শাসক যখন চেয়ারে বসেন, তার চোখ মাছের চোখের মতো জ্বলজ্বলে হয়ে যায়। চেয়ারটি স্থির থাকে। শাসক কথা বলার সময় হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলেন। যেন এই জগৎ–সংসারে তার পূর্ববর্তী শাসকেরা যেসব ভুল করে গেছেন, তিনি তা শোধরাতে এসেছেন। শাসকের কথা শুনলে মনে হয়, তিনি কোনো ভুল করতে পারেন না। তার বর্ণনায় যেকোনো শাসক বড় দুর্বল প্রমাণিত হয়। কিন্তু আমার ভালো লাগে তার চেয়ার। একদিন চেয়ারটি খালি পেয়ে বসে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারটি ঘুরতে শুরু করল। দেখলাম জগৎ ঘুরছে। আমার চিৎকার শুনে ধীরে–স্থিরে শাসক ঘরে প্রবেশ করলেন।
‘চেয়ারটি কেমন?’
‘আগে ঘূর্ণন থামান, তারপর বলছি।’
‘আমি আগেই জানতাম, তুই এই চেয়ারে বসতে চাস। শাসক হতে চাস। আমি যখন কথা বলি, তুই আমার কথা না শুনে চেয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকিস, তখনই বুঝতে পারি।’
‘আপনি ভুল জানেন, আমি এই চেয়ারে বসতে চেয়েছি ঠিকই, শাসক হতে চাইনি।’
‘এই চেয়ারে কেবল একজন শাসক বসতে পারেন।’
‘কিন্তু এর আগে আমি আপনার ছেলেকে বসতে দেখেছি, মেয়েকে বসতে দেখেছি। তাদের তো কোনো সমস্যা হয়নি।’
‘ওদের নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস তোকে কে দিল? এটা নিয়ে প্রশ্ন তুললে জনগণ প্রশ্ন তুলবে?’
‘আমিও তো জনগণ।’
‘না, তুই জনগণ না, আমার কর্মচারী।’
‘আপনার চেয়ারের দোহাই লাগে চেয়ারের ঘূর্ণন থামান।’
‘তোর চোখমুখ দিয়ে যখন রক্ত উঠবে, তখন চেয়ার থেমে যাবে। এক ফোঁটা রক্ত চেয়ারে পড়তে দে। চিৎকার কর। কেউ তোর চিৎকার শুনবে না। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিয়েছি, যাতে বাইরে থেকে আর কেউ তোর চিৎকার শুনতে না পায়। চিৎকার মানুষের হৃদয়ে খুব সহজে পৌঁছে যায়। এটা তো হতে দেওয়া যাবে না।’
‘শাসক, আমার কথা বোঝার চেষ্টা করুন। আমি খুব বেশি সময় কাঁদতে পারি না। আমার শরীর থেকে সহজে রক্তও বের হয় না।’
‘ও তা–ই। তাহলে তো তোকে বাঁচার একটা উপায় খুঁজে দিতেই হয়। নে, এবার হাসতে থাক। পারবি না?’
