দশম শ্রেণিতে ওঠার আগেই অর্ধেক ছাত্রীর বাল্যবিবাহ, কয়েকটি কারণ বলছে পরিবার
Published: 18th, November 2025 GMT
সাতক্ষীরার সবচেয়ে দক্ষিণের উপজেলা শ্যামনগর। জেলা সদর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা উপজেলাটির ভূদৃশ্য খুবই মনোহর। সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের দোতলা–তিনতলা থেকে চারপাশের বহু দূর পর্যন্ত জলরাশি ও গাছের সারি বাধাহীনভাবে চোখে ধরা পড়ে। উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে তিনতলা ভবনের স্কুলটির অবস্থান মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে।
২২ সেপ্টেম্বর টানা বৃষ্টির মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা থেকে স্কুলটিতে পৌঁছাতে সময় লেগে গেল তিন ঘণ্টা। দুপুর ১২টায় স্কুলে পৌঁছে দেখা যায়, কয়েকটি ক্লাস চলছে। কয়েকটি ক্লাসের মেয়েরা ক্লাস শুরুর অপেক্ষায়। উপস্থিতি কম। দশম শ্রেণির ক্লাসে গিয়ে কথা হয় কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে। তারা জানাল, তাদের ক্লাসে ছাত্রীর সংখ্যা এমনিতেই কম। ফলে উপস্থিতিও কম থাকে।
আরও পড়ুনএসএসসিতে অনুপস্থিতির বড় কারণ বাল্যবিবাহ ১৬ জুন ২০২৫কেন কম জানতে চাইলে চারজন ছাত্রী জানাল, তারা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এই স্কুলে পড়ে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তারা ৪০ জন ছিল। এর মধ্যে ৪ জন অন্য স্কুলে চলে গেছে। বাল্যবিবাহের শিকার একজনসহ দশম শ্রেণিতে ১৭ জন ছাত্রী আছে। ২০ জনের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। অর্থাৎ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে এই ব্যাচের মেয়েদের ৫০ শতাংশের বাল্যবিবাহ হয়েছে। বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের মধ্যে শুধু একজন ক্লাসে ফিরে এসেছে। বাকিদের কেউ কেউ এরই মধ্যে মা হয়েছে।
কেন কম জানতে চাইলে চারজন ছাত্রী জানাল, তারা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এই স্কুলে পড়ে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তারা ৪০ জন ছিল। এর মধ্যে ৪ জন অন্য স্কুলে চলে গেছে। বাল্যবিবাহের শিকার একজনসহ দশম শ্রেণিতে ১৭ জন ছাত্রী আছে। ২০ জনের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। অর্থাৎ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে এই ব্যাচের মেয়েদের ৫০ শতাংশের বাল্যবিবাহ হয়েছে।জেলার দক্ষিণ প্রান্তের উপকূলীয় এই স্কুল শুধু নয়, সাতক্ষীরা শহর ও এর উত্তর প্রান্তের উপজেলার স্কুলগুলোতেও বাল্যবিবাহের একই রকম প্রকোপ। বাল্যবিবাহ নিরোধ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের মতে, এ জেলায় বাল্যবিবাহ হয় না এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে যতসংখ্যক মেয়ে ভর্তি হচ্ছে, দশম শ্রেণিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শুধু বাল্যবিবাহের কারণে ওই ছাত্রীদের ৩০ থেকে ৪৮ শতাংশ ঝরে পড়ছে।
আরও পড়ুনদেশ থেকে বাল্যবিয়ে দূর করতে চায় সাদিয়া ২৬ অক্টোবর ২০২৫২০ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ৪ দিনে জেলার ৭টি স্কুল ও মাদ্রাসা পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া ৪টি স্কুলের তথ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা গেছে, ওই ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। এ বছরও বাল্যবিবাহ হয়েছে। শুধু একটি মাদ্রাসার শিক্ষকেরা দাবি করেন, গত তিন বছরে সেখানে বাল্যবিবাহ হয়নি। যদিও এ দাবি সত্য নয় বলে জানিয়েছেন অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও স্থানীয় অধিকারকর্মীরা।
এক উপজেলায় দেড় শতাধিক বাল্যবিবাহ
শ্যামনগর উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মিনা হাবিবুর রহমান জানান, সেপ্টেম্বর মাসে তাঁরা একটি জরিপ চালিয়ে ধারণা করছেন, শ্যামনগর উপজেলায় চলতি বছরের এ পর্যন্ত অন্তত ১৬০ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। উপজেলায় ৩৬টি মাদ্রাসাসহ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮২টি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমিক স্তরের ১ হাজার ১২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ জন ছাত্রী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই অনিয়মিত। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ ঝরে পড়েছে। এই শিক্ষার্থীদের ২৫ শতাংশ মেয়ে। এর মধ্যে অন্তত ২০ শতাংশ বাল্যবিবাহের শিকার।
