Prothomalo:
2025-11-06@08:09:57 GMT

কৌতুক কি শুধুই মজার?

Published: 7th, August 2025 GMT

সন্ধ্যাবেলা স্ত্রী ও স্বামী একত্রে গান ধরেছে। অথচ সকালেই তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। ঝগড়া দেখে মনে হয়েছিল বুঝি এখনই দুজন মিলে কাজি অফিসে যাবে ডিভোর্স দিতে। কিন্তু দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা হতে হতে পরিবেশ এমন মধুর হয়ে গেল কীভাবে? এই ধরনের দৃশ্য দেখতে যতটা হালকা মনে হয়, বাস্তবে ততটা নয়। দুজনের চেতন মনে হয়তো আপস হয়েছে, কেউ হয়তো ক্ষমা চেয়েছে, হয়েছে মিটমাট, কিন্তু অবচেতন মন কি সত্যিই ক্ষমা করে দেয়? দেখা যায়, ভবিষ্যতে আবার যখন ঝগড়া বাধে, তখন তারা ঠিকই ফিরে যায় যেখানে শেষ হয়েছিল সেই পুরোনো জায়গায়—‘তুমি তো সেদিনও এমন করেছিলে।’ 

চেতন মনে আমরা যেটাকে ক্ষমা বলে সাব্যস্ত করি, অবচেতন হয়তো তাকে রাগ, ক্ষোভ কিংবা অপমান হিসেবে ধরে রাখে। আমরা জানি চেতন ও অবচেতন আলাদা, কিন্তু ভুলে যাই সেই আলাদা স্বরূপের প্রভাব। ফ্রয়েডের মতে, আমাদের অবচেতন মন সব সময় সচল। আমরা যেভাবে কথা বলি, ভুল করি, কৌতুক করি—সবকিছুর মধ্যেই অবচেতন নানা কৌশলে নিজেকে প্রকাশ করে। তাঁর মতে, অবচেতন প্রকাশের তিনটি প্রধান পথ—স্বপ্ন, ভুলবশত উচ্চারণ (যাকে বলা হয় Freudian Slip), আর কৌতুক ও উপহাস।

বই: জোকস অ্যান্ড দেয়ার রিলেশন টু দ্য আনকনশাস লেখক: সিগমুন্ড ফ্রয়েড প্রথম প্রকাশ: ১৯০৫

আরেকটা উদাহারণ দেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক, একজন ব্যক্তির বসের প্রতি অসন্তোষ আছে। সে মুখে কিছু বলে না, কারণ সামাজিক নিয়ম বা চাকরির ভয় আছে। কিন্তু হয়তো সে একদিন বলে ফেলে—‘আমাদের বস তো দেখি মহাপণ্ডিত, সবই জানেন—অফিসের এসিটা ভালো চলছে না, সেটাও উনি বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করে দেবেন! নিশ্চয়ই তিনি হেগেলীয় ভাববাদ দিয়ে এসি না চলার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন।’

এখানে আসলে বসের পাণ্ডিত্যের প্রতি শ্রদ্ধা নয় বরং উপহাসের মাধ্যমে ক্ষোভ বা রাগের প্রকাশ ঘটেছে। এই ধরনের রসিকতায় অবচেতন মনের চেপে রাখা বক্তব্য এমনভাবে বেরিয়ে আসে, যেন সেটি ‘মজা করেই’ বলা হচ্ছে। 

ফ্রয়েড বইটিতে তিনটি স্তরে কাজ করেন। জোকের কাঠামো—কীভাবে জোক গঠিত হয়, ভাষার কারিকুরি, শব্দের খেলা। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ—কেন আমরা হেসে উঠি? উপহাসের মানসিক প্রেরণা কী? অবচেতন ও জোকের সম্পর্ক—আমাদের অবদমিত চিন্তাগুলো কীভাবে উপহাসের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

যখন কেউ উপহাস করে, তখন তারা হয়তো বলে—‘আমি তো মজা করছিলাম!’ কিন্তু ফ্রয়েড বলেন, ওই ‘মজার’ আড়ালে আসলে একধরনের চাপা সত্য কাজ করে, যে কথাটি ব্যক্তির অবচেতন মন বলার জন্য ছটফট করছিল। মোটকথা, আমাদের ব্যক্তিজীবনে বা সামাজিক জীবনে অগ্রহণযোগ্য চিন্তাগুলোর একটি নিষ্কাশনব্যবস্থার মতো কাজ করে এই উপহাস বা রসিকতা। 

