ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ: পশ্চিম তীরে ‘নতুন নাকবা’র ছায়া ২২২২
Published: 16th, October 2025 GMT
মে মাসের এক সকাল। খাল্লেত আল-ডাবার শান্ত পরিবেশ কেঁপে ওঠে বুলডোজার ও অন্যান্য যন্ত্রের শব্দে। সেই সঙ্গে গ্রামে প্রবেশ করেন ইসরায়েলি সৈন্যরা। স্থানীয় লোকজনকে ঘর থেকে বের করে দেন। গবাদিপশুগুলো ছেড়ে দেন খোলা মাঠে।
৫ মে, দিন শেষে মাসাফের ইয়াত্তার কেন্দ্রে অবস্থিত ফিলিস্তিনিদের ছোট একটি সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। চলতি বছর অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনী পরিচালিত অন্তত চারটি বৃহৎ ধ্বংসযজ্ঞের একটি এটি। স্থানীয় মানুষের কাছে এ ধ্বংসযজ্ঞ ‘নাকবা’র চেয়ে কম কষ্টের নয়। এটি তাঁদের কাছে এক ‘নতুন নাকবা’—১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের হামলায় ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতি ও জাতিগত নির্মূলের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি।
স্থানীয় মানুষের মতে, মে মাসের ধ্বংসযজ্ঞ চলাকালে কয়েক ডজন সামরিক যান, সাঁজোয়া গাড়ি ও জিপ ওই গ্রাম ঘিরে রেখেছিল। পরিবারগুলোর নারী–শিশুসহ অন্য সদস্যরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্বলন্ত সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখের সামনে তাঁদের বাড়িঘর এবং ঘরের পেছনের দেয়ালগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে দেখেন।
বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো তখন থেকে নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ কয়েক বছর আগে তৈরি গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যরা অসহায় অবস্থায় নাজুক তাঁবুতে থাকছেন। শীত ও গ্রীষ্মের চরম তাপমাত্রায় এসব তাঁবু থেকে গা বাঁচানো যায় না।
আমরা প্রস্তরযুগে ফিরে গেছি। গুহা ও তাঁবুতে থাকছি। নেই জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। তবু কেউ গ্রাম ছেড়ে যাননি।মোহাম্মদ রাবিয়া, পশ্চিম তীরের আত-তুবানি গ্রামের কাউন্সিলপ্রধান‘এ ঘটনা খাল্লেত আল-ডাবার মানুষের জীবনের সব মৌলিক সুবিধা—পানি, বিদ্যুৎ, সৌরশক্তি, পানির কূপ, আবর্জনার পাত্র, এমনকি রাস্তার বাতি গুঁড়িয়ে দিয়েছে,’ বলেন মোহাম্মদ রাবিয়া। তিনি কাছের আত-তুবানি গ্রামের কাউন্সিলপ্রধান ও মাসাফের ইয়াত্তার বেদুইন পরিবারগুলোর বিষয়াদি দেখভাল করেন।
মোহাম্মদ রাবিয়া বলেন, ‘আমরা প্রস্তরযুগে ফিরে গেছি। গুহা ও তাঁবুতে থাকছি। নেই জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। তবু কেউ গ্রাম ছেড়ে যাননি।’
সামরিক প্রশিক্ষণ অঞ্চল
পশ্চিম তীরের দক্ষিণে মাসাফের ইয়াত্তা এলাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত খাল্লেত আল-ডাবা। এটি হেবরনের দক্ষিণে পাহাড়ঘেরা ১২টি ফিলিস্তিনি গ্রামের একটি।
জাতিসংঘের আগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাসাফের ইয়াত্তায় ১ হাজার ১৫০ জন বাস করেন। তবে রাবিয়া বলেন, প্রকৃত সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। তাঁরা মূলত ভেড়া পালন এবং গম ও বার্লি চাষ করেন। এটি তাঁদের আয়ের প্রধান উৎস।
