‘ভোট দিলাম সন্দ্বীপে, এমপি পেলাম মালদ্বীপে’ বনাম ‘যার যত ভোট, তার তত আসন’
Published: 10th, July 2025 GMT
গ্রামীণ একটি পরিবেশে তিন ব্যক্তি বসে আলাপ করছেন। একজন জিজ্ঞাসা করছেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনটা কেমন হয়?’ পাশেরজন উত্তর দিচ্ছেন, ‘ভোট দিলাম সন্দ্বীপে, এমপি পেলাম মালদ্বীপে।’ এরপর তিনজনই হেসে উঠলেন। ভিডিওর মানুষগুলো কোনো বাস্তব চরিত্র নন। তাদের তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্যে।
আরেক ভিডিওতে এক এআই চরিত্র বলছে, ‘আনুপাতিক মানে যার যত ভোট, তার তত আসন।’
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে নানা প্রচারণা দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই প্রচারণার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও। তথ্য যাচাইয়ের (ফ্যাক্ট চেক) উদ্যোগ ডিসমিসল্যাবের সম্প্রতি এসব ভিডিও নিয়ে এক গবেষণায় এ কথা জানিয়েছে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ১৩টি ভিডিও বিশ্লেষণ করেছে ডিসমিসল্যাব। তাদের গবেষণা বলছে, ভিডিওগুলোর মধ্যে অনেকগুলো তৈরি করা হয়েছে গুগলের ভিডিও তৈরির টুল ‘ভিও’ দিয়ে। এসব ভিডিওর মধ্যে পিআর পদ্ধতির পক্ষে ৩টি এবং বিপক্ষে ১০টি ভিডিও রয়েছে।
পিআর পদ্ধতির পক্ষে যা বলা হচ্ছে
ডিসমিসল্যাব বলছে, একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক এআই চরিত্র পিআর পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলে, ‘আনুপাতিক মানে যার যত ভোট, তার তত আসন।’ উত্তরে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘ও, তাই নাকি? এইটা তো ইনসাফ।’ ৩০ জুনের আরেকটি ভিডিওতে এআই দিয়ে তৈরি এক তরুণ ও একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে আলাপচারিতা দেখা যায়। শুরুতে তরুণ বলে, ‘দাদা, আমি প্রত্যেকবার ভোট দিই, কিন্তু আমার ভোটটা নষ্ট হয়ে যায়।’ উত্তরে অপর ব্যক্তি বলেন, ‘কারণ, আমরা পিআর সিস্টেমে ভোট দিচ্ছি না। যদি পিআর সিস্টেমে নির্বাচন হয়, প্রতিটি ভোটের হিসাব থাকে, প্রতিটি দল সংসদে অংশ পায়।’
বিপক্ষে যেসব যুক্তি
পিআর পদ্ধতির নির্বাচনী ব্যবস্থার বিপক্ষের ভিডিওগুলোর বেশির ভাগই ব্যঙ্গাত্মকভাবে তৈরি বলে জানিয়েছে ডিসমিসল্যাব। পিআর পদ্ধতির পক্ষে পোস্ট হওয়া ভিডিওগুলোর প্রতিটিতে একাধিক দৃশ্য দেখা গেলেও, এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে হওয়া ভিডিওগুলোতে একক দৃশ্য দেখা যায়।
১ জুলাইয়ের একটি ভিডিওতে ডিসমিসল্যাব দেখেছে সেখানে এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘অযোগ্যরা করছে জোট, পিআর পদ্ধতিতে দিতে ভোট । ভোট দিব নোয়াখালী, এমপি হবে পটুয়াখালী।’ ভিডিওটির নিচে ডান কোণে ‘ভিও’র লোগো দেখা গেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, এসব ভিডিওর মাধ্যমে এমন যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে একটি নির্দিষ্ট আসনের ভোটাররা নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচন করতে পারবেন না। রাজনৈতিক দল তাদের মোট প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে এলাকার সংসদ সদস্য নির্বাচন করে দেবে।
২ জুলাইয়ের ভিডিও বিশ্লেষণ করে ডিসমিস্যল্যাব দেখেছে, সেখানে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনকে এইচএসসি পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে ফেল করার পরও মোট নম্বরের ভিত্তিতে পাস হয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলো আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকবেন না। ভোটাররা দলীয় প্রতীকে ভোট দেবেন। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদের আসন বণ্টন করা হবে।
