বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষায় এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রযুক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। এআইয়ের সর্বোত্তম ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়ে এআই–নির্ভর শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ তৈরিরও পরামর্শ দিচ্ছে তারা। আর তাই গবেষণা খাতে এআই ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি এআইয়ের কারণে কী কী সংকট হতে পারে, তা তুলে ধরতে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রয়াস ইনস্টিটিউট অব স্পেশাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (পাইজার) মিলনায়তনে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘এআই ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার নতুন সুযোগ’ শীর্ষক এ সেমিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) প্রয়াস ইনস্টিটিউট অব স্পেশাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (পাইজার)। সেমিনারে ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটিসহ বিভিন্ন এআই টুল বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা সেমিনারে অংশ নেন।

সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের এমফিল গবেষক জাহিদ হোসাইন খান এআই ও গবেষণার নানান পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘২০২০ সাল থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বৈশ্বিক গবেষণা ও নতুন জ্ঞান অন্বেষণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর তাই বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের এআই প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া উচিত। এআই প্রযুক্তি দ্রুতগতিতে উন্নত হচ্ছে, ফলে অনেক বিশেষজ্ঞ নতুন ডিজিটাল বৈষম্য তৈরির আশঙ্কা করছেন। আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এআই প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার সুযোগ নিতে হবে। এ জন্য এআই প্রযুক্তির ভালো ও মন্দ দিকগুলো নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’

পাইজারের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো.

নুর উল্লাহ বলেন, ‘পশ্চিমা দুনিয়ায় গবেষণার ব্যাপক বিস্তৃতি দেখা যায়। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের সামনে এআই নতুন সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। এআইকে ব্যবহার করে গবেষণার অসাধারণ সুযোগ তৈরি হচ্ছে, সেই বিষয়টিকে তুলে ধরতে আমরা এই সেমিনার আয়োজন করেছি। স্বাস্থ্য বা জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহী করে তুলতে কাজ করছি।’

পাইজারের অডিওলজি অ্যান্ড স্পিচ ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথলজি বিভাগের প্রধান ফাতিমা আলম বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন নতুন বাস্তবতা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার জন্য এখন এআই ও এআই–নির্ভর প্রযুক্তির ব্যবহার সারা বিশ্বেই বাড়ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের সামনে এআইকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড় করানো যাবে না। এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন নতুন গবেষণার সুযোগ তৈরি করতে হবে। বিশ্বের বড় বড় গবেষণাগার বর্তমানে এআই ব্যবহার করছে। আর তাই শিক্ষার্থী ও গবেষকদের পাশাপাশি শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এআই প্রযুক্তিমুখী হওয়া প্রয়োজন।
বর্তমানে চ্যাটজিপিটিসহ বিভিন্ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা ব্যবহার করছেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ত র ম ব দ ধ মত ত ব যবহ র কর ন র ভর প ইজ র

এছাড়াও পড়ুন:

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।

নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।

এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।

যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।

এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে

এআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।

ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।

প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।       

নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।

অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।

এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।

জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।

অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
  • এআই দিয়ে তৈরি লেখা চিনবেন যেভাবে
  • এআই নিয়ে শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর গা ছাড়া মনোভাব, বললেন বিজ্ঞানী জিওফ্রি হিন্টন