দিনের বেলায় খুব একটা দেখা না গেলেও, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলেই জেগে ওঠে পাবনার সব অবৈধ বালুমহল। সারারাত ধরে চলে নদী থেকে বালু উত্তোলনের মহোৎসব। যত্রতত্রভাবে বালু তোলার কারণে প্রতি বছর নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা।

রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় চলা বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। তারা জানান, আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে বালু উত্তোলন চললেও এখন এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

এলকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মা নদীর পাবনার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের চর ভবানীপুর, দোগাছী ইউনিয়নের চর বলরামপুর, ভাঁড়ারা ইউনিয়নের দড়ি ভাউডাঙ্গি, চরতারাপুর ইউনিয়নের দিঘী গোয়াইলবাড়ি, শুকচর, সুজানগর উপজেলার চর ভবানীপুর, বরখাপুর, উদয়পুর, হাট মালিফা, নাজিরগঞ্জ, সাগরকান্দি, বেড়া উপজেলার ঢালারচর, নগরবাড়ি, চাকলা, ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী, লক্ষীকুণ্ডা এলাকাসহ জেলার অন্তত ২০টি পয়েন্টে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে। বালুবাহী ট্রাকগুলো জেলা শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনের সামনে দিয়েই বাধাহীনভাবে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে।

আরো পড়ুন:

বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অবরুদ্ধ

নোয়াখালীতে ইউপি সদস্যকে মারধর করল যুবদল-ছাত্রদল

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষক বলেন, ‍“গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর সম্প্রতি কিছুদিন বালু উত্তোলন বন্ধ ছিল। গত এক সপ্তাহ ধরে আবার শুরু হয়েছে। কৌশল পাল্টিয়ে এখন দিনের বদলে রাতে তোলা হচ্ছে বালু। আগে এইসব বালু মহলে নেতৃত্ব দিতেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা, ৫ আগস্টের পর তারা পালিয়ে যাওয়ার পর এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় চলছে বালু উত্তোলন।”

রাতে বালু পরিবহন করা হয় ট্রাকে 

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, প্রতিদিন একেকটি পয়েন্টে ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বালু বিক্রি হয়। সবমিলিয়ে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার বালু বিক্রি হয়। বালু বিক্রির টাকার একটি অংশ চলে যায় স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিভিন্ন মহলের পকেটে। ফলে মাঝে মধ্যে জেলা বা উপজেলা প্রশাসন দুই-একটি লোক দেখানো অভিযান চালালেও বেশিরভাগই থাকে নজরের বাইরে।

চর ভবানীপুর এলাকার কৃষক সাঈদ প্রামাণিক ও এস্কেন্দার হোসেন জানান, আগে নদী শুকিয়ে গেলে জেগে ওঠা চরে বাদামসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করতেন তারা। গত কয়েক বছর ধরে তারা ফসল আবাদ করতে পারছেন না। নদী শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বালু উত্তোলন শুরু হয়। ফসলি জমি নষ্টের পাশাপাশি রাস্তাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছেন সবাই। কিছু বলতে গেলে বালু উত্তোলনকারীরা হুমকি দেন। এ বিষয়ে স্থানীয় লোকজন প্রশাসনকে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পুলিশ প্রশাসনই যদি তাদের (বালু উত্তোলনকারী) সহযোগিতা করে তাহলে কে সহযোগিতা করবে?

এ বিষয়ে জানতে চর তারাপুর ও ভাঁড়ারা এলাকার কয়েকজন বালু ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তারা বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

বালু উত্তোলনে দলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে পাবনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, “এটা তো বহুদিন ধরেই চলে আসছে। এখন হয়তো লোকালি ওরা করে, কিন্তু সাংগঠনিকভাবে তো হচ্ছে না। এ বিষয়ে এতো ব্যস্ত হওয়ার কি আছে।”

তিনি আরো বলেন, “আওয়ামী লীগের আমলে কি বালু তোলা হয়নি? তখন কি সাংবাদিকরা নিউজ করেছে? তখন কোথায় ছিল তারা? তারপরও এগুলো তো প্রশাসন দেখে, আমরা হয়তো ওইভাবে দেখি না বা করিও না।”

নিজেদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে পাবনা পুলিশ সুপার মোরতোজা আলী খান বলেন, “এটা তো লোকজনের বক্তব্য। আপনাদের এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও নৌ-পুলিশকে ধরতে হবে। এসব বিষয়ে মূল কাজটা তাদের। অভিযানের জন্য যদি জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে আমাদের কাছে ফোর্স চায়, আমরা ফোর্স দিয়ে দেই। আমার জানা মতে, আগে যেভাবে বালু উত্তোলন হতো, এবার তা হচ্ছে না।”

পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আপনার মাধ্যমেই জানলাম। এছাড়া দুই-একটা মাধ্যমেও শুনেছি যে রাতে বালু তোলা হচ্ছে। আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) বলে দিয়েছি। তারা ইতোমধ্যে কয়েকটি মোবাইল কোর্ট (ভ্রাম্যমাণ আদালত) পরিচালনা করেছে। আরো মোবাইল কোর্ট অব্যাহত থাকবে।”

ঢাকা/মাসুদ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র ন ত কর ম উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

গন্ধগোকুলের বাঁচার লড়াই

দেশের অনেক এলাকা থেকেই গন্ধগোকুল হারিয়ে গেছে; কিন্তু পাবনার বেড়া পৌর এলাকার কয়েকটি মহল্লায় এখনো এ প্রাণীর বিচরণ চোখে পড়ে। তবে আগের মতো অত বেশি দেখা যায় না। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোটের (আইইউসিএন) তালিকা অনুযায়ী এগুলো ‘বিপদাপন্ন’ প্রাণী।