তবে অনেক ফেমিনিস্ট ও উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তাবিদ ফ্রয়েডের এই ভাবনাকে ‘সীমিত’ বলে মত দিয়েছেন। তাঁদের মতে, ফ্রয়েডের কৌতুক বিশ্লেষণ প্রায় পুরোটাই ইউরোপীয় মধ্যবিত্ত পুরুষদের রুচি ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এতে নারীর অভিজ্ঞতা, ঔপনিবেশিক বা ভিন্ন সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত।

সিমোন দ্য বোভোয়ার ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’–এ উল্লেখ করেছেন যে ফ্রয়েড নারীদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছেন এবং নারীকে পুরুষতান্ত্রিক স্বাভাবিকতা থেকে বিচ্যুত কোনো সত্তা ধরে নিয়েছেন। এই লিঙ্গধর্মী বায়োলজিক্যাল নির্ধারণবাদ কৌতুক বিশ্লেষণেও প্রতিফলিত হয়, যেখানে মনে হয় হাসি-ঠাট্টা শুধু পুরুষ শ্রেণির অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা। 

আরও পড়ুনঅ্যানিমেল ফার্ম: বিপ্লবোত্তর সময়ে আত্মসমালোচনার দর্পণ২৬ মে ২০২৫

সিমোন দ্য বোভোয়ার ছাড়াও কেট মিলেট, বেটি ফ্রিড্যান, ক্যারল গিলিগান এবং ন্যান্সি চোডরো—সবাই ফ্রয়েডের নারীসংক্রান্ত তত্ত্বের সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে তাঁর ‘পেনিস এনভি’ ধারণাকে তাঁরা পুরুষতান্ত্রিক ও অতীতপ্রবণ বলে চিহ্নিত করেছেন। যদিও সরাসরি ‘জোকস অ্যান্ড দেয়ার রিলেশন টু দ্য আনকনশাস’ বইটির ওপর তাঁরা কেউ বিশেষভাবে মন্তব্য করেননি, তবে ফ্রয়েডের জেন্ডার-বায়াস তাঁর কৌতুক বিশ্লেষণের ভেতরেও প্রতিফলিত হয়েছে।

আধুনিক কগনিটিভ সাইকোলজিস্টরা জোকসের ব্যাখ্যাকে অতি সরলীকৃত এবং একরৈখিক বলেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফ্রয়েডের তত্ত্বে ব্যবহৃত ‘সাইকিক এনার্জি’ ধারণাটিকে অনেকেই বৈজ্ঞানিকভাবে অপরিমাপযোগ্য এবং বিশ্লেষণ-বিয়োজনযোগ্য বলে চিহ্নিত করেছেন। এই এনার্জি নিষ্কাশনের ধারণার কোনো বাস্তব নিউরোসাইকোলজিক্যাল ভিত্তি নেই—এমনকি ফ্রয়েড নিজেও সেটিকে পর্যবেক্ষণ বা পরিমাপ করতে পারেননি। ফলে আজকের বিজ্ঞানভিত্তিক মনোবিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বকে মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে করেন। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি এসেছে ‘ইনকনগ্রুয়েটি থিওরি’ থেকে—যা আধুনিক কগনিটিভ সাইকোলজির একটি মেইনস্ট্রিম ব্যাখ্যা। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কৌতুকের মূল উৎস হলো প্রত্যাশার ভাঙন, অর্থাৎ যেখানে বাস্তবতা ও প্রত্যাশার মধ্যে ফারাক তৈরি হয়, সেখানেই মজা জন্ম নেয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন কেউ ভাষার দ্ব্যর্থতা, সংস্কৃতিগত রেফারেন্স, কিংবা যৌক্তিক অসামঞ্জস্যকে চমৎকারভাবে ব্যবহার করে, তখন তা মানুষকে হাসায়—এবং এই হাসির পেছনে কোনো অবচেতন যৌনতা বা আক্রমণাত্মক বাসনা থাকতেই হবে এমন না। এমনকি ‘বেনিং ভায়োলেশন থিওরি’ ও মিসেস্ট্রুবিয়েশন থিওরি’র গবেষণাও দেখিয়েছে—অনেক কৌতুক সম্পূর্ণরূপে সামাজিক স্বতঃস্ফূর্ততা বা মানসিক শিথিলতার প্রতিফলন, যেখানে অবচেতনের জটিলতা একেবারেই অনুপস্থিত।