আরও পড়ুনআলোচনায় আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন১৫ অক্টোবর ২০২৪.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসন ‘স্থায়ীভাবে স্থগিত’ করায় কী প্রভাব পড়বে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বৃহস্পতিবার রাতে ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি ‘তৃতীয় বিশ্বের সব দেশ’ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন ‘স্থায়ীভাবে স্থগিত’ করবেন। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রশাসনের অভিবাসন দমননীতি আরও কঠোর হলো।
বুধবার ওয়াশিংটন ডিসিতে ন্যাশনাল গার্ডের দুই সদস্যকে গুলি করা হয়। তাঁদের একজন পরে মারা গেছেন। এ ঘটনার পরদিনই ট্রাম্প ওই বক্তব্য দেন। ঘটনাটির প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে একজন আফগান নাগরিকের নাম এসেছে। তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
ট্রাম্প তাঁর মালিকানাধীন সামাজিকমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘আমি তৃতীয় বিশ্বের সব দেশ থেকে অভিবাসন স্থায়ীভাবে স্থগিত করব, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থা পুরোপুরি পুনরুদ্ধার হয় এবং বাইডেন প্রশাসনের আমলে লাখ লাখ মানুষকে দেওয়া অবৈধ প্রবেশের সুযোগ বন্ধ করা যায়।’
‘তৃতীয় বিশ্ব’ বলতে ট্রাম্প কোন কোন দেশকে বোঝাচ্ছেন, তা স্পষ্ট করেননি। সাধারণত এ শব্দগুচ্ছ দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল ‘গ্লোবাল সাউথ’ দেশগুলোকে বোঝানো হয়।
এ নিষেধাজ্ঞা দরিদ্র দেশগুলোকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে, আর যেসব দেশ বিনিময়ে কিছু দিতে পারে, যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ বা কৌশলগত সুবিধা-তাদের ক্ষেত্রে হয়তো শিথিল থাকবে। এমন ঘোষণার মূল লক্ষ্য হলো, সরকারকে কঠোর দেখানো, রাজনৈতিক আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গি বদল, অভিবাসীদের ভয় দেখানো ও তাঁদের মানুষ হিসেবে কম মূল্যবান ভাবার পরিস্থিতি তৈরি করা; বাস্তবে এটি কার্যকর করা যাক বা না যাক এবং আইনগত ফলাফল যা-ই হোক।ট্রাম্প বলেন, যেকেউ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সম্পদ নয় বা আমাদের দেশকে ভালোবাসতে অক্ষম, তাঁকে এ দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন, এমন কাউকে আর কোনো ফেডারেল সুবিধা বা ভর্তুকি দেওয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, ‘যাঁরা অভ্যন্তরীণ শান্তি নষ্ট করেন, এমন অভিবাসীদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে। আর যাঁরা সরকারিভাবে নির্ভরশীল, নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত বা পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নন—এমন বিদেশিদের বহিষ্কার করা হবে।’
চলতি বছর ট্রাম্প ১২টি দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন এবং আরও সাতটি দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা সীমিত করেছেন। বছরজুড়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ওপর আরও নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে তা হলো—
ট্রাম্প প্রশাসন কী বলছে
বুধবার ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে ২৯ বছর বয়সী আফগান নাগরিক রহমানউল্লাহ লাখানওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর ট্রাম্প ঘটনাটিকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে আখ্যা দেন।