প্রাণীটির আসল নাম গন্ধগোকুল হলেও বেড়া উপজেলায় এটি ‘নেল’ নামে পরিচিত। অনেকে এগুলোকে বাগডাশও বলেন। এর শরীর থেকে পোলাও চালের গন্ধের মতো মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়। সন্ধ্যার পর অন্ধকার নামলে পৌর এলাকার বিভিন্ন বাড়ির ঘরের চাল ও গাছের ওপর দিয়ে শুরু হয় এর চলাচল। এ সময় এর শরীরের গন্ধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি থেকে রস নিঃসৃত হতে থাকে বলে যে স্থান দিয়েই এরা যাক না কেন, বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেখানে সেই গন্ধ নাকে আসে। তখন মহল্লার বাসিন্দারা বুঝতে পারেন, আশপাশে হয়তো গন্ধগোকুল আছে, নয়তো একটু আগেই আশপাশ দিয়ে গেছে।

দীর্ঘদিন ধরেই গন্ধগোকুল বা নেল নামের প্রাণীটির সঙ্গে বেড়া পৌরবাসীর সম্পর্ক। বেশির ভাগ বাসিন্দার কাছেই প্রাণীটি বেশ পছন্দের। তবে অল্প কিছু মানুষ এগুলোকে অপছন্দ করেন গৃহপালিত হাঁস-মুরগি, কবুতর ধরে নিয়ে যাওয়ার কারণে। তবে গত ১০-১২ বছরের মধ্যে পৌরবাসী এই প্রাণীকে ফাঁদ পেতে ধরেছেন বা এগুলোর কোনো ক্ষতিসাধন করেছেন বলে শোনা যায় না।

বন্য প্রাণী ও পরিবেশবিশেষজ্ঞদের মতে, গন্ধগোকুল প্রকৃতির উপকারী একটি নিশাচর প্রাণী। গন্ধগোকুল ব্যাঙ, ইঁদুরসহ ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধিতে দারুণ ভূমিকা রাখে; কিন্তু ভুল ধারণার কারণে অনেকেই প্রাণীটির জীবন হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। একটি সময় ছিল, যখন এগুলোকে দেশের প্রায় সর্বত্রই— বনাঞ্চল বা বনসংলগ্ন ঝোপঝাড় বা গ্রামাঞ্চলে দেখা যেত। তবে এখন এগুলো বিলুপ্তির পথে।

গন্ধগোকুল তাল ও খেজুরের রস পান করে, ইঁদুর, ছোট পাখি ও পোকামাকড় প্রভৃতি খেয়ে জীবনধারণ করে; কিন্তু কখনো কখনো গৃহপালিত হাঁস-মুরগি বা কবুতর ধরে নিয়ে যায় বলে মানুষ এগুলো ফাঁদ পেতে ধরে হত্যা করে। আবার অনেক সময় রাস্তা পারাপারের সময় গাড়িচাপায়ও মারা যায়। এতে এগুলোর অস্তিত্ব কিছুটা হুমকির মুখে পড়েছে। এগুলোকে বিপদাপন্ন বলা যেতে পারে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গন্ধগোকুলের রয়েছে বিশেষ এক ভূমিকা। খাদ্যশৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান প্রাণীটির। এগুলো মূলত ক্ষতিকর পোকামাকড় ও ফলমূল খেয়ে এর বীজ বিস্তারের মাধ্যমে পরিবেশের প্রচুর উপকার সাধন করে। যেমন বটের ফল বা অন্যান্য ফল যখন খায়, তখন এর মলের দ্বারা নির্গত সেই বীজগুলো সফল উদ্ভিদে পরিণত হয়। অর্থাৎ এর পেটের ভেতর দিয়ে ফলের বীজগুলো গজানোর উপযুক্ত পরিবেশ (জার্মিনেশন) পায় বলে তা পরবর্তী সময়ে বীজের অঙ্কুরোদ্‌গমে শতভাগ কার্যকর হয়ে থাকে।

বছরে সাধারণত দুবার প্রজনন করে। গর্ভধারণকাল দুই মাসের কিছু বেশি। পুরোনো গাছের খোঁড়ল, গাছের ডালের ফাঁক, পরিত্যক্ত ঘর, ধানের গোলা বা তাল-সুপারির আগায় ছানা তোলে। সাধারণত প্রতিবারই ছানা হয় তিনটি।

বেড়ার মনজুর কাদের মহিলা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, ‘দেশের অনেক এলাকা থেকেই গন্ধগোকুল বিলুপ্ত হতে বসেছে। তবে বেড়া পৌর এলাকায় এগুলোর বিচরণ যেমন কিছুটা বেশি, তেমনি পৌরবাসীও এগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল।’

প্রাণীটির ছবি তুলে রাজশাহী বিভাগীয় বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবিরের কাছে পাঠালে তিনি সেটিকে ‘বাগডাশ’বলে শনাক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘প্রাণীটির অস্তিত্ব এখনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় আছে। এর মধ্যে বেড়া পৌর এলাকায় এগুলোর বিচরণ কিছুটা বেশি বলে শুনেছি।’

বেড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, বাগডাশ বা গন্ধগোকুল মানুষের কাছাকাছি থাকে; কিন্তু মানুষ দেখলে খুবই ভয় পায়। খুবই লাজুক স্বভাবের প্রাণী এটি। আবাসভূমি ধ্বংস ও হাঁস-মুরগি বাঁচানোর জন্য ব্যাপক নিধনের কারণে এগুলো এখন বিপন্ন। তবে প্রাণীটি কিন্তু প্রকৃতির বন্ধু। তাই সবারই উচিত এগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া।

সম্পর্কিত নিবন্ধ