পশ্চিম তীরের প্রায় ২০ শতাংশ জমির মতোই, ইসরায়েল ১৯৮০-এর দশকে ওই এলাকার একটি অংশকে সামরিক প্রশিক্ষণ অঞ্চল ‘ফায়ারিং জোন ৯১৮’ ঘোষণা করেছে। এর পর থেকেই তারা স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
৫ মের ধ্বংসযজ্ঞের সময় ইসরায়েলি সেনারা বলেছিলেন, এটি সামরিক প্রশিক্ষণ অঞ্চলের জন্য জরুরি।
এর আগে ইসরায়েলি–ফিলিস্তিনি গবেষণা সংস্থা আকেভট জানায়, পশ্চিম তীরের কিছু এলাকা সামরিক প্রশিক্ষণ অঞ্চল ঘোষণা করার কাজ ১৯৮১ সালে তখনকার ইসরায়েলি কৃষিমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারনের প্রস্তাবিত ছিল। পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।
মাসাফের ইয়াত্তায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড হলো বৃহত্তর পরিসরে জাতিগত নির্মূল নীতির অংশ। এর লক্ষ্য ফিলিস্তিনিদের এ এলাকা থেকে সরানো।ফ্রেডেরিক ভ্যান ডোঙ্গেন, ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) ব্যবস্থাপকখাল্লেত আল-ডাবার বাড়িঘর বারবার সামরিক আদেশে ধ্বংস করা হয়। স্থানীয় লোকজন বলেন, কারণ ভিন্ন হতে পারে—অনুমতি ছাড়া নির্মাণ, সামরিক প্রশিক্ষণ এলাকার কাছাকাছি অবস্থান বা অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনে জমি দাবি। কিন্তু উদ্দেশ্য একটাই। তা হলো, ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তর।
ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা সংস্থা ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) ব্যবস্থাপক ফ্রেডেরিক ভ্যান ডোঙ্গেন গত সপ্তাহে বলেন, ‘মাসাফের ইয়াত্তায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড হলো বৃহত্তর পরিসরে জাতিগত নির্মূল নীতির অংশ। এর লক্ষ্য ফিলিস্তিনিদের এ এলাকা থেকে সরানো।’
আরও পড়ুনইসরায়েলি আগ্রাসনে পশ্চিম তীরে ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বাস্তুচ্যুতি১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫‘আমি যদি যাই, আমি মরব’
যাঁরা বসতি ধ্বংসের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৬৫ বছর বয়সী সামিহা মুহাম্মদ আল-ডাবাবসেহ আছেন। জন্মের পর থেকে এই নারী ওই গ্রামে রয়েছেন। তাঁর মুখে কয়েক দশকের কষ্ট ও সংগ্রামী জীবনের ছাপ স্পষ্ট।
‘আমি চিৎকার করে উঠি, সেনারা এখানে!’, স্মরণ করেন সামিহা মুহাম্মদ। ‘কয়েক মিনিটের মধ্যে সেনারা ঘরে ঢুকে আমাদের জোরপূর্বক বের করে দেন, কিছু নেওয়ার অনুমতি দেননি—না খাবার, না কাপড়। তাঁরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলেন, “এটি তোমার জমি নয়। এখানে তোমার ঘর বা ঠিকানা থাকবে না।’”
মে মাসের আগে সামিহাদের পরিবার তিনবার এমন ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছে। মে মাসে তাঁদের ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর তাঁরা একটি গুহায় আশ্রয় নেন। এটি সামিহা নিজে খুঁড়ে বানিয়েছিলেন। পরিবারের নারী ও শিশুরা গুহার ভেতর ঘুমাত, পুরুষেরা বাইরে মাটিতে থাকতেন।
মে মাসের আগে সামিহাদের পরিবার তিনবার এমন ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছে। মে মাসে তাঁদের ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর, তাঁরা একটি গুহায় আশ্রয় নেন। এটি সামিহা নিজে খুঁড়ে বানিয়েছিলেন। পরিবারের নারী ও শিশুরা গুহার ভেতর ঘুমাত, পুরুষেরা বাইরে মাটিতে থাকতেন।কিন্তু গত ১৭ সেপ্টেম্বর, এমনকি এ গুহাও ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া তাঁবু, পানির ট্যাংক ও অস্থায়ী শৌচাগার নিশানা করা হয়।