বাল্যবিবাহ নিরোধ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের মতে, এ জেলায় বাল্যবিবাহ হয় না এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে যতসংখ্যক মেয়ে ভর্তি হচ্ছে, দশম শ্রেণিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শুধু বাল্যবিবাহের কারণে ওই ছাত্রীদের ৩০ থেকে ৪৮ শতাংশ ঝরে পড়ছে।হাবিবুর রহমান বলেন, বাল্যবিবাহের কারণে দশম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলগুলোতে গড়ে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ এবং মাদ্রাসাগুলোতে ৫০ শতাংশ ছাত্রী থাকে না। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ হার আরও বেশি। শিক্ষকেরা এসে বলেন, ‘স্যার, আমার স্কুলে বাল্যবিবাহ হয়ে যাচ্ছে।’ অভিভাবকদের বলেও কিছু করা যাচ্ছে না। শিক্ষকেরাও নিবেদিতপ্রাণ নন, খোঁজ রাখেন না। এ ছাড়া শিক্ষকেরা এমপিওভুক্তি, উপবৃত্তি বাতিল হতে পারে ভেবে বাল্যবিবাহের খবর খুব একটা প্রকাশ করতে চান না।
হাবিবুর রহমানের মতে, সরকার এই মুহূর্তে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। বাল্যবিবাহ নিবন্ধন না হওয়ায় নির্যাতন বা বিবাহবিচ্ছেদের শিকার হলেও মেয়েরা কোনো আইনি প্রতিকার পায় না।
২০ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ৪ দিনে জেলার ৭টি স্কুল ও মাদ্রাসা পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া ৪টি স্কুলের তথ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা গেছে, ওই ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে।বাল্যবিয়ে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দশম শ র ণ ত স প ট ম বর জন ছ ত র র উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
দশম শ্রেণিতে ওঠার আগেই অর্ধেক ছাত্রীর বাল্যবিবাহ, কয়েকটি কারণ বলছে পরিবার
সাতক্ষীরার সবচেয়ে দক্ষিণের উপজেলা শ্যামনগর। জেলা সদর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা উপজেলাটির ভূদৃশ্য খুবই মনোহর। সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের দোতলা–তিনতলা থেকে চারপাশের বহু দূর পর্যন্ত জলরাশি ও গাছের সারি বাধাহীনভাবে চোখে ধরা পড়ে। উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে তিনতলা ভবনের স্কুলটির অবস্থান মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে।
২২ সেপ্টেম্বর টানা বৃষ্টির মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা থেকে স্কুলটিতে পৌঁছাতে সময় লেগে গেল তিন ঘণ্টা। দুপুর ১২টায় স্কুলে পৌঁছে দেখা যায়, কয়েকটি ক্লাস চলছে। কয়েকটি ক্লাসের মেয়েরা ক্লাস শুরুর অপেক্ষায়। উপস্থিতি কম। দশম শ্রেণির ক্লাসে গিয়ে কথা হয় কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে। তারা জানাল, তাদের ক্লাসে ছাত্রীর সংখ্যা এমনিতেই কম। ফলে উপস্থিতিও কম থাকে।
আরও পড়ুনএসএসসিতে অনুপস্থিতির বড় কারণ বাল্যবিবাহ ১৬ জুন ২০২৫কেন কম জানতে চাইলে চারজন ছাত্রী জানাল, তারা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এই স্কুলে পড়ে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তারা ৪০ জন ছিল। এর মধ্যে ৪ জন অন্য স্কুলে চলে গেছে। বাল্যবিবাহের শিকার একজনসহ দশম শ্রেণিতে ১৭ জন ছাত্রী আছে। ২০ জনের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। অর্থাৎ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে এই ব্যাচের মেয়েদের ৫০ শতাংশের বাল্যবিবাহ হয়েছে। বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের মধ্যে শুধু একজন ক্লাসে ফিরে এসেছে। বাকিদের কেউ কেউ এরই মধ্যে মা হয়েছে।