‘পারব।’
শাসকের কথা শুনলে মনে হয়, তিনি কোনো ভুল করতে পারেন না। তার বর্ণনায় যেকোনো শাসক বড় দুর্বল প্রমাণিত হয়। কিন্তু আমার ভালো লাগে তার চেয়ার। একদিন চেয়ারটি খালি পেয়ে বসে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারটি ঘুরতে শুরু করল। দেখলাম জগৎ ঘুরছে। আমার চিৎকার শুনে ধীরে–স্থিরে শাসক ঘরে প্রবেশ করলেন। ‘চেয়ারটি কেমন?’আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম। মনে হলো আমার মা একটি ঘুঙুর বাজাচ্ছেন। আমি হাসছি। বাবা বাজার থেকে আষাঢ় মাসের আম নিয়ে ফিরছেন। মা সেই আম কাটছেন। তার চোখ চিকচিক করছে। আমি ভাবলাম আর হাসলাম। আমার শাসক দরজা-জানালা সব খুলে দিলেন। অনেক মানুষ জড়ো হলো ঘরের ভেতর। আমাকে চেয়ারে বসা দেখে তারা শাসকের মহানুভবতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। হাততালির শব্দ পড়ল। শাসকের চেয়ারে আমি তখনো ঘুরছি। আমার ছবি তোলা হলো। ভিডিও করা হলো। আমি তখনো ঘুরছি। আমার আর হাসি আসছিল না। এবার আমি এক গ্লাস রক্ত চাইলাম। শাসকের আগের শর্তে ফিরে যেতে চাইলাম। আমার পূর্বনারীদের মতো, পূর্বপুরুষদের মতো। মনে হলো শাসকের আগের শর্তই ভালো ছিল। এক গ্লাস রক্ত চাইলাম, যাতে চেয়ারে ঢেলে দিতে পারি। কিন্তু তারা ভাবল, আমি পানি চাচ্ছি। শাসক বলল ফলের রস দিতে। কালো জামের রস আনা হলো আমার জন্য। ভাবলাম, চেয়ারের ঘূর্ণন থামিয়ে আমাকে নামিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু কেউ আমাকে নামাল না। তারা ঘূর্ণন থামার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। মনো হলো আমি একাই দুটি মোরগে পরিণত হলাম। একটি মোরগ আরেকটি মোরগকে ঠোকর দিয়ে যেমন রক্তাক্ত করে, এবার নিজেই নিজেকে সেভাবে রক্তাক্ত করার পালা। নিজেকে ঠোকরাতে থাকলাম, রক্ত বের হয়ে শরীরেই শুকিয়ে গেল, চেয়ারে পড়ল না। আমি চোখ বন্ধ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কিছু সময়ের মধ্যেই অচেতন হলাম। মানুষের হাসি কিংবা হাততালির শব্দ আমার কানে পৌঁছাতে পারল না। এরপর নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটি ধবধবে পরিষ্কার বিছানায়। শাসকের হাতে কালো জামের রসভর্তি গ্লাস। তিনি আমাকে এক গ্লাস জামের রস পান করালেন। এ জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
শাসক একা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। বলে চললেন, ‘বাইরে ঝড় হয়েছে। ঝড়ের পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্তু এই ঝড়ে অনেক পাখির ডানা ভেঙে গেছে। অনেক পাখি পালক হারিয়েছে। কোনো কোনো পাখির বাসা ভেঙে পড়েছে। মৃত ছানাদের জন্য ছটফট করছে মা পাখি। স্কুলগামী ছেলেটা জুতার ফিতাটা আরও ভালোভাবে গিঁট দিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ঝড় হলে আয়নাগুলো আরও স্বচ্ছ হয়। হয়েছেও তা–ই।’
‘আপনার চোখও স্বচ্ছ হয়েছে।’
‘বলছিস?’
‘জি।’
‘তাহলে এবার আমি তোকে আমার চেয়ারে বসতে দেব। অল্প সময়ের জন্য বসলেই দেখবি অসংখ্য চোখ। চোখগুলো ঘৃণায় ভরা, অথচ তারা ভালোবাসার গল্প বলছে।’
‘না, না, আমি আর ওই চেয়ারে বসতে চাই না।’
‘বোকা, চেয়ারে বসে সামনে হেলে পড়েছিলি কেন?’