‘যদি খাল্লেত আল-ডাবায় একটি গাছও থাকে, আমি তার ছায়ায় থাকব,’ বলেন সামিহা। ‘এখানকার মাটি আমার প্রাণ। যদি আমি চলে যাই, আমি মরব।’
সামিহা মুহাম্মদ জানান, এখন তিনি একটি গাছের নিচে বসবাস করছেন। বলেন, ‘আমরা (ইহুদি) বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণের ভয় নিয়ে বাঁচি। সবকিছু সত্ত্বেও আমরা গ্রাম ছাড়ব না।’
আরও পড়ুনপশ্চিম তীরে তিন হাজার জলপাইগাছ উপড়ে ফেলল ইসরায়েলি সেনারা২৪ আগস্ট ২০২৫ভয়ের মধ্যে বসবাস
সামিহার ছোট ছেলে ৩১ বছর বয়সী মুজাহিদ আল-ডাবাবসেহ, স্ত্রী ও তিন সন্তানের সঙ্গে একটি গুহায় থাকেন। সঙ্গে আরও ১১ জন আত্মীয়। কৃষক মুজাহিদ বলেন, গুহায় রাতগুলো ‘দীর্ঘ ও ভয়ংকর’।
‘শিশুরা বুলডোজার ও বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণের দুঃস্বপ্ন দেখে,’ বলেন মুজাহিদ। ‘আমি ভয় পাই সাপ, পোকা বা তৃষ্ণার। আমাদের জীবন খুব কঠিন। বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, নিরাপত্তা নেই।’
মুজাহিদ বলেন, বাবার সঙ্গে পাথর বয়ে তাঁরা ঘর তৈরি করেছিলেন। সেই ঘর ধ্বংস করার দৃশ্য তাঁর জীবনের একটি অংশ হারানোর মতো ছিল।
‘(ইসরায়েলি) দখলদারি খাল্লেত আল-ডাবাকে দ্বিতীয় গাজা বানিয়ে দিয়েছে। তারা মাটির ওপরের সব ধ্বংস করেছে, শুধু ধ্বংসস্তূপ বাকি রয়েছে,’ বলেন মুজাহিদ। ‘কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। এখানকার কোনো ফিলিস্তিনি শিশু কখনো চলে যাবে না।’
আরও পড়ুনপশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের মারধরে মার্কিন নাগরিক নিহত, তদন্তের দাবি১২ জুলাই ২০২৫এ গ্রামে মাত্র ১২০ জন বসবাস করেন। শিশুর সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ। সবাই ডাবাবসেহ বংশের সদস্য। গ্রামের নাম এখানে একসময় বিচরণ করা হায়নাকে মনে করিয়ে দেয়। স্থানীয় লোকজন বলেন, এখন এখানে শিকার করছেন ইসরায়েলি সেনা ও অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা।
অনেকের কাছে বারবার বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়া শুধু বাড়িঘরের বিষয় নয়; এটি জীবনকে মুছে ফেলার চেষ্টা—পানির কূপ, সৌর প্যানেল, নর্দমাব্যবস্থা, এমনকি রাস্তার বাতি। প্রতিবার বাসিন্দারা যা পারেন এগুলো পুনর্নির্মাণ করেন। আর প্রতিবারই প্রতিজ্ঞা করেন, তাঁরা এলাকা ছেড়ে যাবেন না।খাল্লেত আল-ডাবা এখন গুহা, ধ্বংসস্তূপ ও তাঁবুর সংমিশ্রণে গড়া। তবু এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের প্রতীক। স্থানীয় লোকজন বলেন, এটি সাত দশকের বেশি সময় ধরে চলা তাঁদের সংগ্রামের প্রতীক।
‘এটি চলমান নাকবা,’ বলেন রাবিয়া। ‘কিন্তু মানুষ মাটি আঁকড়ে থেকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চারবার বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে। চারবারই মানুষ এলাকায় থেকে গেছে।’
