলে মনে করেন নিউ ইয়র্কভিত্তিক এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ এশিয়া ইনিশিয়েটিভের পরিচালক ফারওয়া আমের। তিনি বলছেন, এর একটি বড় উদাহরণ হলো—মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত কীভাবে শেষ হলো, সে বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক।

ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, তিনি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছেন। কিন্তু ভারত বারবার বলেছে, এতে ট্রাম্পের কোনো ভূমিকা ছিল না এবং মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের সে সময় কোনো কথাও হয়নি।

অন্যদিকে পাকিস্তান বলেছে, তারা ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করবে।

ফারওয়া আমের বলছেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় ফেরার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে পাকিস্তান ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও তেলের মজুত অনুসন্ধানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কয়েকটি চুক্তি করেছে।

এই সবকিছুই ভারতের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। এখন দিল্লি কঠিন একটি পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। আমের বলেন, এই পরিস্থিতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি পরীক্ষা।

কিছুদিন আগেও ট্রাম্প ও মোদি একে অপরকে প্রকাশ্যে প্রশংসা করেছেন। নিজেদের ‘বন্ধু’ বলেও অভিহিত করেছেন। কিন্তু এখন আর সে সম্পর্ক আর নেই।.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র কর ছ ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

টেপরির গল্প

আমার ছোট বোন টেপরি যখন জন্ম নিল, তখন বাংলা সিনেমার চিরায়ত সেই দুটি অপশন আমাদের সামনে চলে এল। ‘আম্মা নাকি টেপরি?’ অর্থাৎ সেদিন হাসপাতালে কোনো টেরিবেরি হয়ে গেলে আজ টেপরির জন্মদিনটাই আম্মার নিরস মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিণত হতে পারত।

জন্মের সময় টেপরির নাক প্রচলিত অর্থে বোঁচা ছিল। এই কারণেই আমি এই নাম রেখেছিলাম দুষ্টামি করে। জন্মের পর ওর গায়ের রং শ্যামলা ছিল, চুল ছিল কোঁকড়ানো। এই তথ্য গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর দাদি মরাকান্না জুড়িয়ে দিলেন।

আমরা বুঝতেই পারছিলাম না, দাদির এই কান্নার কারণ কী! তারপর জানা গেল, ‘শ্যামলা মেয়েকে কেউ বিয়ে করে না’; ‘কোঁকড়ানো চুলের মেয়েদের স্বামীকপাল মন্দ হয়’...মূলত এসব ছাইভষ্ম ভেবে দাদি গঙ্গাকে আরও জলবতী করবার ব্রত নিয়েছিলেন।

মেয়ে ‘কালো’ নাকি ফরসা—এই বিষয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ১১৪ নম্বর কেবিনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করা কয়েক শ বছরের এক বৃদ্ধা আয়া আঙুল তুলে বললেন, ‘এই ম্যায়ার চুল পাতলা হইব, মাথার তালু ফরসা, মুখে-চোখে-গতরে কালা দাগগুনি সব প্যাটের ময়লা। ফুটব ফুটব গায়ের রং ফুটব!’

টেপরি বড় হতে থাকল, সেই শতবর্ষী আয়ার কথামতো আজ টেপরির চুলগুলোতে কেমন মিষ্টি অথচ আঁশটে গন্ধ, আর গায়ের রং? ওর গায়ের রং রুই মাছের ডিমের মতো, যখন তা ঢিমে আঁচে রান্না করা হয় সাত–আটটা কাঁচা মরিচের ভাপে।

এসব বাহ্যিক রূপবৈচিত্র্যের বাইরেও ও টেপরি, যে কিনা সকালে দাঁত মাজা বাদ দিয়ে আম্মার পাশে একটা ছোট বঁটি নিয়ে পেঁয়াজের পর পেঁয়াজ, রসুনের পর রসুন দফারফা করে।