‘আপনিও তো হেলে বসেন। তাতে তো কোনো সমস্যা হয় না।’
‘শোন, আমি এমন এক শহরে বড় হয়েছি, যে শহরটি অনেক পুরোনো স্থাপনা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটা স্থাপনা আরেকটা থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। তাই কখনো কোনো স্থাপনা ভেঙে পড়লে পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারত না। একবার ভূমিকম্প হলো। পুরো শহর কেঁপে উঠল। স্থাপনাগুলো ভেঙে গেল। মানুষগুলো সেই সব স্থাপনার ভেতর থেকে বের হয়ে এল কাটা হাত, পা, মাথা, কপাল নিয়ে, আর মৃতরা পড়ে রইল ধ্বংসস্তূপের ভেতর। শহরের বুকের এক পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটিতে তখন স্রোত আরও বেগবান হলো। তবু লাশগুলো পড়ে রইল। আমার পিতা তখন ওই শহরের শাসক ছিলেন। সেই লাশ উদ্ধার না করে শহরটি ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। বললেন, “শহরে আপাতত কোনো মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। এটি এখন থেকে জাদুঘর হিসেবে বেবেচিত হবে।” আমরা বিশ্বাস করলাম। জাদুঘর দেখাশোনার জন্য লোক নিয়োগ দেওয়া হলো। তারা দিনরাত পরিশ্রম করে সেই পরিত্যক্ত শহরে ফুল ফোটাল। আমরা ভুলে গেলাম, ধ্বংসস্তূপের নিচে শুধু লাশ ছিল না, অনেক জীবিত মানুষও ছিল।
‘শহরটি যেদিন ধসে পড়েছিল, আমি সেদিন শহরে ছিলাম না, পিতার সঙ্গে দূরে ভ্রমণে গিয়েছিলাম। এসে দেখি, আমাদের প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে মা নেই। মায়ের পায়ের জুতা জোড়া একটা জায়গায় পড়ে আছে। মাকে টেনেহিঁচড়ে হয়তো কোনো ধ্বংসস্তূপের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়েছে। মাকে হত্যা করে জনগণ তাদের দুঃখ ভোলার চেষ্টা করেছে।‘শহরটি যেদিন ধসে পড়েছিল, আমি সেদিন শহরে ছিলাম না, পিতার সঙ্গে দূরে ভ্রমণে গিয়েছিলাম। এসে দেখি, আমাদের প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে মা নেই। মায়ের পায়ের জুতা জোড়া একটা জায়গায় পড়ে আছে। মাকে টেনেহিঁচড়ে হয়তো কোনো ধ্বংসস্তূপের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়েছে। নয়তো এই ধ্বংসের দায় আমার পিতার ওপর চাপিয়ে মাকে হত্যা করে জনগণ তাদের দুঃখ ভোলার চেষ্টা করেছে। আমার পিতা আমাকে বললেন, “শাসকের চেয়ার সব সময় ঘূর্ণনশীল। এটাকে আয়ত্তে রাখতে না পারলে চেয়ারই শাসকের হাড়, মাংসসহ খেয়ে ফেলে।” আমাকে তিনি একটি ঘূর্ণনশীল চেয়ারে বসতে অভ্যস্ত করে তুললেন। প্রথমে মাথা ঘুরত, বমি হত। রক্তবমি হলে দেখতাম চেয়ারটি থেমে যাচ্ছে। পিতা বললেন, “হাসতে শেখো।” আমি হাসতে শিখলাম। ধীরে ধীরে চেয়ারটি আমার বশে এল। কিন্তু সেই ধ্বংসস্তূপ তৈরি হওয়ার পেছনে পিতার দায় ছিল কি না, বলতে পারলাম না। আমি ঘুমিয়ে পড়লেই আমার পিতা কোথায় যেন চলে যেতেন। ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মায়ের কোনো একটি শাড়ির আঁচল নিজের মাথায় টেনে বলতেন, “তোমাকে আজও পেলাম না।” শাসকের দুঃখ বড় গোপন। যে নিজের দুঃখ গোপন করে সে–ই শাসক।
‘আর ইতিহাস? সে তো সব সময় কমপক্ষে তিনটি রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়। জনগণ বেশি হলেও দুটি রাস্তা ব্যবহার করে। আর শাসক ইতিহাস মুছে দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করে। মানুষ ইতিহাস ভুলে না থাকলে তাকে শাসন করা গেলেও শোষণ করা যায় না।’
‘সেই শহর এখন কোথায়?’