আরও পড়ুনইসরায়েলিদের হামলা-নির্যাতন: অতিষ্ঠ বেদুইন পরিবারগুলো ছাড়ছে পশ্চিম তীর০৫ জুলাই ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: খ ল ল ত আল ড ব ধ ব সযজ ঞ র র ধ ব সযজ ঞ ইসর য় ল র স থ পনক র র ব ড় ঘর ম হ ম মদ ধ ব স কর ঘর ধ ব স পর ব র জ বন র র একট অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ: পশ্চিম তীরে ‘নতুন নাকবা’র ছায়া ২২২২
মে মাসের এক সকাল। খাল্লেত আল-ডাবার শান্ত পরিবেশ কেঁপে ওঠে বুলডোজার ও অন্যান্য যন্ত্রের শব্দে। সেই সঙ্গে গ্রামে প্রবেশ করেন ইসরায়েলি সৈন্যরা। স্থানীয় লোকজনকে ঘর থেকে বের করে দেন। গবাদিপশুগুলো ছেড়ে দেন খোলা মাঠে।
৫ মে, দিন শেষে মাসাফের ইয়াত্তার কেন্দ্রে অবস্থিত ফিলিস্তিনিদের ছোট একটি সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। চলতি বছর অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনী পরিচালিত অন্তত চারটি বৃহৎ ধ্বংসযজ্ঞের একটি এটি। স্থানীয় মানুষের কাছে এ ধ্বংসযজ্ঞ ‘নাকবা’র চেয়ে কম কষ্টের নয়। এটি তাঁদের কাছে এক ‘নতুন নাকবা’—১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের হামলায় ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতি ও জাতিগত নির্মূলের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি।
স্থানীয় মানুষের মতে, মে মাসের ধ্বংসযজ্ঞ চলাকালে কয়েক ডজন সামরিক যান, সাঁজোয়া গাড়ি ও জিপ ওই গ্রাম ঘিরে রেখেছিল। পরিবারগুলোর নারী–শিশুসহ অন্য সদস্যরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্বলন্ত সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখের সামনে তাঁদের বাড়িঘর এবং ঘরের পেছনের দেয়ালগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে দেখেন।
বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো তখন থেকে নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ কয়েক বছর আগে তৈরি গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যরা অসহায় অবস্থায় নাজুক তাঁবুতে থাকছেন। শীত ও গ্রীষ্মের চরম তাপমাত্রায় এসব তাঁবু থেকে গা বাঁচানো যায় না।
আমরা প্রস্তরযুগে ফিরে গেছি। গুহা ও তাঁবুতে থাকছি। নেই জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। তবু কেউ গ্রাম ছেড়ে যাননি।মোহাম্মদ রাবিয়া, পশ্চিম তীরের আত-তুবানি গ্রামের কাউন্সিলপ্রধান‘এ ঘটনা খাল্লেত আল-ডাবার মানুষের জীবনের সব মৌলিক সুবিধা—পানি, বিদ্যুৎ, সৌরশক্তি, পানির কূপ, আবর্জনার পাত্র, এমনকি রাস্তার বাতি গুঁড়িয়ে দিয়েছে,’ বলেন মোহাম্মদ রাবিয়া। তিনি কাছের আত-তুবানি গ্রামের কাউন্সিলপ্রধান ও মাসাফের ইয়াত্তার বেদুইন পরিবারগুলোর বিষয়াদি দেখভাল করেন।
মোহাম্মদ রাবিয়া বলেন, ‘আমরা প্রস্তরযুগে ফিরে গেছি। গুহা ও তাঁবুতে থাকছি। নেই জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। তবু কেউ গ্রাম ছেড়ে যাননি।’
সামরিক প্রশিক্ষণ অঞ্চল
পশ্চিম তীরের দক্ষিণে মাসাফের ইয়াত্তা এলাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত খাল্লেত আল-ডাবা। এটি হেবরনের দক্ষিণে পাহাড়ঘেরা ১২টি ফিলিস্তিনি গ্রামের একটি।
জাতিসংঘের আগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাসাফের ইয়াত্তায় ১ হাজার ১৫০ জন বাস করেন। তবে রাবিয়া বলেন, প্রকৃত সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। তাঁরা মূলত ভেড়া পালন এবং গম ও বার্লি চাষ করেন। এটি তাঁদের আয়ের প্রধান উৎস।