ওপরের সমালোচনাগুলো থেকে যে বিষয়টি ফোকাসড তা হলো—ফ্রয়েড কৌতুককে খুব বেশি ‘যৌন’ ও ‘আক্রমণাত্মক’ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। আধুনিক গবেষণা বলেছে, সব কৌতুকের পেছনে চাপা বাসনা বা অবদমিত আগ্রাসন নেই। এ বক্তব্য এক অর্থে ঠিক। কিন্তু ফ্রয়েড কোনো দিন বলেননি যে সব কৌতুকই অবচেতন বাসনার ফল। তিনি বরং টেনডেন্সাস ও নন–টেনডেন্সাস কৌতুকের পার্থক্য করে দেখান, এবং বলেন যে কিছু কৌতুক সত্যিই নিরীহ ও খেলো ধরনের, আবার কিছু কৌতুক সাংস্কৃতিকভাবে জটিল, এবং এগুলোর পেছনে থাকে গভীর মানসিক কাঠামো।

ফ্রয়েডের এই বৈষম্য করার ক্ষমতা অর্থাৎ একমাত্রিক না হয়ে ‘লেয়ারড’ ব্যাখ্যার পথ তাঁকে আজও প্রাসঙ্গিক রাখে। তিনি কৌতুককে দেখেন ব্যক্তি ও সমাজের অন্তর্লোকে প্রবেশ করার এক দরজা হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো জাতিগোষ্ঠী বা শ্রেণির বিরুদ্ধে চালু থাকা বিদ্রুপাত্মক কৌতুক শুধু ‘মজা’ নয়, বরং সমাজের অবচেতন পক্ষপাত ও আগ্রাসনেরই ভাষ্য হতে পারে। আধুনিক কগনিটিভ সায়েন্স এমন বিশ্লেষণ দিতে চায় না, বা পারেও না—কারণ, তা মূলত তথ্যপ্রক্রিয়াভিত্তিক, মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা কেন্দ্রিক নয়।

তদুপরি, ফ্রয়েডের পদ্ধতি ছিল হারমোনিওটিক—অর্থাৎ তিনি অর্থ অনুসন্ধান করতেন, ব্যাখ্যা করতেন। আজকের অনেক দর্শন ও সাহিত্যতত্ত্ব এই ব্যাখ্যানাত্মক ধারা থেকেই উপকৃত। লাকা থেকে শুরু করে জিজেক—সব আধুনিক মনোবিশ্লেষক তাত্ত্বিকই এই ফ্রয়েডীয় ট্র্যাডিশনের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন। তাই যদি কৌতুককে কেবল ‘ইনফরমেশনাল অ্যানোমলি’ বা ‘বেনিং ইনকনগ্রুয়েটি’ হিসেবে দেখা হয়, তাহলে ভাষার রাজনীতি, সংস্কৃতির সংকেত, কিংবা অবচেতন প্রতিচ্ছবি অনুধাবনের অনেক দিক অধরাই থেকে যায়। 

অন্যদিকে, নারীবাদী ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচকেরা ফ্রয়েডের কাজকে ‘পুরুষতান্ত্রিক’ ও ‘ইউরোকেন্দ্রিক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই সমালোচনাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা ফ্রয়েডকে বাতিল করার যুক্তি নয়; বরং তাঁর তত্ত্বকে আরও প্রসারিত ও পুনর্বিচার করার আহ্বান। কৌতুক যদি একধরনের সাংস্কৃতিক টেক্সট হয়, তবে তার ব্যাখ্যা নির্ভর করবে কালের প্রেক্ষাপটে, শ্রোতার অবস্থানে এবং ভাষার প্রেক্ষিতে। ফ্রয়েড প্রথম সেই ব্যাখ্যার ভাষা তৈরি করে দেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক—যদিও তা নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন আলোচনার দাবি রাখে।

