যক্ষ্মা বা টিবি বলতে আমরা বুঝি কাশি আর ফুসফুস ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া। কিন্তু যক্ষ্মার জীবাণু শুধু ফুসফুসকে আক্রান্ত করে তা নয়, এটি মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে লিভার, কিডনি, ত্বক বা শরীরের চামড়া-হাড়সহ দেহের যেকোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

তবে ফুসফুসে যক্ষ্মা সংক্রমণের হার ৮৫ শতাংশের বেশি হওয়ায় সেটাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফুসফুসের বাইরে বাকি ১৫ শতাংশ যক্ষ্মা শরীরের অন্য যেকোনো জায়গায় হতে পারে। বলা যায়, হাত–পায়ের নখ ও মাথার চুল ছাড়া শরীরের যেকোনো জায়গায় যক্ষ্মা হতে পারে।

ফুসফুসের বাইরে যক্ষ্মা

ফুসফুসের বাইরে লসিকাগ্রন্থি বা লিম্ফ নোডের যক্ষ্মা সবচেয়ে বেশি হতে দেখা যায়। সম্প্রতি সার্জিক্যাল অপারেশনের পর সেই ক্ষতস্থানে যক্ষ্মা জীবাণু সংক্রমণের হার বাড়ছে। এ ছাড়া হাড়, মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্কে যক্ষ্মার সংক্রমণও কম নয়।

সুপ্ত যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে অনেক বছর বেঁচে থাকতে পারে। একে লেটেন্ট টিবি বলে। সক্রিয় বা অ্যাকটিভ না হলে এটি অসুস্থতা সৃষ্টি করে না। এটিকে সুপ্ত যক্ষ্মা বলা হয়। যখন কোনো কারণে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, তখনই এটি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

চিকিৎসা কী

সঠিক ও নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে যক্ষ্মা সম্পূর্ণ ভালো করা সম্ভব। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পুরো কোর্স সম্পন্ন করা অত্যন্ত জরুরি। এটা ব্যক্তিভেদে ৬ মাস, ৮ মাস বা ১২ মাস, এমনকি ১৮ মাস লাগতে পারে। কারণ, কেউ যদি সম্পূর্ণ কোর্স, যাঁর জন্য যতটুকু প্রয়োজন, তা শেষ না করেন, তাহলে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। তখন আর সাধারণ ওষুধে যক্ষ্মা সারে না।

আরও পড়ুনযক্ষ্মা সম্পর্কে ৫ ভ্রান্ত ধারণা২৪ মার্চ ২০২৩

বিশেষ অঙ্গের যক্ষ্মায় এর বাইরে আরও কিছু চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে, যেমন স্টেরয়েড, অস্ত্রোপচার ইত্যাদি। ফুসফুসের যক্ষ্মায় কাশি বা কাশির সঙ্গে রক্তপাত থাকে। অন্য যক্ষ্মায় এমনটা না-ও হতে পারে।

এর উপসর্গ নির্ভর করে কোথায় যক্ষ্মা হয়েছে, তার ওপর। যেমন কোমর বা মেরুদণ্ডে ব্যথা ও ফ্র্যাকচার, গলা ও অন্যান্য স্থানের লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া, পেটে পানি আসা, চেতনা লোপ পাওয়া ইত্যাদি।

যেকোনো দীর্ঘস্থায়ী জ্বরে যক্ষ্মার কথা মনে রাখতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

ডা.

আয়শা আক্তার, উপপরিচালক, ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতাল, আগারগাঁও, ঢাকা

আরও পড়ুনবোন টিবি বা হাড়ে যক্ষ্মা হলে বুঝবেন কীভাবে২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ভাষার লিখিত রূপের প্রমিতকরণ, সাধু রীতি টিকিয়ে রাখতে হবে

‘বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রধান অভিভাবক। এটা স্বীকৃত অভিভাবকত্ব। এ জন্য বাংলা ভাষার লিখিত রূপের প্রমিতকরণ তার অন্যতম দায়িত্ব। বাংলা অভিধান প্রণয়ন, ব্যাকরণ সংকলন ও ভাষার সাধু রূপকে জীবিত রাখার জন্য একাডেমির উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।’ আজ বুধবার বাংলা একাডেমির ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত বক্তৃতায় বক্তা ফয়জুল লতিফ চৌধুরী এ মন্তব্য করেন।

বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আজ বিকেলে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বক্তা সাহিত্যিক ও গবেষক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, ‘ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য এর প্রবাহমানতা। মৌখিক রূপে এই প্রবাহমানতা বজায় থাকবে। সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র ও নাটকে মুখের ভাষার প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। এতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি অনাবশ্যক। বরং এমন প্রতিবন্ধকতা অনেকটা ভাষার অধিকার তথা মানবাধিকারে বাধা প্রদানের মতোই। তবে ভাষার লিখিত রূপের প্রমিতকরণ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, অভিধানভুক্ত শব্দ ছাড়াও নতুন নতুন অনেক শব্দ ভাষার ভান্ডারে যুক্ত হচ্ছে। এসব শব্দ কবি, লেখক, সাহিত্যিকেরা তাঁদের রচনায়ও ব্যবহার করছেন। এসব শব্দ সংগ্রহ করে, সেগুলোর বিশেষ প্রয়োগের উদাহরণসহ একটি শব্দভান্ডার সৃষ্টি করা দরকার। এই শব্দভান্ডার থেকে যাচাই–বাছাই করে কিছু কিছু শব্দ অভিধানভুক্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। তা ছাড়া অনেক সময় আমরা সংস্কৃত–প্রভাবিত শব্দ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করি। এটাও সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। এভাবে আমাদের শব্দভান্ডার কমে আসছে। সংকীর্ণ হয়ে আসছে।’

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বক্তা ফয়জুল লতিফ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চলিত ও সাধু আমাদের ভাষার এই দুই প্রকারের রীতি রয়েছে। এটা আমাদের ভাষার খুবই গৌরবের বিষয়। পৃথিবীর অনেক দেশের ভাষায়ই এমনটা নেই। সাধু রীতি যেন মরে না যায়, বাংলা একাডেমিকে সে জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’ এ জন্য তিনি বছরে অন্তত একটি হলেও সম্পূর্ণ সাধু রীতিতে লেখা গল্প, প্রবন্ধের সংকলন বা পত্রিকা প্রকাশের সুপারিশ করেন। একই সঙ্গে প্রযুক্তি ও সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বয় করে কম্পিউটারে প্রয়োগের উপযোগী ফন্ট, বানান সংশোধনসহ কারিগরি বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণেরও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

স্বাগত বক্তব্যে মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘বাংলা একাডেমি গত ৭০ বছরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, মননশীলতা ও গবেষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের ভূমিকা পালন করেছে। দেশের ও দেশের বাইরের বাংলাভাষী মানুষের কাছে অনেক ভালোবাসা ও গভীর আস্থা অর্জন করেছে। এ জন্য বাংলা একাডেমির প্রতি তাঁদের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। তবে যে ধরনের রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করতে হয় এবং রাজনৈতিকভাবে অনেক সময় যেমন চাপ প্রয়োগ করতে হয়, তাতে জনগণের সেই প্রত্যাশা যথাযথভাবে পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিশেষ করে বাংলা একাডেমির ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, এই প্রতিষ্ঠান আর পাঁচ-দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। এর আজকে যে নাম–যশ, মানুষের যে আস্থা, তা রাতারাতি হয়নি। বহু মানুষের বুদ্ধি, আবেগ, শ্রম এর সঙ্গে যুক্ত। এই অতীত ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে একাডেমিকে ভবিষ্যতের জন্য উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’ তিনি একাডেমির শুরু থেকে অদ্যাবধি যাঁরা যেভাবে একাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে অনেক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বাংলা একাডেমিকে চলতে হয়েছে। এটা ঠিক যে ভাষাকে অবলম্বন করেই আমাদের জাতীয়তাবোধের উন্মেষ হয়েছিল। সে সময় মুসলিম লীগের রাজনীতি ছিল পাকিস্তানি জাতীয়তার পক্ষে। সেই পরিস্থিতিতে বাংলা একাডেমির কাজ করার সুযোগ ও সামর্থ্য কম ছিল। যাঁরা বাংলা নিয়ে কাজ করার কথা ভেবেছেন, তাঁদের অনেক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এর মধ্যেও প্রথম পরিচালক (এখন মহাপরিচালক) হিসেবে ড. মুহম্মদ এনামুল হক এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো মানুষেরা যেভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য একাডেমির কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন, সে জন্য তাঁদের প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে।’

সভাপতি আরও বলেন, ‘বাংলা একাডেমি মূলত ১৯৬৯ সালের অসহযোগ আন্দোলন ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কাল থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে কাজ করতে পেরেছে। তবে আমরা এখন চিন্তাচেতনা, সাহিত্য–সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের শূন্যতার মধ্যে পড়েছি। এই অবস্থা থেকে আমাদের উঠতে হবে। এ জন্য বাংলা একাডেমিসহ লেখক, সাহিত্যিক, গবেষক, রাজনীতিক সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