পশ্চিম তীরের প্রায় ২০ শতাংশ জমির মতোই, ইসরায়েল ১৯৮০-এর দশকে ওই এলাকার একটি অংশকে সামরিক প্রশিক্ষণ অঞ্চল ‘ফায়ারিং জোন ৯১৮’ ঘোষণা করেছে। এর পর থেকেই তারা স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
৫ মের ধ্বংসযজ্ঞের সময় ইসরায়েলি সেনারা বলেছিলেন, এটি সামরিক প্রশিক্ষণ অঞ্চলের জন্য জরুরি।
এর আগে ইসরায়েলি–ফিলিস্তিনি গবেষণা সংস্থা আকেভট জানায়, পশ্চিম তীরের কিছু এলাকা সামরিক প্রশিক্ষণ অঞ্চল ঘোষণা করার কাজ ১৯৮১ সালে তখনকার ইসরায়েলি কৃষিমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারনের প্রস্তাবিত ছিল। পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।
মাসাফের ইয়াত্তায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড হলো বৃহত্তর পরিসরে জাতিগত নির্মূল নীতির অংশ। এর লক্ষ্য ফিলিস্তিনিদের এ এলাকা থেকে সরানো।ফ্রেডেরিক ভ্যান ডোঙ্গেন, ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) ব্যবস্থাপকখাল্লেত আল-ডাবার বাড়িঘর বারবার সামরিক আদেশে ধ্বংস করা হয়। স্থানীয় লোকজন বলেন, কারণ ভিন্ন হতে পারে—অনুমতি ছাড়া নির্মাণ, সামরিক প্রশিক্ষণ এলাকার কাছাকাছি অবস্থান বা অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনে জমি দাবি। কিন্তু উদ্দেশ্য একটাই। তা হলো, ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তর।
ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা সংস্থা ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) ব্যবস্থাপক ফ্রেডেরিক ভ্যান ডোঙ্গেন গত সপ্তাহে বলেন, ‘মাসাফের ইয়াত্তায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড হলো বৃহত্তর পরিসরে জাতিগত নির্মূল নীতির অংশ। এর লক্ষ্য ফিলিস্তিনিদের এ এলাকা থেকে সরানো।’
আরও পড়ুনইসরায়েলি আগ্রাসনে পশ্চিম তীরে ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বাস্তুচ্যুতি১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫‘আমি যদি যাই, আমি মরব’
যাঁরা বসতি ধ্বংসের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৬৫ বছর বয়সী সামিহা মুহাম্মদ আল-ডাবাবসেহ আছেন। জন্মের পর থেকে এই নারী ওই গ্রামে রয়েছেন। তাঁর মুখে কয়েক দশকের কষ্ট ও সংগ্রামী জীবনের ছাপ স্পষ্ট।
‘আমি চিৎকার করে উঠি, সেনারা এখানে!’, স্মরণ করেন সামিহা মুহাম্মদ। ‘কয়েক মিনিটের মধ্যে সেনারা ঘরে ঢুকে আমাদের জোরপূর্বক বের করে দেন, কিছু নেওয়ার অনুমতি দেননি—না খাবার, না কাপড়। তাঁরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলেন, “এটি তোমার জমি নয়। এখানে তোমার ঘর বা ঠিকানা থাকবে না।’”
মে মাসের আগে সামিহাদের পরিবার তিনবার এমন ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছে। মে মাসে তাঁদের ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর তাঁরা একটি গুহায় আশ্রয় নেন। এটি সামিহা নিজে খুঁড়ে বানিয়েছিলেন। পরিবারের নারী ও শিশুরা গুহার ভেতর ঘুমাত, পুরুষেরা বাইরে মাটিতে থাকতেন।