কেন কম জানতে চাইলে চারজন ছাত্রী জানাল, তারা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এই স্কুলে পড়ে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তারা ৪০ জন ছিল। এর মধ্যে ৪ জন অন্য স্কুলে চলে গেছে। বাল্যবিবাহের শিকার একজনসহ দশম শ্রেণিতে ১৭ জন ছাত্রী আছে। ২০ জনের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। অর্থাৎ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে এই ব্যাচের মেয়েদের ৫০ শতাংশের বাল্যবিবাহ হয়েছে।জেলার দক্ষিণ প্রান্তের উপকূলীয় এই স্কুল শুধু নয়, সাতক্ষীরা শহর ও এর উত্তর প্রান্তের উপজেলার স্কুলগুলোতেও বাল্যবিবাহের একই রকম প্রকোপ। বাল্যবিবাহ নিরোধ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের মতে, এ জেলায় বাল্যবিবাহ হয় না এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে যতসংখ্যক মেয়ে ভর্তি হচ্ছে, দশম শ্রেণিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শুধু বাল্যবিবাহের কারণে ওই ছাত্রীদের ৩০ থেকে ৪৮ শতাংশ ঝরে পড়ছে।
আরও পড়ুনদেশ থেকে বাল্যবিয়ে দূর করতে চায় সাদিয়া ২৬ অক্টোবর ২০২৫২০ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ৪ দিনে জেলার ৭টি স্কুল ও মাদ্রাসা পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া ৪টি স্কুলের তথ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা গেছে, ওই ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। এ বছরও বাল্যবিবাহ হয়েছে। শুধু একটি মাদ্রাসার শিক্ষকেরা দাবি করেন, গত তিন বছরে সেখানে বাল্যবিবাহ হয়নি। যদিও এ দাবি সত্য নয় বলে জানিয়েছেন অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও স্থানীয় অধিকারকর্মীরা।
এক উপজেলায় দেড় শতাধিক বাল্যবিবাহ
শ্যামনগর উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মিনা হাবিবুর রহমান জানান, সেপ্টেম্বর মাসে তাঁরা একটি জরিপ চালিয়ে ধারণা করছেন, শ্যামনগর উপজেলায় চলতি বছরের এ পর্যন্ত অন্তত ১৬০ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। উপজেলায় ৩৬টি মাদ্রাসাসহ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮২টি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমিক স্তরের ১ হাজার ১২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ জন ছাত্রী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই অনিয়মিত। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ ঝরে পড়েছে। এই শিক্ষার্থীদের ২৫ শতাংশ মেয়ে। এর মধ্যে অন্তত ২০ শতাংশ বাল্যবিবাহের শিকার।
বাল্যবিবাহ নিরোধ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের মতে, এ জেলায় বাল্যবিবাহ হয় না এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে যতসংখ্যক মেয়ে ভর্তি হচ্ছে, দশম শ্রেণিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শুধু বাল্যবিবাহের কারণে ওই ছাত্রীদের ৩০ থেকে ৪৮ শতাংশ ঝরে পড়ছে।হাবিবুর রহমান বলেন, বাল্যবিবাহের কারণে দশম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলগুলোতে গড়ে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ এবং মাদ্রাসাগুলোতে ৫০ শতাংশ ছাত্রী থাকে না। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ হার আরও বেশি। শিক্ষকেরা এসে বলেন, ‘স্যার, আমার স্কুলে বাল্যবিবাহ হয়ে যাচ্ছে।’ অভিভাবকদের বলেও কিছু করা যাচ্ছে না। শিক্ষকেরাও নিবেদিতপ্রাণ নন, খোঁজ রাখেন না। এ ছাড়া শিক্ষকেরা এমপিওভুক্তি, উপবৃত্তি বাতিল হতে পারে ভেবে বাল্যবিবাহের খবর খুব একটা প্রকাশ করতে চান না।
হাবিবুর রহমানের মতে, সরকার এই মুহূর্তে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। বাল্যবিবাহ নিবন্ধন না হওয়ায় নির্যাতন বা বিবাহবিচ্ছেদের শিকার হলেও মেয়েরা কোনো আইনি প্রতিকার পায় না।
২০ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ৪ দিনে জেলার ৭টি স্কুল ও মাদ্রাসা পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া ৪টি স্কুলের তথ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা গেছে, ওই ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে।বাল্যবিয়ে