‘আমার পিতা তার লাল ডায়েরিতে নিজ হাতে লিখেছিলেন, “ধ্বংসস্তূপের ওপর আরেকটি শহর গড়ে তুলতেই হবে। ইতিহাস থেকে মানুষের দূরত্ব তৈরি করার জন্য এটা প্রয়োজন।”’
এ কথা শোনার পর আমার পা শিরশির করে উঠল। আমি সেই পুনর্নির্মিত শহরে বসবাস করছি, যে শহরের নিচে একটি ধ্বংসস্তূপ রয়েছে। আর ভাবতে পারছিলাম না।
শাসক বললেন, ‘ওই শহরে প্রবেশের একটা পথ রয়েছে। আজ তোকে সেই শহরে নিয়ে যাব।’
‘না, আপনি আমাকে আর ফিরতে দেবেন না।’
‘এমনও তো হতে পারে, তুই নিজেই আর ফিরতে চাইবি না।’
এদিকে শাসক নিজ হাতে আমাকে কালো জামের রস পান করাচ্ছেন, সেই ছবি পত্রিকায় ছাপা হলো। ভিডিও টিভিতে দেখানো হলো। মানুষ আমাকে বলল, ‘আরে তুই তো সৌভাগ্যবান।’
আমি সেই ধ্বংসস্তূপ দেখতে চাই কি না, সেই বিষয়ে শাসক আমাকে আগামী জন্মদিন পর্যন্ত ভেবে সিদ্ধান্ত জানাতে বললেন। শাসকের পিতার লেখা ডায়েরিটা পড়তে চাইলাম। তিনি নিরাশ করলেন না। হাতে পেয়ে পড়লাম। এমন এক পিচ্ছিল রাস্তার বর্ণনা সেখানে আছে, যেই রাস্তায় চলার সময় তিনি তার ছেলের হাত ধরেছিলেন। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম, যাব। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম যাব না। এভাবে একেকবার একেক ভাবনা এসে আমাকে উলট-পালট করে দিয়ে যাচ্ছিল। একদিন ঘরে এসে শুনি, মেঝের মাটি ধসে আমার স্ত্রী, সন্তান মাটির গর্তে ঢুকে গেছে। এবার আর আমার না বলার উপায় থাকল না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম র প ত জ ম র রস প রব শ আম র ক র ভ তর র জন য বলল ন ই শহর পড়ল ম শ করল
এছাড়াও পড়ুন:
জনগণ দায়িত্ব দিলে বিএনপি আবার দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত: তারেক রহমান
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দুর্নীতি লাখো মানুষের প্রতিদিনের জীবনকে দম বন্ধ করে ফেলেছে। বহু বছর অব্যবস্থাপনার পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই অবশ্যই কঠিন হবে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসই প্রমাণ করে, যখন সৎ নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা ও জনগণের সমর্থন একসঙ্গে আসে, তখন পরিবর্তন অসম্ভব নয়। জনগণ যদি দায়িত্ব দেয়, বিএনপি আবার সেই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত।
আজ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা বলেন। তিনি তাঁর পোস্টে দুর্নীতির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিএনপি কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে, সে বিষয় নিয়েও লেখেন তিনি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তাঁর পোস্টে লিখেছেন, ‘দুর্নীতি কীভাবে বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দিচ্ছে, তা বুঝতে দূরে যাওয়ার দরকার নেই। মেধার ভিত্তিতে চাকরি খুঁজতে বের হওয়া একজন গ্র্যাজুয়েটের সঙ্গে কথা বললেই বুঝবেন। মাসের পর মাস ধরে একটি সাধারণ সরকারি সেবা পেতে হিমশিম খাওয়া কৃষকের দিকে তাকান। হাসপাতালে গিয়ে এক তরুণের পরিবার কীভাবে ভোগান্তিতে পড়ে, সেটা শুনুন। অথবা ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখতে ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়া উদ্যোক্তাদের ভোগান্তি দেখুন।’
দুর্নীতি লাখো মানুষের প্রতিদিনের জীবনকে দম বন্ধ করে ফেলেছে বলে উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, খাবারের দাম কেন বাড়ে, স্কুলে ভালো পড়াশোনা কেন মেলে না, রাস্তায় কেন নিরাপত্তা নেই—সবকিছুর পেছনে সেই একই কারণ, দুর্নীতি।
বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই নতুন নয় বলে উল্লেখ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা বহু যুগের আলোচনার বিষয়। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস আমাদের সেই লড়াইয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, আর মনে করিয়ে দেয় সেই সময়টাও, যখন বাংলাদেশ সত্যিকারের অগ্রগতি করেছিল। আর সেই সময়টা এসেছে মূলত বিএনপির আমলে।’
তারেক রহমান বলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানো, পরিচ্ছন্ন সরকারি সেবা আর অর্থনীতিকে মুক্ত করার কাজে হাত দিয়েছিলেন, যা অনিয়ম-ক্ষমতার অপব্যবহার কমিয়ে দিয়েছিল। তারপর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে আধুনিকায়ন শুরু হয়। নতুন ক্রয় নীতিমালা, কঠোর আর্থিক আইন, শক্তিশালী অডিট ব্যবস্থা, আর স্বচ্ছ নজরদারি কার্যকর করা হয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল ২০০৪ সালে দুদক গঠন। এটি এমন এক স্বাধীন কমিশন, যেখানে সরকার চাইলে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বিশ্বব্যাংক, এডিবি—সবাই বলেছিল, এটি বাংলাদেশের জবাবদিহির বড় অগ্রগতি।
তারেক রহমান বলেন, টিআইবির জরিপেও দেখা গেছে, ২০০২ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। মানুষ নিজেরাই বলেছে, দুর্নীতি কমেছে। এটা কোনো গল্প নয়, এটা তখনকার সংস্কারের প্রমাণ।
তারেক রহমান উল্লেখ করেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বাজেট নিয়ন্ত্রণ, অডিট, ব্যাংকিং ও মানি লন্ডারিংবিরোধী আইন প্রণয়নের মাধ্যমে শক্তিশালী অর্থ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ও নিয়মের মধ্যে সরকারি স্বচ্ছ ক্রয়নীতি চালু করে, যা পরবর্তী সময়ে দেশের সবচেয়ে বড় স্বচ্ছতার আইনের ভিত্তি তৈরি করে। টেলিকম, মিডিয়া, বিমান পরিবহন খাতে উন্মুক্ত বাজার গড়ে তোলে প্রতিযোগিতা বাড়ানো হয়। ফলে দুর্নীতি কমে, সাধারণ মানুষের সুযোগ বাড়ে। এ ছাড়া প্রশাসনের জটিলতা কমিয়ে এবং জবাবদিহি বাড়ানোর মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশে এমন কিছু বড় পরিবর্তন ঘটেছে, যার জন্য তাঁর দল গর্ব করতে পারে। দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে ধারাবাহিক রেকর্ড একমাত্র বিএনপিরই আছে।
আগামী দিনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরও শক্তভাবে চালাতে বিএনপির কিছু পরিকল্পনা তুলে ধরেন তারেক রহমান। সেগুলো হলো—
১. প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা: আদালত, দুদক, নির্বাচন কমিশন, সরকারি সেবা; কেউই যেন রাজনৈতিক চাপের মধ্যে না থাকে।
২. পুরোপুরি স্বচ্ছতা: উন্মুক্ত দরপত্র, সম্পদ বিবরণী, রিয়েল–টাইম অডিট ও শক্তিশালী তথ্য অধিকার আইন।
৩. বিচার ও আইনশৃঙ্খলা সংস্কার: পেশাদার পুলিশিং, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি ও ডিজিটাল তথ্যপ্রমাণ।
৪. ই-গভর্ন্যান্স: লাইসেন্স, জমি, পেমেন্ট—সব অনলাইনে এনে ঘুষের সুযোগ কমানো (বিশ্বমান অনুযায়ী ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ দুর্নীতি কমতে পারে)।
৫. হুইসলব্লোয়ার সুরক্ষা: অনিয়ম ফাঁস করতে যারা সাহস দেখায়, তাদের নিরাপত্তা প্রদান।
৬. নৈতিক শিক্ষা: স্কুল-কলেজ থেকেই সততার চর্চা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা।
৭. শক্তিশালী আর্থিক নজরদারি: ডিজিটাল ব্যয় ট্র্যাকিং ও স্বাধীন অডিট এবং সংসদের কঠোর তদারকি।