মে মাসের আগে সামিহাদের পরিবার তিনবার এমন ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছে। মে মাসে তাঁদের ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর, তাঁরা একটি গুহায় আশ্রয় নেন। এটি সামিহা নিজে খুঁড়ে বানিয়েছিলেন। পরিবারের নারী ও শিশুরা গুহার ভেতর ঘুমাত, পুরুষেরা বাইরে মাটিতে থাকতেন।কিন্তু গত ১৭ সেপ্টেম্বর, এমনকি এ গুহাও ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া তাঁবু, পানির ট্যাংক ও অস্থায়ী শৌচাগার নিশানা করা হয়।
‘যদি খাল্লেত আল-ডাবায় একটি গাছও থাকে, আমি তার ছায়ায় থাকব,’ বলেন সামিহা। ‘এখানকার মাটি আমার প্রাণ। যদি আমি চলে যাই, আমি মরব।’
সামিহা মুহাম্মদ জানান, এখন তিনি একটি গাছের নিচে বসবাস করছেন। বলেন, ‘আমরা (ইহুদি) বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণের ভয় নিয়ে বাঁচি। সবকিছু সত্ত্বেও আমরা গ্রাম ছাড়ব না।’
আরও পড়ুনপশ্চিম তীরে তিন হাজার জলপাইগাছ উপড়ে ফেলল ইসরায়েলি সেনারা২৪ আগস্ট ২০২৫ভয়ের মধ্যে বসবাস
সামিহার ছোট ছেলে ৩১ বছর বয়সী মুজাহিদ আল-ডাবাবসেহ, স্ত্রী ও তিন সন্তানের সঙ্গে একটি গুহায় থাকেন। সঙ্গে আরও ১১ জন আত্মীয়। কৃষক মুজাহিদ বলেন, গুহায় রাতগুলো ‘দীর্ঘ ও ভয়ংকর’।
‘শিশুরা বুলডোজার ও বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণের দুঃস্বপ্ন দেখে,’ বলেন মুজাহিদ। ‘আমি ভয় পাই সাপ, পোকা বা তৃষ্ণার। আমাদের জীবন খুব কঠিন। বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, নিরাপত্তা নেই।’
মুজাহিদ বলেন, বাবার সঙ্গে পাথর বয়ে তাঁরা ঘর তৈরি করেছিলেন। সেই ঘর ধ্বংস করার দৃশ্য তাঁর জীবনের একটি অংশ হারানোর মতো ছিল।
‘(ইসরায়েলি) দখলদারি খাল্লেত আল-ডাবাকে দ্বিতীয় গাজা বানিয়ে দিয়েছে। তারা মাটির ওপরের সব ধ্বংস করেছে, শুধু ধ্বংসস্তূপ বাকি রয়েছে,’ বলেন মুজাহিদ। ‘কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। এখানকার কোনো ফিলিস্তিনি শিশু কখনো চলে যাবে না।’
আরও পড়ুনপশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের মারধরে মার্কিন নাগরিক নিহত, তদন্তের দাবি১২ জুলাই ২০২৫এ গ্রামে মাত্র ১২০ জন বসবাস করেন। শিশুর সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ। সবাই ডাবাবসেহ বংশের সদস্য। গ্রামের নাম এখানে একসময় বিচরণ করা হায়নাকে মনে করিয়ে দেয়। স্থানীয় লোকজন বলেন, এখন এখানে শিকার করছেন ইসরায়েলি সেনা ও অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা।
অনেকের কাছে বারবার বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়া শুধু বাড়িঘরের বিষয় নয়; এটি জীবনকে মুছে ফেলার চেষ্টা—পানির কূপ, সৌর প্যানেল, নর্দমাব্যবস্থা, এমনকি রাস্তার বাতি। প্রতিবার বাসিন্দারা যা পারেন এগুলো পুনর্নির্মাণ করেন। আর প্রতিবারই প্রতিজ্ঞা করেন, তাঁরা এলাকা ছেড়ে যাবেন না।খাল্লেত আল-ডাবা এখন গুহা, ধ্বংসস্তূপ ও তাঁবুর সংমিশ্রণে গড়া। তবু এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের প্রতীক। স্থানীয় লোকজন বলেন, এটি সাত দশকের বেশি সময় ধরে চলা তাঁদের সংগ্রামের প্রতীক।
‘এটি চলমান নাকবা,’ বলেন রাবিয়া। ‘কিন্তু মানুষ মাটি আঁকড়ে থেকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চারবার বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে। চারবারই মানুষ এলাকায় থেকে গেছে।’
আরও পড়ুনইসরায়েলিদের হামলা-নির্যাতন: অতিষ্ঠ বেদুইন পরিবারগুলো ছাড়ছে পশ্চিম তীর০৫ জুলাই ২০২৫