ফ্রয়েডের কৌতুক বিশ্লেষণ সব জায়গায় হয়তো নির্ভুল নয়, কিন্তু তাতে করে তাঁর গুরুত্ব ম্লান হয় না। বরং ফ্রয়েডকে পাঠ করার আসল গুরুত্বই হলো আমরা কোথায় হেসে উঠি, কেন হেসে উঠি এবং কীসের ওপরে হাসি—সেই হাসির পেছনের অনুচ্চারিত সত্য খুঁজে বের করা। 

ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা তখনই আবার সত্য হিসেবে গণ্য হয় যখন আমরা দেখি রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রের জন্য রাষ্ট্র আমাদের ওপর খড়্গ চালায়, জেলে ঢুকিয়ে মারে। তখন সমান্তরালে আরেকটি বিষয় দাঁড়িয়ে যায়, আমরা কি পরিবারে কিংবা কর্মস্থলে কোনো রাজনীতির আশ্রয় নিই না? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তবে তো আমাদের পারিবারিক ও কর্মস্থলের জোকসগুলোও ময়নাতদন্তযোগ্য। সেই জায়গা থেকে আমাদের আবার ফিরে আসতে হবে ফ্রয়েডের বক্তব্যে। নানা কারণেই ফ্রয়েডীয় দৃষ্টিকোণকে উপেক্ষা করেও গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হচ্ছে আমাদের।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর ছ ন তত ত ব প রক শ আম দ র উপহ স র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

টেপরির গল্প

আমার ছোট বোন টেপরি যখন জন্ম নিল, তখন বাংলা সিনেমার চিরায়ত সেই দুটি অপশন আমাদের সামনে চলে এল। ‘আম্মা নাকি টেপরি?’ অর্থাৎ সেদিন হাসপাতালে কোনো টেরিবেরি হয়ে গেলে আজ টেপরির জন্মদিনটাই আম্মার নিরস মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিণত হতে পারত।

জন্মের সময় টেপরির নাক প্রচলিত অর্থে বোঁচা ছিল। এই কারণেই আমি এই নাম রেখেছিলাম দুষ্টামি করে। জন্মের পর ওর গায়ের রং শ্যামলা ছিল, চুল ছিল কোঁকড়ানো। এই তথ্য গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর দাদি মরাকান্না জুড়িয়ে দিলেন।

আমরা বুঝতেই পারছিলাম না, দাদির এই কান্নার কারণ কী! তারপর জানা গেল, ‘শ্যামলা মেয়েকে কেউ বিয়ে করে না’; ‘কোঁকড়ানো চুলের মেয়েদের স্বামীকপাল মন্দ হয়’...মূলত এসব ছাইভষ্ম ভেবে দাদি গঙ্গাকে আরও জলবতী করবার ব্রত নিয়েছিলেন।

মেয়ে ‘কালো’ নাকি ফরসা—এই বিষয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ১১৪ নম্বর কেবিনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করা কয়েক শ বছরের এক বৃদ্ধা আয়া আঙুল তুলে বললেন, ‘এই ম্যায়ার চুল পাতলা হইব, মাথার তালু ফরসা, মুখে-চোখে-গতরে কালা দাগগুনি সব প্যাটের ময়লা। ফুটব ফুটব গায়ের রং ফুটব!’

টেপরি বড় হতে থাকল, সেই শতবর্ষী আয়ার কথামতো আজ টেপরির চুলগুলোতে কেমন মিষ্টি অথচ আঁশটে গন্ধ, আর গায়ের রং? ওর গায়ের রং রুই মাছের ডিমের মতো, যখন তা ঢিমে আঁচে রান্না করা হয় সাত–আটটা কাঁচা মরিচের ভাপে।

এসব বাহ্যিক রূপবৈচিত্র্যের বাইরেও ও টেপরি, যে কিনা সকালে দাঁত মাজা বাদ দিয়ে আম্মার পাশে একটা ছোট বঁটি নিয়ে পেঁয়াজের পর পেঁয়াজ, রসুনের পর রসুন দফারফা করে।