এই তো কিছুদিন আগেও, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ পড়ার পর টেপরির সঙ্গে অনেক দিন কথা বলিনি। বলতে পারিনি। আমার ভেতর তখন কী হয়েছিল আমি আজও বুঝিনি। উপন্যাসে ছোট বোন রঞ্জু মারা গিয়েছিল। আর তার ভাই ‘খোকা’ ভেসে গিয়েছিল দেশ নামের একটা পুকুরের অনেক গভীরে। হয়তো এই দেশকে আমারও তখন একটা পুকুর মনে হয়েছিল।

একুশ মে, বারটা এক, একটা ছোট্ট কেক, আমরা চারজন। দেশলাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে মোমবাতিগুলো কেকের ওপর চোখ বন্ধ করে বসে ছিল নাগা সন্ন্যাসীদের মতো। কেকের ওপর আমার দেওয়া ‘টেপরি’ নামটাই লেখার কথা ছিল, কিন্তু সেটা বানান ভুল হয়ে ‘পেটরি’ হয়ে গেছে। এত চ্যুতি–বিচ্যুতির ভেতর আব্বা কেক মুখে নিয়ে বলে, ‘মা, তোমার হাত ধোয়া ছিল তো?’

পরিবারের আত্মীয় নাম্নী লোকেরা টেপরির জন্মদিনের কথা জানে নাকি জানে না, আমি জানি না। খেয়াল করলাম, তেমন কেউই টেপরিকে বারটায় কিংবা বারটা একে, এমনকি তিরিশেও উইশ করল না। এমন সময়ে টেপরির মোবাইলে একটা মেসেজ এল, কিন্তু সেটাও টেলিকম কোম্পানি থেকে। টেপরিও এসব বুঝে যাবে...এদের সবাইকে চিনে যাবে একদিন।

টেপরির ব্যাপারে একটা–দুটো বাক্য বলা অসম্ভব। সে হয়তো সেই বোনটা, যে টেলিফোনের অন্য পাশে বসে তার রাগের মাথায় ঘরছাড়া ভাইকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার জন্য হু হু করে কাঁদে।

অকারণ এই কান্নাপর্ব আমার যাপিত সময়ে সশস্ত্র হামলা করে, দেখি অপু আর দুর্গা কাশবনে ছুটছে, দূরে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে হারিয়ে যাচ্ছে রেলগাড়ি।

টেপরি বড় হয়ে গেল। বিস্ময়কর একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে কিশোরী থেকে তরুণী আর তারপর আরও ধীরে ধীরে ধীরে কোনো এক ‘নারী’ হয়ে উঠল ও।

আমি ওকে দেখি আর ভাবি, বিকেলের পর বিকেল। দেব দেব করে কোনো একটা বড়সড় গিফট আর দেওয়া হয়ে ওঠে না। এই মন ভোলানো ভাবনাগুলোই ওকে গিফট হিসেবে দেওয়া গেলে ভালো হতো।

কিন্তু এসব ভাবতে ভাবতে দাদির দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে টেপরির বিয়েটাও হয়ে গেল। আম্মার শরীর খারাপ থেকে খারাপতর হওয়ায় নিজের বিয়ের কাজও ওকেই করতে হলো।

বিয়ের আগের সময়গুলোতে আমাদের প্রিয় আব্বা হঠাৎ এক–দেড় মাসেই অনেকটুকু বুড়িয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে আমি বুঝলাম, আব্বা ইস্পাত কঠিন হলে এই একটা মাত্র বিষয়ে উনি প্রচণ্ড অসহায়বোধ করেন। বাবা–মেয়ের সম্পর্কটাই হয়তো এমন।

টেপরি এখন দূরে চলে যাবে আমাদের কাছ থেকে। আমাদের বাসাটা ‘পাখিহীন’ হয়ে কীভাবে টিকে থাকবে; আমি অফিসের ফাঁকে, রাস্তার জ্যামে, সিনেমা হলে সিনেমা শেষ হওয়ার পর, নদীর পাড়ের বাতাসে কিংবা মধ্যরাতের ছাদে হঠাৎ-বিঠাৎ সেইটাই ভাবি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