সেদিন রাতে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘বাইডেন প্রশাসনের সময় আফগানিস্তান থেকে যেসব বিদেশি যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাপারে আমাদের সবাইকে আবার নতুন করে পরীক্ষা করতে হবে।’
পরের দিন বৃহস্পতিবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ও অভিবাসন দপ্তর (ইউএসসিআইএস) আফগানদের সব ধরনের অভিবাসন আবেদন অনির্দিষ্টকালের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করার ঘোষণা দেয়।
ইউএসসিআইএসের পরিচালক জোসেফ এডলো পরে এক্সে লেখেন, প্রেসিডেন্টের নির্দেশে ‘উদ্বেগজনক বলে বিবেচিত সব দেশের নাগরিকদের দেওয়া প্রতিটি গ্রিন কার্ড আবার কড়াকড়িভাবে পরীক্ষা করার’ আদেশ দিয়েছেন তিনি।
তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে অভিবাসন স্থগিতের ঘোষণার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকা স্বামী-স্ত্রী, সন্তান বা মা–বাবার দেশটিতে প্রবেশ বন্ধ হতে পারে—যত দিন না এ সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। এতে দীর্ঘ দূরত্বে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি, পরিবারভিত্তিক অভিবাসন আবেদন বিলম্বিত ও পারিবারিক পুনর্মিলন কর্মসূচি ব্যাহত হবেঅভিষেক সাক্সেনা, আন্তর্জাতিক অভিবাসনবিষয়ক পরামর্শকএডলোর দপ্তর জানায়, যেসব দেশের নাগরিকদের গ্রিন কার্ড আবার পরীক্ষা করা হবে, সেগুলো জুন মাসে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষিত ভ্রমণ–নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে।
‘এ দেশ ও মার্কিন জনগণের সুরক্ষা সর্বাগ্রে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ পূর্ববর্তী প্রশাসনের বেপরোয়া পুনর্বাসন নীতির মূল্য বহন করবে না’, বলেন এডলো।
জুনে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা করে, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকে রক্ষায়’ ১৯টি দেশের নাগরিকদের ওপর পূর্ণ বা আংশিক ভ্রমণ–নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে।
পূর্ণ নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশগুলো হলো আফগানিস্তান, চাদ, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ইরিত্রিয়া, হাইতি, ইরান, লিবিয়া, মিয়ানমার, সোমালিয়া, সুদান ও ইয়েমেন। আংশিক নিষেধাজ্ঞায় আছে (এখনো কিছু সাময়িক ভিসা দেওয়া হয়)–বুরুন্ডি, কিউবা, লাওস, সিয়েরা লিওন, টোগো, তুর্কমেনিস্তান ও ভেনেজুয়েলা।
বৃহস্পতিবার রাতে ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে বলেন, তিনি ‘তৃতীয় বিশ্বের সব দেশ’ থেকে অভিবাসন স্থায়ীভাবে স্থগিত করবেন।
‘স্থায়ীভাবে স্থগিত’ করার অর্থ
এর অর্থ পরিষ্কার নয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করা আন্তর্জাতিক অভিবাসনবিষয়ক পরামর্শক অভিষেক সাক্সেনা আল–জাজিরাকে বলেন, সাধারণভাবে ‘স্থায়ী বিরতি’ শুনতে চূড়ান্ত বলে মনে হলেও অভিবাসন আইনে এর নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই।
সাক্সেনা বলেন, বাস্তবে ‘স্থায়ী বিরতি’ বলতে সাধারণত এমন নিষেধাজ্ঞা বোঝায়; যার কোনো শেষ তারিখ নেই। কিন্তু এটি আইনের দিক থেকে অপরিবর্তনীয় অবস্থা নয়।
মার্কিন অভিবাসন ও নাগরিকত্ব আইন (আইএনএ) অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট নির্দিষ্ট সময় কিংবা অনির্দিষ্টকালের জন্য অভিবাসীদের প্রবেশ স্থগিত করতে পারেন; যতক্ষণ না তিনি নিজে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বা বাতিল করেন। তবে এটি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। সাক্সেনা বলেন, ‘যদি এ অনির্দিষ্ট স্থগিতাদেশ কংগ্রেসের পাস করা কোনো আইনের বিরোধী হয়, তবে আদালতে এর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প