এই তো কিছুদিন আগেও, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ পড়ার পর টেপরির সঙ্গে অনেক দিন কথা বলিনি। বলতে পারিনি। আমার ভেতর তখন কী হয়েছিল আমি আজও বুঝিনি। উপন্যাসে ছোট বোন রঞ্জু মারা গিয়েছিল। আর তার ভাই ‘খোকা’ ভেসে গিয়েছিল দেশ নামের একটা পুকুরের অনেক গভীরে। হয়তো এই দেশকে আমারও তখন একটা পুকুর মনে হয়েছিল।

একুশ মে, বারটা এক, একটা ছোট্ট কেক, আমরা চারজন। দেশলাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে মোমবাতিগুলো কেকের ওপর চোখ বন্ধ করে বসে ছিল নাগা সন্ন্যাসীদের মতো। কেকের ওপর আমার দেওয়া ‘টেপরি’ নামটাই লেখার কথা ছিল, কিন্তু সেটা বানান ভুল হয়ে ‘পেটরি’ হয়ে গেছে। এত চ্যুতি–বিচ্যুতির ভেতর আব্বা কেক মুখে নিয়ে বলে, ‘মা, তোমার হাত ধোয়া ছিল তো?’

পরিবারের আত্মীয় নাম্নী লোকেরা টেপরির জন্মদিনের কথা জানে নাকি জানে না, আমি জানি না। খেয়াল করলাম, তেমন কেউই টেপরিকে বারটায় কিংবা বারটা একে, এমনকি তিরিশেও উইশ করল না। এমন সময়ে টেপরির মোবাইলে একটা মেসেজ এল, কিন্তু সেটাও টেলিকম কোম্পানি থেকে। টেপরিও এসব বুঝে যাবে...এদের সবাইকে চিনে যাবে একদিন।

টেপরির ব্যাপারে একটা–দুটো বাক্য বলা অসম্ভব। সে হয়তো সেই বোনটা, যে টেলিফোনের অন্য পাশে বসে তার রাগের মাথায় ঘরছাড়া ভাইকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার জন্য হু হু করে কাঁদে।

অকারণ এই কান্নাপর্ব আমার যাপিত সময়ে সশস্ত্র হামলা করে, দেখি অপু আর দুর্গা কাশবনে ছুটছে, দূরে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে হারিয়ে যাচ্ছে রেলগাড়ি।

টেপরি বড় হয়ে গেল। বিস্ময়কর একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে কিশোরী থেকে তরুণী আর তারপর আরও ধীরে ধীরে ধীরে কোনো এক ‘নারী’ হয়ে উঠল ও।

আমি ওকে দেখি আর ভাবি, বিকেলের পর বিকেল। দেব দেব করে কোনো একটা বড়সড় গিফট আর দেওয়া হয়ে ওঠে না। এই মন ভোলানো ভাবনাগুলোই ওকে গিফট হিসেবে দেওয়া গেলে ভালো হতো।

কিন্তু এসব ভাবতে ভাবতে দাদির দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে টেপরির বিয়েটাও হয়ে গেল। আম্মার শরীর খারাপ থেকে খারাপতর হওয়ায় নিজের বিয়ের কাজও ওকেই করতে হলো।

বিয়ের আগের সময়গুলোতে আমাদের প্রিয় আব্বা হঠাৎ এক–দেড় মাসেই অনেকটুকু বুড়িয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে আমি বুঝলাম, আব্বা ইস্পাত কঠিন হলে এই একটা মাত্র বিষয়ে উনি প্রচণ্ড অসহায়বোধ করেন। বাবা–মেয়ের সম্পর্কটাই হয়তো এমন।

টেপরি এখন দূরে চলে যাবে আমাদের কাছ থেকে। আমাদের বাসাটা ‘পাখিহীন’ হয়ে কীভাবে টিকে থাকবে; আমি অফিসের ফাঁকে, রাস্তার জ্যামে, সিনেমা হলে সিনেমা শেষ হওয়ার পর, নদীর পাড়ের বাতাসে কিংবা মধ্যরাতের ছাদে হঠাৎ-বিঠাৎ সেইটাই ভাবি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